টরেটক্কা টরন্টো – সন্তান প্রতিপালন

জানুয়ারী ৬, ২০২১

কাজী সাব্বির আহমেদ

পিতামাতার জন্য সন্তান-সন্ততি হচ্ছে পার্থিব জীবনে সৃষ্টিকর্তার সেরা দান। আর সুসন্তান হচ্ছে আমাদের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। পবিত্র কোরান শরীফে সৎ ও ন্যায়ের পথে দীক্ষাপ্রাপ্ত সন্তান-সন্ততিকে আমাদের জীবনের সৌন্দর্য্য বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর যদি আমরা আমাদের সন্তানাদি প্রতিপালনে ব্যর্থ হই, তবে সেটি হবে আমাদের জন্য অশেষ দূর্ভাগ্য এবং ভোগান্তির কারণ। সুরা তাগাবুন-এর ১৫ নম্বর আয়াতে এই জন্যই বলা হয়েছে -“নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদ ও সন্তানাদি ফেতনাস্বরূপ”, যদি তাদেরকে সঠিকভাবে হেফাজত না করা হয়। সন্তান-সন্ততি হচ্ছে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আমাদের জন্য আমানত। পরকালে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা পিতামাতাকে তাদের সন্তানাদির বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, “সন্তানকে শিষ্টাচার শিক্ষা দাও। কেননা তুমি এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। তুমি তাকে কতটা শিষ্টাচার শিখিয়েছ এবং তাকে কী শিক্ষা দিয়েছ? আর সে তোমার প্রতি তার আনুগত্য ও সহযোগিতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে” (সুনানে বায়হাকি, হাদীস ৪৬৯১)। আল্লাহ্‌ তা’য়ালা সুরা লোকমান-এ কিভাবে সন্তান পালন করতে হবে তার একটি বিশদ দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। শুধু ইসলাম ধর্মেই নয়, অন্যান্য ধর্মেও সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য এবং একই সাথে পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যকে গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। চীনের প্রাচীন ধর্ম তাও-এর দীক্ষা অনুসারে পিতামাতা সন্তানের কাছে দেবতাতূল্য পূজনীয়। জীবন গঠনে ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলা যে জরুরী তা কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা সমর্থন করেন। মনীষী জন রাস্কিন বলেন,”তিনটি ‘আর’ (রিডিং,রাইটিং,এরিথমেটিক), এর পরে জীবন গড়তে চতুর্থ ‘আর’ অর্থাৎ রিলিজিওন প্রয়োজন। আর তা না হলে অনিবার্য পরিণতি হবে পঞ্চম ‘আর’ অর্থাৎ রাস্কেল বা দুর্বৃত্ত।”

আমরা যখন অনেকটা পরিণত বয়সে আমাদের মিড ক্যারিয়ারের সময় এদেশে আসি, আমাদের অনেকেরই পক্ষে হয়ত আর নতুন করে একটা ডিসেন্ট ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে উঠে না। একটা ডিসেন্ট ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য যে ‘গেম-প্ল্যান’-এর দরকার সেটা হয়ত নতুন ইমিগ্র্যান্টদের কাছে কিছুটা থাকে অজানা, আর বাকীটা থাকে ‘ক্যাচ-টুয়েন্টি-টু’-এর মতন অধরা। মাস গেলেই যখন বাড়ী ভাড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের বিল দৈত্যের আকৃতি নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় তখন আমাদের অনেকেরই পক্ষে আর ক্যারিয়ার গঠনের দিকে তাকানোর সময় থাকে না। হাতের কাছে যা কিছু একটা পাওয়া যায় এই মানসিকতাতেই আমরা তখন একটা সার্ভাইভাল জব খুঁজতে থাকি, এবং এক সময় আমরা হয়ত একটা ‘প্রিকারেয়াস জব’ পেয়েও যাই। তখন আবার দেখা যায় যে, ‘পে ভালো কিন্তু আওয়ার নেই কিংবা আওয়ার আছে অথচ পে ভালো না’। অর্থাৎ একজনের আয়ে সংসার চালানো অসম্ভব, ফল স্বরূপ স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই নেমে পড়তে হয় জীবিকার অন্বেষণে। একবার যখন আমরা এই রকম জবে ঢুকে পড়ি, তখন খুব সহজেই এর থেকে বের হয়ে নিজেদের আসল ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগী হতে পারি না। আগামী পর্বে কানাডাতে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ব্যাপারে কী করণীয় তা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বিশদভাবে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।

কানাডাতে আসার পরপরই জীবিকার তাগিদে বেশীর ভাগ নতুন ইমিগ্র্যান্ট পরিবার তাদের সন্তানদের প্রতি যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। সন্তানদের সাথে ‘কোয়ালিটি টাইম’ না কাটানোর কারণে ধীরে ধীরে তাদের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। এই দূরত্ব এত ধীরে তৈরি হয় যে চিরচেনা সন্তানেরা যে কিভাবে বদলে যাচ্ছে সেটা সহজে চোখে পড়ে না, কিন্তু যখন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তখন হয়ত আর কিছুই করার থাকে না, ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের ভেতর বাংলাদেশী কম্যুনিটির তেরো জন তরুণ নিজে থেকে তাদের জীবন প্রদীপকে নিভিয়ে দিয়েছেন। যে বয়সে এই তরুণদের কাছে জীবন থাকবে উচ্ছলতায় পূর্ণ ও দীপ্তিময়, কিসের কারণে তারা হলো বিষণ্ণতার শিকার, হারিয়ে ফেললো জিজীবিষা। সে বয়সে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে সমস্ত বাঁধা বিপত্তি হবে পরাজিত, কিসের কারণে তারা নিজেরাই হলো জীবনের কাছে পরাজিত। কানাডার অন্যতম প্রধান সম্প্রচার মাধ্যম সিবিসি-এর নিউজ রিপোর্টার ফারাহ মেরালি বাংলাদেশী কম্যুনিটির তরুণদের মাঝে এই আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ২০২০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর। এই প্রতিবেদনে ফারাহ মেরালি উল্লেখ করেন যে নেসার আহমেদ, গোলাম মোস্তফা, মাহতাব উদ্দিন এবং ইমাম উদ্দিন, বাংলাদেশী কম্যুনিটির এই চারজন মিলে এই আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর মূল কারণ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে প্রায় দুই বছর ব্যাপী এক অনুসন্ধান চালান। তারা তাদের এই অনুসন্ধানের ফলাফল ‘বেঙ্গলি ইনফরমেশন এন্ড এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস’-এর সহযোগিতায় প্রিন্টেড রিপোর্ট আকারে প্রকাশ করেন। তাদের অনুসন্ধানে যে কারণগুলি উঠে এসেছে তার ভেতর প্রধান দু’টি কারণ হচ্ছে, সন্তানদের সাথে তাদের পিতামাতাদের মানসিক দূরত্ব এবং একাডেমিক পড়ালেখার চাপ। এই দুইয়ের কারণে আমাদের সন্তানদের মাঝে সহজেই তৈরি হতে পারে গভীর বিষণ্ণতা। সেই বিষণ্ণতার বহির্প্রকাশ যখন তাদের আচরণে প্রকাশ পায় সেটা সঠিকভাবে অনুধাবন করে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা বিশেষ জরুরী। কিন্তু দেখা গেছে যে এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মানসিক সমস্যাকে তেমন গুরুত্ব না দেয়া কিংবা স্টিগমা বা সামাজিকভাবে লজ্জাকর ভেবে চেপে রাখা। আত্মহত্যার মতন ভয়ানক পরিণতি যাতে না ঘটে তার জন্য প্রথম যেটা দরকার সেটা হলো এদেশে সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আমাদের যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে সে গুলোকে চিহ্নিত করা।

টরন্টোর একটি স্কুলের শ্রেণীকক্ষের দৃশ্য। ছবি : গ্লোবাল নিউজ

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে প্রথম জেনারেশন ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ার এখানে গড়ে নিতে পারি না। তখন আমরা সেই অপূর্ণ স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চাই আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের মধ্য দিয়ে। অনেকটা জোর করেই চাপিয়ে দেই আমাদের সেই স্বপ্ন তাদের উপর যা কিনা তাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে এক বিরাট বোঝা। আর সেই বোঝা বইতে না পেরে আমাদের সন্তানেরা এক সময় হয়ে উঠতে পারে দিশেহারা এবং একই সাথে বেপরোয়া। আর এটাই ঘটেছিলো চব্বিশ বছর বয়স্ক মেহনাজ জামানের ক্ষেত্রে। ভালো একাডেমিক রেজাল্ট একটি ভালো ক্যারিয়ারের নিশ্চয়তা দিবে, আর ভালো ক্যারিয়ার একটি নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিবে – আপাত দৃষ্টিতে নিষ্পাপ এবং সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য এই ধারণা থেকেই মেহনাজের পিতামাতা তাকে সব সময়ই ভালো রেজাল্টের জন্য তাগাদা দিতেন। কিন্তু মেহনাজ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে একসময় সে তার লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। তার এই ড্রপ-আউটের খবর কিন্তু বাসার কেউ জানত না। এখানেই তৈরি হয় এক ভয়াবহ দূরত্ব। মেহনাজ মনে করেছিল তার পিতামাতা এই খবর সহজভাবে নিতে পারবে না। অথচ মেহনাজের সাথে যদি তার পিতামাতার এমন সম্পর্ক থাকত যাতে সে নিসংকোচে বলতে পারত তার অসুবিধার কথা তবে কিন্তু জীবন সহজ হয়ে উঠত মেহনাজের জন্য, তার পরিবারের জন্য। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বৃহত্তর টরন্টোর মারখাম শহরের মেহনাজ তার বাবা, মা, বোন ও দাদীসহ মোট চারজনকে ক্রো-বার দিয়ে খুন করে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার এই যে, এই খুনগুলি কিন্তু একসাথে করেনি সে। প্রথমে সে মা ও দাদীকে হত্যা করে, তারপর বোন বাসায় ফিরলে তাকে খুন করার পর তার ট্যাক্সি চালক বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এই সময় মেহনাজ একটি অনলাইন গেমসের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে তার সতীর্থ খেলোয়াড়দেরকে মেসেজের মাধ্যমে জানায় তার খুনের কাহিনী। সেই খেলোয়াড়দের একজন যখন পুলিশকে জানায় তখন পুলিশ কিছুটা গড়িমসি করে মেহনাজকে গ্রেফতার করে। অনেকে অবশ্য মনে করেন যে পুলিশ তৎপর হলে মেহনাজের বাবা হয়ত এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতেন। যাই হোক বিচারে মেহনাজের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে এবং আগামী চল্লিশ বছরের মধ্যে সে প্যারোলে মুক্তি পাবার যোগ্য হবে না। নিজ হাতে বাবা মাকে খুন করার আরেকটি দৃষ্টান্ত রয়েছে নর্থ আমেরিকার বাংলাদেশী কম্যুনিটির ভেতর। সেটা ঘটেছিল ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো অঙ্গরাজ্যের সান জোসে কাউন্টিতে। বাইশ বছর বয়সী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হাসিব বিন গোলাম রাব্বী তার বাবা মাকে মর্মান্তিকভাবে খুন করে। সেই খুনের সাক্ষী ছিল তার ছোটভাই ওমর বিন গোলাম রাব্বী। ওমর তার জবানবন্দীতে বলে যে খুনের সময় সে শাওয়ারে ছিল কিন্তু তার ভাই হাসিবের সাথে যে তার বাবার বাকবিতণ্ডা হচ্ছিল সেটা সে শুনতে পাচ্ছিল। সেই বাকবিতণ্ডার বিষয় ছিল তার ভাইয়ের পড়াশুনা এবং ক্যারিয়ার। এক পর্যায়ে সে উপর্যপুরী গুলির শব্দ শুনতে পায়। তাদের বাবা মা উভয়েই বাংলাদেশী কম্যুনিটিতে বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন। তাদের এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে কম্যুনিটির সবাই বাকহারা হয়ে যান।

আমরা যদি আমাদের কম্যুনিটিতে ঘটে যাওয়া এইসব দূর্ঘটনাগুলিকে বিশ্লেষণ করি তবে একটি প্যাটার্ন আমাদের নজরে আসবে। এই প্যাটার্নটি হচ্ছে, প্রথমে সন্তানদের সাথে পিতামাতার মানসিক দূরত্ব তৈরি হওয়া, তারপর বিষণ্ণতা নামক এক ব্যাধির উপস্থিতিকে উপেক্ষা করা, আর সর্বোপরি পিতামাতাকে নিবৃত রাখার জন্য সন্তানদের একটি পর্যায় পর্যন্ত ভনিতা করে যাওয়া। সন্তান প্রতিপালনের সবচেয়ে ব্যর্থতার অধ্যায় হচ্ছে যখন আমাদের সন্তানেরা দু’টি সমান্তরাল জীবন বেছে নেয়। বাসায় একরকম, আর বাসা থেকে বেরিয়ে যখন কানাডিয়ান সমাজে প্রবেশ করে তখন আরেক রকম জীবন। এই দুই জীবনের বোঝা তারা বেশীদিন বয়ে বেড়াতে পারে না, এক সময় অনিবার্য হয়ে পড়ে মুখোমুখি সংঘর্ষের। সেই সংঘর্ষেরই ফলাফল এই সব দূর্ঘটনাগুলি। আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি যে সন্তানেরা আমাদের মনের মতন করে গড়ে উঠেনি, বড় ধরণের এক সংঘাত অবশ্যাম্ভাবী। এই সময় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা খুবই দরকারী। এই সময় জবরদস্তী করে কোন কিছু তাদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে বরং ভালো একজন কাউন্সিলরের সাহায্য নেয়াটাই হবে সঠিক পদক্ষেপ। প্রফেশনাল কাউন্সিলর কিন্তু সরাসরি সমস্যার সমাধান করে দিবে না, বরং এই সময়ে আমাদের কী করণীয় সেটাই বাতলে দিবে। একই সাথে সন্তানদের কী করণীয় সেই সম্পর্কে তাদেরকেও সজাগ করে দিবে। টরন্টোস্থ ‘আবু হুরাইয়া’ মসজিদের তরুণ ইমাম শেখ মুউতাসিম হামিদি এ রকম একজন কাউন্সিলর যার কাছে অনেকেই পরামর্শের জন্য যান। এই তরুণ ইমাম তাঁর জুম্মার খুতবাতে প্রায়ই সন্তান প্রতিপালন নিয়ে কথা বলেন। তিনি একই সাথে পিতামাতা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব এবং পিতামাতার প্রতি সন্তানদের দায়িত্বের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেন।

আমাদেরকে খতিয়ে দেখতে হবে যে আমাদের সন্তানেরা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তারা আমাদের ইংরেজী ভাষায় দূর্বলতা, মূলধারা কানাডিয়ান সমাজের সাথে অ্যাসিমিলেট করার অক্ষমতা এবং প্রেকারেয়াস জবের সাথে আমাদের সংশ্লিষ্টতার কারণে আমাদের সম্পর্কে তারা কোন উঁচু ধারণা পোষণ করে না। এই ধারণা থেকেই তারা একসময় ভাবতে শুরু করে যে সার্বিকভাবে এটাই হচ্ছে আমাদের কম্যুনিটির অবস্থা। ফলে তারা এই বিশেষ কম্যুনিটির সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা বজায় রাখতে কুন্ঠা বোধ করে। তাদের এই হীনমন্যতার জন্য আসলে কিন্তু তারা দায়ী নয়, দায়ী আমরা। কারণ আমরা তাদের এই হীনমন্যতা দূর করার জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই না কিংবা হয়ত তাদের মনোজগতের খবরই রাখি না। অথচ আমরা যদি আমাদের কম্যুনিটির বিভিন্ন ব্যক্তি যারা নর্থ আমেরিকা তথা সারা বিশ্বে তাদের কর্মের দ্বারা নাম করেছেন তাদের কীর্তিকলাপের সাথে আমাদের সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দেই, তবে তারা সহজেই এই হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এ প্রসঙ্গে আমরা বাংলাদেশী প্রকৌশলী এফ আর খানের কীর্তির কথা তাদেরকে বলতে পারি যাকে কিনা বলা হয়ে থাকে যে আধুনিক উঁচু বিল্ডিং-এর জনক। তাঁর আবিষ্কৃত ‘টিউবুলার স্ট্রাকচার’-এর কারণেই সম্ভব হয়েছে আজকের দুনিয়ার এতসব আকাশছোঁয়া বহুতল ভবন নির্মাণের। এফ আর খান ছাড়াও আরো অনেকেই আছেন যাদের কীর্তির কথা আমরা গৌরবের সাথে আমাদের সন্তানদের কাছে তুলে ধরতে পারি।

সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সব পিতামাতারই কাম্য। কিন্তু আমরা যে ক্যারিয়ারটা আমাদের সন্তানদের জন্য ভালো মনে করছি, সেটা হয়ত তাদের পছন্দ নয়। আমাদের উচিৎ হবে তাদের পছন্দ কোনটি সেটি আগে জানা। তাদের মতামতকে মূল্য দেয়া। তারপর যদি দেখি তাদের সিদ্ধান্ত ভুল, আমাদের উচিৎ হবে সেটি কেন ভুল তা তাদের কাছে যুক্তি সহ তুলে ধরা। আমাদের কখনই উচিৎ হবে না অন্য কারো সাথে তাদের তুলনা করা। তাদেরকে ভুল করার কিংবা ব্যর্থ হবার জন্য স্পেস দেয়া উচিৎ, যাতে তারা নিজেরাই তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। কথায় বলে, মানুষ শিখে দুইভাবে – দেখে কিংবা ঠেকে। দেখে শেখার জন্য আমাদেরকে তাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন ‘রোল মডেল’কে। আমাদের চারপাশে কিন্তু উপযুক্ত রোল মডেলের অভাব নেই যাদের জীবন ও কর্ম আমাদের সন্তানদের জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার উৎস। ‘খান একাডেমী’-এর নাম আজ বিশ্বজোড়া। এই ‘খান একাডেমী’-এর প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় প্রজন্মের ইমিগ্র্যান্ট সালমান খান আমাদের সন্তানদের জন্য হতে পারে একজন রোল মডেল। কিংবা অপেক্ষাকৃত বয়সে নবীন সম্মানিত এমপিপি ডলি বেগম যিনি এক সাধারণ বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্ট ফ্যামিলির সন্তান, তার সাফল্যের দ্বারাও অনুপ্রাণিত হতে পারে আমাদের সন্তানেরা। আবার নিউইয়র্ক-বেইজড তেত্রিশ বছর বয়স্ক তরুণ ফাহিম সালেহ-ও হতে পারে আমাদের সন্তানদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। নিউইয়র্কে বেড়ে উঠা ফাহিম গ্র্যাজুয়েশনের পরে চাকরির পথে না হেঁটে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে কিছু করার জন্য ‘হ্যাক হাউজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। নানা ধরণের আইডিয়া নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে এক সময় ফাহিম ‘উবার’-এর বিকল্প হিসেবে মোটর সাইকেল ভিত্তিক ‘পাঠাও’ গড়ে তুলে বাংলাদেশে। ‘পাঠাও’-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে ফাহিম শুধুমাত্র একজন সফল উদ্যোক্তাই নয়, একই সাথে সে একজন সফল উদ্ভাবক। বাংলাদেশের পর সে তার এই ‘পাঠাও’-এর মডেলকে ‘গোকাডা’ নামে বাজারজাত করার জন্য যায় নাইজেরিয়াতে। কিন্তু ২০২০ সালের জুলাই মাসে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে ফাহিম সালেহ তার নিজস্ব অফিস সহকারীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয় তার নিউইয়র্কস্থ অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর। পিতা সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি ‘কালের কন্ঠ’ পত্রিকায় ‘ছোট্ট ফাহিমের অর্থনীতি’ শিরোনামে একটি লেখাতে ফুটিয়ে তুলেন কিভাবে তিনি তার ছোট্ট ফাহিমকে বড় করেছেন। পরিণত বয়সে আমেরিকাতে পিএইচডি করতে যখন তিনি আসেন তখন ফাহিমের বয়স মাত্র চার। ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া যৎসামান্য টাকায় তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা এবং ছোট্ট ফাহিমকে নিয়ে দুই বেডরুমের ছোট এক অ্যাপার্টমেন্টে থেকে সংসার চালাতেন। সেই সময়ে তিনি যখন ফাহিমের খেলনার আব্দার মিটাতে পারতেন না, তখন তাকে বলতেন ‘টাকা নেই, পয়সা নেই’। ফাহিমও তখন না বুঝেই সুর করে বলত ‘আব্বু, টাকা নেই, পয়সা নেই’। কিন্তু তিনি তার সন্তানদেরকে পর্যাপ্ত সময় দিয়েছেন, তাদেরকে বুঝতে দিয়েছেন তার প্রকৃত অবস্থার কথা। তাই ফাহিম দশ বছর বয়সেই নিজেই উদ্যোক্তা বনে যায়। ডলার স্টোর থেকে ক্যান্ডি কিনে সেটা কিছুটা লাভে স্কুলে বিক্রী করে ফাহিম প্রথম উপার্জন করতে শেখে। তার কিছুদিন পরে মেয়েদের গহনা বানানোর একটা সস্তা মেশিন কিনে তা দিয়ে নানা ডিজাইনের গহনা তৈরি করে সে তার উদ্ভাবনী মেধার পরিচয় দেয়। আর এক সময় সে দাঁড়া করে ফেলে ‘পাঠাও’ কিংবা ‘গোকাডা’-এর মতন প্রতিষ্ঠান। তার বাবার লেখাতে এটাই ফুটে উঠেছে যে সীমিত সম্পদ কখনই মেধা বিকাশের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, ছোট্ট ফাহিম সেটাই প্রমাণ করে দিয়ে গেছে। ফাহিম পিতামাতার প্রতি তার দায়িত্ব পালনেও ছিল অতুলনীয়। বাবার জন্মদিনে বাবার জন্য একটা টেসলা গাড়ী উপহার দিয়েছিল সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে। সেটার একটা ভিডিও করে ইউটিউবে সে আপলোড করেছিল যা এখন ফাহিমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য একটি সুখস্মৃতি। আমাদের সন্তানদের জন্য ফাহিম অবশ্যই একজন রোল মডেল। ফাহিমের কর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের সন্তানেরা একদিন উদ্ভাবক এবং উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হবে, ‘স্টিভ জবস’ কিংবা ‘বিল গেটস’-এর কাতারে নিজেদের নাম লেখাতে সক্ষম হবে, অভিভাবক হিসেবে আমরা এই স্বপ্ন অবশ্যই দেখতে পারি। তাদেরকে আমরা দেখতে চাই এদেশের সুনাগরিক হয়ে তাদের নিজ নিজ ক্যারিয়ারে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের কম্যুনিটির মুখ উজ্জ্বল করতে। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো