টরেটক্কা টরন্টো

ক্যারিয়ার গঠন- ১

ফেব্রুয়ারী ৫, ২০২১

কাজী সাব্বির আহমেদ

অভিবাসন একটি জটিল প্রক্রিয়া, যথাযথ কারণ ছাড়া মানুষ সাধারণত নিজ মাতৃভূমি, মাতৃভাষা এবং আপনজনদের পরিমন্ডল পরিত্যাগ করে অজানা কোন দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে মানুষ তার নিজের এবং পরিবারের জন্য একটি উন্নত জীবন নিশ্চিত করতেই পা বাড়ায় অভিবাসী জীবনের অভিমুখে। সবাই চায় তার বর্তমান অবস্থার অর্থাৎ জীবনযাত্রার মানের উন্নতি। একজন মানুষ কেমন মানের জীবন যাপন করছেন তা কিন্তু নিরূপণ করা যায় তিনি তার জীবনে কি কি অর্জন করেছেন তার উপর ভিত্তি করে। আজ যা কিছু তিনি অর্জন করেছেন, এক সময় তা কিন্তু ছিল তার কাছে প্রত্যাশার বস্তু। অর্থাৎ জীবনের প্রতি সেই মানুষটির যা কিছু প্রত্যাশার ছিল তার থেকে কিছু তিনি অর্জন করেছেন, আর বাকীগুলো তিনি অর্জনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই চেষ্টার কিন্তু শেষ নেই, মানুষ সারা জীবন চেষ্টা করে যায় তার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য। একজন অভিবাসী যখন তার নতুন দেশে এসে নতুন জীবন শুরু করেন তখন কিন্তু তাকে অনেকটা কেঁচে গণ্ডূষ করেই জীবন শুরু করতে হয়। অর্থাৎ যা কিছু তিনি অর্জন করেছিলেন অতীতে তার অনেকটাই তাকে ত্যাগ করতে হয়। সাথে করে তিনি আনতে পারেন নগদ কিছু অর্থ সম্পদ আর তার অর্জিত বিদ্যাশিক্ষা। স্কিল ক্যাটেগরিতে আসা অভিবাসীদের জন্য এই বিদ্যাশিক্ষাই হয়ে উঠে তার জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ কিংবা যুদ্ধ জয়ের হাতিয়ার।

আব্রাহাম মোসলো প্রণীত মানব জীবনের চাহিদার পিরামিড

বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিকবিদ আব্রাহাম মোসলো জীবনের প্রতি মানুষের এই প্রত্যাশাগুলিকে তাদের গুরুত্ব অনুযায়ী যূথবদ্ধ করে একটি পিরামিড আকারে সাজিয়েছেন। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে তার নূন্যতম প্রত্যাশা কিংবা প্রয়োজন খাদ্যের, তারপর আসে বস্ত্রের প্রশ্ন। অর্থাৎ ‘অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান’ এই তিনটি উপাদান হচ্ছে বেঁচে থাকার মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা বা চাহিদা, যা কিনা আব্রাহাম মোসলো শ্রেণীভুক্ত করেছেন ‘ফিজিওলজিক্যাল চাহিদা’ শিরোনামে। এরপর জীবনের জন্য রয়েছে ‘চিকিৎসা ও শিক্ষা’-এর প্রয়োজন যা কিনা ‘নিরাপত্তা চাহিদা’ শিরোনামে শ্রেণীভুক্ত। এইভাবে এই দুইটি শ্রেণীর চাহিদাকে আব্রাহাম মোসলো একত্রে করে অভিহিত করেছেন ‘মৌলিক চাহিদা’ হিসেবে যা কিনা তার বিখ্যাত ‘মানব জীবনের চাহিদার পিরামিড’-এর ভিত্তিমূল। মৌলিক চাহিদা পূরণের পরই কেবল আসে পরবর্তী চাহিদা পূরণের পালা। অর্থাৎ এই পিরামিডের নীচের স্তরের প্রত্যাশাগুলি পূরণ না হলে, উপরের স্তরের প্রত্যাশাগুলি জীবনের জন্য অনেকটা অপ্রাসংগিক হয়ে যায়। অতএব দেখা যাচ্ছে যে প্রত্যাশার সোপানগুলি ধাপে ধাপে পূরণ করেই মানুষকে অর্জন করতে হয় উন্নত মানের জীবনকে। এই যাত্রাকে সহজ এবং সফল করার জন্য যেমন দরকার হয় জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির, তেমন দরকার হয় বিভিন্ন রকমের সামাজিক সুযোগ সুবিধার। দেশ হিসেবে কানাডা এই সামাজিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পৃথিবীর মাঝে অন্যতম সেরা একটি দেশ। কানাডা তার সকল নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করেছে ‘চিকিৎসা ও শিক্ষা’ এবং যারা অপারগ তাদের জন্য ‘অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান’। তাই কানাডাকে বলা হয়ে থাকে একটি ‘ওয়েল ফেয়ার কান্ট্রি’। কানাডার সরকারকে তার নাগরিকদের জীবনের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে খরচ করতে হয় জনগণের দেয়া ট্যাক্স তহবিল থেকে। নিজের ‘অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান’-এর জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেই যোগাড় করার জন্য দরকার এদেশের উপযোগী একটি ক্যারিয়ার যা কিনা আমাদেরকে এদেশের বিশাল কর্মযজ্ঞে সামিল হওয়ার সুযোগ করে দিবে। আর সেইসাথে নিজের উপার্জন থেকে সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে নিজেকে একজন গর্বিত ‘ট্যাক্স পেয়িং’ নাগরিক হিসেবে কানাডাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে আমরা নতুন ইমিগ্র্যান্টরা আমাদের কানাডিয়ান জীবনের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারব।

অভিবাসী হয়ে টরন্টোতে আসার পর আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল একটি নিরাপদ এবং আরামদায়ক বাসস্থান খুঁজে বের করা। আমার ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন সহপাঠী গোলাম ফারুকের সহায়তায় সেটি বেশ সহজেই সম্পন্ন হয়েছিল। আমার স্ত্রীর ভাষায় হঠাৎ ‘দেবদূত’-এর মতো আভির্ভূত হয়ে গোলাম ফারুক আমাদের এই বিরাট উপকারটি করেছিল (‘নতুন জীবন’ পর্ব দ্রষ্টব্য)। ব্যাংক একাঊন্ট খোলা থেকে শুরু করে কিভাবে ‘ফ্লায়ার’ দেখে কেটাকাটা করতে হবে – সব ব্যাপারেই গোলাম ফারুকের পরামর্শ আমাদের কানাডার নতুন জীবনকে সহজ করে তুলেছিল। আমার এই বন্ধুটিই আমাকে এদেশে কিভাবে চাকরী খুঁজতে হবে সেই পথও বাতলে দিয়েছিল। তার মুখেই প্রথম জানতে পারি ‘হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট কানাডা’ বা সংক্ষেপে ‘এইচআরডিসি’-এর কথা। সরকারী অর্থায়নে চালিত এই প্রোগ্রামের অধীনে বিভিন্ন সংস্থা নতুন ইমিগ্র্যান্টদেরকে এদেশে তার যোগ্যতানুযায়ী চাকরী পেতে সহায়তা করে। কিংবা নতুন ইমিগ্র্যান্ট্ররা কিভাবে নিজেদেরকে এদেশের চাকরীর বাজারের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে হবে তার জন্য তারা বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ট্রেইনিং দিয়ে থাকে। টরন্টোতে আসার প্রায় দেড় মাস পরে অগাষ্টের মাঝামাঝি সময়ে আমি চাকরী খোঁজা শুরু করলাম। এর মাঝে অবশ্য চাকরী খোঁজার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের যোগাড় সেরে ফেলেছি -সিঙ্গাপুর থেকে সাথে করে নিয়ে আসা আমার এবং আমার স্ত্রীর দুই সেট আইবিএম-এর থিংকপ্যাড ল্যাপটপ, বেস্টবাই থেকে অতিরিক্ত সময়ের ওয়ারেন্টি ছাড়া কেনা এইচপি লেজারজেট প্রিন্টার যা আজও বহাল তবিয়তে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে আর রজার্স থেকে নেয়া ইন্টারনেট কানেকশন। একদিন টিটিসি-এর বাসে ‘পিসিপিসি’ নামক এক সংস্থা যারা নতুন ইমিগ্র্যান্টদের চাকরী পেতে সাহায্য করে তাদের একটা অ্যাড চোখে পড়ল। ঠিকানা টুকে নিয়ে পরদিনই বাসে চড়ে হাজির হলাম মার্কহাম আর লরেন্স ইন্টারসেকশনে অবস্থিত তাদের অফিসে। রিসেপশনে গিয়ে জানালাম আমার আসার উদ্দেশ্য। কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে আমাকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল চব্বিশ কিংবা পঁচিশ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গী এক তরুণী। আমি সাথে করে আমার সমস্ত সার্টিফিকেট, চাকরীর অভিজ্ঞতার সনদ আর হালনাগাদ করা একটি রেজুমি নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি ১৯৯২ সালে বেইজিং-এর ‘ইউনিভার্সিটি অব পোষ্টস এন্ড টেলিকমুনিকেশনস’ থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করি। আবার ২০০২ সালে ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’-এর ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেই। টরন্টোতে আসার আগে আমি প্রায় দশ বছরের মতন পার্মানেন্ট রেসিডেন্স হিসেবে সিঙ্গাপুরে বসবাস করেছিলাম। আমার শেষ কর্মস্থল ছিল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন-এর অধীনে ‘সেন্টার ফর রিসার্চ ইন পেডাগজী অ্যান্ড প্রাকটিস’ অথবা সংক্ষেপে ‘সি. আর. পি. পি.’ নামক একটি রিসার্চ সেন্টার। ‘সিনিয়ার সফটওয়্যার ডেভেলপার’ হিসেবে আমার কাজ ছিল কমপিউটিশনাল লিঙ্গুইস্টিক টেকনোলজীর মাধ্যমে ক্লাশরুম টিচিং-এর মান বিশ্লেষণ করা। এর পূর্বে ‘সিস্টেম এনালিস্ট’ হিসেবে কাজ করেছি ‘সিঙ্গাপুর পলিটেকনিক’-এ (‘আগমন’ পর্ব দ্রষ্টব্য)। সিঙ্গাপুরে আমি আমার ক্যারিয়ারের পুরো সময়টাই ব্যয় করেছি একাডেমিক ইনস্টিটিউশনগুলিতে ‘ওয়েব বেইজড লার্নিং টেকনোলজী’ বিষয়ক গবেষণামূলক প্রকল্পে। আর তার সুবাদে আমার বেশ কিছু পাবলিকেশনও হয়েছে, যা আমার রেজুমিতে উল্লেখ আছে। আমার রেজুমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সেই তরুণী আমাকে বলল, দুই সপ্তাহের জন্য তোমাকে ‘পিসিপিসি’তে রেজিস্ট্রেশন করা হল। এখন থেকে আমি হচ্ছি তোমার জব কাউন্সিলর, তোমার রেজুমিতে কোন পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই। তোমাকে আমি ‘ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো’-এর কিছু জব পোষ্টিং-এর লিঙ্ক পাঠাব ই-মেইলে তুমি সেখানে অ্যাপ্লাই করে দেখতে পার। আর আমাকে সে ‘জব সার্চ’ নামের এক সপ্তাহের এক ওয়ার্কশপে রেজিট্রেশন করিয়ে দিল যা কিনা পরের সোমবার থেকে শুরু হবে। আর এই সেন্টারের যাবতীয় সুবিধাদি, যেমন ফটোকপি করা কিংবা রেজুমি প্রিন্ট করা ইত্যাদি আমি অনায়াসে ব্যবহার করতে পারব।

সেদিন রাতেই সে কিছু লিঙ্ক আমাকে পাঠিয়েছিল, আমি সেই লিঙ্কগুলির সবকয়টাতেই অ্যাপ্লাই করে দিলাম। উত্তর এলো শুধু এক জায়গা থেকে, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সেন্ট জর্জ ক্যাম্পাসের সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর ‘সফটওয়্যার ডেভেলপার’ পদের জন্য আবেদনপত্রের। যথা সময়ে ইন্টারভিউও হয়ে গেল। আমি ইতিমধ্যে ‘জব সার্চ’ নামক ওয়ার্কশপের কারণে কানাডার জব ইন্টারভিউ-এর বেসিক টেকনিকগুলি শিখে ফেলেছি। নিজের স্ট্রং পয়েন্ট আর উইক পয়েন্ট কিভাবে বর্ণনা করতে হবে অথবা কিভাবে সফলভাবে ডেডলাইনের ভেতর কাজ সম্পন্ন করতে হলে কি কি বিষয়ের উপর জোর দিতে হবে, এরকম সব  ট্রিকি প্রশ্নের উত্তর আমার মুখস্থ। ফলে ইন্টারভিউ আমার আশানুরূপ হয়েছিল, কিন্তু তারপরও যখন ডাক পেলাম না তখন একদিন তাদেরকে ফোন করে জানতে চাইলাম আমাকে কেন সিলেক্ট করা হয়নি। এটাও কিন্তু ‘জব সার্চ’ ওয়ার্কশপ থেকে শেখা। তারা আমাকে জানাল যে আমার ইন্টারভিউতে কোন সমস্যা ছিল না কিন্তু আমার চেয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন আরেকজনকে তারা পেয়েছে যার ইন্ডাস্ট্রি এক্সপোজার আমার থেকে বেশী। অনেক সময় তাদের ইন্টারনাল ক্যান্ডিডেট থাকে যখন কোটা পূরণ করার জন্য অন্যান্য ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ নেয়া হয়ে থাকে। যা হোক একসময় যখন দু’সপ্তাহ শেষ হল, তখন আমার সেই কাউন্সিলর তরুণীটি আমাকে ‘গুডউইল জব শপ’ নামক আরেকটি ‘এইচআরডিসি’ সেন্টারে যেতে রিকমেন্ড করল।

পরামর্শ অনুযায়ী একদিন টিটিসি-এর বাসে চেপে হাজির হলাম কেনেডি এবং এগলিংটন ইন্টারসেকশনে অবস্থিত ‘গুডউইল জব শপ’-এ। দু’সপ্তাহের একটি কোর্সে অংশ নেয়ার রেজিট্রেশন করে ফেললাম এখানে। রেজিট্রেশনের নিয়মকানুন অনেকটা ‘পিসিপিসি’-এর মতন, তবে কোর্সের বিষয়বস্তু অনেক ভার্সেটাইল। আমার সঙ্গে প্রায় পনেরজন এই কোর্সে অংশ নিচ্ছে যাদের সবাই আমার মতন নতুন ইমিগ্র্যান্ট, একজন বাদে। ইন্ডিয়া থেকে আসা সে নাকি তিন বছর আগে এসেছে। অবশ্য ‘এইচআরডিসি’-এর গাইডলাইন অনুসারে যারা পাঁচ বছরের ভিতর কানাডা এসেছে তারা নতুন ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে বিবেচ্য। আমাদের কোর্স ইন্সট্রাক্টর দু’জন -দু’জনেই অবশ্য আমাদের মতন ইমিগ্র্যান্ট তবে বেশ অনেক বছর আগে আসা। একজন ইন্ডিয়া থেকে আসা, তার নাম গীতা যে আমাদের সকালের সেশন নিবে। আরেকজন ইথিওপিয়া থেকে আসা, প্রায় চৌদ্দ বছর পর নামটা আর মনে নেই। সেই ভদ্রলোক আমাদের বিকালের সেশন নিবে। প্রথম দিন কেটে গেল নিজেদের পরিচয় দিতে আর সেই সাথে অন্যান্য কোর্সমেটদের সাথে পরিচিত হতে। প্রথমদিনে ইথিওপিয়ান ইন্সট্রাক্টর আমাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিল কেন আমরা ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডাতে এসেছি। চিরাচরিত প্রশ্নের উত্তর অনেকটা মুখস্থ পড়া বলার মতন করেই সবাই দিল, সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্যই এদেশে আসা। এমন উত্তরই হয়ত সে মনে মনে আসা করছিল। তবে তার একটি মন্তব্য আমার খুব মনে ধরেছিল। সে বলেছিল, তোমরা যদি কানাডাতে তোমাদের ক্যারিয়ার গড়তে না পার তবে তোমাদের স্বপ্ন হয়ত পূরণ নাও হতে পারে।

গুডউইলের সেশনগুলি ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং এবং প্রাণবন্ত। এখানে রেজুমি কিভাবে ঠিক করতে হবে সেটার উপর বেশী সময় না দিয়ে বরং কিভাবে ইন্টারভিউ দিতে হবে কিংবা কানাডিয়ান কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন হবে অথবা কর্মক্ষেত্রে কিভাবে সহকর্মীদের সাথে মিশতে হবে এগুলোই নিয়ে বেশী আলোচনা হত। এমন এক পজিটিভ পরিবেশ তৈরি করা হত যেন আমাদের প্রত্যেকেরই ‘জব’ পাওয়া সারা, এখন সেটা কিভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে কিংবা ক্যারিয়ারের সিঁড়ি বেয়ে কিভাবে উপরে উঠতে হবে সেটা নিয়েই এতসব কর্মশালার আয়োজন। আমাদের সেশনগুলিতে বাইরে থেকে বেশ কিছু এক্সপার্ট আনা হতো যারা আমাদের সাথে বিভিন্ন ধরণের কেস হিস্ট্রি শেয়ার করত, যা মূলত একজন নতুন ইমিগ্র্যান্ট কিভাবে কানাডিয়ান ওয়ার্কফোর্সে সহজ এবং সাবলীলভাবে প্রবেশ করতে পারে সেটার উপর জোর দিয়ে। গুডউইল আমাদেরকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিল সেটা হলো আমাদের শিক্ষাগত ডিগ্রীর একটা কানাডিয়ান রেকগনিশেন নেয়া। আমি সেই পরামর্শ মোতাবেক আমার ডিগ্রীগুলির কানাডিয়ান সমমানের ডিগ্রীর সার্টিফিকেশন নিয়ে রেখেছিলাম যা পরবর্তীতে আমার বিশেষ কাজে এসেছিল। এই সময় গুডউইল বেশ কিছু ‘জব এজেন্সী’কেও আমাদের কর্মশালাতে আমন্ত্রণ জানায় যারা কিনা আমাদের রেজুমি আগ্রহের সাথে সংগ্রহ করে তাদের ডাটাবেইজে যুক্ত করে। পরবর্তী সময়ে আমি এক ইন্টারভিউ-এর ডাক পাই যেখানে আমি আবেদনই করিনি। আবার সেই ইন্টারভিউ দিয়ে আমি কানাডাতে আমার প্রথম জবটি বাগিয়ে ফেলি। পরে জানতে পারি যে আমার সেই এমপ্লইয়ার যে জব এজেন্সীর মাধ্যমে আমার রেজুমিটি পায় সেই জব এজেন্সী গুডউইল থেকে আমার রেজুমিটি সংগ্রহ করেছিল। যথাসময়ে সেই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

গুডউইল থেকে প্রথম যে শিক্ষাটি পেয়েছি সেটা হলো এদেশে কোন কাজকেই ছোট করে দেখা হয় না। কাজের ধরণ কিংবা পদমর্যাদা দিয়ে কাউকে বিচার করা হয় না। তাই একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী সহজেই গর্বের সাথে তার কাজের ধরণ বর্ণনা করতে পারে এই বলে যে, এই শহরকে ঝকঝকে তকতকে রাখাই তার কাজ। একথা সত্য যে আমাদের অনেকেরই পক্ষে কর্মক্ষেত্রের পদমর্যাদার সাথে সামাজিক মর্যাদার সামানুপাতিক হিসেব থেকে বের হয়ে আসাটা বেশ কঠিন। গুডউইল থেকে দ্বিতীয় যে শিক্ষাটি পেলাম সেটা হলো সামাজিক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করা এবং সেটাকে কাজে লাগানো। এ প্রসংগে কোর্স ইন্সট্রাক্টর গীতা এক কেস হিস্ট্রি আমাদের সাথে শেয়ার করেছিল। ইন্ডিয়া থেকে আসা এক আইটি প্রফেশনাল তার লাইনে কোন জব পাচ্ছিল না। অগ্যতা সে হেয়ার সেলুনে কর্মরত তার স্ত্রীর সহকারী হিসেবে সেখানকার ফ্লোর ক্লিন করার কাজ নিল। সেই সেলুনে এক বাঁধা কাস্টমারের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে সে জানাল যে সে আসলে আইটি প্রফেশনাল কিন্তু বর্তমানে সারভাইভালের জন্য ফ্লোর পরিস্কারের কাজ করছে। সেই কাস্টমারটি কাজ করত আইবিএম-এ, সে তার জন্য একটা ইন্টারভিউ-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তারপর থেকে সেই আইটি প্রফেশনালকে আর ফ্লোর পরিস্কারের কাজ করতে হয়নি।

এই সময় সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একটা ইন্টারভিউ-এর সুযোগ আমার এসেছিল। সেই সুযোগটা আমি পুরোপুরি কাজে লাগাতে না পারলেও সেখান থেকে যে শিক্ষাটা আমি পেয়েছিলাম, সেটা অবশ্য পরবর্তীতে পুরোটাই আমি কাজে লাগিয়ে হাতে হাতে ফল পেয়েছি। কোন এক হাউজ পার্টিতে আমার সেই ‘দেবদূত’-এর মতন আভির্ভূত বন্ধু গোলাম ফারুক ‘রিম’-এ (যা বর্তমানে ‘ব্ল্যাকবেরী’) কর্মরত তার বুয়েটের এক সহপাঠীর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। কথা প্রসঙ্গে আমি যে নতুন এসেছি এবং ‘সফটওয়্যার ডেভেলপার’-এর চাকরী খুঁজছি জানতে পেরে সে আমার রেজুমি চাইল। তাকে আমার রেজুমি ই-মেইলে পাঠানোর দুই একদিন পরই আমি ‘রিম’-এর হিউম্যান রিসোর্স থেকে একটা ফোন পেলাম। আমার নাম-ধাম, ‘রিম’-এ কেন চাকরী করতে আগ্রহী ইত্যাদি জিজ্ঞেস করার পর হিউম্যান রিসোর্সের মহিলাটি আমাকে জানাল যে সে শীঘ্রই আমার টেকনিক্যাল ইন্টারভিউ-এর ব্যবস্থা করবে। তবে ইন্টারভিউটি হবে কনফারেন্স কলের মাধ্যমে। আগে কোনদিন টেলিফোনে ইন্টারভিউ দেইনি, তাই দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করতে লাগলাম ইন্টারভিউ-এর জন্য। এক সময় ইন্টারভিউ-এর দিনক্ষণ এসে উপস্থিত হলো। আমার সেলফোনের প্ল্যান অনুযায়ী ইনকামিং এবং আউটগোইয়িং দু’রকম কলেরই বরাদ্দকৃত সময়সীমা অতি অল্প। সেই সময়সীমা অতিক্রম করে কথা চালালে যে আর্থিক দন্ড দিতে হবে সেটা আমার জন্য মোটেই সুখকর হবে না। তাই হোম ফোন দিয়েই কল দিলাম ইন্টারভিউ-এর জন্য। আমার জানা ছিল না যে এই ইন্টারভিউ প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে হবে। স্পীকারে না দিয়ে এই পুরো দেড় ঘণ্টা আমি সেই ভারী ফোন আমার কানে লাগিয়ে রেখেছিলাম, ফলে ইন্টারভিউ শেষে আমার বাম হাত প্রায় অবশ হয়ে গিয়েছিল। আর ইন্টারভিউ-এর ধকলে আমার মনও একই সাথে অবশ, মনে হলো এক বিরাট ঝড় বয়ে গেল। আমি প্রায় দশ বছরের মতন সিঙ্গাপুরে সফটওয়্যার ডেলেপমেন্ট নিয়ে কাজ করেছি একাডেমিক পরিসীমায়। আমার মাস্টার্সের থিসিস ছিল ‘ইন্টেলিজেন্ট টিউটরিং সিস্টেম’। থিসিসের জন্য আমাকে একটি থ্রী-টিয়ার ওয়েববেইজড টিউটরিং সিস্টেম তৈরি করতে হয়েছিল ‘জাভা ল্যাঙ্গুয়েজ’ দিয়ে। সিঙ্গাপুরে আমি যখন এক ইনস্টিটিউট থেকে আরেক ইনস্টিটিউটে চাকরীর জন্য ইন্টারভিউ দিতাম তখন তারা আমার রিসেন্ট প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করত আর দেখত আমি কিভাবে তাদের প্রজেক্টে কন্ট্রিবিউট করতে পারব। কিন্তু ‘রিম’-এর ইন্টারভিউ শুরুই হলো একেবারে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর বেসিক কন্সেপ্ট দিয়ে -‘হোয়াট ইজ দি ডেফিনিশন অব অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং?’। পাক্কা দেড় ঘণ্টায় তারা আমাকে গলদঘর্ম করে ছাড়ল। ইন্টারভিউ শেষে আমি বুঝতে পারলাম যে আমাকে আবার টেক্সটবুক নিয়ে বসতে হবে, কারণ আমি যে সেই কেঁচে গণ্ডূষ করে আমার ক্যরিয়ার এখানে গড়তে বসেছি, আমাকে যে এন্ট্রি লেভেলের জব-এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। ‘রিম’-এর সেই ইন্টারভিউ বোর্ডের কাছে আমি ঋণী কারণ তারা আমাকে সেটা সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল।

(চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো