জুলি বিদায় নিলেন পেশাজীবনে এক অমোচনীয় কলঙ্কের দাগ রেখে


খুরশিদ আলম

অবশেষে গভর্নর জেনারেল এর পদ থেকে বিদায় নিলেন জুলি পায়েট। কিন্তু বিদায় নেওয়ার আগে তিনি তাঁর পেশাজীবনের ইতিহাসে রেখে গেলেন কলঙ্কের এক অমোচনীয় দাগ। বাকি জীবন তাকে কলঙ্কের এই বোঝা নিয়েই দিন অতিবাহিত করতে হবে।
২০১৭ সালে জুলি পায়েট-কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কানাডার গভর্নর জেনারেল এর পদে। অত্যন্ত সম্মানজনক এক পদ এটি। এ পদে যারা থাকেন তাঁরা কানাডায় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর প্রতিনিধি। দ্বিতীয় এলিজাবেথ মূলত বৃটেনের রানী হলেও কানাডার সংবিধান অনুযায়ী তিনি এদেশেরও রাষ্ট্র প্রধান। গভর্নর জেনারেল সেই রাষ্ট্র প্রধানের প্রতিনিধি হিসাবে কানাডার সাংবিধানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুমোদন দিয়ে থাকেন।
এই ‘রানী এবং রানীর প্রতিনিধি গভর্নর জেনারেল’ এর পুরো বিষয়টি আসলে ব্রিটিশ কলোনিয়ালইমজ এর ‘হেরিডিটি’ বা বংশগতি-কে টিকিয়ে রাখার একটি চেষ্টা। এ নিয়ে কানাডায় যথেষ্ট বিতর্কও রয়েছে। অনেকেই এই প্রথাটিকে বাদ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় মত প্রকাশ করেছেন। জুলি পায়েট এর কান্ডকীর্তির পর নতুন করে আবার সেই দাবী বিভিন্ন মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন অনেকেই। কিন্তু যতদিন এই প্রথা কানাডার সংবিধানে স্বীকৃত ততদিন পর্যন্ত রানী আর গভর্নর জেনারেল এর পদমর্যাদাকে মেনে নিতে হচ্ছে কানাডিয়ানদেরকে।
উল্লেখ্য যে, জুলি পায়েট এর বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল সম্প্রতি। আর সেই অভিযোগসমূহ প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছিল সেগুলোর মধ্যে আছে- তিনি অধস্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে চরম অসভ্যতা ও দুর্ব্যবহার করতেন। প্রায়শই অফিসে তাঁর অধস্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি করে কথা বলতেন, তাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন এবং জনসমক্ষে তাদেরকে অপদস্থ করতেও ছাড়তেন না। কাগজপত্র ছুড়ে ফেলা এবং অশোভন শব্দ ব্যবহার করার অভিযোগও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। এবং সর্বোপরি গভর্নর জেনারেল এর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারার অভিযোগও উঠে তাঁর বিরুদ্ধে।

গভর্নর জেনারেল এর পদ থেকে বিদায় নিলেন জুলি পায়েট। কিন্তু বিদায় নেওয়ার আগে তিনি তাঁর পেশাজীবনের ইতিহাসে রেখে গেলেন কলঙ্কের এক অমোচনীয় দাগ। ছবি: জাস্টিন টাং /দি কানাডিয়ান প্রেস


আর শুধু জুলি পায়েট-ই নন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর সেক্রেটারী ও দীর্ঘদিনের বন্ধু আসুন্তা ডি লরেঞ্জো’র বিরুদ্ধেও।
গভর্নর জেনারেল এর এহেন কর্মকান্ডের রিপোর্টটি গত বছর মাঝামাঝি সময়ে সিবিসি নিউজে প্রকাশ হবার পর সর্বত্রই নিন্দার ঝড় উঠেছিল। সেদিন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন অনেকেই। কেউই ভাবেননি গভর্নর জেনারেল এর কার্যালয়ে এমন বিষাক্ত কর্ম পরিবেশ বিরাজ করছে। ঐ সময় বিরোধী দল এনডিপি’র প্রধান জাগমিত সিং বলেছিলেন, ‘‘ট্রুডো সরকারের উচিৎ গভর্নর জেনারেল জুলি পায়েট এর বিরুদ্ধে কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের যে অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত করে দেখা।’’ পার্লামেন্টে তিনি আরো বলেছিলেন, “গভর্নর জেনারেল এর অফিসের কর্মচারী ও কর্মকর্তাগণ যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা অত্যন্ত যন্ত্রণাপ্রদ এবং প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা রয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য।”
বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। পার্লামেন্টে তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি সরাসরি তাঁর উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন, “হয়রানি থেকে মুক্ত একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর্মক্ষেত্রে কাজ করার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক কানাডিয়ানের এবং এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালে জরফবধঁ ঐধষষ এর কর্মীদের উপর পরিচালিত এক জরিপেও দেখা গিয়েছিল গভর্নর জেনারেল এর অফিসে কর্মরত লোকজন তাঁদের কর্মস্থলের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। সিটিভি নিউজ জানায়, ঐ জরিপে শতকরা ২২ জন বলেছিলেন, বিগত বছরে তাঁরা চাকরীতে হয়রানির শিকার হয়েছেন এমনটা তাঁরা অনুভব করেছেন। আর জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৭৪ জন বলেছিলেন তাঁরা তাদের উপর কর্তৃত্বকারী কারো না কারো দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন।
সিবিসি নিউজকে ইতিপূর্বে একটি সূত্র জানিয়েছিল, কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মীগণ তাদের ম্যানেজারের কাছে হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ করতে গেলে ম্যানেজারগণ তাদের অপারগতা প্রকাশ করে কর্মীদের বলতেন, তিনি নিজেও ঐ রকম হয়রানির শিকার।
জুলি পায়েট এর বিরুদ্ধে অধস্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি অসভ্য আচরণের অভিযোগ উঠার পর টরন্টো স্টার পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, “এটি একটি কুৎসিত চিত্র; আর যদি ঘটনা সত্য হয় তবে শুধু জরফবধঁ ঐধষষ এর কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য তা শুধু অন্যায্যই নয়, কানাডার আইনেও সেটি অবৈধ।”
এই অবৈধ কাজটি জুলি পায়েট যে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই করে আসছিলেন সেটি পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সত্য প্রমাণিত হয়। এবং এর পরই তিনি গভর্নর জেনারেল এর পদ থেকে গত জানুয়ারী মাসের ২১ তারিখে পদত্যাগ করেন। কিন্তু রেখে যান কলঙ্কের এক গভীর দাগ। একই সাথে পদত্যাগ করেন জুলি পায়েট এর সেক্রেটারী ও বন্ধু আসুন্তা ডি লরেঞ্জো-ও। জুলি পায়েট এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনিও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন।
গত বছর জুলি পায়েট এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠার পর প্রিভি কাউন্সিল অফিস এর পক্ষ থেকে একটি স্বতন্ত্র পরামর্শ সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য। কয়েক মাস তদন্ত করে ঐ সংস্থা সম্প্রতি যে রিপোর্ট জমা দেয় তাতে দেখা যায় উত্থাপিত অভিযোগসমূহ ছিল সত্য। তখন জুলি পায়েট প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পরে সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি তাঁর পদত্যাগের কথা প্রকাশ করেন এবং তাঁর কর্মস্থলে তাঁর ভাষায় সাম্প্রতিক সময়ে যে ‘উত্তেজনা’ বিরাজ করছিল তাঁর জন্য ক্ষমা চান। তিনি এও বলেন যে, “একটি স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ কর্ম পরিবেশে কাজ করার অধিকার রয়েছে প্রত্যেকেরই।”
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এই অধিকারের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি বা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। অধস্তনদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছেন। তাঁদেরকে চরমভাবে অপমান করেছেন।
এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, এমন একজন ব্যক্তি যার আচরণগত সমস্যা রয়েছে, যিনি ক্ষমতার সুযোগে অধস্তনদের সঙ্গে অশোভন ব্যবহার করতেন, তাঁদের অপদস্থ করতেন, মৌখিকভাবে নিপীড়ন করতেন তিনি কি করে গভর্নর জেনারেল এর মত একটি দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন? নিয়োগের আগে কেন তাঁর অতীত ইতিহাস যথাযথভাবে অনুসন্ধান করে দেখা হয়নি?
জুলি পায়েট এর পদত্যাগের পর পরবর্তী গভর্নর জেনারেল কে হবেন সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্যান্য দলের সঙ্গেও আলোচনার আহ্বান জানান কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান এরিন ও’টুল। তিনি বলেন, গভর্নর জেনারেল আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং তিনি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়েও ভূমিকা রাখেন। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর উচিত বিরোধী দলের সঙ্গে এ নিয়ে পরামর্শ করা এবং গভর্নর জেনারেল ও লেফটেনেন্ট গভর্নর জেনারেল পদে কাউকে নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে আগে যে প্রক্রিয়া ছিল তা পুন:স্থাপন করা।
উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালে স্টিফেন হারপারের নেতৃত্বাধীন বিগত কনজার্ভেটিভ সরকারের আমলে গভর্নর জেনারেল ও লেফটেন্টে গভর্নর জেনারেল পদে নির্দলীয় পরামর্শ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাউকে নির্বাচিত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু লিবারেল সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১৭ সালে তা বিলুপ্ত করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য বলেছেন তাঁর সরকার পরবর্তী গভর্নর জেনারেল পদের জন্য কাউকে মনোনিত করার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া আরো জোরদার করার দিকে নজর দিচ্ছে। তিনি বলেন, জুলি পায়েটকে নিয়োগ দেওয়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বর্তমান যে প্রক্রিয়া আছে তা অনুসরণ করা হয়েছিল। বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে তিনি একথা বলেন। জুলি পায়াট-কে নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে ছিল তখনও প্রধানন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর পক্ষ সমর্থন করার জন্য বলেছিলেন, “জুলি পায়াট একজন শ্রেষ্ঠগুণসম্পন্ন গভর্নর জেনারেল। তাকে ঐ পদ থেকে স্থানান্তরিত করার কোন পরিকল্পনা আপাতত নেই।”
কিন্তু সিবিসি নিউজ জানায়, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং তাঁর অফিসের কর্মকর্তাগণ কখনোই জুলি পায়াটের অতীত কর্মস্থলের রেকর্ড জানতে চাননি গভর্নর জেনারেল হিসাবে তাঁর নিয়োগ চুড়ান্ত করার আগে। গভর্নর জেনারেল পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি মন্ট্রিয়ল সায়েন্স সেন্টার এবং কানাডা অলিম্পিক কমিটিতে কর্মরত ছিলেন। বিভিন্ন সূত্র সিবিসি নিউজকে জানায়, জুলি পায়াটের নিয়োগ চূড়ান্ত করার আগে ঐ দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে হয়তো আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। কারণ সেখান থেকে তাঁর আচরণগত সমস্যার কথা জানা যেত। তিনি যে ঐ দুটি প্রতিষ্ঠানেও সহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন তাও জানা যেত।
সিবিসি নিউজের রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায় যে, গভর্নর জেনারেল পদে দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র অল্পকিছুদিন আগে (২০১৬ সালে) মন্ট্রিয়ল সায়েন্স সেন্টার থেকে তাকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছিল অধস্তনদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য। এছাড়াও যে বছর (২০১৭) তিনি গভর্নর জেনারেল পদে নিয়োগ পান সে বছরই শুরুর দিকে তাকে কানাডিয়ান অলম্পিক কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল যখন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে যে তিনি অধস্তÍনদের সঙ্গে অশোভন ব্যবহার করেছেন এবং মৌখিকভাবে নিপীড়ন করেছেন।
একবার জুলি পায়েট একজন মহিলা কর্মীকে এমন তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন যে তা সহ্য করতে না তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে জুলি পায়াটের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো-তে ২০১৬ সালের অলিম্পিক গেম এর সময়। অলিম্পিক কমিটির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তদের কয়েকজনই সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। সেদিন রিও ডি জেনিরো-তে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন জুলি পায়েট ও তাঁর ছেলে। ঐ অনুষ্ঠানটিতে তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়েছিলেন। অলম্পিক কমিটির সদস্য হিসাবে নয়। অনুষ্ঠান শেষে তিনি রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন অলম্পিক কমিটির গাড়ি এসে তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে নিয়ে যাবে এই জন্য। কিন্তু গাড়ি আসতে একটু দেরী হয়েছিল সম্ভত। আর এ জন্য রেগে তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, রাস্তার ঐ দুষিত বাতাসের মধ্যে দাড়িয়ে থাকাটা স্বাস্থ্যসম্মত ছিল না এবং তা ছিল অকল্পনীয়।
কানডিয়ান অলিম্পিক কমিটির একজন সাবেক কর্মী বলেন, “অফিসের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা তাকে কোনভাবেই খুশি করতে পারতেন না। তিনি যখন তখন হঠাৎ করেই রেগে উঠতেন।
কর্মস্থলে অধস্তন সহকর্মীদের সঙ্গে এরকম যখন তখন রেগে উঠার অভ্যাস বা অশোভন ব্যবহার করার অভ্যাস জুলি পায়াট এর আরো আগে থেকেই ছিল। সিবিসি নিউজ জানায়, গত শতকের নব্বুই দশকে যখন তিনি কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সিতে কাজ করতেন তখনও তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে এমন কিছু আচরণ করেছিলেন যার কথা আজো অনেকে মনে রেখেছেন। তাঁদের কয়েকজন বলেছেন, জুলি পায়াট এর সঙ্গে পুনরায় সংস্রবের কোন ন্যুনতম ইচ্ছাও নেই তাঁদের। জুলি পায়েট নাকি ছুটির দিনেও অথবা কর্মদিবসে সন্ধ্যার পরেও কর্মীদের বাড়িতে ফোন দিতেন গালাগাল কারার জন্য।
কানাডার একটি অনলাইন নিউজপেপার ‘রচড়ষরঃরপং’ ২০১৭ সালে একটি সংবাদ প্রকাশ করে জুলি পায়েট-কে নিয়ে। ঐ সংবাদে বলা হয় ২০১২ সালে তিনি যখন মেরিল্যান্ডে বাস করতেন তখন তাঁর বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেকেন্ড ডিগ্রী আক্রমণের একটি অভিযোগ গঠন করেছিল। পরে অবশ্য সেই অভিযোগ থেকে তাঁকে রেহাই দেওয়া হয়। অন্যদিকে টরন্টো স্টার এক রিপোর্টে জানায় ঐ মেরিল্যান্ডেই গাড়ি চালানোর সময় ২০১১ সালে এক পথচারীকে আঘাত করেন তিনি এবং সেই ব্যক্তি মারা যান। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও তদন্ত শেষে পুলিশ জুলি পায়াটের বিরুদ্ধে কোন দোষ খুঁজে পায়নি।
উল্লেখ্য যে, সহকর্মীদের সঙ্গে অভদ্র আচরণ করা বা তাদেরকে গালমন্দ করার স্বভাবই যে শুধু জুলি পায়াটের ছিল তা নয়। তিনি অতিমাত্রায় অহংকারী বা দাম্ভিকও ছিলেন যা তাঁর অন্যান্য কর্মকান্ডে প্রকাশ পায়। মূলত গভর্নর জেনারেল এর দায়িত্ব পাবার পর থেকেই জুলি পায়েট ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকেন। তাঁর আচার আচরণ হয়ে উঠে আরো অহংকারী ও উদ্ধত ব্যক্তির মত। তিনি সরকারী অর্থেরও যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। গভর্নর জেনারেল এর দৃষ্টিনন্দন সরকারী বাসভবন ও কার্যালয় জরফবধঁ ঐধষষ এ তিনি সাধারণ মানুষের প্রবেশ পছন্দ করতেন না। এ কারণে জরফবধঁ ঐধষষ এ তিনি তাঁর নির্জনতা বজায় রাখার জন্য সরকারের তথা জনগণের টেক্স মানির কয়েক লক্ষ ডলার ব্যয় করেছেন সংস্কারের জন্য। এই প্রকল্পে প্রায় দেড় লক্ষ ডলার ব্যয় করা হয় একটি প্রাইভেট সিড়ি নির্মাণ কাজের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। কিন্তু সেই সিড়ি আর নির্মাণ করা হয়নি। এছাড়াও আরো প্রায় সোয়া লক্ষ ডলার ব্যয় করা হয় একটি প্রবেশদ্বার এবং কয়েকটি দরজা নির্মানের জন্য যার মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে তাঁর অফিস থেকে দূরে সরিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, এই জরফবধঁ ঐধষষ এর বিশাল সবুজ চত্বরে সাধারণ নাগরিকেরা গ্রীষ্মকালে ঘুরতে আসেন। এটি সাধারণ মানুষের জন্য খোলা থাকে। এখান পিকনিক, খেলাধূলাসহ আরো নানান বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে থাকেন স্থানীয় জনগণ। পর্যটকরাও আসেন ভবনটি দেখতে। কিন্তু জুলি পায়েট এর পছন্দ ছিল না জনগণের এই আনাগোনা। সিবিসি নিউজকে একটি সূত্র জানায়, জুলি পায়েট চাইতেন তাঁর আসা যাওয়া যেন কোন সাধারণ মানুষের চোখে না পড়ে। এমনকি জরফবধঁ ঐধষষ এর কোন রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীও না। আরো আশ্চার্যের বিষয় হলো, তাঁরই নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আরসিএমপি’র কোন কর্মীকেও তিনি তাঁর আসা যাওয়া পথে দেখতে চাইতেন না। তাঁদের উপর নির্দেশ ছিল তাঁরা যেন সরাসরি তাঁর অফিসের সামনের দরজার কাছে প্রহরার জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে হলওয়ের পাশে একটি রুমে অবস্থান করেন যাতে করে তাঁরা তাঁর চোখে না পড়েন।
তিনি তাঁর পালিত বিড়ালের জন্য হেরিটেজ ভবন হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দৃষ্টিনন্দন জরফবধঁ ঐধষষ এর নকশাও পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন দোতলায় একটি আলাদা দরজা বানিয়ে যে দরজা দিয়ে তাঁর বিড়াল বাইরে আসা যাওয়া করতে পারবে।
অধস্তনদের সঙ্গে অভদ্র আচরণ করা বা তাদেরকে গালমন্দ করার স্বভাব সম্ভবত জুলি পায়াট এর অস্তিমজ্জায় গাঁথা আছে। আর সেই জুলি পায়াট-কে যখন কানাডার গভর্নর জেনারেল এর পদে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন অনেকেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা প্রধানন্ত্রীর ঐ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রশ্নও তুলেছিলেন।
একটি সুসভ্য দেশে কেউ অসভ্যতা করবেন এটি কারোরই কাম্য নয়। হোক তিনি রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কেউ অথবা খোদ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানন্ত্রী। কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড বর্ণবাদের মত একটি জঘন্য অসভ্যতাকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন এবং নিজেও ছিলেন চরম বর্ণবাদী। আজ এত বছর পরে হলেও সেদিনের সেই অসভ্যতার ফল তিনি পাচ্ছেন। তাঁকে আজ নিন্দা জানানো হচ্ছে। তাঁর সম্মানে স্থাপন করা ভাস্কর্যসমূহ সরানোর জোর দাবী উঠছে দেশজুড়ে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে ইতিমধ্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে তাঁর ভাস্কর্য। তাঁর নামে নামকরণ করা বিভিন্ন স্কুলের নাম বদল করার দাবীও উঠেছে। এ সবই তাঁর অতীত অসভ্যতার ফল।
জুলি পায়াট-ও অসভ্যতা করেছেন। অসভ্যতা করে তিন পদ হারিয়েছেন। নিন্দার ঝড় উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। আর এ কারণে টরন্টোর নিকটবর্তী ডারহাম সিটির স্কুল বোর্ড জুলি পায়াটের সম্মানে নামকরণ করা একটি স্কুলের নাম বদল করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। খুব শীঘ্রই বোর্ড কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানা গেছে।
মানুষ তাঁর কর্মফল এভাবেই পায়। এটাই জাগতিক নিয়ম। কিন্তু কেউ এ থেকে শিক্ষা নেয়, আর কেউ নেয় না।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ