করোনা ভ্যাকসিন : স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার পূর্বাভাস কানাডায়

খুরশিদ আলম

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন এবার আমরা একটি ভাল গ্রীষ্ম উপভোগ করতে পারবো। তিনি একে আখ্যায়িত করেছেন ‘এ ওয়ান ডোজ সামার’ হিসাবে।

অর্থাৎ আসছে গ্রীষ্মে আমরা গত গ্রীষ্মের তুলনায় অনেকটাই নিরাপদে থাকতে পারবো। উপভোগ করতে পারবো বাইরের জীবন। কারণ ইতিমধ্যেই কানাডার অর্ধেকেরও বেশী মানুষ প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন। আশা করা যাচ্ছে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরো অধিক সংখ্যক মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় চলে আসবেন। আর এই ভ্যাকসিনের সুফল ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ আরো কয়েকটি দেশে। ভয়াবহ বিপদের মুখ থেকে এই দেশগুলো ক্রমশ স্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে কানাডায়ও মানুষের জীবন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে এই গ্রীষ্মে বা শরতে। আর দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নেয়া হয়ে গেলে পরিস্থিতি আরো উন্নত হবে এমনটাই আশা বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

রাজনীতিকরা এই বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শেই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং আইন-কানুনের ঘোষণা দিয়ে আসছেন করোনা মহামারির শুরু থেকে। অবশ্য সব রাজনৈতিক নেতারা পরামর্শ শুনছেন তা নয়। এর মধ্যে প্রথম কাতারে যে কজন আছেন তারা হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো-সহ আরো কয়েকজন। তবে  পালের সেরা হলেন এই দুই জড়বুদ্ধিসম্পন্ন সাবেক ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট। তাদের বিচারবুদ্ধিহীন আচরণ ও মূর্খতার কারণে এবং বিশেষজ্ঞদের কথা না শুনার কারণে এই দেশ দুটিতে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে করোনা মহামারীতে। এটাকে কি গণহত্যা বলা যায় না? আমার তো বিশ^াস এটি গণহত্যাই। এখন এই গণহত্যার দায় কে নিবে? আর তাঁদেরকে কি কোনদিন বিচারের আওতায় আনা যাবে এই গণহত্যার দায়ে? তারা যদি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কথা শুনতেন, সময় মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন তবে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হতো না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

কানাডা অবশ্য শুরু থেকেই সতর্ক ছিল শতভাগ না হলেও। তবে সিনিয়র হোম বা লং টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে মহামারির বিপদ ঠেকানো যায় নি। এই হোমগুলোতে আগে থেকেই নানানরকমের অব্যবস্থাপনা বিরাজ  করছিল। আর সেটা জানা যায় যখন বিপদ ঠেকানোর জন্য সেনাবাহিনী নামানো হয়েছিল অন্টারিওর লং টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে।

কানাডায় করোনার প্রথম ঠেউ শুরু হলে সবচেয়ে বেশী আঘাত আসে এই লং টার্ম কেয়ার হোমগুলোতেই। এ ছাড়া বাদবাকী পরিস্থিতি ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিল দেশটি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যৌথ উদ্যোগে এবং সাধারণ মানুষের সচেতনার কারণে। এবং সেটি ভ্যাকসিন ছাড়াই। কারণ ভ্যাকসিন তখনো বাজারে আসেনি।

এখন কানাডায় তৃতীয় ঢেউ চলছে। আর এই ঢেউ মোকাবেলায় সাথে আছে ভ্যাকসিন। ইতিমধ্যে এই ভ্যাকসিনের সুফলও দেখা যাচ্ছে। তাই চিকিৎসক ও রাজনীতিকগণ আশার আলো দেখাচেছন কানাডিয়ানদেরকে। তবে একই সাথে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করছেন তাঁরা। কারণ, সামনে এখনো অনেকটা পথ বাকী রয়েছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে।

পাবলিক হেলথ এজেন্সী অব কানাডা চলতি মে মাসের মাঝামাঝি সময় একটি প্রাথমিক নির্দেশিকা বা গাইডলাইন দিয়েছে আসন্ন গ্রীষ্মে আমরা কতটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবো সেই বিষয়ে। মহামারী বিষয়ক আইন-কানুনের কঠোরতা কমিয়ে কতটা শিথিল করা যেতে পারে এবং আমরা ঘরে-বাইরে কতটা স্বাচ্ছন্দভাবে চলাফেরা করতে পারবো সে বিষয়ে প্রদত্ত এই নির্দেশিকা নিয়ে জনমনে অনেকটাই আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে। তবে এ সবই নির্ভর করছে আগামী কয়েক সপ্তাহে কত ভাগ কানাডিয়ান ভ্যাকসিনের আওতায় আসবেন তার উপর। পাবলিক হেলথ এজেন্সী অব কানাডার পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘যদি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভ্যাকসিন নেবার উপযুক্ত ৭৫% ব্যক্তি প্রথম ডোজ নিতে পারেন এবং ২০% ব্যক্তি দ্বিতীয় ডোজ নিতে সক্ষম হন তবে এবারের গ্রীষ্মে লোকজন ক্যাম্পিং, হাইকিং এবং পিকনিকও করতে পারবেন। রেস্টুরেন্টের পাটিওতে বসে খেতেও পারবেন। তবে অধিক লোকজনের ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। সিটিভি নিউজের এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়।

টরন্টোর মেয়র জন টরি গত এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে এস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন নিচ্ছেন স্থানীয় শপার্স ড্রাগ মার্ট এর একটি স্টোরে। ছবি: কোল বার্সটোন/দি কানাডিয়ান প্রেস

আর আগামী শরতের মধ্যে যদি ৭৫% ব্যক্তি দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নিতে সক্ষম হন তবে তারা ইনডোর মেলামেশা বা খেলাধূলা করতে পারবেন নিজ পরিবারের বাইরের লোকদের সঙ্গেও। ফ্যামিলি গ্যাদারিংও করতে পারবেন।

তবে এই মূহুর্তে জনগণকে চলমান আইন ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে নিজের পরিবারকে এবং কমিউনিটিকে নিরাপদে রাখার জন্য। সিটিভি নিউজকে এ কথা  বলেন কানাডার স্বাস্থ্য মন্ত্রী প্যাটি হাজডু।

কানাডায় এখন কভিড-১৯ ভ্যাকসিন বেশ দ্রুততার সঙ্গেই দেয়া হচ্ছে সাপ্লাই ঠিক থাকার কারণে। কানাডার অধিবাসীদের মধ্যে ইতিমধ্যে শতকরা ৫১.৬১ জন প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন। অন্টারিওতে শতকরা ৫১.১ জন। আর সংখ্যার হিসাবে কানাডায় প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন মোট ১৯,৬১৪,২৩০ জন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১,৬৬৫,৭৮৩ জন। এই হিসাব মে মাসের ১৯ তারিখের।

কানাডায় ভ্যাক্সিনেশনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকজন এখন অধিকমাত্রায় সুরক্ষিত। কিন্তু তারপরও মনে রাখতে হবে, আমরা এখনো স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়া থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছি।

কানাডার আগে যে কটি দেশ অধিক সংখ্যক নাগরিককে ভ্যাকসিন প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সেই সব দেশ থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা আশাব্যঞ্জক। ঐ সব দেশে সংক্রমণের হার কমেছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার কমেছে। ইনটেন্সিভ কেয়ারে রোগির সংখ্যাও কমেছে।  ফলে আমরা আশা করতেই পারি কানাডায় ভ্যাকসিন আমাদের সুদিন ফিরিয়ে আনবে। তবে ধৈর্য ধরতে হবে। নজর রাখতে হবে আমাদের চার পাশে। সতর্ক থাকতে হবে সবসময়। মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্য বিধি।

ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার সহযোগী অধ্যাপক এবং গ্লোবাল হেলথ এপিডেমিওলজিস্ট রায়ওয়াত দেওনন্দন সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘এখন থেকে সামনের প্রতিটি দিনেই পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে। কারণ, ভ্যাকসিন কাজে দিচ্ছে। যে সকল দেশে কানাডার আগে ভ্যাকসিনেশন এর কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে সে সকল দেশের দিকে সামান্য নজর দিলে আমরাও আশাবাদী হয়ে উঠতে পারি। আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।’

উল্লেখ্য যে, ইজরাইল করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ থেকে অনেকদূর এগিয়ে আছে। চলতি মে মাসের ১৫ তারিখে প্রকাশিত এক খবরে দেখা গেছে ঐ দেশটিতে বিগত এক সপ্তাহে দুই শতের সামান্য কিছু বেশী লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছন পাঁচজন। গত জানুয়ারী মাসের মধ্যভাগে দেশটিতে এক সপ্তাহে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ছিল ষাট হাজারেরও বেশী এবং মৃতের সংখ্যা ছিল চার শতেরও বেশী। উন্নতিটা নাটকীয় সন্দেহ নেই। এবং এটি ভ্যাকসিনের কারণেই সম্ভব হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের অবস্থাও ছিল চরম বেকায়দায়। আক্রান্তের দিক থেকে প্রথম সারির কয়েকটি দেশের মধ্যে সে দেশটি ছিল। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন-ও আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল তাঁকে। ভ্যাকসিন প্রদান জোরদার করার পর সে দেশটির অবস্থাও উন্নত হচ্ছে প্রতিদিন। আশা করা হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন বিধিনিষেধ ক্রমান্বয়ে তুলে নেয়া হবে। স্কাই নিউজের এক খবরে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের টিকাদান কর্মসূচির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ‘ভ্যাকসিন টাস্ক ফোর্স’-এর সদ্য সাবেক প্রধান কর্মকর্তা ক্লাইভ ডিক্স দাবী করেছেন আগামী আগস্ট মাসের মধ্যেই যুক্তরাজ্য করোনা মুক্ত হবে। তিনি জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনগুলির প্রতিরোধী টিকা ব্যবহার করেই করোনামুক্ত হবে ব্রিটেন। গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে গণ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। সে সময় থেকেই ওই কর্মসূচির দায়িত্বে ছিলেন ক্লাইভ। সম্প্রতি তিনি পদত্যাগ করেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও উন্নত হচ্ছে। মোটা মাথার ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে দেশটিতে করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল অন্যান্য দেশের তুলনায়। তার ধাক্কা যুক্তরাষ্ট্রকে এখনো সামলাতে হচ্ছে। চলতি মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মোট মৃতের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ নব্বুই হাজারে দাড়িয়েছে। অকল্পনীয় এক ফিগার। তবে শেষ পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলতে শুরু করেছেন দেশটির জনগণ। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। আর এটি সম্ভব হচ্ছে ভ্যাকসিনের করণে। ফাউসি আশা প্রকাশ করে বলেন, আগামী বছর এ সময়ের আগেই করোনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিন প্রদানে সফলতা এবং নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়ায় চিকিৎসকরা এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।

মূলত ভ্যাকসিন কর্মসূচির সফলতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক, রাজনীতিবিধ ও জনগণ সকলেই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের ঘরে-বাইরে বেশিরভাগ জায়গায় মাস্ক ছাড়া থাকার অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দেশটিতে এখন অনেকেই মাস্ক ছাড়া চলাচল করছেন, রাস্তাঘাটেও মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি ওভাল অফিসে রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে মাস্ক খুলে ফেলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই।

বিবিসি’র এক খবরে বলা হয়, নতুন নির্দেশনায় বেশিরভাগ জায়গায় ঘরের ভেতরে বা বাইরে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে। তবে জনাকীর্ণ বাস, প্লেন এবং হাসপাতালে তা পরতে বলেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) সর্বশেষ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পূর্ণ টিকা গ্রহণকারীরা স্যোসাল ডিস্টেন্স বজায় না রেখেও চলাফেরা করতে পারেন।

মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক ব্যাধি গবেষণা ও কর্মপন্থা কেন্দ্রের পরিচালক মাইকেল ওস্টারহোম বলেন, ‘দেশব্যাপী করোনা মহামারি প্রতিরোধ ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। আমরা স্পষ্টতই করোনা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।

তবে কানাডা কতটা ভালো অবস্থানে আছে সে বিষয়ে চুড়ান্ত কোন মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা একদিকে যখন আশার বাণী শুনাচ্ছেন ভ্যাকসিন এর বিষয়ে তখন আবার একই সঙ্গে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করছেন এই বলে যে, এখনি রিলাক্স হবার সময় আসেনি। তাছাড়া ভ্যাকসিন সাপ্লাই ঠিক মত না হলেও সমস্যা দীর্ঘায়িত হতে পারে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে যে, ভ্যাকসিন উৎপাদনকারীদের উপর শতভাগ আস্থা রাখা যাচ্ছে না। তারা চুক্তিমোতাবেক ভ্যাকসিন সাপ্লাই ঠিক মত দিতে পারছে না সময়মত। ফলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে কানাডাসহ অনেক দেশকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার সময় বৃদ্ধি করা। প্রথম দিকে শুনা গিয়েছিল প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় ডোজ এক মাস পরে নিতে হবে। পরে সাপ্লাই ঠিক মত না হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো দুুই ডোজের মধ্যে চার মাসের ব্যবধান থাকলেও সমস্যা নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই এই সিদ্ধান্ত দেন।

তবে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নেয়ার পরই নাকি মৃত্যুঝুঁকি কমে যায় শতকরা ৮০ ভাগ। ‘পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড’ নামের এক সংস্থার সম্প্রতি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজে মৃত্যুঝুঁকি কমে যায় শতকরা ৮০ ভাগ এবং দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর তা প্রায় ৯৭ শতাংশ কমে যায়। সংবাদ মাধ্যম খালিজ টাইমসের বরাতে এ তথ্য জানা যায়।

অন্যদিকে ফাইজারের ভ্যাকসিনেও প্রথম ডোজের পরে মৃত্যুর ঝুঁকি ৮০ শতাংশ কমে ও দ্বিতীয় ডোজের পরে তা প্রায় ৯৭ শতাংশ কমে যায়। মডার্না সম্পর্কেও প্রায় একই কথা বলা হচ্ছে।

এদিকে সাপ্লাই সংকটের কারণে কানাডায় এখন আবার চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে ভ্যাকসিনের ‘মিক্স এ্যান্ড ম্যাচ’ এর। অর্থাৎ প্রথম ডোজ হিসাবে যারা অ্যাস্ট্রাজেনিকা নিয়েছেন তাদেরকে এখন দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে ফাইজারের ভ্যাকসিন দেয়া যায় কি না তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানায়, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের অধ্যাপক ম্যাথিউ স্ন্যাপ বলছেন, এক ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও আরেক ডোজ ফাইজারের ভ্যাকসিন নিলে প্রাপ্তবয়স্কদের শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা ও মাংসপেশিতে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে তিনি এও বলছেন যে, এগুলো খুব গুরুতর নয়।

অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নিলে দীর্ঘ মেয়াদে সুরক্ষা পাওয়া যায়। করোনার নতুন ধরন থেকে সুরক্ষা পেতে ও সরবরাহ বিঘ্নিত হলে ক্লিনিকগুলোকে দুই ধরনের দুই ডোজ ভ্যাকসিন দিতে বলা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দ্য কম-কভ নামে একটি গবেষণায় এ কথা বলা হয়।

অবশ্য এই ‘মিক্স এ্যান্ড ম্যাচ’ এর বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরো সময় লাগবে।

তবে আশার কথা এই যে, সব মিলিয়ে কানাডায় করোনা পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়া ডে’র লংউইকএন্ড শেষে এই লেখা যখন লিখছি তখন দেখলাম অন্টারিতে সংক্রমণের সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। গত ২৪ মে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১০৩৯ জন। তার আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ১৪৪৬। ইনসেন্টিভ কেয়ারেও রোগীর সংখ্যা কমে এসেছে। মাসখানেক আগে পরিস্থিতি ছিল বেগতিক। টরন্টোর ইনসেন্টিভ কেয়ারগুলোতে জায়গা ছিল না। ফলে অনেক রোগীকে টরন্টোর বাইরে পাঠাতে হয়েছিল।

ধারণা করা হচ্ছে ভ্যাকসিনের সুফল এগুলো। ভ্যাকসিন আমাদের জন্য অবিশ^াস্য কাজ করছে। গুরুতর অসুস্থ হওয়া বা হাসপালে ভর্তি হওয়া থেকে আমাদেরকে সুরক্ষা দিচ্ছে। মৃত্যুর সম্ভাবনাও কমিয়ে দিচ্ছে ব্যাপকভাবে। ভ্যাকসিনের এই কার্যকারিতা নিয়ে আমরা খুব আশাবাদী হতেই পারি এবং সেটি সেলিব্রেটও করতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে কানাডায় এখনো সংক্রমণের হার বেশী এবং এ পর্যন্ত যে অর্জনটুকু আমরা করতে পেরেছি তা আবার নষ্ট হয়ে যেতে পারে আমাদের অসাবধানতা বা অতি উৎসাহিত ফলে। সিবিসি নিউজকে এ কথা বলেছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও কানাডার ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক অ্যালসন কেলভিন।

কানাডার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার তেরেসা টাম-ও কানাডিয়ানদেরকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দুই ডোজ নেয়ার পরও কেউ শতভাগ প্রতিরক্ষা পাবেন এমন গ্যারান্টি নেই। ভ্যাকসিন সংক্রমণের হার কমায় তবে তার অর্থ এই নয় যে এটি সংক্রমণ নির্মূল করে দেয়।

তবে যথেষ্ট ইতিবাচক আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন ডাক্তার তেরেসা টাম। তিনি বলেন যারা ইতিমধ্যে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন তারা কাছের পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে ঘরের বাইরে মেলামেশা করতে পারেন এই গ্রীষ্মে। তিনি আরো বলেন, যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন তারা অধিকতর সুরক্ষিত অবস্থায় আছেন এমটা ভাবতে পারেন। তবে তাদেরকে সর্বোচ্চ সুরক্ষার জন্য দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে এবং বসন্তের এই সময়টুকুতে সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখতে হবে যথাযথভাবে যদি আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমটি আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে উপভোগ করতে চান।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ