প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬৭

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে গেল। আপা দুলাভাই দুপুর একটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। সাইকা ৪টার সময় চলে গেল। তার ছেলেকে স্কুল থেকে পিক করে একেবারে তার ব্রিস্টল এর বাসায় চলে যাবে। একেবারে শেষ পর্যন্ত ছিলো আমাদের সাথে সানজিদা। সে একেবারে আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে, তার ট্রেনে সে তার বাসায় চলে গেল।

পরদিন খুব ভোরে আমাদের প্যারিস যাত্রা। তাই বাসায় এসেই ঐ রাতে ব্যাক প্যাকে টুকটাক আমার জরুরী জিনিস গুছিয়ে নিলাম। সারাদিনের আমার মেডিসিন, পানির বোতল আর বেশ কিছু ড্রাই খাবার। রাতের ডিনারে খেতে খেতে আপাদের সাথে অনেক আড্ডাও মারলাম। ভোরের প্রথম ট্রেনেই আমাদের যেতে হবে। আপা তাই দুশ্চিন্তা করছিল। আমারও খুব ভাবনা হচ্ছিল। কারণ ৭:০০ টায় ট্রেন ছেড়ে দেবে। তারও ১ ঘন্টা আগে স্টেশনে গিয়ে, যাদের সাথে আমাদের কনট্যাক্ট তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। যাইহোক আমরা নিজেরাই স্টেশনে গিয়েই খবর নিলাম। মাত্র একটি ট্রেন চেঞ্জ করতে হবে। ৪:৩০ এই প্রথম ট্রেন। আমরা রাত ৩:৩০ এর মধ্যেই উঠে সব গুছিয়ে নিলাম। আপা ঐ রাতেই উঠে আমাদের চা আর কেক, বিস্কিট দিল। তারপর বড় সড় খাবারের ব্যাগ ধরিয়ে দিল। ভীষণ উত্তেজনায় সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ‘প্যারিস যাব’ শুধু এই চিন্তাই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। খুব ছোটবেলা থেকে আমার ৪/৫টি দেশের দর্শনীয় স্থানে যাবার তীব্র বাসনা ছিলো – তার মধ্যে অন্যতম ছিলো ফ্রান্সের এই প্যারিস। তারপর এই ‘ইউরোস্টার ট্রেন’ এ উঠারও একটা তীব্র ইচ্ছা ছিল। শুনেছি এটা উপরেও চলে, আবার পানির নীচে একটা টানেলের মধ্য দিয়েও ঘন্টাখানেক চলে (যদিও বাস্তবে মোটেই ঘন্টাখানেক চলে না, সব মিলিয়ে ট্রেনটা ৫/৭ মিনিটের মত)। পানির নিচে দিয়ে ট্রেনটা যাবে? ভাবতেই একটা অদ্ভূত রকম ভয় ভয় আনন্দ কাজ করছিল মনের মধ্যে।

আমাদের গাইড মেয়েটি ।

ভেবেছিলাম আমরাই বোধ হয় একমাত্র যাত্রী হবো, ভোরের ট্রেনে। আমি আবার কিঞ্চিত বাতিকগ্রস্ত। ৬টায় টাইম হলে, পারলে ৪টার সময় গিয়ে বসে থাকি। আর আমার স্বামী মহাশয় ঠিক তার উল্টো। সে ৬ টার সময় টাইম হলে ৬:৩০ এ যেয়ে পৌছায়। বাংলাদেশে সেটা সম্ভব। তাই বলে এসব দেশে? তাই এবারে আর তার কথানুযায়ী কিছুই হবে না। আমিতো পারলে রাতেই গিয়ে ‘সাবওয়ে’ স্টেশনে বসে থাকি। যাক শেষ পর্যন্ত ৪:১৫তে রওনা দিলাম। আপা দুলাভাই ঐ ভোরে উঠেই আমাদের বিদায় জানালো। আমরা ৪:৩০ এ গিয়ে পৌঁছালাম। ট্রেন ছাড়বে ৪:৪৫ এ। আমার পায়ের জন্য সিড়িতে উঠানামা করতে পারছিলাম না। সব জায়গাতেই আমার জন্য লিফট এ উঠা নামা করতে হচ্ছিল। মোটামুটি লন্ডনের সাবওয়ের ‘লিফট’ আমার দেখা সব থেকে ছোট ‘লিফট’। একটা বেবী স্ট্রলার থাকলে, চেপেচুপে ২/৩ জন মানুষ দাড়াতে পারে। আমার স্বামী খুবই অপছন্দ করলেও আমার জন্য বারবার যেতে হচ্ছিল। তাইতো আমি সবার আগে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম।

যাইহোক ইস্টহ্যাম থেকে ৪৫ মিনিটের আগেই ‘প্যানক্রাশ রেলস্টেশন’ এ চলে এলাম। এটা একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল রেলস্টেশন বলে। আমরা খুব দ্রুত আমাদের প্যাকেজের সাইন বোর্ডের কাছে চলে গেলাম। বেশ অনেকটা দূর। একটা রেস্টুরেন্টের মধ্যেই আমাদের বসতে বলেছিল। কিছুক্ষণ পরই একটা লোক এসে আমাদের নাম ধরে ডেকে নিয়ে গেল, এবং আমাদের সরাসরি ট্রেনের আপডাউন টিকিট এবং প্যারিসের প্যাকেজের বিভিন্ন কাগজপত্র হাতে দিয়ে একেবারে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে, আমাদের প্যারিস ট্যুর আনন্দময় হউক, শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিল।

এই প্রথম আমার স্বপ্নের সেই ‘ইউরো’ ট্রেনে উঠলাম। আমাদের একটা আলাদা রুমের মধ্যে বসিয়েছিল। কেবিনের মত। দরজা পুরা বন্ধ। আর কেউ নাই এই রুমের মধ্যে। মনে হয় প্রথম শ্রেণী এটা । যদিও আমি সবার সথে বসতেই পছন্দ করি। আমি তাড়াতাড়ি জানালার কাছে গিয়ে বসলাম যেন একটি দৃশ্যও আমার দৃষ্টির অগোচর না হয়। মনে হচ্ছে চার পাশে শুধু জীবন্ত ছবি চলছে আমাদের সাথে সাথে। আমি ছবি তুলবো কি? কোনটা রেখে কোনটা তুলবো। আমার স্বামী বললো, চোখ ভরে দেখো। প্রাণে ধারণ করো। তোমার ছবি নষ্ট হয়ে যাবে; কিন্তু হৃদয়ে ধারণ করা ছবি কোনদিন নষ্ট হবে না।

আমার মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা কখন ইংলিশ চ্যানেলের মধ্য দিয়ে ট্রেনটা যাবে? ওটাই আমার দেখার তীব্র ইচ্ছা। ইংলিশ চ্যানেলের ‘ডোভার’ দিয়ে শুরু হবে, আর শেষ হবে ‘ক্যালায়েস’ এ গিয়ে। এটা ৫০ কিলোমিটার পথ। এই ৫০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ পানির নীচ দিয়ে যাবে। আমি তাই চোখ টান টান করে বসে আছি, ঐ চ্যানেলের মধ্য গেলে ব্যাপার টি কি দাড়াবে? একসময় এই চ্যানেলের মধ্যে প্রবেশ করলো ট্রেনটি। সাথে সাথে আমরা ট্রেনের মধ্যে বসেও বুঝতে পারলাম। কারণ, শব্দও চেঞ্জ হয়ে গেল। কেমন জানি গুম গুম আওয়াজ হচ্ছিল। আমিতো সেলফোনের ক্যামেরা বাগিয়ে বসে আছি যে টানেলের মধ্যটা কেমন, তার ছবি তুলবো। ওমা! কিচ্ছু দেখি না। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ট্রেনের ভেতরকার আলোও কেমন জানি নিভু নিভু লাগছিল। আমার কেমন জানি গা ছম ছম করছিল। যাই হোক একসময় এটা শেষ হলো। আবার আলোর মুখ দেখলাম।

অবশেষে আমরা ‘গারে ডু নরড’ স্টেশনে পৌঁছালাম। প্যানক্রাস্ট থেকে এখানে আসতে সময় লাগলো ৩ ঘন্টা ১৬ মিনিট। যদিও প্যারিসের সময় একঘন্টা এগুনো। একটুও ক্লান্তি লাগেনি। কাঁধের ব্যাগ নিয়ে প্যারিসের মাটিতে নেমে পড়লাম। একটু এগুতেই দেখলাম একটি সুন্দরী কন্যা আমাদের নামের সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সহাস্যে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।

(চলবে)

রীনা গুলশান

টরন্টো। gulshanararina@gmail.com