রোড ট্রিপ টু আমেরিকা

আগস্ট ৯, ২০১৭

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

নিতু সাউথ কেরালিনা থেকে ক্যনসাসে মুভ হয়েছে কয়েক বছর হল। ওর ছেলের আকিকা করবে, আমাদের যেতে বলেছে । হিউস্টন থেকে তার ভাই শাহরিয়ার আসবে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে। আরও আসছে হিউস্টন থেকে তার মামা নাসির চৌধুরী পরিবার নিয়ে। আমাকে আর আমার অনুজ নাদিরকে খুব করে বলছে যেতে। বলে চাচা আপনারা আসলে ভীষণ মজা হবে সবাই মিলে। নিতুর শ্বশুর শাশুড়ী এসেছেন ঢাকা থেকে নাতি দেখতে কয়েক সপ্তাহ আগে। আমার এখান থেকে নিতুর ওখানে যাওয়া চাট্টিখানি কথা না, বহু দুরের পথ।
নাদির খুব আগ্রহ দেখাল। বলল, চলেন পথে কয়েক ঘন্টা পর পর ব্রেক নিতে নিতে পৌঁছে যাব । প্রায় পনের বিশ ঘন্টার পথ টরন্টো থেকে। আমি সাহস করিনা, এত দুর ড্রাইভ করে যাবার। গিন্নী আমাদের প্লান শুনে বলল, এত দুরের পথ যাবে গাড়ী চালিয়ে- তোমার মাথাটাথা ঠিক আছেতো? বললাম একদিনে তো আর যাব না আমরা, মাঝখানে একদিন কোথাও থাকব। সে বলে আমি নাই তোমাদের সাথে, তোমরা তোমরা যাও।
আমি মনে মনে প্লান করে ফেললাম পথে শিকাগো’তে একদিন যাত্রা বিরতি হবে। আমার প্রতি বছরের ভেকেশনে তো যেতেই হবে ছেলে মেয়েদের নিয়ে, তাহলে কেনসাসেই হোক এবারের ভেকেশন। প্রায় প্রতিদিনই গুগুল ম্যাপে দেখি দূরত্ব কতদুর আর কতঘন্টা লাগবে। বউ ঝামটা মেরে বলে প্রতিদিন ম্যাপ দেখা লাগে নাকি? কি দেখো এত! এতে করে কি তোমার পথের দূরত্ব কমে যাবে নাকি। আমি বলি যাবে নাকি সেটা বল আমাদের সাথে , সে বলে না। তোমরা যাও আমি যাব না। আমি তার সাথে কোন কথা বাড়াই না আর সাধাসাধিও করিনা। আমি মানসিক ভাবে মুটামুটি প্রস্তুত ভেকেশনের জন্য। নাদিরকে বলি যাবার আগেই শিকাগো’তে হোটেল বুকিং দিতে হবে। কিন্তু ও চায় পথে পথে স্টপ ওভার নিয়ে একটানে কেনসাস চলে যেতে। আমি বলি, না আমার একরাত পথে থাকতে হবে। প্রায় একদিন গাড়ী চালানো সম্ভব না। শার্লীনের সামার ক্লাস অগাস্টে শেষ হলে যাত্রা করব আমরা। দিনক্ষন ঠিক করে ফেলেছি আমি, তখন নাদির বলে ওর ছুটি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। তাছাড়া নতুন গাড়ী কিনেছে কিছুদিন আগে। ফলে এখন হাত খালি – এবার সে যেতে পারবে না।
আমি কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অতদূর একা একা যাব কিনা, নাকি শুধু শিকাগো গিয়েই বেড়িয়ে আসব। মেয়ে শার্লীনকে বলি, তুমি কি কোথায় যেতে চাও ভেকেশনে? ও বলে, ড্যাডি তোমার যেখানে সুবিধা হয় সেখানেই যাব। আমি এতদূর যাব কি যাব না তা তা নিয়ে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না তখনো। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম নিতুর ওখানেই যাব, আল্লাহ ভরসা।
এবার গোল বাধল ছোট মেয়ে শানাইয়াকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে। ওর মা বলে, ওকে নিয়ে এত দূর যেতে পারবে না, ও থাকুক আমার সাথে। জাননা ও কোথাও গেলে কিছুক্ষণ পর পর বলতে থাকে – ডেডি আর উই ক্লোজ ইয়েট ? আর উই ক্লোজ ইয়েট ? আর তুমি ওকে নিয়ে যাবে এতদূর পথ? ওতো যেতেই পারবে না এত দূর পথ। আমি বললাম, না শানাইয়া যাবে আমাদের সাথে। তোমার দুঃচিন্তা করতে হবে না। কারণ, যদি সানাইয়া না যায় তবে খুব কান্নাকাটি করবে আমরা ফিরে আসার পর। জানি ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে যাবে। কারণ, গতবার আমরা যখন আলভী, সারভী আর শার্লীনসহ মন্ট্রিয়ল আর কুইবেকে ভেকেশনে গেলাম তখন সানাইয়া তার মায়ের সাথে কেলিফোর্নিয়ায় মামার বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিল। পরে আমাদের গল্প শুনে তার খুব কান্না- কেন আমরা ওকে নিয়ে যাইনি কুইবেকে। আমি মুটামুটি রিক্স নিয়েই ওকে নিয়ে যাবার প্লান করলাম। প্লান হল রবিবার সকালবেলা রওনা হব আমরা। আমি শার্লীন আর শানাইয়া। বড় ছেলে সারভী গিয়েছে ওর বন্ধুদের সাথে ভেকেশনে, কানাডার ইস্ট কোস্ট – নিউ ফাউন্ডল্যান্ডে আগের সপ্তাহে।
আমরা সকালে নাস্তা করে রওনা হলাম। জিপিএসে নিতুর কেনসাস, অলিথের ঠিকানা সেট করে রওনা দিলাম। প্রায় কয়েক ঘন্টা পর আমরা অন্টারিও লন্ডনের ভিতর দিয়ে সারনিয়া বর্ডারে এসে পৌছালাম। বর্ডারে এসে দেখি লম্বা লাইন। আমি এই প্রথম গাড়ী করে আমেরিকার বর্ডার ক্রস করছি ।

ভ্রমণ সঙ্গী ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে লেখক

এক দিকে বড় বড় লরী ট্র্যাক আর অন্য দিক দিয়ে গাড়ীর লাইন। মনে মনে একটু নার্ভাস। কারণ, ইউএস বর্ডার ইমিগ্রেশনে খান সাহেবদের দেখলে কখন যে কি হয় সেটা বলা যায় না। আমি এক লাইনে গিয়ে ডুকলাম আর আমাদের পাসপোর্টগুলো একত্রে করে ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে দিলাম। পাসপোর্টগুলো কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করে আমাকে পিছনের জানালা নামাতে বলল ইমিগ্রেশন অফিসার। কারণ বাইরে থেকে পিছনের সিটে আলভিকে দেখা যাচ্ছিল না, ওকে দেখে বলল হ্যলো ইয়াং ম্যান। আমাকে জিজ্ঞস করল আমরা কোথায় যাচ্ছি কত দিন থাকব। বললাম আজ রাতে শিকাগো থাকব পরের দিন যাব কেনসাস সিটি আমার নিস’কে দেখতে। সব মিলিয়ে পনের দিন ভেকেশন। ইমিগ্রেশন অফিসার আর কথা না বাড়িয়ে পাসপোর্টগুলো আমার হাতে দিয়ে বলল ‘হেভ এ নাইস ভেকেশন’। আমি পাসপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে তাকে থেঙ্ক ইউ দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ঢুকলাম আমেরিকার মিসিগানে। দেড় ঘন্টা ড্রাইভ করার পর আমরা লাঞ্চ করতে ঢুকলাম মেক্ডোনাল্ড’স এ । খাওয়া দাওয়া সেরে আধা ঘন্টা পর আবার রওনা হলাম শিকাগোর পথে। ভয় পাচ্ছিলাম সানাইয়া’কে নিয়ে। কখন আবার বলা শুরু করবে ‘ ডেডি আর উই দেয়ার ইয়েট ? কিন্তু না সে ভাইয়ের সাথে কথাবার্তা খেলায় ব্যস্ত পিছনের সিটে।
চারঘন্টা চালানোর পর বিকালে গিয়ে থামলাম মেক্ডনাল্ড’স এ বিকালের নাস্তা করতে । কফি স্নেক্স বারগার খেয়ে ফ্রেস হয়ে আবার হিট দা রোড। রাত নয়টায় পৌছে গেলাম শিকাগো শহরে। শহরের আলো, গাড়ীর হর্ন, হাইওয়ে রাশ দেখে মনে হল শিকাগো ব্যস্ত শহর। হোটেলে লাগেজ রেখেই আবার আমরা বের হয়ে পরলাম শহর দেখতে। বিখ্যাত বিন (স্থাপত্য) দেখলাম। আলোঝলমলে রাতের বেলায় তিলত্তমা শিকাগো শহর। ভীষণ ব্যস্ত শহর শিকাগো । বিশাল বিশাল রাস্তা সুউচ্চ টাওয়ার শহরের ভিতর দিয়ে চমৎকার লেক পাশে রিগলি বিল্ডিং আর দৃষ্টিনন্দন Trumph Tower.  ডাউন টাউনে প্রায় ঘন্টা দুই ঘুরাঘুরি হাটাহটি করার পর আমরা হোটেলে আসার পথে রাতে ডিনার খেতে খেলাম সাবওয়েতে (সেন্ডুউইচ স্টোর)। আমরা যখন ঢুকলাম তখন তাদের স্টোর বন্ধ হবার সময়। ইন্ডিয়ান (ভারতীয়) মহিলা আমাদের দেখে বলল, ঠিক আছে অসুবিধা নেই তোমাদের জন্য আমি সেন্ডুইচ বানিয়ে দিচ্ছি। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষন গল্প করলাম মহিলার সাথে। জিজ্ঞাস করলাম এখানে কি অনেক ইন্ডিয়ান থাকে নাকি? সে বলল, হ্যা এই এলাকাতেই প্রচুর ইন্ডিয়ান থাকে। সারা দিনের লম্বা জার্নিতে ভীষণ টায়ার্ড সবাই, হোটেলে গিয়েই ঘুম ।
পর দিন সবাই সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে হোটেলেই সকালের নাস্তা করে আমরা গেলাম আবার শহর দেখতে। পার্কিং খুঁজতে খুঁজতে একটা স্পট লাকিলি পেলাম একদম সেন্টারে। আমরা আবারো ঘুরে ঘুরে শহর দেখলাম। বিরাট শিকাগো পাবলিক লাইব্রেরী শহরের ডাউনটাউনে, শার্লীন দেখে আবাক এত বড় লাইবেরী! শহর দেখা শেষ করে এবার রওনা হলাম কেনসাসে’র পথে। চার ঘন্টা ড্রাইভের পর আবার যাত্রা বিরতী। এবার আমরা লাঞ্চ করার জন্যে থামলাম। খাওয়া সেরে কফি শেষ করে আরেকবার পথ ধরলাম। একটানা গাড়ী চালাতে চালাতে আমার ঘুম এসে যায়। শার্লীনকে বলি টাওয়েল ভিজিয়ে দিতে সেটা দিয়ে চোখ মুছি আমি । তখন ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যায়। আমরা কোথায় আছি সেটা বাসায় আর কেনসাসে ভাবীকে টেকস্ট করে জানিয়ে দিই। ভাবী বলে আর কতক্ষন লাগবে তোমাদের। ওদিকে বন্ধু নজরুল ফোন করে জানতে চায় আমরা কোথায় আছি এখন। কারণ নজরুল বার বার বলে রেখেছে তার ওখানে আরকানস এ বেড়াতে যেতে। নিতুর বাড়ী থেকে পাচ ঘন্টার পথ।
আমরা সন্ধ্যা আটটার দিকে কেনসাসে গিয়ে পৌঁছালাম । ছিমছাম ছোট্ট শহর, এত ব্যস্ততা নেই রাস্তায়। শহরে ঢোকার পথে ব্রিজটা খুব সুন্দর। ছবি তুলল শার্লীন পথ চলতে চলতে। মেজভাই রতন এবং ভাবী দেশে গিয়েছিলেন কয়েক সপ্তাহের জন্য। কেনসাসে ফিরে আসার কথা ছিল আগামী কাল কিন্তু তারা আজই চলে এসেছে। আমাদের দেখে তাদের আনন্দ আর ধরেনা। রতন ভাই আর ভাবীর সাথে দেখা হয়েছিল দেশে ২০০৯ সালে। প্রায় সাত বছর পর আবার দেখা তাদের সাথে। আর নিতুর সাথে দেখা আজ পনের বছর পর। সে এখন পুত্রের জননী । ভাই ভাবী ভাতিজী ও সুমনসহ আমাদের আড্ডা চলল গভীর রাত পর্যন্ত। নিতুর হাতে তৈরী রকমারী সুস্বাদু খাবার ভরা ছিল টেবিলের এপার ওপার। আলভী আর সানাইয়া নিতুর এক বছরের ছেলে রেশানের সাথে ভাব করে নিল খুব অল্প সময়ে। রেশানও নতুন বন্ধুদের সাথে খেলায় মত্ত হয়ে গেল।
পরদিন কেনসাসের আকাশ ছিল মেঘলা। গত রাতে মুশুলধারে প্রচন্ড বৃষ্টি সহ অনেক বজ্রপাত হয়েছিল। নিতুকে জিজ্ঞাস করলাম কি কি দেখা যায় তোমাদের এখানে। ও হেসে বলে চাচা এখানে খুব বেশি দেখার কিছু নাই। ছোট শহর কেনসাস। আমরা বের হলাম শহর দেখতে। অলিথ শহর থেকে আধা ঘন্টা ড্রাইভ করার পর প্রায় কেনসাস শহরের কাছে পৌছে গেছি এমন মুশুলধারে বৃষ্টি , এমন বৃষ্টি যে রাস্তা কিছুই দেখা যায় না। আমরা আর শহর কি দেখব। গাড়ী ঘুরিয়ে বাসায় ফিরে আসি সেদিন। সন্ধ্যার দিকে আবাওয়া ভাল হল। নিতুর সাথে গেলাম মলে। ঘন্টা দুই ঘুরাঘুরি কেনা কাটা করে বাসায় ফিরলাম রাত নয়টার দিকে। রাতে ভাবীর হাতে মজার মজার রান্না খেয়ে আবার চলল আমাদের আড্ডা গভীর রাত পর্যন্ত , আমাদের গল্প থামতেই চায় না । ভাই ভাই দেখা এত বছর পর কত কথা কত গল্প । ছোটবেলার কথা মায়ের কথা ,পাড়ার কথা ,ভাই বোনদের কথা ,আত্মীয় স্ব্জনদের কথা। গভীর রাত পর্যন্ত চলল আমাদের স্মৃতি রোমান্থন ।
পরদিন সকালে গেলাম কেনসাস সিটিতে ইউনিয়ান রেল ইস্টিশন। দেখতে। প্রায় দেড়শ বছরের পুরানো চমৎকার চোট্ট এই রেলওয়ে ইস্টিশন। সেখানের এক কফি শপে স্নেকস আর কফি খেয়ে আমরা গিয়ে ঢুকলাম প্লেনেটেরিয়ামে। লোকজন প্রায় ছিল না সম্ভবতঃ উইক ডে বলে। সব মিলিয়ে পচিশ তিরিশ জন লোক হলে রুমে। আকশের তারা নক্ষত্র কাদের কই অবস্থান তাদের বিভিন্ন গঠন নামকরন দেখে বেশ উপভোগ্য এক ঘন্টা সময় কাটল প্লানেটেরিয়ামে। আজকে এখানের আবাহওয়া ছিল চমৎকার, সাতাশ ডিগ্রীর মতন। যেখানে টরন্টোতে ছিল সেদিন ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস । তারপর শহর ঘুরতে বের হলাম। প্রথম এবং দ্বীতিয় মহাযুদ্বের সৈনিকের আত্মত্যগের দৃষ্টিনন্দন শ্রদ্ধাস্তম্ভ। ভীষণ সুন্দর আর বেশ উচুতে করা এই মনুমেন্ট। দেড়শ বছরের পুরানো দৃষ্টিনন্দন বেশকিছু অফিস বিল্ডিং এখনো খুব ভাল ভাবেই দাড়িয়ে আছে পুরোপুরি কর্মব্যস্ততা নিয়ে । শহর দেখে আমরা বাসায় ফিরলাম দুপুর তিনটার দিকে।
বাসায় ফিরে দেখি ভাবী খাওয়ার পশরা সাজিয়ে বসে আছেন আমাদের অপেক্ষায়। বিকেলে অফিস শেষে দুই ডজন ডোনাটস নিয়ে ঘরে ঢুকল জামাই – সুমন । ছেলে মেয়েরা খুব মজা করে ক্রিস্পি ক্রিম আমেরিকান ডোনাট খেল। আমরাও চা নাস্তা করে বেশ চাংগা চাংগা ভাবে এসে গেলাম। রাতে ডিনার করাতে নিয়ে গেল নিতু । নিয়ে গেল মিডিলইস্টার্ন এক রেস্টোরেন্টে। বেশ মজা করে ভিন্ন স্বাদের কাবাব দোনার আর সালাদ খেলাম। নিতুদের অলিথ শহরটা বেশ ছোট। মাত্র বিশ হাজার লোকের বাস। শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত শহর । গারমিন (জিপিএস ডিভাইস) কম্পানীর হেড কোয়াটার হওয়াতে এই শহরে কিছু মিশ্র বর্ণের ভারতীয় আর মিডিল ইস্টার্ন লোকজন দেখা যায় যারা কর্মসূত্রে এই শহরে বাস করছে।
পরদিন গেলাম মিজুরি নদী দেখতে। ছোট্ট একটা নদী। যেটা কয়েকশ বছর আগে শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম রুট ছিল। কেনসাসের আদি অধিবাসীদেরকে (রেড ইন্ডিয়ান) কিরকম নির্মমভাবে উৎখাত করেছিল শ্বেতাঙ্গরা সেই কাহিনী উৎকীর্ণ করা আছে নদীর পারে একটি মেটাল ফলকে। আর পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নিস্তেজ নিস্তরঙ্গ নদীটি অনেকটাই মৃতপ্রায় আমেরিকান আদিবাসীদের মতন ।

বন্ধু নজরুল বার বার ফোন করে ‘কবে আসবেন আমার এখানে। ভাবীকে বললাম শুক্রবার আমরা নজরুলের ওখানে আরকানস এ যাব । ভাবী ভীষণ রাগ আমার উপর। বলে না যাওয়া লাগবেনা তোমার বন্ধুর বাড়ী এবার। পরের বার যাবে। মাত্র কয়দিনের জন্য কেউ আসে বেড়াতে এত দূর থেকে? আমিতো ভাল করে খাওয়াতেই পারলাম না তোমাদের। অনেক কষ্ট করে ভাবীকে বুঝিয়ে শান্ত করে আমরা শনিবার সকালে রওনা হলাম আরকানস এ । গতরাতে সুমন বলেছিল যাবার পথে ব্রেনসন পরবে। ছোট্ট টুরিস্ট শহর এটি। নেমে দেখে যাবেন। ওখানে টাইটানিক মিউজিয়াম আছে। আমরা আড়াই ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ব্রেনসন এ। পিজ্জাহাটে দুপুরের লাঞ্চ করে দেখতে গেলাম টাইটানিক মিউজিয়াম। জাহাজের আদলে একটা বিল্ডিংয়ে একটা মিউজিয়াম । নাবিকের পোষাক পরা এক লোক টাইটানিক জাহাজের ইতিহাসের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে টুরিস্টদের । ইতিহাস বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ ১৯১২ সালের ১৫ই এপ্রিল নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের ৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণে যাত্রার চার দিন পর প্রায় ২৫০০ যাত্রী নিয়ে এক আইস বার্গের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। ডুবার সময় জাহাজের যে মিউজিসিয়ানরা একটা রুমে তাদের মিউজিক বাজিয়ে যাচ্ছিল তাদের নাম ও ছবিগুলো টাঙ্গানো রয়েছে। অরিজিলাল লাইফ জেকেট, যাত্রীদের টিকেট, কুকুরের জন্য কেনা টিকেট, ইঞ্জিনরুমের বয়লারে কয়লা চালিত বয়লারের অংশ বিশেষ, জাহাজের অরিজিনাল ছোট্ট কেবিন যেখানে সর্বপ্রথম লাইটের ব্যবস্থা ছিল এ সবই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আরো টাঙ্গানো রয়েছে প্রধান নাবিক সহ সব নাবিকদের ছবি। মিউজিয়ামে আরো আছে অলম্পিয়া জাহাজের ইতিহাস। এই জাহাজটিও টাইটানিকের সাথে তৈরী করা হয়েছিল বেলফাস্ট হারবারে। সময় লেগেছিল ২৬ মাস। এই দুই ইতিহাস বিখ্যাত জাহাজের ছবি ও ইতিহাস দেখে আর শুনে আমরা রওনা দিলাম বন্ধু নজরুলের বাড়ী আরকানস এর দিকে। ব্রেনসন থেকে তার বাড়ী যাবার হাইওয়ে ছিল মাত্র দুই লেনের। এক পার্কের ভিতর দিয়ে যাবার পথ। ছোট্ট ছোট্ট এলাকা। গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম কোথাও কোথাও ৫০০/৬০০ লোকের বাসতি । প্রায় জনবসতীহীন নীরব গ্রাম, কোথাও লোকজন চোখে পড়ছে না । দুএকটা ক্যাফে চোখে পড়ল। আড়াই ঘন্টার এই সংকীর্ণ আকা বাকা নীরব দমবন্ধ করা পথ ছিল সত্যিই এক অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম রাসেলভীল, নজরুলের বাসায়। রাতে ভাবীর হাতের বিভিন্ন আইটেমের অতি সুস্বাদু খাবার দিয়ে ডিনার হল।
আমরা পরদিন শহর দেখতে গেলাম নজরুলের সাথে। সকালে তার এক বন্ধু মাকসুদ এল তার এখানে বেড়াতে লস এঞ্জেলেস থেকে সারা রাত ড্রাইভ করে। ঢাকার মতিঝিল কলোনির ছেলে। বেশ অমায়িক উচ্ছ্বল প্রকৃতির। আমার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল কয়েক ঘন্টায়। সেও আমাদের সাথে গেল বেড়াতে। পার্কে গেলাম খুব গরম ছিল সেদিন। ছোট্ট শহর, তেমন দেখার কিছুই নেই। সন্ধ্যায় গেলাম সূর্যাস্ত দেখতে মিডো পাহাড়ে। বেশ উচু পাহাড়। মাঝে মাঝে মারাত্মক সার্প টান নিয়ে উঠতে হল পাহাড়ের চূড়ায়। দারুন সুন্দর দৃশ্য। উপর থেকে পুরো শহরটা দেখা যাচ্ছে। দুরের দুটো শহরও দেখা যাচ্ছে। বেশকিছু স্পেনিশ পরিবার দেখলাম তারাও এসেছে সুযার্স্ত দেখতে। সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে এল তখন আকাশ কালো হয়ে এল। সূর্য আর দেখা যায় না। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি নামবে খুব শিঘ্রই। আমরা সুরযার্স্ত না দেখেই ফিরে এলাম। নজরুলের বাসায় দুই দিন বেড়িয়ে আমরা রওনা হলাম সকালে টরন্টোর দিকে ,এবার অন্য পথে । দেড় ঘন্টা ড্রাইভ করে এলাম লিটিল রক। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের দেশ। ক্লিনটন লাইব্রেরী দেখলাম । তার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময় আমেরিকার উন্নতির জন্য কি কি কাজ করেছে তার সমস্ত রেকর্ড রাখা আছে লাইব্রিরীতে। দোতালা এই লাইব্রেরী বেশ বড় । দেওয়ালে রাখা আছে পৃথিবীর কোন কোন নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে তার কর্ম বিনিময় হয়েছিল তাদের ছবি। কি কি উপহার পেয়েছিল বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানদের কাছ থেকে সেগুলো সাজানো রয়েছে।

এলভিস প্রিসলির বাড়ি

দেড় ঘন্টা পর আমরা আবার রওনা দিলাম এলভিস প্রিসলির গ্রেইস ল্যান্ডের কেন্টাকির দিকে । কেন্টাকির মেমফিছে আমরা গিয়ে পৌছালাম বিকেল সাড়ে চারটায়। রক এ্যান্ড রোল কিং এলভিস প্রিসলীর বাড়ী দেখতে। আমার গায়ে প্রচন্ড শিহরণ- পৃথিবী বিখ্যাত এলভিস প্রিসলী! গায়ক নায়ক রক এ্যান্ড রোল কিং! তার মত বিখ্যাত ধনী আমেরিকান শিল্পীর খুব সাধারণ ছোট বাড়ী দেখে আমি বিস্মিত হলাম। যদিও তার বাড়ীর এলাকা ছিল বেশ বড় এবং ঘোড়া পালনের জন্য রেঞ্জ রয়েছে। দোতালা বাড়ীটীর প্রথম ফ্লোরে ছোট্ট কিচেনে তার ব্যবহৃত প্লেট ডিস ফ্রাইপেন সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে। আর লিভিং রুম এবং বেইসমেন্ট তার বিভিন্ন গানের রের্কড গিটার সাজানো রয়েছে। তার বিভিন্ন হিট গোল্ডেন প্লাটিনাম রের্কডগুলো এবং সার্টিফিকেটগুলো যতœ করে দেয়ালে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যতœ করে রাখা আছে তার বিখ্যাত ড্রেস যেগুলো পরে স্টেজে গান করত আর আমেরিকান মিলিটারীর পোষাক যখন জার্মানীতে তার পোস্টিং ছিল। রক এ্যান্ড রোল কিং এলভিস প্রিসলি সুরের ভুবনে অনবদ্য ইতিহাস সৃষ্টি করে তরুন বয়সে চলে গেলেন না ফেরার দেশে ।

এলভিস প্রিসলির গ্রেইস ল্যান্ড দেখে আবার রওনা দিলাম পৃথিবী বিখ্যাত বক্সার মোহাম্মদ আলীর লুইভিল শহরে। কেনটাকিতে পৌঁছাতে রাত বারটা বেজে গেল। রাতের পথটা এতদুর আসা ছিল ক্লান্তিকর এবং বেশ ঝুকিপুর্ণ। কারণ হাইওয়ের অনেকটা রাস্তা প্রায় তিরিশ চল্লিশ মিনিট পথ ছিল এক লেন আর কনস্ট্রাকসনের কাজ চলছিল। রাস্তার বসানো বিম গুলো দেখে দেখে পথ চলতে হয়েছিল । গতকাল পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়াতে বেশ টায়ারড ছিলাম । হাইওয়েতে ১৩০ কিলো মিটার গতিতে গাড়ী চালালে এমনিতে চোখে ভীষণ প্রেসার পরে । তখন চোখে ঘুম এসে যায় , তার উপর নতুন দেশ। একটা টেনসন তো আছেই, এর উপর অন্ধকার রাত ।
সকাল আটায় উঠে হোটেলে নাস্তা করে বেড়িয়ে গেলাম মোহাম্মদ আলী মিউজিয়াম দেখতে। হোটেল থেকে পনের মিনিট হাটা পথ কিন্তু বেশ গরম ছিল। আমরা কয়েক জন ছাড়া হাতে গুনা কিছু টুরিস্ট দেখতে এসেছিল। তার সময়ে সাদা কালো টিভিতে যেভাবে তার মুষ্টিযুদ্ধ গুলো দেখানো হত সেই সাদা কালো দুটো টিভি রাখা আছে। তার জার্সী বক্সিং রিং বিভিন্ন পুরুস্কার মেডেল সাজানো রয়েছে। একটা রুমে তার সব মুষ্টিযুদ্ধ সহ তার জীবনীর ছবি দেখাচ্ছে। আরো আছে তার মুসলমান হবার ইতিহাস এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে না যাবার কথা ঘোষণা করার পর তার টাইটেল কিভাবে কেড়ে নিয়ে কারগারে পাঠানো হল তার চলচ্চিত্র। দুপুরের দিকে আমরা রওনা হলাম টরন্টোর উদ্দেশ্যে। প্রায় দশ ঘন্টা ড্রাইভিং পথ ।
চার ঘন্টা ড্রাইভ করার পর লাঞ্চ করার জন্যে থামলাম কেনটাকি ফ্রাইড চিকেন রেস্টুরেন্টে। খাওয়া দাওয়া সেরে আবার নেমে পরলাম হাইওয়েতে। গত কয়েক দিনের টানা ড্রাইভ করাতে আমি বেশ ক্লান্ত তাই খুব ঘুম লাগছিল এবং সেটা খুব ভয়ের। দেড় দুই ঘন্টা পর পর বিভিন্ন রেস্টোরেন্টে নেমে কফি খেয়ে চোখ মুখ ধুওয়ে আবার হিট দা রোড। কারণ আমার ঘুমে অবস্থা কাহিল।

ডেট্রয়টে এসে কয়েকদিন পর টিম হর্টন (কানাডিয়ান কফি চেইন) দেখে আমাদের উল্লাস দেখে কে। মন ভরে কফি খেলাম ডনাট খেলাম। বেশ সুন্দর আর বড় কফি সপ কিন্তু লোক জন তেমন নেই। সন্ধ্যায় আমরা এম্বেসেডর ব্রিজ দিয়ে বর্ডার ক্রস করে কানাডার উইন্ডসরে ঢুকে গেলাম। নিজ দেশে (কানাডা) এসে আবারো কফি স্নেক্সস খেয়ে ফ্রশ হয়ে ছোট্ট একটা ব্রেক নিয়ে রওনা হলাম ফাইনাল ডেস্টিনেশন টরন্টোর পথে।
রাত দশটায় পৌছে গেলাম আমাদের শহরে। বাড়ি ফিরে এসে দেখি গিন্নী ডিনারের পশরা সাজিয়ে বসে আছে আমাদের জন্যে। ক্লান্তিবিহীন আনন্দময় দীর্ঘ প্রায় পাচ হাজার কিলোমিটার ড্রাইভের পথচলা শেষ হোল আজ রাত দশটায়। Home sweet home.

৪ঠা আগস্ট,২০১৭
টরন্টো, কানাডা
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
কবি, লেখক ও গল্পকার