কাহিনী বিচিত্রা

ডিসেম্বর ৩, ২০২০

সাইদুল হোসেন

সাইদুল হোসেন একজন বর্ষীয়ান লেখক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৯। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে আরো কয়েকটি গ্রন্থ। তিনি প্রায় প্রায় তিন দশক ধরে আছেন কানাডায়। মানব চরিত্রের নানা দিক নিয়ে তার রয়েছে বিশেষ কৌতুহল। তাঁর ভাষায়- “মানুষের চরিত্র, তাদের চিন্তাধারা, তাদের চাল-চলন, তাদের পোশাক, তাদের আচরণ বড়ই বিচিত্র, একের সঙ্গে অন্যের মিল কদাচিৎ চোখে পড়ে। প্রতিটি চেহারা যেমন ভিন্ন, ঠিক তেমনি ভিন্ন তাদের চরিত্রও। কি নিজ দেশে কি ভিন দেশে, সর্বত্রই এই ব্যবধান বর্তমান। চোখ মেলে দেখলে, কান পেতে শুনলে যে কোন পরিবেশেই এই বৈচিত্র দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আজীবন আমি এই বৈচিত্রের অনুসন্ধানী। নিজ দেশ বাংলাদেশে, বিদেশে নানা কাজে-উদ্দেশ্যে ভ্রমণকালীন, এবং গত দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসকালীন আমি অহরহ মানব-চরিত্রের অধ্যয়নে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি কারণ এতে আমি আনন্দ পাই, নূতন অনেক কিছু শিখি, আমার দেখা চরিত্রদের নিয়ে আমি ভাবি, পরিচিত মহলে আলোচনা করি। কতনা বিচিত্র মানুষের জীবন! ”

সেই সব কাহিনীরই কিছুটা সাইদুল হোসেন তুলে ধরেছেন তাঁর ‘কাহিনী বিচিত্রা’ গ্রন্থে। তার অনুমোদনক্রমে বিচিত্র সেই সব ছোট ছোট কাহিনী ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে। আশা করি পাঠক তা উপভোগ করবেন। – সম্পাদক।

ME, MYSELF, AND I

ইরাকী এক মহিলা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওর বৃদ্ধা, অসুস্থ মাকে ফ্র্যাকচার ক্লিনিকে ডাক্তারকে দেখাতে নিয়ে আসে। আমি সব পেশেন্ট ও তাদের সঙ্গে আসা সব আত্মীয়-বন্ধুদের গ্রীটিংস জানিয়ে ওয়েলকাম করি এবং চিকিৎসা সম্পর্কিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন দিয়ে সাহায্য করি। সেই সূত্রে ঐ মহিলা ও তার পরিবারের অন্যান্য কিছু সদস্যদের সঙ্গেও খানিকটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল। প্রথম যেদিন ওরা এসেছিল সেদিন ওর মাকে ইমারজেন্সি ডিপার্টমেন্ট থেকে ফ্র্যাকচার ক্লিনিকে রেফার করা হয়েছিল। সেদিন ওরা দু’বোন এক সঙ্গে উপস্থিত ছিল। বড় বোনটা কথা খুব কম বলে, চুপচাপ স্বভাবের; ছোটটা বেশী আলাপী, মিশুক। নাম জানতে চাইলে সে জানালো যে ওর নাম Caroline, তারপর আমার সামনে রাখা নোটপ্যাডে সেটা আরবী ভাষাতে লিখে দেখালো  ﻛﺭﻭﻟﻴﻦ।

কদিন দেখা-সাক্ষাতের ফাঁকে আলাপের মাধ্যমে কেরোলাইন ওর পরিবার সম্পর্কে বহু তথ্য আমাকে জানিয়েছিল ঃ

ওরা ইরাকী বটে তবে মুসলিম নয়, ওরা মূলতঃ বহু শতাব্দী আগেকার Assyrian religion and civilization–এর অনুসারী। ওদের নিজস্ব ভাষা আছে, সেই ভাষাতেই ওরা নিজেদের মাঝে কথাবার্তা বলে। যেহেতু ইরাকের নাগরিক তাই বর্তমানে আরবী শিক্ষিত এবং সেই ভাষাতেও কথা বলে। এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে ওরা বর্তমানে খৃষ্টান, তাই নাম নিয়েছে Caroline.

সে আরো জানিয়েছিল যে ওর মায়ের যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর, বাবার বয়স ছিল ৩৪- দু’জনের মাঝে ছিল বয়সে ২০ বছরের ব্যবধান। এবং বিয়ের পরপরই তাদের অন্য দেশে পালিয়ে যেতে হয়েছিল পরিবারের প্রাণ বাঁচানোর জন্য।

অনুমান করে নিয়েছিলাম যে ক্যারোলাইন হয়ত বিবাহিতা। ওর বয়স ৩৪, সে জানিয়েছিল। তাই একদিন ওর বুকের দিকে আংগুল উঠিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করলাম ঃ , Caroline, how many members are there in YOUR family? মুখভরা হাসি দিয়ে জবাব দিল ঃ ME, MYSELF, and I. অর্থাৎ সে এখনো একা।

শুনে বললাম ঃ তোমার বর্ণনাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। Thank you. শোকরান।

সে বলল ঃ আফ্ওয়ান (You are welcome!)

সে আরো জানিয়েছিল যে ওরা ১৩ ভাইবোন (দু’জন ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে)। বাবাও মারা গেছেন, মাকে কেন্দ্র করেই ওরা জীবন কাটাচ্ছে, যদিও সবাই ইরাকে বসবাস করছে না আর। মাত্র বড় বোনটা সেখানে আছে। ভাইবোনদের মাঝে কয়েকজন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং জার্মেনীতে বসবাস করছে। ওর মা ও ওরা দু’বোন ১৯৯১ সন থেকে কানাডায় ইমিগ্রেশন নিয়ে বসবাস করছে।

ডিসেম্বর ২০১০। ক্যারোলাইনকে বললাম ঃ Merry Christmas and Happy New Year. মাসালামা।

Thank you. Bye. বলে মায়ের হুইলচেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে বিদায় নিল ক্যারোলাইন। সেটাই ছিল ওর সংগে আমার শেষ দেখা।

এখন ২০১৬। ওর স্মৃতি, ওর হাসি মুখ, ওর অকপট খোলামেলা আচরণের কথা আজো কখনো কখনো আমার মনে পড়ে। কোথায় আছে, কেমন আছে ক্যারোলাইন আজ কে জানে!

উপরের কাহিনীর সংগে প্রাসংগিক নয় কিন্তু ME, MYSELF, and I কথাটার সংগে ছন্দের মিলের কারণ হেতু দু’টি বিষয়ের উল্লেখ করছি-

১) আমাদের বাসার নিকটের একটা Shopping Plaza–তে একটা চশমার দোকান আছে যার নাম YOU & EYE. নামটা আমার খুব পছন্দ।

২) অপর একটি Eye Clinic-এর bulletin board-এ দেখলাম বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ঃ

-EYE SEE.

– EYE LEARN.

এই প্রকাশভংগীটাও খুব চিত্তাকর্ষক ও অর্থপূর্ণ।

ডিসেম্বর ২১, ২০১০।

স্ত্রী তো পায়ের পুরানো জুতার মত ফেলনা জিনিস!

২০০৮-২০১২ বছরগুলোতে আমাদের কমিউনিটি হাউজিং বিল্ডিংয়ে এক বৃদ্ধ ইন্ডিয়ান পাঞ্জাবী সর্দারজি বাস করতো একা। নিজেই রান্নাবান্না করে খেতো। আমার সংগে গায়ে পড়েই পরিচয় করেছিলো নিজ স্বার্থে কারণ সে ইংরেজী জানতো না, হিন্দিও তেমন জানতো না, যা বলতো তা ছিলো পাঞ্জাবী ও হিন্দি মেশানো খিচুড়ি ভাষা যা আমি ছাড়া অন্য কোন রেসিডেন্ট বুঝতো না। আমাদের এপার্টমেন্টে সে কখনো কখনো গপসপ মারার জন্য আসতো, আমাকেও মাঝেমধ্যে ওর এপার্টমেন্টে ডেকে নিয়ে যেতো ঐ একই উদ্দেশ্যে।

নারীদের প্রতি সর্দারজির ছিলো খুবই তাচ্ছিল্যের মনোভাব যা ওর কথাবার্তায় অহরহই প্রকাশ পেতো। কথা প্রসঙ্গে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম ঃ আচ্ছা সর্দারজি, তুমি একাকী বাস কর কেন? তোমার স্ত্রী কোথায়?

সর্দারজি বললো ঃ আমাদের দু’জনের মাঝে ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণাই অধিকতর প্রবল, তাই দু’জন আলাদা আলাদা বাস করি। সে আমাদের বড় ছেলের বাড়িতে থাকে, এই টরোন্টো সিটিতেই।

আবার প্রশ্ন করলাম ঃ এখন তোমাদের বৃদ্ধ বয়স, একত্র বাস করাটাই তো বাঞ্ছনীয়, তোমরা ঝগড়াঝাটিটা মিটমাট করে ফেললেই পারো। করছো না কেন?

জবাবে অতি তাচ্ছিল্যের স্বরে সর্দারজি যে জবাবটি দিয়েছিলো সেটা ছিলো এরকম ঃ

আমি একজন মর্দ, পাঞ্জাবী সর্দারজি। আমি স্ত্রীর কাছে হার মানবো? কাকুতিমিনতি করে তার মন ভেজাবো? কভি নেহী! আরে ভাইসাব, বিবি তো পায়েরকা জুতি বরাবর হোতি হ্যায়। পসন্দ না হো তো ইক লাথ মারকে বাহার ফেঁকদো, দুস্রি বিবি ঘরমেঁ লে আ-ও।

আওরতকা কেয়া কোঈ কমি হ্যায় দুনিয়ামে?

অর্থাৎ আরে ভাইসাব, স্ত্রী তো পায়ের পুরানো জুতার মত নগণ্য, ফেলনা বস্তু।  পছন্দ না হলে এক লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দাও, আর এক স্ত্রী ঘরে নিয়ে আস। এই দুনিয়াতে পুরুষের জন্য নারীর কি কোন অভাব আছে?

নারীদের প্রতি এমন যার মনোভাব তার ঘরে স্ত্রী বাস করবে কেমন করে?

বিয়ে করার কি প্রয়োজন?

আমাদের বিল্ডিংয়ে cleaner-এর কাজ করে ২০-২৫ বছর বয়সের এক কালো ছেলে। লবিতে বসা এক বৃদ্ধা resident-কে কথা প্রসংগে ছেলেটা জানালো যে ওর ৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে আছে। শুনে সেই মহিলা বললেন ঃ আমি তো মনে করেছিলাম তুমি বিয়েই করনি।

সেই ছেলেটা তখন হাসতে হাসতে বললো ঃ সন্তানের বাবা হতে হলে এদেশে বিয়ে করার কোন প্রয়োজন পড়ে না because this is Canada!

I need a guy to produce a baby!

Rimona. ক্যানাডিয়ান নারী, হোয়াইট। বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছর। হসপিটালের একটা বড় clinic-এ বহু বছর ধরে সে secretary হিসাবে কাজ করে। সেখানে গত ৬-৭ বছর ধরে আমি Volunteer হিসাবে কাজ করে যাচ্ছি। Rimona খুব হাসিখুশি স্বভাবের মিশুক ধরনের মেয়ে। Very helpful. আমাদের মাঝে ভালো পরিচয় রয়েছে। কথাবার্তা হয়।

গত সপ্তাহে একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম ঃ তোমার ছেলেটার বয়স তো ৬-৭ বছর হয়ে গেল। এর পর কি কোন সন্তান হয়েছে তোমার?

রিমোনা বললো ঃ তুমি ভুলে গেছ, আমার ছেলের বয়স এখন ১০ বছর। স্বাস্থ্য ভালো, মাথায় খুব বেড়ে গেছে।

আরো সন্তান হয়েছে কিনা জানতে চাচ্ছ? না, আর হয়নি because I need a guy to produce another baby. But I don’t have a guy in my life for the last 10 years. But I am not too unhappy about that!

Boyfriend is basura

Spanish-speaking এক সহকর্মী তরুণী Volunteer  থেকে জানতে চাইলাম English Boyfriend এবং Girlfriend কথা দু’টির Spanish প্রতিশব্দ কি। সে বললো ঃNovio and Novia.

জিজ্ঞেস করলাম ঃ তোমার কি কোন Novio আছে?

তাচ্ছিল্যের সংগে ডানহাতটাতে একটা ঝাঁকি দিয়ে বললো ঃ Novio? No! Novio no good. Basura.

Basura একটি স্প্যানীশ শব্দ যার অর্থ আবর্জনা, জঞ্জাল- ইংরেজীতে যেটাকে rubbish, garbage বলা হয়।

অর্থাৎ ওর বিবেচনায় boyfriend কোন বাঞ্ছনীয় বা আদরণীয় বস্তু নয়, ওরা হচ্ছে জঞ্জাল, আবর্জনা! অথচ প্রায় প্রতিটি তরুণী বা যুবতীকেই প্রায় সর্বক্ষণ একজন boyfriend-এর বাহুলগ্না হয়ে চলতে দেখা যায় শহরের সর্বত্র।

এই যুবতীর boyfriend-এর প্রতি এত ঘৃণা বা তাচ্ছিল্যের হেতু কি?

আগষ্ট ০৯, ২০১৬

(চলবে)

সাইদুল হোসেন

মিসিসাগা