করোনার দিনগুলো

করোনা অতিমারি: সারা বিশ্বের মানুষকে টিকা দেওয়ার এক কোটি কারণ

জসিম মল্লিক

অন্টারিও প্রভিন্সে স্টে এট হোম ২ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এদিকে পপ আপ ক্লিনিক করে দ্রুত ভ্যাকসিন রোলআউট চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ কানাডিয়ান প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী সামারে কানাডিয়ানরা বাইরে বারবিকিউ করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সেকেন্ড ডোজ ভ্যাকসিনও দ্রুতই শুরু হবে বলে হেলথ কানাডা জানিয়েছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত কানাডায় প্রায় ১৪ লক্ষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ২৫ হাজারের মতো মৃত্যু হয়েছে। আর অন্টারিও প্রভিন্সে আক্রান্ত প্রায় ৬ লক্ষ এবং মৃত্যু সাড়ে পাঁচ হাজার।

অনেক দেশে করোনা ভাইরাস কমতে শুরু করলেও ভারতের পরিস্থিতি ভয়াবহ। কানাডার সাথে ভারতীয় এয়ারলাইন্স বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) বেশি প্রাণঘাতী এবং অধিক সংক্রামক। এর ওপর টিকার কার্যকারিতার বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ছড়ানো করোনার ভারতীয় ধরন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই তথ্য দিয়েছে। করোনার বি.১.৬১৭ ধরনটি গত অক্টোবরে ভারতে প্রথম শনাক্ত হয়। এরপর এরই মধ্যে ৪৪টি দেশে তা পাওয়া গেছে। করোনার এই ধরনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ভারত। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশটিতে প্রতিদিন তিন লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এনডিটিভি বলছে, ভারতে আক্রান্তদের প্রায় শূন্য দশমিক ১ শতাংশের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া করোনার বি.১.১৭ ধরন এবং ভারতীয় ধরন বি.১.৬১৭ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ‘কমতে শুরু করেছে’। তবে উদ্বেগজনকভাবে ভারতীয় ধরনের আরও বিপজ্জনক রূপান্তর ঘটেছে- বি.১.৬১৭.১ এবং বি.১.৬১৭.২ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে করোনার বি.১.৬১৭.১ এবং বি ১.৬১৭.২ ধরনের উচ্চ বৃদ্ধির হার এর অধিক সংক্রমণের বিষয়টিকে বোঝায়। অনেক দেশেই এর দ্রুত বৃদ্ধি দেখা গেছে। এই ধরনের ওপর টিকার কার্যকারিতার বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কিছু গবেষণায় মডার্না ও ফাইজারের টিকার কিছুটা কার্যকারিতা দেখা গেছে। এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ভারতে করোনায় সংক্রমিত মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৭। করোনায় দেশটিতে এ পর্যন্ত মারা গেছে ২ লাখ ৭০ হাজার ২৮৪ জন।

এদিকে টিকার সরবরাহ না থাকলে দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে কিছু দেরি হলে প্রথম ডোজ টিকার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে কি না বা কিছু সময় পর দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিলে একই ধরনের সুফল পাওয়া যাবে কি না, এসব বিষয়ে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করছেন। তাঁদের অনেকে বলছেন, তিন বা চার মাস পরও দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়া যাবে। সুফল অক্ষুন্ন থাকবে। যুক্তরাজ্য ও কানাডায় দ্বিতীয় ডোজ টিকা চার মাস পরে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বিবিসির এক খবরে জানানো হয়েছে, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের অধ্যাপক ম্যাথিউ স্ন্যাপ বলছেন, এক ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও আরেক ডোজ ফাইজারের টিকা নিলে প্রাপ্তবয়স্কদের শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা ও মাংসপেশিতে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে এগুলো খুব গুরুতর নয়।

প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড একটি মাস ভ্যাকসিনেশন ক্লিনিক পরিদর্শনে যান। ছবি : ফ্রাঙ্ক গুন/ দি কানাডিয়ান প্রেস

শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের মিশ্র টিকায় দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা পাওয়া যায় বলেও তাঁদের গবেষণায় জানা গেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দ্য কম-কভ নামে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। তাতে দেখা গেছে, প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার পরে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিলে দীর্ঘ মেয়াদে সুরক্ষা পাওয়া যায়। করোনার নতুন ধরন থেকে সুরক্ষা পেতে ও সরবরাহ বিঘ্নিত হলে ক্লিনিকগুলোকে দুই ধরনের দুই ডোজ টিকা দিতে বলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট ১৩ মে সংখ্যায় বিশ্বে করোনায় মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছে। ‘করোনা অতিমারি: সারা বিশ্বের মানুষকে টিকা দেওয়ার এক কোটি কারণ’ (ঞযব ঢ়ধহফবসরপ: ঞবহ সরষষরড়হ ৎবধংড়হং ঃড় াধপপরহধঃব ঃযব ড়িৎষফ) শিরোনামে লেখা সম্পাদকীয়তে বিশ্বব্যাপী সব মানুষকে দ্রুত টিকা দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। তাদের লেখায় একটি জরুরি সাবধানবাণী উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, টিকা কার্যক্রম বৈশ্বিক পর্যায়ে নিতে না পারলে ভারতের মতো ট্র্যাজেডি অন্যান্য দেশেও ঘটতে থাকবে। লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। দুই ডোজ টিকায় যে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা পাওয়া যায়, সেটা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।

টরন্টো ১৬ মে ২০২১

আমার অনেক একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে

আমার প্রায়ই একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। একলা বাঁচতে ইচ্ছে করে। বৈষয়িক ভাবনা, ঘরবাড়ি, দালান কোঠা এসব খুব বিষময় মনে হয়। প্রচুর সম্পদের ভার আমি নিতে পারব না। ডেবিট ক্রেডিটের হিসাব খুব অসহ্য লাগে আমার কাছে। আমি স্বীকার করি যে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। আবার এটাও ঠিক যখন আমার কিছুই ছিল না তখনও আমি সুন্দরভাবে বেঁচেছিলাম। আনন্দময় ছিল সেই দিনগুলি। অনেক কিছু যে নাই সেই বোধটাই তৈরী হয়নি, তাই কিছু খারাপ লাগেনি। অনেক কিছু যে ছিল না তাতে কোনো কষ্ট পাইনি কখনো। ওই সময়ের জন্য ওটাই ছিল স্বাভাবিক। আমার খুব হালকা হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে। পাখির পালকের মতো হালকা। আগে যেমন বেঁচেছিলাম। নির্ভার একটা জীবন ছিল। উদ্বেগহীন জীবন। ঘুম ভেঙ্গে যেনো কোনো অনাকাঙ্খিত খবর আমাকে বিচলিত না করে। কিন্তু সংসারে এমনই নিয়ম যে প্রতিদিন কিছু লড়াই থাকে। বাঁচার লড়াই। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সামনে এসে পড়ে। প্রতিপক্ষ তৈরী হয়।

আমার খুব একলা বাঁচতে ইচ্ছে করে। চারিদিকে সবই থাকবে। সবকিছুর মধ্যে আমি একলা হয়ে যাব। কিন্তু এই পৃথিবী এতো কোলাহলমুখর যে একলা হয়ে বাঁচা কষ্টকর। এতো স্বার্থের সংঘাত যে নিজের মতো ডুব দিয়ে থাকা যায় না। আমাকে নিয়ে অনেকের অনেক অভিযোগ। স্ত্রীর অভিযোগ, ভাই বোনের অভিযোগ, বন্ধুর অভিযোগ, আত্মীদের অভিযোগ। আমি মানি যে আমার অনেক ত্রুটি আছে, সীমাব্ধতা আছে। আমি চাইলেও এসব ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারব না। আমার অনেক কাছের আত্মীয়রাও আমাকে খারিজ করে দিয়েছে। ডিলিট করে ফেলেছে আমার নাম। যাদের জন্য অনেক করেছি, অনেক মমতা দিয়েছি তারাও আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। কেনো গেছে সেই কারণ জানা নাই। জানতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু জানতে ইচ্ছা করে না। আবার আমাকে ভালবাসে এমন আত্মীয়র সংখ্যাও কম না। আমার খুব একলা বাঁচতে ইচ্ছা করে।

আমাকে নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগ করে না আমার ছেলে মেয়ে। ভুল ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় না। আমার সবকিছুতে ওদের সায় আছে। কখনো কোনো অবান্তর প্রশ্ন করেনা আমাকে। আমার ব্যর্থতা নিয়ে কোনো কথা বলে না। কোনোদিন কোনো কিছুর জন্য জোর করেনি যা আমি করতে পারব না। কোনো রাগ অভিমান করে থাকেনি। বরং আমি রাগ করে আমিই সরি বলেছি অনেকদিন। আমি যে লিখি তাতে ওরা প্রাউড ফীল করে। আমি যে দেশে যাই তাতেও সবসময় সম্মতি থাকে। ওদের বক্তব্য হচ্ছে বাবার যা ভাল লাগে তাই করবে। ওরাই আমার শক্তির জায়গা। সবসময় সমর্থন থাকে বাবার পক্ষে। কোনো কিছু না চাইতেই বাবার জন্য করতে চায়। তাই ওদেরকে কিছু বলা থেকে বিরত থাকি আমি। আমি সবসময় অকপটে ওদের কাছে আমার জীবনের গল্পগুলো বলি। আমার না পাওয়ার গল্প, বেদনার গল্প বলি। কিন্তু এমনভাবে বলি যেনো ওটাই বিরাট আনন্দের কিছু ছিল। যেনো কোনো বিষাদ ভর না করে ওদের মনে। কাউকে বিষাদ দিতে চাই না।

আমার অনেক একলা বাঁচতে ইচ্ছা করে। একলা হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কিভাবে একলা হতে হয় তাই জানি না। চারিদিকের নানা ঘটনা অষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে তাই একলা হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। মায়া জিনিসটা খুব খারাপ, খ্বু পোড়ায়। মায়া কিছুতে ছাড়ে না। সন্তানের জন্য মায়া, স্ত্রীর জন্য মায়া, ভাই বোন, আত্মীয়, বন্ধুর জন্য মায়া। তাই আর একলা হওয়া হয়ে ওঠেনা। এই যে বেঁচে আছি, এই যে দীর্ঘ ঘরবন্দী জীবন, এই যে বস্তুগত জীবন তার মধ্যেও নিজেকে খুব একলা মনে হয়।

সেদিন গাড়িতে যেতে যেতে অরিত্রিকে বললাম,

আমার কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে।

অরিত্রি কথাটার অর্ন্তনিহিত অর্থটা বুঝতে পরেনি। মনে করেছে আমি কোথাও ঘুরতে যেতে চাই বা দেশে যেতে চাই। অরিত্রি বলল,

তাহলে বাংলাদেশে যাও।

হ্যাঁ যাব।

ভ্যাকসিন নিয়েই যাও, ঘুরে আসো।

কিন্তু অরিত্রিকে তো আর বলা যায় না যে আমি একলা বাঁচতে চাই। এসব শুধু কল্পনায়ই থেকে যায়।

টরন্টো ৭ মার্চ ২০২১

আত্মজ এবং স্পর্শের অপেক্ষা

আজকে ছিল রবিবার। উইকেন্ড সবসময় অন্যরকম। সোমবার আসলেই মন খারাপ হয়ে যায়। ইশ্ কেমন করে দুটি দিন পার হয়ে গেলো! আবার সেই একঘেয়ে জীবন। আবার কাজ। সপ্তাহ জুড়ে এই দুটি দিনের জন্য অপেক্ষা। তবে এখন সবকিছুই ভিন্ন। শনিবার বা রবিবারের তেমন কোনো আবেদন নেই। অন্য দিনের সাথে বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। গত বছর ২৩ মার্চ ঢাকা থেকে এসেছি আমি। সেই থেকে প্রতি রবিবার একই রকম। কোথাও যাওয়া নাই, বেড়ানো নাই, অনুষ্ঠান নাই, পরিকল্পনা নাই। শুধু ঘরে থাকা। কখনো গ্রোসারি করা এই যা। আজকের দিনটা ছিল ব্যাতিক্রম। সকাল থেকে কি কি করেছি তার একটা ফিরিস্তি দেওয়া যাক। কালকে ঢাকার একজন বন্ধু বলল, জসিম আমাদের দিনের আট নয় ঘন্টা সময় তোমাকে কোথাও পাই না। কোথাও নাই তুমি। অনলাইনে তোমার গ্রীন বাতি জ্বলে না। সবকিছু যেনো স্তব্দ। মনটা কেমন হাহাকার করে তোমাকে না দেখে। কেনো এমন করো তুমি!

আসলেই ব্যাপারটা কখনো ভেবে দেখিনিতো! যেটা হয় সেটা হলো লেখকরা সাধারণতঃ রাত জেগে লিখে। দিনের অনেকটা সময় ঘুমায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে উল্টো। আমি একদম রাত জাগতে পারি না। আগে আমার ঘুমাতে একটা দেড়টা হতো কিন্তু আমার যখন ভার্টিগো হলো তখন আমি আর্লি শুয়ে পড়তাম। সেই অভ্যাসটা রয়ে গেছে আমার। রাত এগারোটা হলেই আমার দু’চোখ ভেঙ্গে ঘুম চলে আসে। যত দ্রুত সম্ভব আমি বেডে চলে যাই। এবং নিমিষেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই। ঘুমানোর সময় আমার সেলফোন অন থাকে বটে কিন্তু ওয়াইফাই অফ করে রাখি। এর কারণ হচ্ছে আমার ঘুম এতোটাই সেনসেটিভ যে সামান্য শব্দেই আমার ঘুম ছুটে যায়। জেসমিন আমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত দেরিতে বেডে যায়। কিন্তু আমি শুয়ে পড়ার পর আর কোনো ধরণের শব্দ করে না। পা টিপে টিপে হাঁটে। সকাল ছয়টায় অটোমেটিক আমার ঘুম ভাঙ্গবে। এলার্ম দরকার হয় না। ওজু করে ফজরের নামাজ পড়ে আবার একঘন্টা ঘুমাই আমি। তারপর ফোন অন করি।

আজকে রবিবার কেটেছে অন্যরকম। সকালে উঠে নিজের হাতে চাই বানাই। আমি এবং জেসমিন দু’জনের চা। রবিবার আমার আউলা ঝাউলা খাবার খাইতে মন চায়। বরিশালে যখন থাকতাম মা বানিয়ে দিতেন। কোনো রেসিপি না, ইউটিউব না, রান্নার বই না। ম্যানুয়াল সব। সেইসব খাবার ছিল অমৃত সমান আমার কাছে। আজ সকালে ছিটা পিঠা বানিয়ে খেলাম। পরীক্ষামূলক ছিল বটে কিন্তু খারাপ হয়নিতো! তারপর লা লীগার খেলা দেখলাম। আতলাতিকো মাদ্রিদ এবং রীয়াল মাদ্রিদ। আমি কোনোটারই ভক্ত না। কিন্তু আজকের পয়েন্ট ভাগাভাগিতে লাভবান হয়েছে বার্সা। মেসির দল। আমি মেসির ভক্ত। তাই আজকে রীয়াল মাদ্রিদকে সাপোর্ট করেছি। তারপর ৪০ মিনিট জীম বাইক করেছি। হলিউড নতুন মুভি দেখলাম ’দ্যা গার্ল ইন দ্য বেসমেন্ট’। অসাধারণ মুভি। কেউ সুযোগ পেলে দেখে নিও। সন্ধ্যায় দেখলাম ইন্ডিয়ান আইডল হেমা মালিনী স্পেশাল।

দিনের বাকি সময় কুক করতে সাহায্য করলাম জেসমিনকে। আমি রান্না করলাম বীফ। জেসমিন করল চিকেন কারি এবং চিকেন ব্রেষ্টের একটা আইটেম, পাস্তা, পোলাউ, কাবাব। এসব করলাম অর্ক অরিত্রির জন্য। রাত আটটার পর আমি আর জেসমিন দু’জনে গাড়ি নিয়ে বের হলাম। প্রথম গেলাম অরিত্রির বাসায় ডাউন টাউন টরন্টোর ১০ ইয়র্ক স্ট্রীট। তারপর গেলাম হাইওয়ে ধরে অর্কর ওখানে ২০২৫ লরেন্স এভিনিউ ইষ্ট। অরিত্রি ৫১ তলা থেকে নিচে নেমে এলো। খাবারের ব্যাগ দিলাম। আমি গাড়ির গ্ল­াস নামিয়ে অরিত্রির গালে একটু হাত দিলাম। আত্মজার স্পর্শ মন ভাল করে দিল।

অর্ককেও তাই করলাম। দু’জনকেই বললাম তোমাদের জন্য বীফ আমি রান্না করেছি। খেয়ে বলবা কেমন হলো। দু’জনের সেম উত্তর, সিওর, থ্যাংকস বাবা। রাত এগারেটা ৩৬ মিনিটে অর্কর রিপোর্ট এসেছে। বাবা দ্য বীফ ওয়াজ ডেলিশাস। অর্কর স্ত্রী খাতিজা সবসময় দুষ্টুমি করে আমার সাথে। সে লিখেছে, বাবা ইউ আর গুড শেফ। ইউ শুড স্টার্ট আ ইউটিউব চ্যানেল” বাবা কুকস”। অরিত্রির রিপোর্ট এখনও আসে নাই।

টরন্টো ৮ মার্চ ২০২১

চোখ ভেসে যায় জলে!

সেদিন ছিল শুক্রবার। মদিনা ছেড়ে মক্কায় রওয়ানা হওয়ার দিন। মসজিদে নববীতে জুমার নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে দুপুরেই এহরাম বেঁধে রওয়ানা হলাম মক্কায়। বাসে আট ঘন্টার জার্নি। বাসের মধ্যে সম্মিলিতভাবে মুর্হুমুহু লাব্বায়িক আল্লাহুমা লাব্বাইক..তালবিয়া ধ্বনি করতে করতে রাতের ঝলমলে পবিত্র নগরী মক্কায় পোৗঁছলাম। রাত সাড়ে এগারোটায় আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল আল সাফওয়ান রয়্যাল অর্কিডে পৌঁছে গেলাম। দীর্ঘ জার্নি করলেও কোনো ক্লান্তি অনুভূব করছি না। ক্লান্ত হলে চলবে না। হোটেলে চেক ইন করে, ফ্রেশ হয়ে রাতেই যাব ওমরাহ করতে। হজ্জের প্রথম ধাপ ওমরাহ। আমার আর জেসমিনের জন্য এক রূম রিজার্ভ। হোটেলে কক্ষে যাওয়ার আগে আমাদের বলে দেয়া হয়েছে কেউ যেনো রূমের জানালার পর্দা না সরাই। কেনো বলেছে সেটা পরে জেনেছি। আমরা মোয়াল্লামের নির্দেশ পালন করি।

রাত দুইটার দিকে সবাই হোটেলের লবিতে মিলিত হলাম। আমাদের গ্রুপের সবাই একসাথে যাব ওমরাহ্ করতে। তাওয়াফ এবং সাফা মারওয়ায় সায়ী করার মধ্য দিয়ে শুরু হবে হজ্জের মূল কার্যক্রম। আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে ১ নম্বর গেটের দিকে রওয়ানা হয়েছি। সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে মাথা নিচু করে হেঁটে যেতে। আমরা তাই করছি। লম্বা একটা খোলা চত্বর অতিক্রম করে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলাম। বস্তুত বায়তুল্লার চর্তুপার্শ্বেই যে সুদৃশ্য মসজিদ বিস্তৃত ও উন্মুক্ত আঙ্গিনা দ্বারা পরিবেষ্টিত সেটাই মসজিদুল হারাম। সেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে খানিকটা অগ্রসর হওয়ার পর আমাদের সামনের দিকে তাকাতে বলা হলো। তাকিয়েই চোখের সামনে দেখতে পেলাম সেই বিস্ময়! মহা বিস্ময়! কাবাঘর। যাকে বলে আল্লার ঘর। চোখের সামনে জ্বল জ্বলে করে দন্ডায়মান।

যেনো একটা কেনো বাস্তব ঘটনা না। যেনো সবকিছু স্বপ্নে ঘটছে এমন মনে হলো আমার কাছে। এখন বুঝতে পারছি কেনো হোটেলের পর্দা সরাতে মানা করা হয়েছিল, কেনো মাথা নিচু করে অগ্রসর হতে বলা হয়েছে। আমাদের হোটেলটা এমন জায়গায় অবস্থিত এবং আমাদের রূমগুলো ছিল কাবামুখী তাই জানালার পর্দা সরালেই কাবাঘরে পুরোটা দেখা যায়। আগে ভাগেই যেনো আমরা দেখে না ফেলি। সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য পর্দা না সরাতে বা ঢোকার সময় মাথা নিচু করে থাকার  জন্য বলা হয়েছিল।

সেই মুহূর্তটির অনুভূতি ব্যাখ্যা দেওয়া সত্যি কঠিন। লিখে সেই অনুভূতিকে বোঝানো সম্ভব না আমার পক্ষে। এ এক অন্যরকম শিহরন ছিল, আবেগ ছিল, চোখের জলে ভেসে যাওয়া ছিল। হৃদয় নিংড়ানো আবেগ উথলে উঠেছিল বুকের ভিতর থেকে। কোথা থেকে এসেছে এই শিহরন, এই আবেগ, এই উদগত কান্নার রোল জানা নাই। লক্ষ মানুষের ভীড়ে সেই মুহুর্তটা ছিল নিজেকে আবিষ্কারের, নিজেকে চেনার। ইশ্বরের প্রতি অকুন্ঠ নিবেদন ছিল। নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে হয়েছিল। এই জাগতিক জীবন তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। পরলৌকিক এক জগতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সে এক অসম্ভব অনুভূতি আর শিহরন জাগানিয়া মুহুর্ত। পৃথিবীর সব লোভ লালসা, চাওয়া পাওয়া, মায়া মমতা, স্নেহ ,আকাঙ্খা, কাম  সবকিছু অর্থহীন মনে হয়েছিল। এ এমন এক পবিত্রতম স্থান যেখানে পা রাখা সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। সত্যি এক স্বপ্ন।

টরন্টো ১১ মার্চ ২০২১

একটা লাইব্রেরি ও একটি স্বপ্ন

আমার নিজস্ব কোনো সম্পদ নাই। সম্পদ বানানোর কোনো ইচ্ছাও নাই। আমার সম্পদ হচ্ছে আমার সন্তান, আমার পরিবার, আমার ভাই বোন, আমার আত্মীয়, আমার বন্ধুরা। এসব নিয়ে আমি সুখী। তাই আমার কোনো স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নাই। আমার দরকারের পরে অতিরিক্ত যা কিছু আমি দান করে দেই। এই যে আমার কোনো ঘরবাড়ি, সম্পদ নাই সেজন্য আমার কোনো আফসোস নাই। আমার অনেক সম্পদশালী বন্ধু আছে তারা আমাকে সেজন্য অবহেলার চোখে দেখে না, আবার অনেক সম্পদহীন বন্ধুও আছে তারাও আমাকে এড়িয়ে যায় না। কেউ আমার কাছে কোনো হেল্প চাইলে আমি সহজে ফিরিয়ে দেইনা। আবার না চাইতেও অনেকের জন্য করি। আমার নিজের এমন এক একটা দিন গেছে যখন আমারও অনেক কষ্ট ছিল কিন্তু আমি কখনো কারো কাছে হাত পাতিনি। কারণ আমি প্রত্যাখান একদম সহ্য করতে পারি না। তাই আমি সহজে কাউকে ফিরাই না।

আমার মা মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, জসিম তোমার দানের হাত কখনো ছোট করবা না। এটা ঠিক যে আমার ক্ষমতা অতি সীমিত। কিন্তু আমি আমার মায়ের নির্দেশ পালন করি। আমার ছেলে মেয়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। তারা দুজনেই সম্মতি দিয়েছে; বলেছে বাবা তোমার যা মনে হয় তাই করো। তুমি আমাদের জন্য অনেক সেক্রিফাইজ করেছো, এখন তুমি তোমার লাইফ এনজয় করো। আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না। জেসমিনেরও সম্মতি আছে। এটাই আমার শক্তির জায়গা। এমনকি আমি আমার ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে নিয়েও অন্যদের হেল্প করি। আমার নিজের অসুবিধার কথা ভাবি না। কোনো প্রতিদানের কথাও ভাবি না। অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবানদের জন্য করার যে আনন্দ সেটা যে করে সেই বোঝে।

মা সবসময় আমাকে একটা বাড়ির কথা বলতেন। এটা মায়ের একটা অবসেশন ছিল। বলতেন জসিম তুমি তো কোথাও কিছু করলা না। একটা বাড়ি করবা জলপাই তলায়, পুরো তেরো কাঠা জমির ঘেরওয়ালা বাড়ি, ছ’টা আম, চারটে কাঠাল, দশটা সুপুরি আর দশটা নারকেল গাছ লাগাবা, পিছনে থাকবে কলার ঝাড়। কুঞ্জলতা আমার বড় পছন্দ, বুঝলা! বেড়ার গায়ে গায়ে লতিয়ে দেবো। তুমিতো শিম খেতে ভালোবাসো-একটু শিমের মাচান করবা, গোয়ালঘরের চালের উপর লকলকিয়ে উঠবে লাউডগা.। হ্যাঁ ঠিক সেই জলপাই তলায়ই একটা বাড়ি করার প্ল­ান করেছি। তবে সেটা হবে একটা লাইব্রেরি। আমার স্বপ্নের লাইব্রেরি। আমি আমার অনেক বন্ধুর সমর্থন পেয়েছি এই মহতি কাজের ব্যাপারে।

টরন্টো ২৮ মার্চ ২০২১

দেওয়া নেওয়ার এই সংসারে

আমার দশ বছর বয়স থেকে পনোরো বছর বয়স পর্যন্ত সময়টা অদ্ভুৎ এক আলো আধাঁরিতে ভরা ছিল। তখন থেকেই আমার মধ্যে এক অন্য আমি তৈরি হয়েছিল। অনেক যন্ত্রণাময় যেমন ছিল সেই বয়সটা, তেমনি অনেক আনন্দের ছিল। তখন থেকেই আমি ভিষন নিঃসঙ্গতায় ভুগতে শুরু করি। আমার কোনো বন্ধু ছিল না। দলছুট হয়ে গেছিলাম আমি। আমার খেলার সাথীদের সাথেও আমার সখ্য হয়নি কখনো। যা কিছু আমি মায়ের সাথেই শেয়ার করতাম। এক-একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন এক-একটা বিকেল বেলা আছে যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়তো উঠোনে। আকাশের রং যেত পালটে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মাধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ’আমি’ আছে। সেই সব বিষন্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হত। সারা বাড়ি খুঁজে মাকে হয়ত পেতাম বড় ঘরের পাটাতনের সিঁড়ির তলায় গামলায় চাল মেপে তুলছে। আমি অবোধ দুর্জ্ঞেও এক বিষন্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যে মার কাছে গেছি তা মা বুঝত না। শুধু একটুক্ষণের জন্য হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিত। একটুক্ষণের জন্য মাথাটা চেপে রাখত বুকে, এই যা।

স্কুলে পড়ার সময়টায় আমার অনেক কিছুর লোভ হতো। যে যা করত আমি তাই করতে চাইতাম। আমি ক্লাসে ফার্স্ট বয় হতে চাইতাম, আমি মার্বেল খেলতে চাইতাম, ঘুড়ি উড়াতে চাইতাম, চারা খেলতে চাইতাম, ঘুরতে যেতে চাইতাম, ভোরে উঠে আজান দিতে চাইতাম, কোরান মুখস্থ করতে চাইতাম, তিরিশটা রোজা রাখতে চাইতাম, বডি বানাতে চাইতাম, সুন্দর কাপড় পড়ে ফ্যাশন করতে চাইতাম, সিনেমা দেখতে চাইতাম, লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তে চাইতাম, স্কুলের গেটে আইসক্রীম খেতে চাইতাম, ঘটি গরম খেতে চাইতাম, চিনা বাদাম খেতে চাইতাম, মেয়েদের দিকে ছ্যাবলার মতো তাকিয়ে

থাকতে চাইতাম। অনেক কিছুই চাইতাম। কিন্তু সব চাওয়া পূর্ন হতো না। কিন্তু কখনো কাউকে বলতাম না। যদিওবা মা কে বলতাম তাও আমার বুক ভেঙ্গে যেতো দ্বিধায়, লজ্জায়। আমার আত্মসম্মানবোধ খুব প্রখর। প্রত্যাখ্যানকে আমি অনেক ভয় পাই। অনেক তীব্র আকাঙ্খাকে বুকের মধ্যে চেপে রাখতাম। মা একদিন বলল, তুমি তো কখনো কিছু চাও না। না চাইলে মায়েও দুধ দেয় না বুজছ!

আমার ছেলে মেয়েরা পেয়েছে আমার স্বভাব। খুবই অবাক কান্ড যে আমার ছেলে মেয়ে দুজনের একজনও আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে আমার কাছে কিছু চায়নি। দশ টাকাও চায়নি আজ পর্যন্ত। ছোট থাকতে যখন আমি বিদেশে যেতাম দু’জনেই শুধু বইয়ের লিষ্ট দিত আমার কাছে। আমি আমেরিকা থেকে কয়েকবার বাক্স ভরে বই কিনে নিয়ে গিয়েছি। তারপর কানাডা আসার পর যখনই হাই স্কুলে উঠেছে তখন থেকেই দুজনে পার্টটাইম কাজ শুরু করেছে। তারপর থেকে তাদের পিছনে আমার আর কোনো খরচ নাই। উল্টো আমাকে নানা অকেশনের অজুহাতে কত কি গিফট করে। যখন ওরা ছোট ছিল আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওদের যেনো কখনো কিছু চাইতে না হয়, ওদের কি দরকার সেটা আমি বুঝতে পারতাম। আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেটা যেনো তারা না পায়। তারা কখনো কিছু দাবী করেনি আমার কাছে। আজকে আমার চারপাশে চাওয়ার মানুষের সংখ্যাই বেশি। শুধু পেতে চায়, দিতে চায় খুব কম মানুষ। কেনো যে এই বৈপরিত্য কে জানে! হাত পেতে নেওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নাই বরং গ্ল­ানি আছে।

জসিম মল্লিক

টরন্টো ৬ এপ্রিল ২০২১