টরেটক্কা টরন্টো
ক্যারিয়ার গঠন- ৫
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অবশেষে ২০১৪ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ‘এক্সপেরিয়েন’-এর ডাউনটাউন অফিস ছেড়ে ব্যাংকের মিসিসাগা অফিসে এসে জয়েন করলাম। ডাউনটাউনের অফিস এলাকা ছেড়ে আসার জন্য নানা কারণে মনটা কিছুটা অপ্রসন্ন হয়েছিল। প্রথম কারণ হচ্ছে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে অফিসে যাতায়াত করতে করতে এতটাই অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলাম যে নিজেকে ড্রাইভ করে অফিসে আসতে হবে সেটা চিন্তা করতেই মনে হচ্ছিল কাঁধের উপর বিরাট এক বোঝা চেপে বসেছে। হাইওয়ে ফোর-ও-ওয়ান ধরে সকালের কিংবা বিকালের রাশ আওয়ারে গাড়ী চালানো যে কতখানি স্ট্রেসফুল তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। আর উইন্টারে স্নো ড্রাইভিং হচ্ছে আরেক বিভীষিকা। তবে সান্ত্বনা এটুকুই যে পার্কিং নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না, অনেকটা কলেজ ক্যাম্পাসের মতন ব্যাংকের এই অফিস কমপ্লেক্সে চারটি বড় বড় বিল্ডিং-এর সাথে পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস রয়েছে। দ্বিতীয় যে কারণে আমার মন খারাপ হয়েছিল, সেটা হচ্ছে ডাউনটাউন অফিস পাড়ার একটি বইয়ের দোকান। এই বইয়ের দোকানের সামনে দুইটি কাঠের ট্রলিতে গাদাগাদি করে এক গাদা পুরানো বই টাল দেয়া থাকে। আমি প্রায়ই লাঞ্চ আওয়ারে না জানি কী গুপ্তধন পেয়ে যাব সেই উত্তেজনায় হানা দিতাম এই বইয়ের দোকানে। এখান থেকে আমি পুরানো অনেক দুষ্প্রাপ্য বই পানির দামে কিনেছি। তারা প্রতি সপ্তাহেই তাদের পুরানো বইয়ের কালেকশনে নতুন নতুন বইয়ের আমদানী করে। তাই এই পুরানো বইয়ের দোকান কখনই আমার কাছে পুরানো হয় না। এছাড়াও ডাউনটাউনে রয়েছে অসংখ্য পুরানো চার্চ, মিউজিয়াম, পার্ক, ঈটন সেন্টার এবং সেই ঈটন সেন্টার সংলগ্ন চত্বরে স্ট্রিট পারফর্মারদের গান-বাজনা, ম্যাজিক, সার্কাস কিংবা চক দিয়ে ছবি আঁকা সহ নানা ধরণের আকর্ষণীয় কার্যকলাপ। সেই গুলো ছেড়ে অনেকটা গ্রামের মতন এলাকায় অফিস করতে হবে ভেবে মনটা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। মনে শুধু এটুকুই আশা যে আমার প্রভিশন পিরিয়ডের শেষে আমি ইচ্ছে করলে ব্যাংকের ডাউনটাউন অফিসে যেতে পারব।
অফিসে জয়েন করার প্রথম দিনে মার্ক আমাকে অফিস বিল্ডিং-এর নীচ থেকে রিসিভ করে আমার জন্য নির্ধারিত ডেস্কে নিয়ে বসাল। তারপর আমাকে নিয়ে গেল আমার ‘বাডি’ আঞ্জু-এর কাছে। মাত্র কিছুদিন আগে জয়েন করেছে আঞ্জু, এখন তার দায়িত্ব হচ্ছে আমাকে সেটল ডাউন করা। আমার ল্যাপটপে প্রয়োজনীয় সব সফটওয়্যার ইন্সটল করা থেকে শুরু করে, হিউম্যান রিসোর্স সংক্রান্ত কিংবা যে কোন ধরণের প্রয়োজনে আঞ্জু হচ্ছে আমার ‘গো-টু পারসন’। আমিও অবশ্য একই দায়িত্ব পালন করেছিলাম যখন আমার জয়েনের ঠিক দুই সপ্তাহ পরে ফিলিপ যখন জয়েন করেছিল। সেই সুবাদে আজও আঞ্জু এবং ফিলিপের সাথে আমার এক ধরণের সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে যদিও তারা আজ দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন দুই ‘লাইন অব বিজনেস’-এ কাজ করছে। আমার ল্যাপটপে যখন আমি যে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করব সেটা ইন্সটল করা হয়ে গেল তখন আমাকে দেয়া হল আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর আমাদের এই সফটওয়্যারের একটি করে রিলিজ বের হয়। প্রত্যেক রিলিজেই বেশ কিছু আবশ্যকীয় পরিবর্তন আনা হয়। এই রিলিজের মাঝপথে একজন সল্যুশন ডিজাইনারের কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে যাওয়াতে আমাকে অ্যাসাইন করা হলো তার জায়গায়। ব্যাংকে দুই ধরণের এমপ্লয়ী আছে, ফুল-টাইম (যেমন আমি) আর কন্ট্রাক্টর। কন্ট্রাক্টরদেরকে মূলত নির্দিষ্ট কোন প্রজেক্টের আন্ডারে নিয়োগ দেয়া হয় তবে সেই নিয়োগ হয় সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য। মেয়াদ শেষে কন্ট্রাক্টরদের কন্ট্রাক্ট রিনিউ করা হয় না তবে তিন মাস পর প্রয়োজন সাপেক্ষে আবার সেই কন্ট্রাক্টরকে পুনরায় নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। অনেক কন্ট্রাক্টরকে পেলাম যারা দীর্ঘদিন ধরে আমি যে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করা শুরু করেছি সেটা নিয়ে তারা কাজ করছে। ফলে এই সফটওয়্যারের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো তাদের নখদর্পণে, তাই তিন বছরের মেয়াদ শেষে তারা তিন মাসের ছুটি কাটিয়ে আবার ঢুকে পড়তে পারে আমাদের টীমে। কারণ তাদের বদলে আনকোরা নতুন লোক নিলে তারা সফটওয়্যারের লজিক বুঝতেই অনেক সময় নিয়ে নেবে। আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্টটি ছিল অমিত নামের এক কন্ট্রাক্টরের তিন বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে তাই তার কাজ গুলো বুঝে নিয়ে ঠিকঠাক মতন ডেলিভারি দেয়া। এই অমিত অবশ্য তিন মাস পরে আবার ফেরৎ এসেছিল আমাদের টীমে। সে এখনও আমাদের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। অমিতের বাবা-মা কলকাতার বাঙালী, তার জন্ম ইংল্যান্ডে কিন্তু ছয় সাত বছর বয়সে বাবা-মার সাথে টরন্টোতে চলে এসেছে। প্রায় আমার সমবয়সী অমিত বিয়ে করেনি, কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই বেশী পছন্দ করে তবে ছুটিতে তার ইস্ট ইউরোপীয়ান বান্ধবীকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।
প্রথম অ্যাসাইনমেন্টের সূত্র ধরেই আমি ধীরে ধীরে আমার টীমের সাথে পরিচিত হতে শুরু করলাম। যে জিনিষটা আমাকে প্রথমে রপ্ত করতে হল সেটা হল কনফারেন্স কল। ‘ফেস-টু-ফেস’ মিটিং-এর কোন বালাই নেই, ফোন টিপে কনফারেন্স কলে জয়েন করে কানে হেডসেট লাগিয়ে মনযোগ দিয়ে মিটিং-এ কী কথাবার্তা হচ্ছে সেটা শোনা এবং সেই সাথে দরকার মতো নিজের ইনপুট দেয়া। এই কনফারেন্স কল চলে একটার পর একটা, ফলে দিনের একটা বড় অংশই চলে যায় এই লাগাতার ফোন মিটিং-এ। অনেকেই মিটিং চলাকালীনই নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে যাকে ‘মাল্টি টাস্কিং’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আমিও ধীরে ধীরে এই ‘মাল্টি টাস্কিং’-এ অভ্যস্থ হয়ে পড়লাম, তা না হলে প্রজেক্ট টীমের সাথে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন। ‘সফটওয়্যার সল্যুশন ডিজাইনার’ হিসেবে আমার প্রধান কাজ হল ‘বিজিনেস এনালিস্ট’-এর তৈরি করা রিকুয়ারমেন্ট ডকুমেন্টকে ভালোভাবে স্টাডি করে সফটওয়্যারের কোথায় কী পরিবর্তন করতে হবে এবং কিভাবে সেই পরিবর্তন করতে হবে সেটার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে একটা ডকুমেন্ট তৈরি করা। এটাকে বলা হয় ডিজাইন ডকুমেন্ট। ডেভেলপাররা এই ডিজাইন ডকুমেন্ট দেখে বুঝতে পারে সফটওয়্যারের কোথায় প্রয়োজনীয় ‘কোড লজিক’ সংযোগ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই আমাকেই আবার ডেভেলপারের রোল প্লে করতে হয়। টেস্টিং-এর সময় এই ‘কোড লজিক’-এ যদি কোন খুঁত বা ‘বাগ’ ধরা পড়ে, তবে সেই খুঁতকে তাৎক্ষণিকভাবে ফিক্স করাও হচ্ছে আমার কাজ। সবশেষে এই ‘কোড লজিক’ যখন ‘প্রোডাকশন রিলিজ’-এ যাবে তখন ‘সাপোর্ট’ টীমের কাছে সেটা হ্যান্ডওভার করাটাও আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
এই চক্র সম্পন্ন করতে যেয়ে আমি বিভিন্ন টীমের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলাম। লক্ষ্য করে দেখলাম যে এই সফটওয়্যার লাইফ সাইকেলের একটা বড় অংশ সম্পন্ন হয় ‘অফ-শোর’ কিংবা ইন্ডিয়াতে থাকা রিসোর্সদের দ্বারা। আরও লক্ষ্য করলাম যে ‘অন-শোর’ টেকনিক্যাল সাপোর্ট রিসোর্সদের একটি বড় অংশই হচ্ছে ভারতীয় ইমিগ্র্যান্ট। তার পরপরই রয়েছে চাইনিজ, ইস্ট ইউরোপীয়ান আর মিডল ইস্টার্ন ইমিগ্র্যান্ট। চাইনিজরা আবার দুই রকমের, মেইনল্যান্ড চাইনিজ আর হংকং, মালেয়শিয়া কিংবা ভিয়েতনাম থেকে আসা চাইনিজ। আমি যেহেতু দীর্ঘ সাত বছর উচ্চশিক্ষার জন্য চীনের বেইজিং-এ ছিলাম সেই সূত্রে আমি খুব সহজেই মেইনল্যান্ড চাইনিজদের সাথে মিশতে পারি। তারা যখন দেখে আমি বিশুদ্ধ উচ্চারণে ম্যান্ডারিন বলতে পারি তখন সেই বন্ধুত্বটা আরো গাঢ় হয়ে উঠে। আবার মালেয়শিয়া, সিঙ্গাপুরে প্রায় এক যুগ কাটিয়ে এসেছি বলে হংকং কিংবা মালেয়শিয়ার চাইনিজদের সাথেও খুব সহজে মিশে যেতে পারি। চীনে লেখাপড়া করার সময় পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের ছেলেমেয়েদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার এবং মেশার সুযোগ হয়েছিল। সেই কারণে ইস্ট ইউরোপীয়ান কিংবা মিডল ইস্টার্নদের সাথে মিশতেও আমার তেমন বেগ পেতে হয়না। অনেক মিডল ইস্টার্ন কলিগ আবার আমার মুখে ‘লা মুশকিল’ শুনে প্রথমে থতমত খেয়ে যায়, মনে করে আমি বুঝি আরবী পারি। পরে অবশ্য তাদেরকে জানাই যে আমার আরবীর দৌড় ঐ পর্যন্তই। আর ইন্ডিয়ানরা তো প্রথমেই ধরে নেয় আমিও তাদের মতন ইন্ডিয়ান। কারণ এখানে হাতে গোনা কিছু পাকিস্তানি, শ্রীলংকান এবং তার চেয়েও কম বাংলাদেশী আছে। এই কম সংখ্যক বাংলাদেশীদের ভেতর থেকে আবার আমার ক্যাডেট ফ্যাটার্নিটির দুই-চারজনকে পেয়ে গেলাম। ফলে অবধারিতভাবেই তাদের সাথে মাসে কিংবা দুই মাসে একবার লাঞ্চ করার জন্য অফিস ক্যাম্পাসের বাইরে শুশি কিংবা মিডল-ইস্টার্ন রেস্টুরেন্টে যাওয়া শুরু হয়ে গেল।
দুপুর বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত হচ্ছে আমাদের লাঞ্চ ব্রেক। সাধারণত সবাই বাসা থেকে লাঞ্চ প্যাক করে নিয়ে আসে। লাঞ্চের সময় ক্যান্টিনে গিয়ে হয় নিজের আনা খাবার কিংবা ক্যান্টিন থেকে কিছু কিনে একসাথে বসে গল্প করতে করতে লাঞ্চ সারতেই সবাই পছন্দ করে। এই একসাথে বসে লাঞ্চ করার জন্য সবারই একটা গ্রুপ থাকে। আমাকে একা একা লাঞ্চ করতে দেখে আমাদের ডেভ টীমের সোয়াতি তাদের গ্রুপে আমাকে যোগ করে নেয়। এই গ্রুপের আবার একটা ই-মেইল গ্রুপ আছে যেখানে আমরা কখন লাঞ্চ করতে নীচে নামব সেটা জানানো হয়। সেই মোতাবেক সবাই নিজ নিজ লাঞ্চ বক্স নিয়ে নীচে হাজির হয়ে যাই। গ্রুপের একজন গিয়ে টেবিল দখল করে প্রথমে আর বাকীরা লাইন দিয়ে মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করার পর হাজির হয় সেই টেবিলে। আমি ছাড়া আমাদের গ্রুপে সবাই ইন্ডিয়ান। আমি আর আঞ্জু বাদে বাকীরা ভেজেটেরিয়ান। যখন কলকাতাতে ফ্রিজে গরুর মাংস আছে সন্দেহে বাড়ীর কর্তাকে পিটিয়ে মারা হল, আমি তখন আমার ভেজেটেরিয়ান কলিগদের সাথে একসাথে বসে গরুর মাংস দিয়ে লাঞ্চ করে গেলাম। তবে আঞ্জুকে দেখতাম সে কখনও গরুর মাংস আনত না লাঞ্চে। মনে মনে ভাবলাম ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ হওয়াতে আজ আমরা মাথা উঁচু করে চলতে পারছি। আমাদের গ্রুপের হারজিৎ আমাদেরকে প্রতিদিন এক টুকরো গুড় দেয় খেতে, এটা নাকি তাদের পাঞ্জাবী শিখদের ট্রেডিশন খাওয়ার পর গুড় মুখে দেয়া। লাঞ্চের পর আমরা দল বেঁধে হাঁটতে বেরোই। শুধু আমরা একাই যে হাঁটতে বের হই তা নয়, অনেকেই দল বেঁধে হাঁটতে বেরোয় তখন। আমাদের ক্যান্টিনের পাশেই রয়েছে বিশাল ‘রিসেস কমপ্লেক্স’ যেখানে টিভি রুম, কোয়ায়েট এরিয়া, টেবিল টেনিস খেলার সরঞ্জাম এমন কি একটি প্রেয়ার রুমও রয়েছে। এক সময় টেবিল টেনিসে আমার হাত ছিল দূর্দান্ত, হাতের কাছে খেলার সরঞ্জাম আর খেলার পার্টনার পেয়ে আমি আবারও মেতে উঠলাম টেবিল টেনিস খেলায়। এক সময় আমাদের এক টুর্নামেন্টে বাঘা বাঘা চাইনিজ আর ইন্ডিয়ান প্লেয়ারদের হারিয়ে রানার্স আপও হয়ে গেলাম। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইস্ট ইউরোপীয়ান রোমান পাপভ। আমার কাছে মনে হলো আমি যেন আবার আমার কলেজ জীবনকে ফেরৎ পেয়েছি এখানে জয়েন করে। ফলে যখন আমার তিন মাসের প্রভিশন পিরিয়ড শেষ হলো আমি আর ডাউনটাউন অফিসে যাওয়ার উৎসাহ পেলাম না। অনেকটা কলেজ ক্যাম্পাসের মতন মিসিসাগার এই অফিসের পরিবেশেই বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করা শুরু করলাম।
‘এক্সপেরিয়েন’-এ থাকাকালীন প্রতি মাসে ছিল একটি করে ‘অল হ্যান্ডস অন ডেক’ মিটিং। আর এখানে সেটা হয় প্রতি দুই মাসে একবার। তবে প্রতি তিন মাসে ‘টাউন হল’ নামে আরেক মিটিং-এর দেখা পেলাম এখানে। সাধারণত ‘হিলটন’ কিংবা অন্য কোন ফাইভ স্টার হোটেলের কনফারেন্স রুম বুক করে প্রায় সারাদিন ধরে চলে এই মিটিং যেখানে দেখা মেলে উপরের লেভেলের লীডারদের। তারা এই মিটিং-এ ব্যাংকের ‘রোড ম্যাপ’ কিংবা ‘ডেভেলপমেন্ট থিম’ নিয়ে কথা বলে। যেমন আমাদের কাজে যেন ভুলের অবকাশ না থাকে সেই জন্য তারা ‘সিক্স সিগমা’ নামক ম্যানেজমেন্ট টেকনিকের ‘ফার্স্ট টাইম রাইট’ ফর্মুলাটি আমাদের মগজে অনেকটা মন্ত্রের মতন ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। আমরা অবশ্য সেই ‘লেকচার’-গুলোর চেয়ে কখন হোটেলের ‘বুফে লাঞ্চ’-এর সময় হবে সেটাতেই বেশী আগ্রহী হয়ে বসে থাকি। তারা আমাদের মনোভাব ভালোই বুঝতে পারে তাই ‘লেকচার’-গুলোকে ইন্টারেস্টিং করার জন্য তারা নানা ধরণের ছেলে-ভুলানো কৌশলের আশ্রয় নেয়। যেমন কেউ কেউ উদ্ভট ডিজাইনের স্যুট কিংবা মোজা ছাড়া জুতা পরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আবার কেউ কেউ তাদের পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের প্রথমেই বাহামাতে কবে ছুটি কাটাতে গিয়েছিল তার একটা বিশাল ছবি জুড়ে দেয়। কেউ কেউ আবার প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে তারা এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পেরে খুবই এক্সসাইটেট এবং তারা তাদের প্রতিটি মুহূর্ত এই প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় করছে। কিন্তু দিন শেষে তারা যে মেসেজটা আমাদেরকে দেয় সেটা হলো ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’। যদিও ‘টাউন হল’ মিটিং-এ আমাদেরকে ফ্রি বুফে লাঞ্চ দেয়া হয়। আমাদের মেধা, শ্রম এবং সময় যেন আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে তাদের সেট করা ‘রোড ম্যাপ’ অনুসারে এই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি সেটাই হচ্ছে বটম লাইন।
গোটা কয়েক সফটওয়্যার রিলিজের কাজ করার পর আমার ডাক পড়ল একটা বিশেষ প্রজেক্ট থেকে। আমাদের সফটওয়্যারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মডিউল হচ্ছে বাইরের এক ভেন্ডরের কাছ থেকে নেয়া। ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা আর সেই ভেন্ডরের সফটওয়্যার ব্যবহার করবে না। অর্থাৎ আমাদেরকে সেই মডিউলটি ফ্রম দ্য স্ক্র্যাচ তৈরি করতে হবে। সময় দুই বছর। এই জাতীয় একটা সফটওয়্যার তৈরি করার জন্য দুই বছর হচ্ছে খুবই টাইট টাইম লাইন। ডিজাইন থেকে শুরু করে ‘চয়েস অব টেকনোলজী’ কোথাও ভুল করার কোন অবকাশ নেই – ‘ফার্স্ট টাইম রাইট’-এর অগ্নি পরীক্ষা। আমাদের প্রজেক্টের জন্য বরাদ্দ করা হলো একটা মাঝারী আকারের কনফারেন্স রুম যেখানে প্রজেক্টের সবাইকে পাশাপাশি বসে কাজ করতে হবে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের ভাষায় একে ‘ওয়ার রুম’ বলা হয়ে থাকে। সেই প্রজেক্ট টীমে বাছাই করা বেশ কিছু রিসোর্সকে আনা হয়েছে প্রজেক্টের গুরুত্ব এবং টাইট টাইম লাইনের কারণে। তবে বেশীরভাগ রিসোর্সই মেইনল্যান্ড চায়না থেকে আসা চাইনিজ ইমিগ্র্যান্ট। তারা আবার চীনের বিখ্যাত সব ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করা গ্র্যাজুয়েট। সাথে আছে ইস্ট ইউরোপীয়ান অ্যালেক। সমস্যার গভীরে যেয়ে সমাধান বের করার ক্ষেত্রে এরা একেকজন একেকটা জিনিয়াস। আমার কাজ হচ্ছে জটিল এই মডিউলের সিস্টেম এনালাইসিস করে সেটাকে ডিজাইন ডকুমেন্টে পরিণত করা। মিলিটারি প্রিসিশন বজায় রেখে লাগাতার কাজ। এক সময় আমাদের ‘চয়েস অব টেকনোলজী’-তে বড় ধরণের গলদ ধরা পড়ল। সফটওয়্যার ইন্ড্রাস্ট্রিতে নামকরা এক কোম্পানীর যে টেকনোলজীকে আমরা ব্যবহার করছিলাম সেখানে সমস্যা দেখা দিল। এই সময় আমরা নিজেরাই একটা সফটওয়্যার ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে নিলাম আমাদের কাজ চালানোর জন্য, তার জন্য অবশ্য আমাদেরকে খেসারত দিত হলো বেশ কিছু সময়ের। সেটা মেকাপ করার জন্য আমাদেরকে তখন রেগুলার আওয়ারের বাইরেও কাজ করা শুরু করতে হলো। অতিরিক্ত সময় কাজ করাটা আমাদের জন্য অনেকটা রুটিনে পরিণত হয়ে উঠল। তবে আমাদের প্রজেক্ট ম্যানেজার প্রায়ই পিজ্জা কিংবা নান্দোস থেকে লাঞ্চ এনে আমাদেরকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করত। এক সময় আমরা যখন সফলভাবে সেই প্রজেক্টটা শেষ করলাম তখন সত্যিই সবাই খুব এক্সসাইটেট হয়ে উঠেছিলাম। আমরা আমাদের এই সাফল্যকে উৎযাপন করার জন্য বিশেষ এক ইভেন্টকে বেছে নিলাম – ‘অ্যাক্স থ্রোয়িং’। টার্গেট লক্ষ্য করে ছোট সাইজের সত্যিকারের কুড়াল ছুড়ে মারার খেলা।
এই প্রজেক্ট শেষ করার পর আমাকে পাঠানো হলো আরেকটি প্রজেক্টে যেটার পুরো টীম রয়েছে ডাউনটাউন অফিসে। মিসিসাগার অফিসে তিন বছরের কিছু সময় কাটিয়ে আমি আবার ফিরলাম আমার পূর্ব পরিচিত ডাউনটাউন অফিস পাড়ায়। লাঞ্চ আওয়ারে এবার হানা দেয়া শুরু করলাম বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘ইন্ডিগো’-তে। এখানে বই নিয়ে বসে পড়ার সুযোগ আছে, আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমি স্টিফেন কিং-এর মাত্র প্রকাশিত ‘ইনিস্টিটিউট’ বইখানি প্রায় অর্ধেক পড়ে ফেলেছিলাম। বাকীটা অবশ্য আমি আমার লোকাল লাইব্রেরী থেকে ইস্যু করে পড়েছিলাম।
২০২০ সালের জানুয়ারীতে সারা দুনিয়াতে যখন কোভিড ছড়িয়ে পড়ল, সেই ঢেউ এসে এক সময় কানাডাকেও স্পর্শ করে। পরবর্তীতে সেটা মহামারী থেকে অতিমারী কিংবা প্যান্ডেমিকের রূপ ধারণ করে। ফলে আমরা মার্চের মাঝামাঝি থেকে পুরোপুরি ভাবে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ শুরু করি যা আজও চালিয়ে যাচ্ছি। কবে আবার আমরা অফিসে যেতে পারব সেটা এখনও অনিশ্চিত, তবে আশার কথা যে টীকা দেয়ার কার্যক্রম যেভাবে এগুচ্ছে তাতে করে হয়ত এ বছরের শেষে আমরা আবার অফিসে ফেরত যেতে পারব।
কাজী সাব্বির আহমেদ
টরন্টো