কাহিনী বিচিত্রা
সাইদুল হোসেন
ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১
হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান সমাচার
প্রথম কাহিনী : রাম রহিম
আমাদের হসপিটালে চিকিৎসার জন্য আসা পেশেন্টদের মাঝে বেশ কিছু পরিমাণ গায়ানীজ-ক্যানাডিয়ানের দেখা পাওয়া যায় যাদের নাম থেকে সহজেই ওদের ইন্ডিয়ান ওরিজিন এবং হিন্দুত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। এদের পূর্বপুরুষগণকে দেড়শ’ বছর পূর্বে বৃটিশ সরকার ইন্ডিয়া থেকে কৃষি শ্রমিক হিসাবে গায়ানা (South America) নিয়ে এসেছিল। কিছু নামের দৃষ্টান্ত-
রাম গোপাল, রাম পেরসাউদ, রাম সহায়, রাম গোলাম, রাম সেভক, রাম রত্তন, রাম জত্তন, রাম পিয়ারী (নারী), রাম দুলারী (নারী)
কিন্তু রাম রহিম?
এই ব্যক্তি হিন্দু না মুসলিম?
জিজ্ঞাসা করলাম ঃ স্যার, যদি অপরাধ না নেন তাহলে জিজ্ঞাসা করতে চাই, আপনি হিন্দু না মুসলিম?
– আমি হিন্দু, বললেন তিনি।
– রহিম তো মুসলিম নাম, সেটা তাহলে আপনার নামের অংশ কেন? জানতে চাইলাম আমি।
আমার প্রশ্ন শুনে তিনি হাসলেন। বললেন, রহিম চাচা ছিলেন আমার বাবার অন্তরংগ বন্ধু, দু’জনকে আলাদা করে কদাচিৎ দেখা যেতো। আমার জন্মের আগের কথা, মায়ের মুখে শোনা। আমাদের দু’পরিবার ছিল একই পরিবারের মত, উৎসবে-আনন্দে, বিপদে-বিষাদে একাত্ম, ধর্মীয় বিভেদের কোন স্থান ছিল না দুই পরিবারের মাঝে। রহিম চাচা ছিলেন বাবার স্কুল-কলেজে সহপাঠী, পরিণত বয়সে বুদ্ধিপরামর্শদাতা, সময়ে-অসময়ে অর্থ সাহায্যদাতা, মাবাবার মাঝে দাম্পত্যকলহ মিটমাটকর্তা এবং আরো অনেক কিছু।
তাই মা যখন প্রেগন্যান্ট বাবা হঠাৎ একদিন মাকে বললেন ঃ তোমার যদি ছেলে হয় তাহলে ওর নাম রাখবো রহিম।
মা খুব অবাক হননি, তিনি দু’জনের বন্ধুত্বের গভীরতার খবর রাখতেন। তিনি বললেন ঃ তোমার না হয় এই নামটা পছন্দ কিন্তু তোমার মা-বাবা? হিন্দু সমাজ? ওরা কি বলবে? ওরা মেনে নেবে কি?
বাবা বললেন : তোমার কথাটা অবশ্য সত্য। তবে বড় কথা হলো আমি আমার ছেলেকে হিন্দু হিসাবেই মানুষ করবো, গড়ে তুলবো, এই আশ্বাস তাদেরকে দেবো। ছেলেকেও তাই বুঝাবো। আর ওকে তো আমরা রহিম বলে ডাকবো না, অন্য একটা হিন্দু নামে ডাকবো, শুধু কাগজে “রহিম” নামটা থাকবে। রহিমকে আমি ভুলতে চাই না। বাবার যুক্তি মা মেনে নিলেন কারণ রহিম চাচাকে তিনিও খুব পছন্দ করতেন। বাবার আবেগকে তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না।
অতএব জন্মের পর আমার নাম রাম রহিমই রাখা হলো; পরিবার বা সমাজ শুরুতে খানিকটা আপত্তি উঠালেও ক্রমে চুপ হয়ে গেলো। ওদিকে আমি “গোপাল” নামে পরিচিত হয়ে বড় হতে লাগলাম।
দ্বিতীয় কাহিনী : I am a good Muslim
নাসিরা রামধন
সেই হসপিটালেরই একজন এমপ্লয়ি। মহিলা। তার Hospital ID Card এ নাম লেখা রয়েছে Nasira Ramdhon. গলার সোনার লকেটে আরবী ভাষায় লেখা NASIRA.
জিজ্ঞাসা করলাম ঃ আপনার প্রথম নামটা (নাসিরা) তো মুসলিমদের মত কিন্তু পরেরটা “রামধন” তো হিন্দুদের মত। আপনি আসলে কোন ধর্মের লোক?
তিনি বললেনঃ আমি মুসলিম। আমাদের পারিবারিক নাম ছিল রমজান (Ramzan)। কিন্তু বহুদিন আগে কেমন করে আমার জানা নেই Ramzan-টা mmigration papers-এ Ramdhon হয়ে গিয়েছিল যা আর বদলানোর চেষ্টা করা হয়নি। সেই থেকেই আমরা “রামধন”। Confusion is there, but still we are Muslims
বললামঃ শুনে আশ্বস্ত হলাম। ধন্যবাদ।
এবার অন্য প্রসংগে গেলাম। বললামঃ পারিবারিক নাম তো বললেন রমজান। এবার বলুন তো গত রমজানে fasting করেছেন?
– না, করিনি, করতে পারি না, খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি fasting করলে।
– সালাত অর্থাৎ daily five times prayer করেন? আবার প্রশ্ন করলাম।
– করি তবে পাঁচবার পারি না, নানা কারণে হয়ে উঠে না। But even then I am a good Muslim.
তৃতীয় কাহিনী ঃ Akil Visram
এবার শুনুন Akil Visram-এর কথা।
পনর বছর বয়সী এক পেশেন্ট এলো, নাম তার Akil Visram. সংগে ওর মা। জানতে চাইলামঃ আকিল, তোমার নামে মুসলিম এবং হিন্দু দু’ধরণেরই প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। এমনটা কেন?
আকিল বললঃ আমি মুসলিম, মা-ও মুসলিম, বাবাও মুসলিম। দাদা ছিলেন হিন্দু, পারিবারিক নাম ছিল তাঁদের Visram. তিনি মুসলিম হয়েছিলেন বটে কিন্তু Visram পদবীটা ছাড়েননি। তাই মুসলিম হওয়া সত্বেও আমাদের last name -টা Visram .
চতুর্থ কাহিনীঃ Soft-core Muslim
Omar Jose
আজ ক্লিনিকে তার মায়ের সংগে আসা এক অল্প বয়সী ছেলের সংগে কিছু কথাবার্তা-
আমার নাম Omar Jose. আমার বাবা একজন Portuguese Catholic Christian. মা মুসলিম। তাই আমার ফাস্ট নেইম Omar. বাবা Trinidad-এর বাসিন্দা, ওখানেই মায়ের সংগে পরিচয়, ভালোবাসা, বিয়ে। মা এখনো মুসলিম। বাবার কোন আপত্তি নেই। মা ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি তেমন পালন করে না। তবে আমাকে কিছু কিছু শেখায় বটে।
জিজ্ঞাসা করলামঃ ওমার, তুমি নিজেকে কি ভাব- খৃষ্টান অথবা মুসলিম?
– আমি নিজেকে একজন মুসলিম বলে মনে করি। Pork খাইনা, alcohol পছন্দ করি না। আল্লাহ’তে বিশ্বাস করি, মানি।
– ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তুমি কি জানো?
– I am not a hard-core Muslim, don’t know much about Islam. I am a soft-core Muslim, trying to know the basics of Islam. I am only 15 years old.
.
-Qur’an-এর নাম শুনেছ? Five times daily prayers এর কথা জানো কি?
– Prayer করি না, মা শেখায়নি। Qur’an -এর নাম শুনেছি কিন্তু সেটা কখনো দেখিনি বা পড়িনি, বললো ওমার।
– Qur’an- এর very easy English translation এক কপি যদি তোমাকে দিই তুমি কি সেটা পড়তে রাজী আছ?
– Sure, I’ll give it a try, বললো ওমার।
ওমারের ডাক্তারের সংগে দেখা করার কাজ শেষ হলে আমাকে পটুর্গীজ ভাষায় ধন্যবাদ (Obrigado) বলে বিদায় নিল।
(পরবর্তী visit-এ আমি ওমারকে কুরআন ও অন্যান্য কিছু ইসলামী কাগজপত্র দিয়েছি।)
পঞ্চম কাহিনীঃ Culturally Muslim.
বহু বছর পর আমার এক ভাগ্নে ওর ১২ বছর বয়সের ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিল। কিছুক্ষণ বসে গল্প করে চলে গেলো। বলে গেল যে-
১) কোন সমস্যা নেই, মামা, ভালোই আছি। আত্মীয়-বন্ধুদের সংগে তেমন যোগাযোগ রাখি না। অন্যান্য বাংলাদেশীদের সংগেও না। অবাঞ্ছিত কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চাই না।
২) ছেলেটা বাংলা একেবারেই বোঝে না কারণ ইচ্ছা করেই শিখাইনি। ওর সংগে আমি শুধু ইংরেজীতেই কথা বলি।
৩) ধর্মকর্মে কোন মন নেই। আমি religiously Muslim নই, আমি একজন culturally Muslim.পরকাল নিয়ে ভাবি না।
৪) মুসলিমদের মাঝে নোংরা রকম দলাদলি, ফাটাফাটি। তাই আমি মুসলিমদের সযতনে এড়িয়ে চলি।
ষষ্ঠ কাহিনীঃ AMEENA, NADIRA
AMEENA. আমীনা গায়ানীজ মেয়ে, WALMART-এ কাজ করে। আমাদের বাসার কাছেই সেই WALMART.
ওদের Customer Service desk-এ আমার কিছু কাজ ছিল। গেলাম সেখানে একদিন সকালে। Ameena সেখানে কাজ করছিল। ওর Name Tag-এ Ameena লেখা দেখে বললামঃ আসসালামু আলাইকুম।
সে হেসে জবাব দিলঃ ‘ওয়ালাইকুম সালাম’, কিন্তু সংগে সংগে একথাও বললঃ কিন্তু আমি মুসলিম নই, খৃষ্টান।
শুনে বললামঃ তাহলে তোমার নামটা মুসলিমদের মত কেন?
উত্তরে আমীনা জানালো যে ওরা গায়ানার অধিবাসী, মা খৃষ্টান, বাবা মুসলিম। আমীনা নামটা ওর বাবার দেয়া।
এবার NADIRA’র কথা
এই মহিলা একটা Audio-Video Store-এ কাজ করেন, বয়স বর্তমানে প্রায় ৪০ বছর। অনেকদিন ধরেই তাকে চিনি। শুরুতে যখন ঐ স্টোরে যাওয়া-আসা শুরু করি তখনও AMEENA-র নামের মত বিভ্রাটে পড়েছিলাম। মহিলা জানিয়েছিলেন যে যদিও তার NADIRA নামটা মুসলিমদের মত, বাস্তবে তিনি একজন হিন্দু। সাউথ আমেরিকার Suriname State-এর অধিবাসী। ওদেশে পাশ্ববর্তী দেশ গায়ানার মত হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান সব ধর্মের লোকেরা অতি উদার, সবাই মিলেমিশে বসবাস করে, ধর্মীয় কোন গোঁড়ামি নেই। যার যাকে খুশী বিয়ে করে, ধর্মান্তর করাবার কোন প্রবণতা
নেই। বিবাহিত জীবনে যে যার ধর্ম পালন করে অথবা অন্যেরটা গ্রহণ করে। ছেলে-মেয়েদের নাম রাখার ব্যাপারেও ঐ উদারতা বা স্বাধীনতা কাজ করে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই নাম দেখে ধর্ম বোঝার কোন উপায় নেই। নাদিরা একজন চমৎকার মহিলা, তার আচার-ব্যবহার অতি উত্তম।
সপ্তম কাহিনীঃ আমার মাবাবা তো নামাযি-মুসল্লী মুসলিম ছিলেন
এক মহিলা জানালেন যে তিনি নিয়মিত নামায- রোযা করেন, কুরআন তিলাওয়াত করেন কিন্তু তার স্বামী (৬৫) কোনদিনও ধর্মকর্ম কিছুই করে না; বারবার বলেও তাকে নামায-রোযা করতে রাজী করানো যায়নি আজো।
স্বামীকে সেটার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি অতি স্পষ্ট ভাষায় জানালেন যে ঐসব বিষয় তার কাছে গুরুত্বহীন। ধর্মকর্ম নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে, আখিরাতের পুরষ্কার বা শাস্তি নিয়ে তার মনে কোনই দুর্ভাবনা নেই, ওসব কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। আল্লাহর উপর অথবা কুরআনের উপর ঈমান নিয়ে তিনি ভাবেন না কখনো। তিনি মরে গেলে তার আত্মীয়-স্বজন তার মৃতদেহ ইসলামী মতে দাফন-কাফন করবে না অন্য কিছু করবে সেটা নিয়েও তার মনে কোন বিকার নেই।
আপনি কি নিজেকে একজন মুসলিম বলে মনে করেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, তিনি মনে করেন যে তিনি একজন মুসলিম কারণ তার মাবাবা তো নামাযি-মুসল্লী মুসলিম ছিলেন।
একটু ভিন্ন ধরনের ভালোবাসা
(এক)
Humber River Hospital-এ ভলান্টিয়ার হিসাবে ৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই খুব অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ কাজে যেতে পারিনি। এমনি সময় একদিন একখানা Get Well Card এসে হাজির, প্রেরক olunteer Services dept. খুলে দেখলাম তাতে হাতে লেখা এই কথাগুলো-
Dear Sayed,
May the sun warm you and the moon restore you, and may the stars light your path to feel better soon.
Just a short note to say hello and to let you know that you are missed!
Humber just is not the same without your warm smile and kind words.
Please take good care and know that you are in our thoughts!
Your friends in
Volunteer Services
Louisa,Christine & Robin
Department management–এর সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা আমাকে অভিভূত করলো। আমি ওদের কাছে কৃতজ্ঞ।
(দুই)
আমি বেশ কয়েক বছর ধরে হসপিটালের Fracture Clinic-এ ভলানটিয়ার হিসাবে কাজ করছি। ওখানকার সব ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্কার্স, সেক্রেটারি মহিলারা আমাকে খুব সম্মান করে, ভালোবাসে। ওরা চায় যে সপ্তাহের সবদিনই যেন আমি ওখানে কাজ করি, অন্য কোথাও নয়। কিন্তু ডিপার্টমেন্টের প্রয়োজনে আমাকে মাঝেমাঝে অন্য location-এও কাজ করতে হয়। তেমনি একদিনের কাহিনী।
Front Information Desk-এ কাজ করছি। সকাল বেলা, ১০টা- সাড়ে ১০টা বাজে। এমনি সময় আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে Dr. Tountas আমাকে দেখে থামলেন। বললেন ঃ তুমি আজ আমাদের ক্লিনিকে যাওনি কেন? We miss you.
কিছুক্ষণ পর এলো Lorna. সে একজন সেক্রেটারি। সে বললো ঃ তুমি আমাদের ক্লিনিকে যাওনি কেন আজ সকালে? We miss you..
এলো clinic assistant এক বৃদ্ধা, Olive ওর নাম। বললো ঃ তুমি এখানে বসে কাজ করছ আর আমরা ওখানে তোমার অপেক্ষা করছি। Have you deserted us? We miss you there!
বাহ! এতো মজার ব্যাপার দেখছি, সবাই আমাকে miss করছে! সব দেখেশুনে মনে বড় তৃপ্তি বোধ করলাম এই ভেবে যে ওরা আমাকে গুরুত্ব দেয়, appreciate করে। ভলানটিয়ারিংয়ের এটা একটা বড় ধরনের পুরস্কার বৈকি!
– সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা