মানুষের ন্যায় অন্যায়বোধ


রোজানা নাসরীন

মানুষের ন্যায় অন্যায়বোধের বসবাস তার চেতনার মধ্যেই। মানুষ এই চেতনা বহন করছে বলে এটা একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত তার ভেতরেই থাকে, এবং এটা সবার মধ্যেই চিরদিন ধরে থেকে যায়। মানব শিশু বেড়ে ওঠার সাথে সাথে এই বোধ অনেকখানি পরিপক্ক রূপ লাভ করে। জীবন বিকাশের সাথে সাথে ন্যায় অন্যায়বোধ চিরদিন থেকে জেগে থাকে বলে সে সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠে। এই ন্যায় অন্যায়বোধ মানব জন্মের সঙ্গে এমনভাবে জড়িত থাকে, যা তার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে মানুষকে জীবনভর পরিচালিত করে।
সমাজ মানসের প্রতিকৃতি গড়ে ওঠে একটি ভূখণ্ডের মানুষের মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ চাওয়া পাওয়ার উপর। সেখানেই থাকে জাতির দৃষ্টিভঙ্গী, আর থাকে ন্যায় অন্যায়বোধের যথার্থ অনুভব। মানুষ কোন কিছুর উপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকতে চায়। তার নির্ভরতার জায়গাটা হয় মানব সমাজ। তাই সাধারণ সামাজিক মানুষ ভাবে সমাজ যাকে ভালো বলে তাই ন্যায় এবং সমাজ যাকে খারাপ বলে তাই অন্যায়। তারা এই ভাবনা নিয়ে সমাজের অনুকূল স্রোতে ভাসতে থাকে। তবে মানুষের ভালো-মন্দ নির্ভর করে ঐ সমাজের মানুষের প্রবণতার উপর। সমাজ বললেই কোন থিওরি ভালো বা খারাপ হয়ে যায় না। একটি সমাজ ও সংস্কৃতি অনেক বছরের চলমান প্রক্রিয়া মাত্র, কিন্তু ন্যায় অন্যায়বোধের চরমসীমা নয়। কিন্তু সমাজের অতি সাধারণ মানুষ যেমন তা বোঝে না, তেমনি সমাজের নেতৃত্বে থাকা কিছু কিছু ব্যক্তিরাও তাদের অন্ধত্ব ও স্বার্থের জন্য সে বিষয়টা অনুধাবন করতে চায় না, ও অনেকটা জোর করে সমাজে আগের নিয়মই চালিয়ে রাখতে চায়। তাই সেখানে ন্যায়বোধ নিয়ে অনেক বিতর্কিত রূপ জেগে থাকে, ও তারা সমাজের কোনকিছু না-দেখে শুধু জানে কেউ কেউ মানুষকে চালাতে এবং কোন কোন মানুষ জানে তাদের কথা অনুসারে চলতে। এই সুযোগে সমাজে অনেক পঙ্কিলতা এসে বাসা বাঁধে, ও এমণভাবে তা গেড়ে বসে যাকে আর এতটুকু সরানো সম্ভব হয়না। সে জগদ্দল পাথরের মত আচলায়তন হয়ে চেপে থাকে। যা পরবর্তীতে কানুন হয়ে, প্রথা হয়ে চেপে ধরে নৈতিকতার কণ্ঠ। আর তখন সত্যিকারের ন্যায়বোধের ধারণা শুধু পেছনে পড়ে হাঁপায়। সেক্ষেত্রে বলা যায় সমাজ কেবল সুনিয়ন্ত্রিত নিয়ম, কোন অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়। সমাজের দায়িত্ব থাকে যেখানে ন্যায়বোধ একেবারেই কাজ করে না সেখানে সমাজের নিয়মকে প্রতিষ্ঠা করা শুধু। এখানে ন্যায় অন্যায় বোধের কোন সম্পর্ক থাকে না, তাই সমাজের নিয়মই সেরা একথা কখনই বলা যায় না। কিছু কিছু ন্যায়-সমৃদ্ধ কথা যা সমাজের সব মানুষ ভাবে না, ভাবে সমাজের অল্পসংখ্যক মানুষ। তাই কোন মানুষ যখন নৈতিকতার সাথে মত প্রকাশ করে তখন তার মতকে সমাজের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কখনও একটা মানুষের কথা সমাজকে গতি দান করতে পারে। কোন মানুষের মত অপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে বুঝি সেই সমাজে বিদ্যমান অনুশাসন অনুসারে নিয়ম মেনে যে কোন উক্তি করা। সে ক্ষেত্রে সমাজে ন্যায় অন্যায়বোধের দৃশ্যান্তর কদাচিৎ দেখা যেতে পারে। মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অবস্থান করছেন যারা সমাজে নিয়ম কানুন থাকা সত্ত্বেও তার নৈতিক মানদণ্ডের উপর ভর করে নিজের মত প্রকাশ করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে সমাজের যদি একজন মানুষও তার মত প্রকাশ করেন এবং সমাজের সকল মানুষ যদি তার বিপক্ষে দাঁড়ায়ও সে মত মানুষের ভালোর জন্য স্বীকৃতি হতে পারে। যদিও সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু মানুষকে অনেকটা প্রভাবিত করে থাকে। সংখ্যাগুরুর মতবাদই মানুষের মনোজগতের সকল শক্তি বহন করে। তবু সমাজ অধিপতির বুঝতে হবে কোন বিষয়গুলো সব মানুষের জন্য উপকার বয়ে আনতে পারে। কেবল মাত্র ভোটের জন্য রাজনীতি করলে একসময় সমাজ অন্ধকারে পতিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র নায়কদের অনেক সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।
আজকাল মানুষের সকল কার্যক্রম দলীয় শৃঙ্খলে বাঁধা। তৃতীয় বিশ্বে যেমন দলটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা প্রথম বিশ্বে দেখা না গেলেও একই মহামারীর কবলে সবাই নাহলেও দলীয় মানুষেরা পতিত। দলীয়ভাবে মানুষগুলো যেমন সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই হয়ে যায় মানুষের একমাত্র লক্ষ্য। যেখানে নৈতিকতা কখনো থাকে কখনো তা অনৈতিকতার কবলে পড়ে হাঁপিয়ে মরে। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মধ্যে এই মনোবৃত্তি অনেক বেশি। যেমনি হোক না কেন দলটির সিদ্ধান্তই মানুষের সিদ্ধান্ত বলে চাপিয়ে দেয়া দলীয় মানুষের লক্ষ্য থাকে। কেউ দলের বাইরে গিয়ে কিছু বলতে পারে না সে। তাই সকলেই কোন কোন দলে বিশ্বাসী। বাঙালিরা যেমন আওয়ামী লিগ, বিএনপি, বামপন্থী দল, ধর্মীয় দলের অনুরাগী হয়ে বেঁচে থাকে তাদের মনোবৃত্তি ও পরিবেশের ভিত্তিতে। দলের বাইরে কেউই তার জীবদ্দশায় যেতে পারে না, ভাবতে পারে না। কেউ যদি এর বাইরে কিছু ভাবে তাহলে তাকে ধরে এনে দলীয় মনোবৃত্তির কাছে কেউ না কেউ সোপার্দ করবেই। এটাই তার জীবন বিধান হয়ে যায়। এখান থেকে সে মুক্তি চাইলেও সে মুক্তি পায়না, তাকে বেঁধে ফেলা হয় এই জীবনধর্মে। মানুষের মর্যাদা যে স্বতন্ত্র হতে পারে, কেউ তার ধার ধারে না, চিন্তাও করে না। কেউ যদি দলের বাইরে থেকে যায় সে হয় চরম উপেক্ষিত। এখানেই মানুষের আদর্শগত দিকটি মরে যেতে থাকে। মানুষের মনে যে নৈতিক সিদ্ধান্ত লুকানো থাকে, এবং তা যদি দলের সিদ্ধন্তের অনুযায়ী না হয়, তাকে সে প্রকাশ করতে পারে না। দলগত সিদ্ধান্তই সেখানে হয়ে ওঠে চরম সিদ্ধান্ত। তাই মানুষ স্বতন্ত্রভাবে কিছু ভাবতে পারে না। আমাদের নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার জন্য, সকল মানুষের জীবনের জন্য, যে সিদ্ধান্ত ভাল হলে মনে হয় সে সিদ্ধান্ত মানুষের গ্রহণ করা উচিত। এখানে কোন বিশেষ সম্প্রদায় এবং দলের যে কার্যক্রম এবং মতবাদ মানুষের সাধারণ জীবন চলাকে বাঁধাগ্রস্থ করে, সে বিধান ব্যর্থ বলে মানুষেরই চিহ্নিত করা উচিত। নইলে সে সমাজ অন্ধকারে ডুবে মরে। মানুষ শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণের জন্য নিশিদিন কাজ করে যায়। সম্প্রদায়, দল, নির্বিশেষে যদি মানুষের ন্যায়বোধ তার কার্যকরী ভূমিকা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে, সেই মত হয়ে ওঠে মানুষের কাছে পূজনীয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাই এখনো একদল মানুষ অনেক পুরাতন মতবাদকে ধরে এই আধুনিক যুগে এসেও সেই মত জীবন চালাচ্ছে। তাতে মানুষের মধ্যে প্রকট হয়ে দেখা দেয় বিভেদ, অবশিষ্ট থেকে যায় মানুষের যত্নে লালন করা ন্যায় বোধটুকু। সমাজের সকল মানুষ তাকে সত্য মনে করেনা, কেউ কেউ তার গভীর সমালোচনা করে। আসলে সমাজের মানুষ চায় কেবল একটা হাস্যোজ্জ্ব্ল জীবন মাত্র। কেউ কিন্তু মানুষের বিভাদ নিয়ে ভাবে না, কিন্তু তারপরও বিভেদই একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে। কারণ মানুষ ভাবতে পারে না প্রথার বাইরে কী করে যেতে হয়। মানুষ যে যার দর্শন নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যায়। এক্ষেত্রে মানুষের জীবন দর্শন হওয়া উচিৎ যুগোপযোগী। মানুষের ভাবার সময় এসেছে এখন সত্যিই দল মানুষের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষার্থে পারঙ্গম কিনা, সেখানে মানুষের নৈতিকবোধ কতটুকু কার্যকর।
মানুষ তার মস্তিস্ককে প্রসারিত করার জন্য তাকে সকলের বোধকে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করা উচিত। মানুষকে সেই পথ তাদেরই আবিষ্কার করতে হবে; কীভাবে মানুষের প্রতি সদয় হয়ে উদারতার সাথে সমাজকে পরিপক্ক করে তোলা যায়। মানুষের হৃদয়ে নৈতিক বোধগুলো জন্ম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। কেউ তাকে নিয়ে জীবনের শেষপর্যন্ত পথ চলে, আবার কেউ তাকে সমূলে উৎপাটন করে সেখানে বোনে অনৈতিকতার বীজ। কেউ কেউ ভাবে নীতিবাক্য বইয়ের পাতার জন্য জীবনের জন্য নয়। আবার কেউ কেউ ভাবে সেখানে কিছু থাকে জীবনের জন্য, কিছু থাকে সেখানে পুরাতন নীতিবোধ। আর সমাজের কেউ কেউ বোঝে; যে বোধ পুরাতন সে জীবনের জন্য নয়। আমরা জানি যে বোধ পূর্ণাঙ্গভাবে জীবনধর্মী নয় সে কখনো জীবনের জন্য হতে পারে না। কিছু মানুষের স্বার্থ লুকিয়ে থাকে বলে সেই নীতিবোধগুলো যদি তাদের অপরিচিত বলে মনে হয়, তবে তারাই সমাজকে অনৈতিক কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। যেখানে নীতিবোধের কোন বিকশিত রূপ থাকে না। যেখানে জীবনের জন্য নৈতিকতা লুকিয়ে থাকে তাই শুধু নীতিবাক্য, তা সে যে ফর্মেই হোক। বইয়ের পাতায় ছাপার অক্ষরে লুকিয়ে থাকলেই সে মানুষের নৈতিকতা বহন করে না, যদি সে সকল নৈতিকবোধ সম্পন্ন মানুষের অনুকরণীয় হয়ে উঠতে না পারে। বইয়ের পাতায় যে নীতিবাক্য যোগ করা হয় তা অবশ্যই জীবনের জন্য, কখনো বইয়ের পাতার জন্য নয়। নৈতিকতার পরিবর্তন যুগের সাথে পরিবর্তিত না-হলে মানুষ সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। যুগের প্রয়োজন অনুসারে মানুষের ভেতরে জন্ম হওয়া নৈতিকতার পরিবর্তন হয়ে থাকে। মানুষের প্রয়োজন তার পরিবর্তন করা। যদি সেখানে পরিবর্তন লক্ষ্য করা না-যায় সে মুখ থুবড়ে পড়ে। একই মানুষ পৃথিবীর শেষপর্যন্ত টিকে থাকে না। নতুন মানুষ জন্মের সাথে পরিবর্তিত রূপ নিয়ে আসে। তারপর যে নৈতিকবোধ তার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়, সেই বোধ সে জীবনের সর্বত্র দেখতে চায়, যদিও মানুষের মধ্যেই তৈরি হয় তার বিরোধিতার প্রতিরূপ। সেই অনুসারে সমাজের কেউ নৈতিক কাজ করে কেউ অনৈতিক কাজ করে গত হয়। মানুষের ভিতরে নৈতিকবোধ থাকে, সে জীবনভর অনৈতিক কাজ করে গেলেও। যখন তার প্রতি কোন অন্যায় হয় তখন তার সেই নৈতিকবোধ জেগে ওঠে, এবং তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে
বিধায় সে তার শক্তি অনুযায়ী প্রতিশোধ নিতে ব্যস্ত হয়। কেউ পারে এবং কেউ পারে না। আবার কেউ তার সাথে ঘটে যাওয়া অনৈতিকতার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কখনো নীতি অনুযায়ী কাজ করে কখনো অনৈতিকভাবে। সেই থেকে আমরা জানতে পারি মানুষের সকলের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় নৈতিকবোধ থাকে। কেউ তার নৈতিকবোধকে জনকল্যাণে সকলের জন্য কাজে লাগায় ও কেউ তাকে শুধুমাত্র নিজের জন্যই ক্ষয় করে যায়। মানুষের ন্যায়বোধগুলো অন্যায়বোধকে নির্দেশ করে। যেমন তার ন্যায়বোধের বিপরীতে যে বোধগুলো রয়েছে, যা অন্যায় বলে নিজের কাছেই মনে হচ্ছে তা-ই অন্যায়বোধ। তাকে আলাদা করে চিনতে কারো কষ্ট হয় না। কিন্তু সমাজে মাঝে মাঝে তার স্বার্থের জন্য অন্যায়কে ন্যায় বলে যদি ভাবা হয়ে থাকে তাহলে সেখানেই রয়েছে বিভ্রাটের সুত্রপাত। তারপর সমাজে অন্যায়বোধ বাড়তেই থাকে, যাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
কখনো প্রয়োজন মানুষকে অন্যায় করতে বাধ্য করে কিন্তু সে জানে যে তা অন্যায়। ন্যায় অন্যায়বোধ মানুষের মনের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে। কখনো প্রথায় সে বোধ হারিয়ে যায় বিধায় মানুষ তাকে দেখতে পায় না। কিন্তু মানুষের ভেতরেই তার বসবাস। একটু খুঁজে দেখলেই তাকে পাওয়া যায়। মানুষ ইতোমধ্যে তার সন্ধান পেয়েছে। মানুষ ন্যায় অন্যায়কে চেনে বলেই সে অন্যায়কে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। মানুষ অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ একটা পৃথিবী আশা করে। যদিও সর্বত্র ন্যায়বোধ থাকে না কিন্তু তাকে অতিক্রম করাই মানুষের লক্ষ্য। সে ক্রমাগত অগ্রসরতার মাধ্যমে অন্যাকে বাদ দিয়ে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে করতে সামনে এগুতে চায়। তাই সে চেষ্টা করতে থাকে ন্যায়বোধ দ্বারা সমাজকে পরিশুদ্ধ করার, এবং সভ্যতার অগ্রযাত্রাকালে মানুষের ন্যায় অন্যায় বোধ সঙ্গে থাকবে চিরকাল। যে বোধ দ্বারা সে নিশ্চিত করবে মানুষের জয়।
রোজানা নাসরীন
টরন্টো