প্রবাসে পরহিতকর্ম -৮০

ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
কাল বেশ রাতে লন্ডনের ‘ইস্ট হ্যাম’ এ পৌঁছেছিলাম। খুব লজ্জা লাগছিল এই ভেবে যে এত রাতে বেল টিপবো। সারা বাড়ি জেগে উঠবে। যেহেতু আমাদের কাছে চাবি নাই তাই ইচ্ছা না হলেও এই অনাকাঙ্খিত কাজটি করতে হবে। এই জন্যই আমার ছেলে রায়হান কারো বাড়িতে উঠতে চায় না। এইসব সাত/পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মাজেদা আপার বাড়ির সামনে চলে এলাম। ওমা, এসে দেখি উদ্বিগ্ন আমার মায়াবতী, পরম স্নেহশীল আপা এবং দুলাভাই গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে দন্ত বিকশিত করে বললো, “ আলহামদুলিল্লাহ – খুব চিন্তা হচ্ছিল। যাক ঠিক সময়েই এসেছিস।” আমার পিতৃস্থানীয় দুলাভাই বিড়বিড় করে কি সব দোয়া পড়লো।
দোতালায় উঠে দেখি, ওমা- তারা দুজনই এখনও ডিনার করেনি। আমদের জন্য বসে আছে। আমরা বকাবকি করলাম। তারপর তাড়াহুড়া করে, হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। দেখি আপা সারাদিন ধরে রেধেঁছে, আমার কথিত সব প্রিয় আইটেম। নিহারী, গরুর মাংশ, পোলাও আবার ভুড়িও রান্না করেছে। এটা সাধারণত একদিনে রান্না করলে ভালো হয় না। ২/৩ দিনে করলে বেশী মজা হয়। এত রাতে এত খাবার? যাইহোক প্রচন্ড ক্ষুধাও পেয়েছিল। আয়াত দুলাভাই খুব খাদ্যরসিক। খেতে খেতে খুব মজার মজার গল্প করছিল। রাত ৩টা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে গেলাম। আগামী কাল লন্ডনেই থাকা হবে। অতএব খুব ভোরে উঠার তাড়া নাই।
সাকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মাজেদা আপা চালের আটার রুটি আর সাথে নিহারী পরিবেশন করেছে। সাথে আবার অনেক রকম মিষ্টান্ন। খুব মজা করে নাস্তা করলাম। এর মধ্যে মাজেদা আপার বড় ছেলে এসে তার বাড়িতে আমাদেরকে ডিনারের দাওয়াত দিয়ে গেল। অবশ্য সাজ্জাদ ৪/৫ দিন আগেই দাওয়াত দিয়েছিল। মাজেদা আপার দুই ছেলে দুই মেয়ে। সবাই খুবই ভাল ওয়েল এস্টাবলিসড্ এবং লন্ডন শহরে যার যার নিজের বাড়িতে থাকে। বড় মেয়ে সাজেদাও তার জামাই এবং শাশুড়িকে নিয়ে আমাদেরকে দেখে গেছে এবং দাওয়াত করে গেছে। আবার খুব সুন্দর একটা শাল উপহার দিয়ে গেছে। কিন্তু ওর বাসাটা একটু দূরে। আজ একটু রিলাক্স করতে মান চাইছে। তবু দুপুরে খাবার পর একটু দুজনে বের হলাম। আশেপাশেই একটি ঘুরলাম। তারপর অনেক বড় একটা জার্মান গ্রোসারী শপে গেলাম। কিছু কেনা কাটা করা দরকার। রাতে সাজ্জাদের বাসায় যাবো। যদিও মাজেদা আপা ওদের বাসার জন্য পিঠা বানাচ্ছে দেখে এসেছি। তবুও আমিতো খালা। খালি হাতে যাওয়া যায়? তাছাড়া আগামী কাল আবার লম্বা সফর। যদিও যেতে খুব বেশী সময় লাগবে না। তবু কিছু কেনবার জন্য গেলাম খরফষ-তে। এটি জার্মানীর বিশাল এক অন্তর্জাতিক ডিসকাউন্ট সুপারমার্কেট চেইন। অনেকটা আমাদের কানাডার ‘সুপার স্টোর’ এর মত। তবে এখানে খাবারের সম্ভার অনেক বেশী। অনেকগুলো নতুন ধরনের ফলও চোখে পড়লো। অনেকটা সময় নিয়ে কেনা কাটা করলাম। রাতে সাজ্জাদের বাসায় দাওয়াত, তাই একটা ভাল দেখে ক্যান্ডি কেক কিনলাম। অনেক রকম ফল কিনলাম। আর অনেক ধরণের ড্রাই ফুড কিনলাম। কারণ আগামী কালের যাত্রায় লাগবে।
এখান থেকে বের হয়ে একটু এদিক সেদিক ঘুরে সোজা বাসায় চলে এলাম। আবার পিঠা সহযোগে চা পান করলাম। চা পান করতে করতে দুলাভাইয়ের সুদীর্ঘ চাকুরী জীবনের অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যাই। দুলাভাই খুব সুন্দর করে বর্ণনা করতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গিয়েছেন উনি। আর এখন ঘুরছেন ‘তাবলিগে’র জন্য। উনি প্রতি বছর তিন চিল্লায় যান বিভিন্ন দেশে।
সন্ধ্যার দিকে সাজ্জাদ তার গাড়ী নিয়ে এলো। এটা ইস্ট হ্যাম এরিয়ার মধ্যেই। ইস্ট হ্যাম, টাউন হলের কাছেই। ১০৩ ফ্লেন্ডার স্ট্রিট। খুব সুন্দর ডুপ্লেক্স হাউস। একই ইস্ট হ্যাম এরিয়ার মধ্যে। মাজেদা আপার বাড়ি যেখানে সেখানে মনে হয় হাজার খানেক বাড়ি পরপর সবই টাউন হাউজ। শত বছরের পুরানো। অথচ এটাও ইস্ট হ্যাম এরিয়ার মধ্যেই। কিন্তু এখানকার বাড়িগুলো সবই নতুন ডিজানের। ডিটাচড্ এবং সেমি ডিটাচড্ বাড়ি। বেশ ছিমছাম সাজ্জাদের বাড়িটা। আর সাজ্জাদের বউ ফারহানা রহমান পিয়া, বাড়িটা একেবারে ছবির মত সাজিয়ে রেখেছে। কোথাও কোন বাহুল্য নাই। ঠিক যেখানে যেটা দরকার ঠিক ততটুকুন-ই। খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করলো পিয়া। সাজ্জাদ ও পিয়ার দুটি মেয়ে -সামিহা হোসেন ও ফাতিমা হোসেন। দারুন মিষ্টি দেখতে এবং খুব লাজুক টাইপের। বর্তমান সমেয়ের বাচ্চারা যেমন, এরাও তেমন-ই। সালাম দিয়েই ভেতরে চলে যায়। এরাও তাই করলো। আগেকার দিনে মনে আছে, যখন বাড়িতে মেহমান আসতো, বড়দের থেকেও আমরা ছোটরা মেহমানদের নিয়ে বেশী উত্তেজিত থাকতাম। যতক্ষণ মেহমানরা থাকতো আমারা তাদের সাথে লেপটে থাকতাম। মনে আছে, উল্টো আম্মা আব্বারা দাবড়ানি দিত এই বলে -“এই বাইরে যা, বড়দের কথা এত শুনতে হবে না।” আর এখন? বাচ্চারা যে বাড়িতে থাকে, মেহমানরা আসলে টেরও পায় না। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে যেন নির্বাসিত করে রেখেছে একটা বলয়ের মধ্যে। সেখানে মানুষের কোন কারবার নাই, সব যন্ত্রের কারবার।
যাই হোক, পিয়ার সাথে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। পিয়ার সাথে আমার খুব ভালো জমে যায়। সে খুব ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়। ওর বাবাও নাকি ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়। আমার খুব ভাল লাগলো। যদিও এখন আর গায় না। বিয়ের পর অন্য আরো দশটা মেয়ের মত সেও নিভৃতচারিনি এবং সংসার ধারক হয়ে গেছে। সংসারের প্রতি অপরিসিম ভালবাসা এবং সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহ আমাদেরকে, এই ত্যাগে দুঃখিত করে না। বা ক্লিষ্ট করে না। হয়ত, বার্ধ্যক্যে এসে ঐ সব শিল্প কথন মনে করে বুকের নিভৃত কোনে একটু চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয়। পিয়ালকেও দেখলাম সংসার, চাকরী আবার নতুন করে একটু পড়াশুনাও করছে। তাই সব মিলে মহা ব্যস্ত।
কথা বলতে গিয়ে পিয়া একটু চলে টেবিল সাজাতে। প্রচুর খাবার বানিয়েছে। কিছু খাবর আবার বাইরে থেকেও আনিয়েছে। বেশীর ভাগ মাংস জাতীয় খাবার। তার মধ্যে কয়েক ধরণের কাবাব। খুব মজার মজার কিছু কাবাব ছিল। তার মধ্যে ২/৩ টা আমি এর আগে খাইনি। পিয়া বললো, ওগুলো টার্কিশ কাবাব। শিক কাবাব টা সব জায়গাতে একই ধরণের। তবে এদের টা অনেক বেশী লম্বা। এছাড়া পিয়া বিরিয়ানিও রান্না করেছিল। শেষ পাতে ছিল ৫/৬ রকমের মিষ্টি। খুব মজা করে মিষ্টি খেলাম। আমি মিষ্টি খেতে খুবই ভালবাসি। রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। তবু সাজ্জাদ আবার কফি বানিয়ে আনলো। অবশেষে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম। সাজ্জাদ আবার আমাদেরকে বাসা অবধি নামিয়ে দিয়ে গেল।
আপার বাসায় এসে আবার যাত্রা শুরুর পালা। এই কদিন লন্ডন এবং প্যারিসে ঘোরাঘুরি করতে যে সব কাপর বের করেছিলাম সেগুলো সব গুছিয়ে নিলাম। এবারে লম্বা সফর। শুধু যেটা পরে বের হবো সেটা বাদে সব সুটকেসে বন্দি করলাম। এছাড়া কাঁধের একটা ব্যাগে যাবে আগামীকালের সব টুকটাক খাবার। যদিও পানিটা নিতে দিবে না।
সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে আবারো আড্ডা চলছিল। রাত ২টা পর্যন্ত আড্ডা মেরে ঘুমাতে গেলাম। যদিও সারারাত ঘুম আসছিল না। মনের মধ্যে অস্বাভাবিক অস্থিরতা কাজ করছিল। এটা ঠিক এবারে যাচ্ছি বেলজিয়াম। যাকে বলা হয় ‘ইউরোপের রাজধানী’। ছোট বেলা থেকে বেলজিয়ামের বিখ্যাত গ্লাস এবং আরো অনেক কিছু সম্পর্কে শুনে শুনে বড় হয়েছি। সেই বেলজিয়ামে যাচ্ছি এ কথা ভেবে ভেবে সারা রাত জেগেই কাটালাম। ভোরে নিজেই ঝটপট উঠে রেডী হলাম। নামাজ পড়েই ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি ঐ ভোরে উঠেই আমার স্নেহময়ী মাজেদা আপা অমাদের জন্য চা নাস্তা বানিয়ে রেডি। শুধু তাই নয়, পিঠা স্যান্ডউইচসহ বিভিন্ন রকম ফল, কেক এর স্লাইজ ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল।
তারপর ঘড়ি দেখলাম। প্রথম ট্রেনের সময় আর আধঘন্টা। আমরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে বেরিয়ে পড়লাম। আপা নীচে এসে নামিয়ে দিয়ে গেল। দোয়া পড়ে ফুঁকে দিল। বারবার বললো, বেলজিয়ামে গিয়েই যেন ফোন করি।
কেন জানি মাজেদা আপা’র এই বিদায়ের স্নেহ, তার চোখের আকুতি ২০০৬ এ বাংলাদেশে আমার ‘আম্মা’ কে শেষবারের মত দেখে আসার সময় আম্মার সেই স্নেহের আকুতির কথা মনে করিয়ে দিল। পৃথিবীতে সব স্নেহের আর ভালবাসার চোখের রং একই কেন হয়? (চলবে)
রীনা গুলশান। টরন্টো।