অন্য গল্প-২

আমার বিশ্বাস

এ কে এম ফজলুল হক

ঈদের দিন রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছি। সিগনালে আমার এক আত্মীয়ের সাথে মুখোমুখি। তিনি আমার সাথে কথা বললেন না। খুব কষ্ট লাগলো। কারণ, ঈদের দিন তো অন্তত কথা বলতে পারতেন। যাহোক, কথা না বলার কারণটা বলছি। আমি তখন এদেশে নতুন, উনার বাসায় দাওয়াত। এসব দাওয়াতে যা হয়, প্রথমে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়া, তারপর গ্লে­াবাল পলিটিক্স থেকে ঘুরে এসে ধর্ম। আমি ধর্মের জায়গায় এসে একটু হুমড়ি খেলাম। উনি ধর্ম সম্পর্কে যা তা বলছেন। আমি হজম করতে পারলাম না- প্রতিবাদ করলাম, শুরু হলো তর্কাতর্কি। ব্যাস, সে থেকে কথা বন্ধ।

তিনি কথা বন্ধ করেছেন তাতে কি, এরকম অনেকেই করবে তারপরও আমি বিশ্বাসী। আমি বিশ্বাসী, এটা সবাই জানে। আশপাশের সবাই। আমার বিশ্বাসের পেছনে আমার কমফোর্ট। আমার অনুভূতি। আমার এ অনভূতি আমাকে বাঁচতে শিখিছিয়ে, নিরন্তর সাহস জোগাচ্ছে…. অনেক কিছুই করেছে…যার ফলে আমি একজন মানুষ। মানুষ হয়েছি আমি অনেকগুলো ধাপে। কানাডা এসে সে ধাপ পূর্ণ হলো। এ শেষ ধাপে এসে দেখেছি প্রচন্ড সংগ্রামের মধ্যেও বেঁচে থাকার কি আনন্দ! সে এক নিরন্তর গল্প-

কানাডা আসলাম শূন্য হাতে। ক’দিনের মধ্যেই আমার হাতে দু চার টাকা যা ছিল তাও শেষ। একেবারে কপর্দক শূন্য। তিন বাচ্চা নিয়ে করুণ অবস্থা। কারো কাছ থেকে চাইবো সে রকম মানুষও আমি নই। একবার ভাবলাম ফিরে যাই দেশে। দেশে আমার ব্যাংকের চাকরি তখনও বহাল আছে। যোগাযোগ করলাম ব্যাংকের সাথে, তারা বললো  ‘চলে আসো’। আমি চলে যাওয়ার জন্য মন স্থির করলাম। যাওয়ার আগে আমি কানাডার সুন্দর জায়গাগুলো দেখে যেতে চাই। বিদায়ী দর্শন। আমি একেক জায়গায় যাচ্ছি আর মনে মনে কানাডাকে দ্বিগুন বেগে পছন্দ করার শুরু করছি। কি মুশকিল! একদিন গেলাম সেন্টার আইল্যান্ডে। চারিদিকে অপূর্ব সুন্দর। পরিষ্কার পরিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ, পাশ ঘেঁষে শ্বেত শুভ্র হাঁসের জলকেলী ঠিক সিনেমার দৃশ্য গুলোর মতো। তারপর নায়েগ্রা, চেরি পিকিং সব অতি সুন্দর। যতই দেখছি ততোই মুগ্ধ হচ্ছি। তখন চারিদিক থেকে আসার শুরু হলো উপদেশ …. ‘এই দেশে যেয়ে কি করবি, এখানে থেকে যা… দেশে তো সেই ট্রাফিক জ্যাম আর দুর্নীতি… আগের মতোই আছে। ‘আগের মতোই’ ঠিক আছে….. কিন্তু এখানে আমাকে চাকরিটা দিবে কে-এই মধ্য বয়সে? তারপর, সেটা আমার জন্মভূমি।   আর এদিকে বাচ্চারা! কি মধু যে ঢেলে দিলো কানাডা আহা…তারা আর যাবে না। একদম শিকড় গেড়ে বসে গেলো আর আমি উদভ্রান্তের মতো উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছি। শেষমেষ উপায় একটা বের হলো….বেগম পাড়া থিওরি। মানে পরিবার এখানে থাকবে আমি যাবো দেশে। বাহ্, কি সুন্দর বুদ্ধি। আমি এ বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না। তাহলে পরিবার এখন থাকছে তিন বছর….সিটিজেন হওয়া পর্যন্ত, তারপর ওরা চলে যাবে দেশে এ-ই সিদ্ধান্ত।

সমস্ত পৃথিবী নিশ্চুপ। হালকা বাতাসে সামনের ম্যাপেল গাছটার পাতা দোলে, গাছের ছায়া পড়ে মাটিতে আলো ছায়া খেলে। আহ্ কি সুন্দর। ছবি : অনলাইন

আমি এ সিদ্ধান্তের উপর ভরসা করে দেশে চলে গেলাম কোন এক ডিসেম্বরে। এখনো মনে আছে প্রচন্ড বরফের ভিতর দৌড়াদৌড়ি করে আমি টিকেট জোগাড় করছি। পেঁজা পেঁজা বরফ নীল ওভারকোটের উপর পড়ছে। আর সারা গা সাদা করে দিচ্ছে…. ভাল্লুকের মতো। ভাল্লুক হয়ে একদিন দাঁড়ালাম গিয়ে লাইনে… তখন জেলার্স নামের এক দোকান ছিল শপার্স ওয়ার্ল্ডে। সেখানে ডিসেম্বরের সেলস চলছে..আমি হাতড়েপিতড়ে কত গুলো জিনিস কিনলাম সেখান থেকে। অধিকাংশই ফরমাসের জিনিস। এর জন্য এটা… ওর জন্য ওটা, এ ধরণের। এ’সময় কোন এক আত্মীয় দেশ থেকে টেলিফোন করে বললো ‘ভাইরে শুনলাম কানাডায় বড়ো বড়ো ডাব্বা সাইজের হেড এন্ড শোল্ডার শ্যাম্পু পাওয়া যায়…আনতে পারবা একটা…আমার খুশকি তো এখন সাজনা গাছের মতো চারদিকে রেনু ছড়াচ্ছে। উনার রেনু দূরীকরণের জন্য আমি একদিন গেলাম সেই ব্রাম্পটন….তখনো কসকো সম্পর্কে জানা হয় নি। ব্রাম্পটন এক বিরাট ওয়্যারহাউস এ সারাদিন কাটালাম। তারপর বিরাট বিরাট তিনটি লাগেজ নিয়ে একদিন রওয়ানা হলাম দেশে।

দেশে গিয়ে সেই পুরোনো বন্ধুবান্ধব। অফিস। বড়ো বড়ো গ্রুপের অমুক ভাই তমুক ভাই খোঁজ খবর নিচ্ছেন। অফিস শেষে তাদের সাথে শিক কাবাব আর পরোটার আড্ডা দেই অনেক রাত পর্যন্ত। আমার অফিসটা ছিল মীরপুর সাড়ে এগারো নম্বর। একদিন অফিস করছি, দেখি নায়ক আলমগীর গিয়ে হাজির। কি ব্যাপার ‘আমি বিরাট বিপদে পড়েছি ভাই আপনি আমাকে উদ্ধার করেন, বলে হাত ধরে ফেললো। যাহোক সেদিন তাকে বিরাট বিপদে সাহায্য করলাম; এসব আর এখন বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না, রুচি ও হচ্ছে না। আলগমগীর সাহেবের সমস্যা উদ্ধার করে মনে হলো আমাকে দিয়ে হবে।

এদিকে আমি ম্যানেজার। নানা ভেজাল সামলাতে হয়। তারপর মীরপুরের মতো জায়গা, নানা চক্কর। একটা চক্করের কথা বলি। ‘আসলাম’ নামের এক ভদ্রলোক ব্যাংকের টাকা দিয়ে বহুতল ভবন বানালো ব্যাংকের পাশে। এখন আর কিস্তির টাকা দিচ্ছে না। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো টাকা তুলবার। কঠিন কাজ, তারপরও অত্যন্ত কৌশলে এগুলাম। প্রথমে চিঠি চালাচালি তারপর উকিল নোটিশ। উকিল নোটিশ পেয়ে সে লোক মারফত হুমকি দিলো আমার পরিবারকে নাকি নিঃশেষ করে দিবে। আমি তাকে ব্যাংকে ডেকে পাঠালাম। অত্যন্ত খাতির যত্ন করে বললাম  ‘ভাই আপনি আমার পরিবারকে নিঃশেষ করতে চেয়েছেন, ভালো কথা; কিন্তু এটা করতে হলে তো আপনার হাতে মিসাইল থাকতে হবে অথবা মাফিয়ার সংযুক্তি থাকতে হবে। আমি জানি এর কোনটাই আপনার নেই ; সুতরাং…’। সে ‘হা’ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার হা’ র মুখটা এখনো ঠিক মনে আছে, বোয়াল মাছের মতো। পরের ঘটনা- তার সাথে আরো ক্যাচাল করতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম। একদম কঠিন অবস্থা। কিন্তু কোন এক দৈব শক্তি সেদিন আমাকে সাহস জুগিয়েছে, পাশে থেকে। সে শক্তিটাই আমার বিশ্বাস।

আবারো গল্পে ফিরে আসি, দিনের বেলা এসব করছি, আর রাতের বেলা বাচ্চাদের সাথে সাথে সময় দেই। দেশের গভীর রাতে কানাডায় বাচ্চারা স্কুল থেকে আসে। আমি তাদের সাথে গল্প করি অনলাইনে…. আর তাদের মা এ’সময় ঘর সামলায়। এভাবে কয়েকদিন চললো। একদিন দেখলাম আর চলছে না। বাচ্চা গুলো কষ্ট পাচ্ছে। বিশেষ করে কোন অনুষ্ঠানে গেলে অন্যরা তাদের নামিয়ে দেয়। ফেরার পথে আবার কোন একজনকে ধরো…এ করে করে বাচ্চাদের মধ্যে এক ধরণের হতাশা তৈরি হচ্ছে। আমি তো হতাশার মধ্যে তাদের বড়ো হতে দিতে পারি না। আমার জন্য তারা কষ্ট পাবে কেন? তাদের কষ্ট থেকে বের করার জন্য পথ খুঁজতে লাগলাম। একদিন ভোরের দিকে এক স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, এক কালো চিমনি। ঠিক ইট ভাটার চিমনি গুলোর মতো। আমি চিমনির পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছি। কি মনে করে নীচ দিয়ে তাকালাম। পুরোটা কালো। উপরের দিকে শুধু এক টুকরো আলো দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট। রুপার এক টাকার কয়েনের মতো। আমি এ দেখে বিস্মিত হলাম, কেউ কি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে? হয়তো বলছে ।

আমি বিশ্বাসী। ঠিক করলাম কানাডায় গিয়ে লড়বো যা আছে কোপালে। একদিন আবারো ফিরে আসলাম। আমার ফিরে আসার সময় হেড অফ অপারেশন, পরে এ বি ব্যাংকের এমডি, শুধু বললো …..আমাদের দিকটা একটু দেখো। তার উত্তরে আমি এখানে এসে খুব আবেগ মিশিয়ে একটা চিঠি লিখলাম। চিঠির ভাষাটা এ’রকম ….স্যার আমার সর্বোচ্চ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও…পরিস্থিতির কারণে এ সিন্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছি…আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার কারণে ব্যাংক কোনরকম ক্ষতিগ্রস্থ হলে আমার আকাউন্টে টাকা জমা আছে;  সেখান থেকে নিয়ে নিতে পারবে। আর আমি জানি টাকাই সব কিছু না। মানুষের সম্পর্ক সবার উপরে। আমার বিশ্বাস- ব্যাংকের সাথে আমার এ সম্পর্ক অটুট থাকবে…বিনীত অমুক।

এ বলে পাকাপাকিভাবে থেকে গেলাম। শুরু হলো বেঁচে থাকার সংগ্রাম। অনেক সংগ্রামের মধ্যে একটি ভাষা শিক্ষা। গেলাম এনহ্যান্সড ল্যাঙ্গুয়েজে ট্রিনিং সংক্ষেপে, ইএল টি নামের এক প্রোগ্রামে। কনজুমার্স রোডের মাঝামাঝিতে এর অফিস। শিখাচ্ছেন ইরানি ইমিগ্র্যান্ট এক টিচার। টিচারের কাছে আমি শুধু ভাষার বুৎপুত্তিই পাই নি, কানাডা জীবনের অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে। তার সব কিছুই ঠিক ছিল শুধু একটা জায়গায় একটু গোলমেলে; ক্লাসের কোন না কোন পর্যায়ে এসে শুরু করে দিতেন তার মেয়ের গল্প। তার মেয়ে পড়ে ইউ এফ টি তে…সে মেয়ের এ’গুন্ ওই’গুন…শুনতে শুনতে আমাদের মনে হলো সে-ও আমাদের সিলেবাসের একটা অংশ। কোর্স শেষে পরীক্ষা। আমাদের সংশয় হয়ে দাঁড়ালো….ও’র সম্পর্কে কোন রচনা আসে কি-না। ভাগ্গিশ আসে নি। আসলে নির্ঘাত

ফেল করতাম।

ভাষার পর চাকরি। সে বৈতরণী ও উৎরে গেলাম কোন মতে। আমি আস্তে আস্তে কানাডার অংশ হয়ে যাচ্ছি। আসলো সিটিজেনশিপ পরীক্ষা। পরীক্ষায় সতেরো পেয়ে পাশ করেছি। বড়ো দুঃখ হলো যে কানাডার জন্য এতো কিছু ছেড়ে আসলাম…সে সাবজেক্টে আমি কানের গোড়া দিয়ে পাশ। আমি পড়ে পড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

আমি ক্রমাগত হেটে চলছি.. এ জীবনে; কোন এক গন্তব্যের দিকে, আমার বিশ্বাস সেখানেও আমি ভালো থাকবো ইনশাল্লাহ। আমি তৃপ্ত। জীবনের কাছে আমার চাওয়ার কিছুই নেই। এ অনুভবে তাই মাঝে মাঝে দাড়াই বাড়ির সামনের পোর্চ এ। গভীর রাত। আকাশে তখন মেঘের ফাঁকে এক টুকরো চাঁদ। সমস্ত পৃথিবী নিশ্চুপ। হালকা বাতাসে সামনের ম্যাপেল গাছটার পাতা দোলে, গাছের ছায়া পড়ে মাটিতে আলো ছায়া খেলে। আহ্ কি সুন্দর। সুন্দরের এ অমোঘ রূপ দেখি আর বলি……

“ আ-হা কি মধুর তব আয়োজন, সবি আমাদেরই তরে,

বিনিময়ে কিই বা পেলে তুমি, সব কিছু উজাড় করে ?”

এ কে এম ফজলুল হক টরন্টো