মানুষের সৌন্দর্য জ্ঞান
রোজানা নাসরীন
সৌন্দর্য বোধটা আপেক্ষিক। সৌন্দর্যের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়া যায় না। মানুষের মধ্যে জাতি, তাদের পরিবেশ, ভৌগোলিকবোধ অনুযায়ী আলাদা আলদা সৌন্দর্যের সংজ্ঞা দিয়ে থাকে। তবে মানুষের পরিচ্ছন্ন থাকা ও পরিপাটি থাকাকে সকল সভ্য মানুষ পছন্দ করে। কিন্তু সৌন্দর্যের নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা মানুষের জানা নেই। অবশ্য মানব সমাজে প্রথিত কিছু মূল্যবোধ রয়েছে।
মানুষ জন্ম থেকে তার বয়স অনুসারে নানা ভাবে সমাজ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। কারণ মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম সমাজে বেড়ে ওঠে ও বেঁচে থাকে, এবং তার নিয়ম পরিবর্তনে সমাজ অনেক ধীর গতি সম্পন্ন হয়। কিন্তু সৌন্দর্য জ্ঞান মানুষকে সমাজ শিখিয়েছে যেমন সত্য, তেমনি মানুষের অন্যান্য ক্রিয়াও সমাজই শিক্ষা দিয়ে থাকে। একটা শিশু প্রথম জন্ম নেয় তার মা-বাবার ঘরে,পরবর্তীতে তার বয়স অনুসারে মা-বাবাই তাকে সামাজিক হয়ে উঠতে সাহায্য করে বলে সে একজন সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠে। তাই মানুষের সৌন্দর্য জ্ঞানও ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার কাছ থেকে পায়। সে কারণে সে ছোটবেলাই শিখে যায় কাকে কুৎসিত বলতে হবে ও কাকে ভালো বলতে হবে। অনেক শিশুকে একসাথে জড়ো করে তাদেরকে বিভিন্ন পুতুল দেখিয়ে একজন ইন্টার্ভিউ নিয়েছিল, তার রেজাল্ট পাওয়া গেছে এরকম; কালো শিশুরাও বলেছে যে সাদা পুতুলটা ভালো কারণ সেটা দেখতে সুন্দর। এ ছাড়া আর কোন যুক্তি নেই তার কাছে। কালো পুতুলটাকে তারা বলেছে ভালো না, বিশেষ করে কালো শিশুরাও। কারণ সে দেখতে ভালো না। এ থেকে প্রতিয়মান হয় এখনো সমাজে চলছে সৌন্দর্য সম্পর্কে আদিম ধারণা। একজন মানুষের বাহ্যিক চেহারা যাতে কারো কোন হাত নেই, কেউ ভাল এবং খারাপ হয়ে যায় না যতক্ষণ পর্যন্ত সে ভালো বা খারাপ কাজ না করে, এই বিষয়টা কেউ তার অবচেতন মনে তা বিশ্বাস করে না। একজন কালো মানুষকে সে কখনো পছন্দ করে না বলে তাকে সে কুৎসিত বলে। কারণ তার বাবা-মা এভাবেই শিখেছিল, সে যত ছোটই হোক এবং বড়ই হোক। সে ধারণা করে সামজিক নিয়মে, তাই সমাজ তাকে শিখিয়েছে মানুষের সৌন্দর্য জ্ঞান। সে সমাজ কর্তৃক ছোটবেলা থেকে ধারনা করে নিয়েছে কখন মানুষকে ভালো বলতে হবে এবং কখন মানুষকে খারাপ হবে। কিন্তু মানুষ একবারও ভাবে না সব ভালো ও মন্দের মধ্যে একমাত্র সৌন্দর্যটাই হল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু ছোট মানুষটির কাছে যে দেখতে সুন্দর হয় সে হয় ভালো মানুষ। এটা তার সমাজ কর্তৃক শিক্ষা, তার বাবা-মা যেমন শিখেছিল একদিন। মানুষ শুধু বোঝে যে মানুষটি দেখতে কালো সে হয়ে যায় তার কাছে খারাপ মানুষ। কিন্তু যে কালো হয়ে জন্ম নেয়া বা সাদা হয়ে জন্ম নেয়া তার উপরে মানুষের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না, এটাও সবাই জানে কিন্তু কেউ কেউ বিশ্বাস করে না। কালো মানুষ সমাজের কাছে নিগৃহীত হতে যেন জন্মেছে। সমাজ তাকে যত অত্যাচার করে তা অত্যন্ত অমানবিক, কিন্তু সমাজ ভাবে এটা বুঝি তাদের প্রাপ্য, আর সেইমত তার চরিত্রও গঠন হয়ে থাকে। সেও ভেবে নেয় এটা তার নিয়তি। এভাবে তাদের চরিত্রেও স্খলন দেখা দেয়। প্রকৃত কথা, মানুষ ছোটবেলায় যা শিক্ষা নেয় তা কোনদিনও সে ভুলতে পারে না। এভাবেই সমাজে সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মাঝে বিভেদ, এবং এই বিভেদ ঘুচাতে মানুষের গায়ের রং ফর্সা করার কত রকম কাণ্ড শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে এই কাণ্ড গিয়ে ব্যাবসায় পরিণত হয়ে গেছে। আজ ফেয়ার অ্যান্ড লাভলিকে চেনে না এমন কোন মানুষ বাংলাদেশে অবশিষ্ট নেই। এই কানাডাতেও। কোনদিন ব্যাবসায়ীরা এই রং ফর্সা করার ক্রিম এর সাইড এফেক্ট নিয়ে ভাবে না ও তা প্রচার করে না। তারা ভাবে তাদের ব্যাবসা নিয়ে, এবং কেউ যদি এর সাইড এফেক্ট সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস করে তখন কিছু না জেনেই তারা বলে দেয় এই পণ্যের কোন সাইড এফেক্ট নেই। এবং সৌন্দর্য বোধটা নারীর উপর বেশি বর্তায় সকল সমাজেই। নারীকে সুন্দর হওয়ার প্রতি একরকম অনেক মোহ সমাজে কাজ করে। এই সাইড এফেক্টের বিষয় নারীও ভাবে না এবং সমাজও ভাবে না। নারীর জীবন যেহেতু নিয়ন্ত্রিত হয় একেবারেই সমাজে বসবাসরত মানুষ কর্তৃক, তাই সে সম্পর্কে নারী কিছু না-ভেবেই অন্ধের মত তা মেনে নেয় ও এই ধারনা নিয়েই সারাটি জীবন চলে ও মরে যায়। আগে সমাজে প্রচলিত ছিল আর্চি নামক এক ধরণের ক্রিম। এসবই কিন্তু একমাত্র নারীকে ফর্শা করার অভিসন্ধি। ডাক্তারগণ যখন বলছিলেন এই ক্রিমের সাইড এফেক্ট রয়েছে, তখন বন্ধ হয়ে যায় এই ক্রিম ব্যবহারের হিড়িক। এখন নারী সেই ফর্শা করা পণ্য হাতের কাছে পায়না বলে ব্যবহার করে না। সময় গড়িয়েছে অনেক। পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এখন কেবল নারীকে কেন্দ্র করে নয় পুরুষকেও ব্যবসায়িদের মতে চলতে অনেকটা বাধ্য করছে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ।
সমাজ অঙ্গুলি নির্দেশ করে নারীর প্রতি, তাকে সুন্দর হতেই হবে, নয় কোন ছেলে তাকে বিয়ে করবে না। কিন্তু ছেলে দেখতে যতই কালো বা কুৎসিত হোক সমাজের তাতে কিছু যায় আসে না, মেয়েদেরকে ফর্শা হতেই হবে। যার গায়ের রং ফর্শা হবে তার সমৃদ্ধ জীবন আগে শুরু হয়, কিন্তু যে মেয়েটি কালো হয়ে জন্মায় তাকে পার করতে মা-বাবা অনেক চিন্তিত থাকে। তারপর তাকে নিয়ে চলে সমাজের নানা রকম কাহিনী। সমাজই নির্ধারণ করেছে যে মেয়েরা তার বিয়ের উপরে নির্ভরশীল হবে, তাই সে বিয়ের উপর নির্ভর করে থাকে। বিয়ে না হলে তার সন্তান উৎপাদন করার কোন অনুমতি সমাজ দেয় না। সেহেতু তাকে রং ফর্শা করার ক্রিম লাগাতে হবে। সন্তান মানে তার পরবর্তী জীবনের ভরসা। এবং এশিয়ান দেশগুলিতে এই নিয়ম খুব প্রচলিত। পোশাক উৎপাদনকারী ইন্ডাস্ট্রিগুলিও একই সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। যে দেশে যে পোশাক স্বীকৃত সেই ধরণের পোশাকগুলি উৎপাদন করে থাকে কোম্পানিগুলী। নানা ধরণের ডিজাইন দিয়ে পোশাককে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা তাদের একটা দায় হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ স্বীকার করলেও সময় বদলায় আর স্বীকার না করলেও সময় একইতালে বদলায়। তেমনি সময়ের সাথে সাথে আজ বদলেছে মানুষের মানসিক অবস্থা। এখন নারীদের সাথে সাথে পুরুষের জন্যও তৈরি হচ্ছে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ফর ম্যান নামে একটা প্রডাক্ট। এই ব্যাবসা আজকে অনেকখানি সফল হয়েছে। যদি এমন হয় তবে কি সময় সময় তার দ্বৈত চরিত্র বহন করছে? একদিকে নারীর স্বাধীন সত্তা পুরুষ স্বীকার করে না, আন্যদিকে সেই নারীকে ভুলাতে এতসব করছে, নাকি সকল শ্রেণীর মানুষকে ভুলাতে এসব করছে, নাকি নারী-পুরুষের সমতা বিধানের একটি ব্যর্থ চেষ্টা চলছে সমাজের অবচেতনে? যার মূর্ত প্রকাশ হয়েছে এই ধরণের প্রডাক্ট। এটা বোঝা মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে কারণ সমাজে নারীর উপর সহিংসতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজ নেপথ্যে হয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, একদিন সবকিছুই প্রকাশ পেয়ে যাবে। তাই হয়ত মানুষের মনে সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন হয়ে যেতে বসেছে। তাই আজ কেবল সৌন্দর্যবোধ নারীর মধ্যে সীমিত নয়, এটা পুরুষকেও অনেকটা আলোড়িত করতে পেরেছে। নারী আজকাল বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষের সিক্সপ্যাক ফিগার পছন্দ করে বলে পুরুষের মধ্যে ব্যয়াম করে ঐ রকম ফিগার বানাতে অনেক সারা পড়ে গেছে। আবার অনেক ছেলেরা এসবের ধার ধারে না, তারা কেউ কেউ নারীকে এসবের জন্য ঘৃণা করে, আবার কেউ কেউ অলসতার জন্য সুন্দরের প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকে, কেউ কেউ তার কোনটিকে হৃদয়ে স্থান দেয় না। এসব ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে এখনো নারীকেই সুন্দর রূপ ধারণ করার যুক্তিই প্রবল আকারে সমাজে বিরাজ করছে। নারী ছাড়া পুরুষ চলতে পারে না এবং পুরুষ ছাড়া নারী চলতে পারে না, তাই নারী পুরুষের বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা যাই থাক প্রথমে সে কতটুকু সুন্দরী তাই বিচার করতে হবে দ্বিতীয় নম্বরে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা। অথচ তার শিক্ষাগত যোগ্যতাই প্রথম হওয়া উচিত কিন্তু সমাজ তা নির্দেশ করে না। শেষ পর্যন্ত নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া শর্ত অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু পরিণামে একদিন তার নিকট থেকে সবকিছুই লুট হয়ে যায়, কেবল তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কেউ লুট করতে পারে না বলেই তা তার কাছে থেকে যায়। কিন্তু আজও তা একেবারেই সমাজ দ্বারা স্বীকৃত নয়। সমাজে অনেক বিপ্লবী নারীরা বিরাজ করছে, যারা বলে থাকে তাদের স্বাধীনতার কথা, কিন্তু পরিণামে তার সমস্ত সত্তাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সে হয়ে যায় একজন দাসী। সে তখন বলে এটা তার নিয়তি। আসলে নিয়তিকে তৈরি করতে হয় উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। সৌন্দর্যবোধের সাথে মানুষে নিয়তিও ঘুরপাক খেতে থাকে।
সৌন্দর্যবোধ মানুষের মনে অবস্থান করে। মানুষের মন যেদিকে সে ধাবিত করে সেদিকেই পরিচালিত হয়। তাই মনের শক্তিকে অনেকগুণ প্রাধান্য দিয়ে মানুষের সমাজকে পাল্টাতে হয়। সময় যেমন বসে থাকে না মানুষের গতিও তেমনি বসে থাকে না, যে যত তার পুরানো ধারণা নিয়ে বসে থাকে সে ক্ষেত্রে সময়ের কিছু আসে যায় না, সে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যাবেই। এভাবেই অতি ধীর গতিতে সমাজ পরিবর্তিত হয়। যেহেতু মানুষ আগেকার ধ্যান ধারণা নিয়েই পথ চলতে থাকে, কারণ তখন সেই ধ্যান ধারণাই ছিল তাদের শিক্ষা ও সঠিক, কিন্তু আজ সময়টা পালটেছে। তাই বর্তমানের জয়গান গেয়ে যাওয়া মানুষের জন্য ভালো ও সুখের।
রোজানা নাসরীন
টরন্টো