কানাডায় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে
প্রতি বছর গড়ে প্রায় চার হাজার কানাডিয়ান আত্মহত্যা করেন : আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৭৫% পুরুষ!
প্রবাসী কণ্ঠ : কানাডা পৃথিবীর অন্যতম শান্তির দেশ, বিশ্বের সেরা নিরাপদ দেশগুলোর একটি এই কানাডা। দেশটি তার নাগরিকদেরকে সর্বোচ্চ মানের জীবন যাপন পদ্ধতি প্রদান করে থাকে এবং বিশ্বের সেরা চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে বিনা খরচে। কোন বানোয়াট গল্প নয়। ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান ডেভলাপমেন্ট ইনডেস্ক এর তথ্য এটি। কিন্তু এরকম একটি দেশে বাস করেও কারো কারো মনে শান্তি নেই। বিষন্নতা, হতাশা এবং নৈরাশ্য পেয়ে বসে তাদেরকে। কেউ কেউ বেছে নেন আত্মহত্যার পথও! আর এদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশী।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় চার হাজার কানাডিয়ান আত্মহত্যা করেন এবং এই আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৭৫% হলো পুরুষ!
কানাডিয়ান পুরুষদের সমস্যাটি কি তাহলে? কেন তাদের মধ্যে বিষন্নতা সৃষ্টি হচ্ছে। কেন তারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন? এবং এদের কেউ কেউ কেন এক পর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন?
প্রচলিত ধারণাটা এরকম যে, নারীরা বেশী আবেগী, তারা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়েন এবং প্রতিকুল পরিস্থিতি বা নির্যাতনের শিকার হলে অনেকে বিষণ্নতার শিকার হন, মানসিক রোগে আক্রান্ত হন এবং কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। প্রায় ১০% কানাডিয়ান পুরুষ তাদের জীবনে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সঙ্কটের মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে আছে ইমিগ্রেন্ট পুরুষরাও। টরন্টোতে গত এক দশকে প্রায় ডজন খানেক বাঙ্গালী বিষন্নতার শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তারো কয়েক বছর আগে টরন্টোর বাঙ্গালী অধ্যুষিত ১০ টিসডেল এর সুউচ্চ ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে এক বাঙ্গালী আত্মহত্যা করেন। এমনকি বাঙ্গালী ছেলে শিশুও রয়েছে আত্মহত্যার তালিকায়। বুলিং এর শিকার হয়ে টরন্টোতে ১২ বছর বয়সী এক বাঙ্গালী বালক অর্ক চক্রবর্তী আত্মহত্যা করে বছর দুই আগে। ঘটনার পর পুলিশ টরন্টোর মিডটাউন এলাকার একটি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর পাশে অবস্থিত এক ঝোপ থেকে বালকটির লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, সে ঐ বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ঝাপিয়ে পড়ে। আর এটি যে আত্মহত্যা ছিল সেই খবর পুলিশ নিশ্চিত করে প্রায় চার মাস পর। তবে এই আত্মহত্যার পিছনে বুলিং এর ভূমিকা ছিল এমন দাবীই করেন বালকটির মা দূর্বা মুখপাধ্যায়।
টরন্টো স্টার জানায়, যেদিন অর্ক ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সেদিন সে একটি সুইসাইড নোট লিখে বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। ঐ নোটে লেখা ছিল, “ I have been a disappointment to you. I have not been popular at school. No one will miss me if IÕm gone.” নোটটি পড়েই দূর্বা মুখাপাধ্যায় সাথে সাথে ৯১১ এ কল করেন।
এর আগে টরন্টোতে সাবিত খন্দকার এবং ফাহিম আরিফ নামের দুই তরুণ আত্মহত্যা করেন বিষন্নতার শিকার হয়ে। বিষয়টি কমিউনিটিকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়ে যায়। প্রমিজিং এই দুই তরুণকে হারিয়ে তাদের বাবা-মায়ের পাশাপাশি কমিউনিটিতেও নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া।
বিষণ্নতার শিকার হয়ে টরন্টোতে আরেক তরুণ মিনহাজ জামান নিজে আত্মহত্যা করেনি। কিন্তু ভয়াবহ এক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েন তিনি। নিজের বাবা-মা, বোন ও নানীকে হত্যা করেন তিনি। পরে জানা যায় তার মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল।
এ বছর ২৮ জানুয়ারী সিবিসি নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিষয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও ডগলাস রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা বিজ্ঞানী রব হুইটলে বলেন, কানাডায় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের অনেক ছেলে, বাবা, ভাই, স্বামী ও বন্ধু মনো-সামাজিক জটিলতায় ভুগছেন।
রব হুইটলে আরো জানান, “বেশ কিছু গবেষণায় আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুরুষ ও তরুণ গুরুতর মনো-সামাজিক জটিলতায় ভুগছেন। মানসিক স্বাস্থ্য, মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যা সম্পর্কিত অনেক উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান থেকে এটি স্পষ্ট। সূচনাতেই বলা যায়, কানাডায় আত্মহত্যাকারীদের ৭৫ শতাংশের বেশি পুরুষ। তার মানে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫০ জন পুরুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে। একইভাবে সমীক্ষাগুলোতে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, কানাডায় পুরুষেরা নারীদের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি মাদকাসক্ত ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল। এসব নেশাজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে অ্যালকোহল, গাঁজা ও আফিমজাতীয় দ্রব্য। সমস্যার তীব্রতার ওপর আলোকপাত করে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার অপঘাত মৃত্যুসম্পর্কিত পরিষেবা বিভাগ জানায়, ২০২০ সালে ওই প্রদেশে অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের কারণে মৃত্যুবরণকারীদের ৮১ শতাংশই ছিল পুরুষ।”
কানাডার পুরুষ ও তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কিছু তথ্য homewoodhealth.com তাদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরে যা নিন্মরূপ:
– প্রায় ১০% কানাডীয় পুরুষ তাদের জীবনে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সঙ্কটের মুখোমুখি হয়
– প্রতি বছর আনুমানিক ১০ লাখ কানাডীয় পুরুষ বড় ধরণের বিষন্নতায় ভোগে
– প্রতি বছর গড়ে প্রায় চার হাজার কানাডীয় আত্মহত্যা করে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৭৫% হলো পুরুষ
– কানাডার আদিবাসী মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার দেশের জাতীয় গড় হারের দ্বিগুণ। এছাড়াও
– ইনুইট জনগোষ্ঠীর পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার জাতীয় হারের চেয়ে ১১ গুণ বেশি
– সমকামী পুরুষদের মধ্যে বিষন্নতা, উদ্বেগ, আত্মহননপ্রবণতা, আত্মপীড়ন এবং তাদের যৌন সঙ্গীদের তুলনায় মাদকের অপব্যবহারের হার খুব বেশি
– কানাডার পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন হার হলো, নুনাভেট, উত্তর-পশ্চিম টেরিটোরি, ইয়ুকন, নিউ ব্রুন্সউইক, কুইবেক, সাসকাচুন ও আলবার্টায়।
পুরুষদের বড় সমস্যা হলো, তারা বিষণ্নতা বা মনরোগকে আমলে নিতে চান না। অথচ এটাও যে একটি রোগ এবং এর চিকিৎসাও আছে সে বিষয়টি অবহেলিত থেকে যায়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার আহমেদ হেলাল তাঁর এক প্রতিবেদন উল্লেখ করেন, “ মনে রাখতে হবে, মানসিক রোগও কিন্তু ‘রোগ’। অন্যান্য রোগের মতোই এ রোগে মানুষের দেহে আর মনে পরিবর্তন ঘটে। আমাদের যেমন শরীর আছে, তেমনি মনও আছে। মনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মানসিক প্রক্রিয়া বা মেন্টাল প্রসেস। চিন্তাশক্তি, অনুভব করা, স্মরণ রাখা, আবেগকে পরিচালিত করা-সবকিছুই কিন্তু মানসিক প্রক্রিয়া। আর এই মানসিক প্রক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থ-যাকে বলা হয় নিউরোট্রান্সমিটার। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের নির্বাহী কাজ মিলেই আমাদের এসব মানসিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়।
মানসিক প্রক্রিয়াগুলোই আমাদের সব আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। কারও মানসিক রোগ হলে তাঁর নিউরোট্রান্সমিটারের ঘাটতি বা আবেগ আর আচরণের পরিবর্তন দেখা দেয়। এই জায়গাতেই ওষুধের কাজ। ওষুধ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য রক্ষা করে মানসিক রোগকে নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মানসিক রোগ হওয়ার সঙ্গে নিউরোট্রান্সমিটারের ঘাটতি কিংবা বাড়তির পাশাপাশি সামাজিক ও বিকাশজনিত উপাদানও গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে মানসিক রোগের চিকিৎসায় সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্বও কম নয়। ওষুধ যেমন একজন মানসিক রোগীর মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে, তেমনি সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং তাঁর মনকে সুসংহত করার মাধ্যমে যৌক্তিক বিশ্বাস আর আচরণে উৎসাহিত করে।”
ডা: আহমেদ হেলাল তাঁর প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করেন, “মোটা দাগে মানসিক রোগ দুই ধরনের। এক ধরনের মানসিক রোগে রোগী নিজেই বুঝতে পারেন, তাঁর কোনো মানসিক সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের রোগগুলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর। এ ধরনের রোগগুলোকে একসময় বলা হতো নিউরোসিস; যেমন মৃদু উদ্বিগ্নতা, মৃদু বিষণ্নতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি। আরেক ধরনের মানসিক রোগে রোগী কখনো বুঝতেই পারেন না এবং স্বীকারও করেন না যে তাঁর কোনো মানসিক সমস্যা হচ্ছে। এই রোগগুলো খানিকটা গুরুতর, যাকে বলা হতো সাইকোসিস; যেমন সিজোফ্রেনিয়া, গুরুতর বিষণ্নতা, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার ইত্যাদি। এই গুরুতর ধরনের মানসিক রোগ বা সাইকোসিসের চিকিৎসায় ওষুধের ভূমিকা অনেক বেশি। কারণ, এই রোগগুলোতে মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য বেশি মাত্রায় নষ্ট হয়। তাই ওষুধ ছাড়া এ ধরনের রোগকে চিকিৎসা করা প্রায় অসম্ভব। আর ওষুধ দিয়ে একটি পর্যায়ে অবস্থার উন্নতি হলে কিছু বিশেষ সাইকোথেরাপি দেওয়া যেতে পারে। আবার মৃদু মাত্রার মানসিক রোগ, যেখানে রোগী নিজের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের কারণে মূলত মনের রোগটি হয়েছে-সেখানে তীব্র লক্ষণগুলো কমাতে কিছু ওষুধ দেওয়া হয় বটে, কিন্তু পাশাপাশি কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি অত্যন্ত কার্যকরী। যেমন এই গ্রুপের একটি রোগ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি), যেটিতে দীর্ঘ সময় ওষুধও খেতে হয়, আবার প্রয়োজনীয় সাইকোথেরাপিও নিতে হয়। ”
অর্থাৎ বিষণ্নতা বা মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা হলে চিকিৎসার বিকল্প নেই। আর এই চিকিৎসা অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই বিষয়টিই অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে না।
কানাডিয়ান মেন্টাল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, “ টরন্টোর মেন্স হেল্থ নেটওয়ার্কের (TMHN) তথ্য অনুযায়ী, এমনকি ‘পুরুষের স্বাস্থ্য’ এই ধারণাটিও কানাডায় অপেক্ষাকৃত নতুন। সংস্থার কো-চেয়ারম্যান ডা. ডন ম্যাকক্রিয়ারি, যিনি পুরুষের স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকীর (International Journal of Men’s Health) সহযোগী সম্পাদক এবং কানাডায় পুরুষের স্বাস্থ্য বিষয়ে মুষ্ঠিমেয় গবেষকদের একজন, বলেন, এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে।
একটি কারণ হলো, গবেষকদের মধ্যে পুরুষের স্বাস্থ্যের বিষয়টির কম অগ্রাধিকার পাওয়া। আরও বেশি অর্থ ও আরও বেশি সংখ্যক বিশেষজ্ঞ দেওয়া হলে পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চলমান গবেষণা উৎসাহিত হবে।
পুরুষদের এবং সমাজের মনোভাব এ বিষয়ে নীরবতাকে লালন করেছে।
ডা. ম্যাকক্রিয়ারি বলেন, ‘নারীরা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সেবা পাবার ক্ষেত্রে একজোট হয়ে কাজ করছে। কিন্তু পুরুষেরা সেটা করতে চায় না। আমরা আমাদের সমাজে একটি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছি যে, পুরুষদের বলিষ্ঠ হতে হবে, তাকে শক্তিমান হতে হবে। আমাদের সমাজ পুরুষের মধ্যে লৈঙ্গিক বিচ্যুতি দেখলেই খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। দুর্বলতাকে পুরুষোচিত বলে বিবেচনা করা হয় না।”
পুরুষ ও বিষন্নতা
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ক্লিনিক্যাল প্রফেসর ড. মেয়ারস বলেন, ‘পুরুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা সুপ্ত থাকতে পারে। আমরা কয়েক দশক ধরে জানি যে, যে কোনও ধরণের অসুস্থতা স্বীকার করা এবং চিকিৎসকের কাছে যাবার ক্ষেত্রে নারীরা বেশি চটপটে। এর অর্থ এই নয় যে, নারীরা অপেক্ষাকৃত বেশি স্বাস্থ্যবান। এর অর্থ হলো, কিছু পুরুষ বিষয়টি নিছক চেপে যায়। আমাদের বিশ্বাস, পুরুষের মধ্যে অনেক রোগের লক্ষণ শারীরিক কারণে নয়, উদাহরণ স্বরূপ, মাইগ্রেন, পিঠের ব্যথা, পেটের পীড়া এগুলোর জন্ম হয় বিষন্নতা থেকে।’
ড. মেয়ারস বলেন, ‘বিষন্নতা চেপে রাখার পরিণতি ধ্বংসাত্মক হতে পারে। বিপুল সংখ্যক পুরুষ এতে ভুগছে। তারা বিষন্নতাজনিত বিসদৃশ আচরণ করছে। এটি বৈরিতা ও বিরক্তি; মৌখিক সহিংসতা বা গালাগালি; অতিরিক্ত পানাসক্তি; অথবা নারীলিপ্সার রূপ নিতে পারে।’
ড. মেয়ারস, যিনি ভ্যাঙ্কুভারের সেন্ট পলস হাসপাতালের মেরিটাল থেরাপি ক্লিনিকের পরিচালক, আরও বলেন, ‘বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার ক্ষেত্রে কীভাবে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটছে এবং পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য এই দুটোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ থাকে।’ তিনি বলেন, যেখানে ছেলেমেয়ে থাকে এবং চলমান সম্পর্ক রক্ষা করা হয় সেখানে বাবা তার পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নেন। ‘যদি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে পুরুষটি আত্মহননপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন।’
মেলহেল্থ.কম উল্লেখ করেছে যে, পুরুষের বিষন্নতার ক্ষেত্রে জন্মগত কারণ এবং মানসিক চাপ ছাড়াও সামাজিক ও মনস্তÍাত্ত্বিক বিভিন্ন কারণেরও ভূমিকা থাকতে পারে। প্রতিযোগিতা ও নিজেকে শক্তিশালী ভাবার ওপর পুরুষদের মনোযোগ থাকার কারণে বেকারত্ব এবং কর্মস্থলে নারীর উপস্থিতি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। শারীরিক অসুস্থতা, বিশেষ করে জীবনহানির মত পরিস্থিতিও বিষন্নতার কারণ হতে পারে, কারণ এটি একজন পুরুষের শক্তিমত্তা ও মর্যাদার বোধটিকেই সরাসরি প্রভাবিত করে।”
কানাডার সাইকিয়াট্রি জার্নালের সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তিন তিনটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। নিবন্ধগুলোতে যেসব তথ্য ও পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে তা দুঃখজনক। কানাডার মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাসোসিয়েশনসহ অনেক ভাষ্যকার এমন উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি একটি নিরব সঙ্কট। এ কথা বলেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক রবার্ট হুইটলে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, “উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কানাডায় প্রতি সপ্তাহে ৫০ জনের বেশি পুরুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়। একইভাবে ১০ লাখের বেশি কানাডীয় পুরুষ মাদকাসক্তিতে ভুগছে। আবার ফেনটানিল ও আফিম জাতীয় দ্রব্যের অতিরিক্ত সেবনে মারা যাওয়া লোকেদের মধ্যে শতকরা ৮০ জনই পুরুষ। এভাবে পুরুষদের নির্দিষ্ট বয়স গ্রুপের লোকেদের মধ্যে সুস্পষ্টভাবেই মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে। যেমন বালকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে রয়েছে মনোযোগের ঘাটতিজনিত সমস্যা যা তাদেরকে স্কুল থেকে ঝরে পড়া এবং নতুন করে শুরু করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে। সমকামী হিসাবে চিহ্ণিত মানুষদের মধ্যে নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা সামঞ্জস্যহীনভাবে বেশি, বয়োবৃদ্ধ পুরুষদের বস্তুর অপব্যবহারের এবং আদিবাসী মানুষদের আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো পুরুষেরা সরকারের মানসিক স্বাস্থ্য সুবিধার খুব সামান্যই ব্যবহার করে। দেখা গেছে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ হলো পুরুষ। ভিন্নভাবে বললে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কানাডীয় পুরুষ ও বালক বিনা চিকিৎসায় নিরবে ভুগছে, যা ব্যক্তি, পরিবার ও সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য সেবার অভাব এবং অসচতেনতার কারণে বিশাল পরিমাণ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার বাইরে রয়েছেন। মানসিক সমস্যা নিয়ে সমাজে এক ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। মানুষ এটাকে প্রকাশ করতে চায় না, লুকিয়ে রাখতে চায়। কারণ, সমাজে একজন লোক যখন মানসিক সমস্যায় ভোগে, তখন তাকে পাগল হিসেবে ধরা হয়। তার সঙ্গে আত্মীয়স্বজন বা অন্যরা মিশতে চায় না। তাছাড়া মানুষ মনে করে যে, মানসিক সমস্যা রয়েছে এটা প্রকাশিত হলে তারা সমাজের চোখে হেয় হয়ে যাবেন।
কানাডায় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত পুরুষদের সহায়তায় কি কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক রব হুইটলে। এখানে তা তুলে ধরা হলো:
“কানাডার পুরুষদের সহায়তায় কী করা যেতে পারে?
কানাডায় পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরিসংখ্যান অন্য দেশেও যেমন যুক্তরাজ্যেও লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের নারী ও সমতা বিষয়ক কমিটি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে পুরুষ ও বালকদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালু করেছে। এটি একটি খুবই প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যা সব দল ও জনগণের সমর্থন লাভ করেছে।
এই সমীক্ষায় পুরুষ ও বালকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারী সবচেয়ে গুরুতর বিষয়গুলো চিহ্ণিত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু কঠোর প্রশ্ন উত্থাপন করবে। যেমন, কোন বয়স শ্রেণির পুরুষ ও বালকেরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারের বর্তমান স্বাস্থ্যনীতি কতটা কার্যকর।
কানাডায় এ ধরণের কোনও সমীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই, অবশ্য নিকট ভবিষ্যতে তা পাল্টাতে পারে। এজন্যেই আমি কানাডার কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানাই অনুরূপ একটি তদন্ত শুরু করার।
এ ধরণের তদন্ত শুরুর জন্য কানাডার নারীদের অবস্থা জানার জন্য ১৯৬৭-১৯৭০ সালে রয়াল কমিশনের তদন্ত থেকে অনুপ্রেরণা আসতে পারে। ওই তদন্তে নারীদের অসংখ্য অমীমাংসিত ইস্যু উদ্ঘাটনের জন্য ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনা এবং জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়। এতে করে অনেকগুলি ধারাবাহিক সুপারিশমালা প্রণীত হয় যার মধ্যে কানাডায় নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের (মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার) বিষয়টিও ছিলো। এর মাধ্যমে পরে সমাজে নারীর অগ্রগতি নিশ্চিত করতে অনেকগুলি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়।
এই সমীক্ষা কানাডায় পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্নগুলোর জবাব বের করে আনতে পারে। ব্রিটিশ সরকারের তদন্তের মতই এটি পুরুষ ও বালকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী সামাজিক উপাদানগুলো উদ্ঘাটন করতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কিভাবে আরও আবেদনময় করে তোলা যায় সেই উপায় বাতলে দিতে পারে।”
একটি নতুন উদ্যোগ
অধ্যাপক রব হুইটলে আরো বলেন, “পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ বর্তমান উদ্যোগে কার্যত এপিএর মতো সংগঠনের প্রাধান্য রয়েছে যে সংগঠনটি পুরুষ ও পুরুষত্ব বিষয়ে অনেকটা সংশয়দুষ্ট ও সাংঘর্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আমাদের একটি উদ্ভাবনীমূলক চিন্তাধারা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। আর এটা হতে পারে আলোচনার টেবিলে ভিন্নভিন্ন মতের উপস্থাপনের মাধ্যমে আর সেটা সম্ভব সরকারিভাবে তদন্ত কার্যক্রম চালানো হলে। জাতিগত পরিচয় ও পেশাদার গ্রুপসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের বক্তব্য শুনতে হবে। সূক্ষè পার্থক্যগুলো আবিষ্কার করতে হবে এবং এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটাতে হবে।
পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিতর্কে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হতে হবে।
এক্ষেত্রে মনস্তত্ত্ববিদ এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে তবে একইসঙ্গে সমাজের অন্যান্য শরিকেদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। এর মধ্যে থাকবেন জাতীয় নেতা, প্রবীণ সংগঠন, শিক্ষাবিদ, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কর্মরত সংগঠনগুলো এবং পুলিশ/প্রাথমিক সাড়া দানকারীদের প্রতিনিধি। এইসব সংগঠনের অনেকগুলিই পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় অনুপস্থিত ছিলো; বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক নতুন ধারণা যোগ করার জন্য কেবল গালভরা মন্তব্যের চাইতে এইসব সংগঠনের বক্তব্য শোনা জরুরী।
এই বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় আলোচনায় আসতে হবে এবং পুরুষত্ব থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী সামাজিক উপাদান পর্যন্ত সব বিষয়ে ব্যাপকতর আলোকপাত করতে হবে। এতে অবশ্যই বিভিন্ন খাতওয়ারি উদ্যোগ নিতে হবে, যেসব বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে হবে তার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, গ্রামীণ অর্থনীতি, বৃত্তি সম্পর্কিত বিষয়, পারিবারিক আইন এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো বিষয়।
পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন একটি স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের বিষয় এবং একটি সুষ্ঠু ও ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজের জন্য জরুরী। আর সেজন্যেই আমি একটি তদন্ত করার বিষয়টি উত্থাপন করেছি।”