প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬৪
ইউরোপের পথে পথে
(পূর্ব প্রকাশের পর)
রীনা গুলশান
আজকের যাত্রাপথ ছিল সকালে ডাউন টাউন। আমার খুবই কাঙ্খিত একটা দর্শনীয় স্থান। ট্রাফেলগার। এটা নিয়ে একটা মজার স্মৃতি আছে। সেই দুই যুগ আগে আমার প্রিয় নায়ক, শাহরুখ খানের একটা মুভি দেখেছিলাম, যেটা আজ পর্যন্ত বুকের মধ্যে জেগে রয়েছে। ওখানে ওমরেশপুরি প্রতিদিন সকালে যেত কবুতরকে খাবার খাওয়াতে। এবং কবুতরকে খাবার দেবার সময় বলতো, আয় আয় আয়। পরে শাহরুখ খানও কাজলের বাবাকে পটানোর জন্য, ওখানে গিয়ে কবুতরকে খাওয়াতো। হাজার হাজার কবুতর। ঐ কবুতরের মেলা দেখবার একটা প্রবল ইচ্ছা ছিলো। জানিনা এক সাথে অত কবুতর কিভাবে একসাথে হয়। অবশ্য দিল্লী গেটের সামনেও এরকম কবুতরের মেলা বসে। এবারের যাত্রা তাই, বলতে গেলে কবুতর দর্শন।
একেবারে রৌদ্রালোকিত দিবস ছিলো। পথিমধ্যে একটা মজার জিনিষ দর্শন করলাম। একটা পোস্ট বক্স। কাঁচের খুঁপরীর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। দেখলাম প্রচুর দর্শনার্থী তার মধ্যে ঢুকে ছবি তুলছে। খুবই মজা পেলাম। কারণ এটা ওদের কাছে কালের সাক্ষী মানে একটা মিউজিয়াম । কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ এটা এখনো সম্ভবত প্রচলিত আছে। যদিও চিঠি লেখার প্রবণতা মানুষের মধ্যে প্রায় জিরো পার্সেন্টে চলে গেছে। এখন কেউ চিঠি লেখালেখি করে শুনলে রীতিমতো হাসাহাসি করবে। তবুও দর্শনার্থীদের কৌতুহল আমাকেও সংক্রমিত করলো, কারণ যখন জানলাম ঐ নির্দিষ্ট পোস্টবক্সটাই প্রথম পোস্ট বক্স। তাই আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ভুল করলাম না।
এরপর আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে যথা স্থানে পৌঁছাইলাম। অর্থাৎ কাঙ্খিত স্থানে পৌছলাম । ট্রাফালগার স্কয়ারও ওয়েস্টমিনিস্টার সিটির মধ্যেই। এটা একটা পাবলিক স্কয়ার। সেন্ট্রাল লন্ডনেই।
১৮০৫ সালে ব্রিটিশদের সাথে যখন ফ্রান্স আর স্পেনের যুদ্ধ হয়েছিল, তখন বৃটেনের নৌবাহিনীর বিজয় হয়েছিল নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে। আর এটা ছিল ২১ অক্টোবর ১৮০৫ সালে।
আর ট্রাফেলগার স্কয়্যার এর চারিপাশেই ছড়িয়ে আছে মিউজিয়াম ও গ্যালারি। লন্ডনের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সবটাই যেন ট্রাফেলগারের আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে। এখানে মাঝখানে রয়েছে বিশাল এক সিংহ, যার মুখ দিয়ে অনর্গল পানি বের হচ্ছে এবং সেটা চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এত সুন্দর একটা দৃশ্যটা। এই স্কয়্যারের আইডিয়াটাই হয়েছিল যুদ্ধটাকে ঘরে। তাইতো ‘সিংহ’ ভাবনাটা মাথায় আসে, সেই সময়কার বিখ্যাত পেইন্টার স্যার এডউইন ল্যান্ডিসের মাথায়। উনি অনেক রকম স্ট্যাচুর কথা ভেবেছিলেন। কুকুর, বিড়াল, ঘোড়া ইত্যাদি। কিন্তু এতবড় একটা বিজয়, যা কিনা ব্রিটিশদের জন্য অনেক বড় একটা কিছু ছিল। সেই বিজয়ের সাথে একমাত্র সিংহের স্ট্যাচু-ই যায়। উনি বিভিন্ন রকম স্টাইলে সিংহের মূর্তি স্থাপন করেন। শুধুমাত্র ট্রাফেলগারেই নয়। পরবর্তীতে লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে এই সিংহের স্ট্যচু স্থাপন করেন। প্রথম ভাবনা শুধুমাত্র পেইন্টিং এ সীমাবদ্ধ ছিল। এটা ছিল ১৮৫৮ সালে। পরে সেই চিত্রাঙ্গণটা ভাস্কর্য্যে পরিনত করতে তার চার বছর লেগেছিল। এত সুন্দর প্রতিটি সিংহের ভাস্কর্য্য।
লন্ডনের বেশীরভাগ কনসার্ট এমনকি পথ নাটক এখানেই হয়ে থাকে। এই সমস্ত দারুন প্রাসাদ যা চারপাশে ছড়িয়ে আছে। প্রতিটি প্রাসাদ একটি থেকে আরেকটি সুন্দর। আর অতি চমৎকার ঐ ফাউন্টেন। এখানেই তাই প্রতিবছর হয় চমৎকার সব ইভেন্ট।
আর সেই অতি চমৎকার কবুতরের পাল। এরা কোথা দিয়ে এলো? এখানেইবা এরা কেন জমায়েত হয়? এসব প্রশ্ন প্রায় প্রতিটি পর্যটকের মনে আসতেই পারে। আসেও। তবে তার সদুত্তর দিতে গেলে বিভিন্ন মতবাদ পেশ করতে হবে। কি দরকার? আমি আদার ব্যাপারী, আমার জাহাজের খবরে কাজ কি?
তাই এসব প্রশ্নের জবাবে গেলাম না। তবে অতি দুঃখজনক হলো কবুতরের সংখ্যা আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগেও যা ছিল, এখন তার অর্ধেকও নাই। অনেকে বলছিল, অতীতে পর্যটকরা সারাদিন ধরে কবুতরকে ইচ্ছামতন খাওয়াতো। এরপর প্রচুর কবুতর নাকি মারা গেছে। এখন আইন হয়েছে, কোন পর্যটক কবুতরকে খাওয়াতে পারবেন না।
চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। অর এসব নির্মাতাদের কথা মনে মনে ভাবছিলাম। চারদিকে ঝকঝকে রোদ। এরমধ্যেই অচমকা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। কি যন্ত্রণা। সব দেখি ছুটোছুটি বেধে গেছে। একেতো মারাত্মক ঠান্ডা, তার মধ্যে বৃষ্টি! কি আশ্চর্য! আমাদের ছাতাও ছিল না। দৌড়াতেও পারিনা। তারাতাড়ি গলায় পেচানো স্কার্ফটাই ছাতার মত ধরে রাখলাম। এরপর দেখি, হঠাৎ করেই বৃষ্টিটা বন্ধ হয়ে গেল। ওমা! আজব। এটাই তাহলে সেই লন্ডনের বিখ্যাত বৃষ্টি! (চলবে)
রীনা গুলশান
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com