কানাডার শ্বেতাঙ্গ ‘গর্বিত ছেলেরা’ এখন তালেবান আর আল-কায়দার মতো সন্ত্রাসীদের কাতারে তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছেন

ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২১

খুরশিদ আলম

কানাডায় ‘Proud Boys’ নামের উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্যদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সম্প্রতি আবারো আলোচনায় এসেছে গত ৬ জানুয়ারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে নজিরবিহীন তান্ডব চালানোর পর। ঐ হামলায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন ‘গণতন্ত্রের বিশ্ব মোড়ল’ দাবীদার দেশটির সদ্য বিদায় নেয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর সেই ইন্ধনে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাউড বয়েস এর সদস্যরাও পুলিশের নিরাপত্তাব্যূহ ভেঙে কংগ্রেস ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ঐ সময় চলে গোলাগুলি, ভাঙচুর ও লুটপাট। হামলার ঘটনায় একজন পুলিশ অফিসারসহ ৫ জনের মৃত্যু ঘটে।

প্রাউড বয়েস এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করে কানাডার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) নেতা জাগমিত সিং এই সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী দল হিসাবে ঘোষণা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে তিনি পার্লামেন্টে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গত ২৫ জানুয়ারী প্রাউড বয়েস’কে সন্ত্রাসী দল হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে সব দলের সদস্যদের সমর্থন লাভ করে। কানাডার ফেডারেল সরকারও বলেছে তারা প্রাউড বয়েস-কে সন্ত্রাসী দলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বিবেচনা করছে।

উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে যখন হামলার ঘটনা ঘটে তখন দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জয়ের আনুষ্ঠানিক সত্যায়নে যৌথ অধিবেশন চলছিল। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখে একপর্যায়ে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন স্থগিত করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে পরে ফের অধিবেশন শুরু হয়।

নজিরবিহীন ঐ তাণ্ডব চালায় ভোটে পরাজিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সশস্ত্র উগ্র সমর্থকরা। ঐ দিনের হামলার ঘটনাটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক চরম লজ্জাজনক উপাখ্যান। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুসারী শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শে বিশ্বসী বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সদস্যরা সেদিন দলবেধে বিভিন্ন অস্ত্র হাতে নিয়ে হামলা চালায়। ঐ হামলাকে ‘ন্যক্কারজনক’ অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় দলের নেতারাই। তবে হামলাকারীদের ‘মহান দেশপ্রেমিক’ বলে প্রশংসা করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প যাকে বছরখানেক আগে একবার ‘motherf**ker’ বলে গালি দিয়েছিলেন কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিম কেম্পবেল। কানাডার ইতিহাসে এই কেম্পবেল-ই একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী যিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৯৩ সালে।

কংগ্রেস ভবনে ঐ দিনের হামলার ঘটনার পর তার নিন্দা জানিয়েছিলেন বিশ্ব নেতারাও। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, “গণতন্ত্রের ওপর এ আঘাতের ঘটনায় কানাডিয়ানরা প্রচণ্ড বিরক্ত।” এ ঘটনাকে লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এক টুইটারে তিনি মার্কিন কংগ্রেস ভবনে হামলা, দাঙ্গা ও হতাহতের ঘটনাকে ‘কলঙ্কজনক’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

কিন্তু এই কলঙ্ককে সেদিন মোটেও আমলে নেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আগের মতই তার নির্লজ্জ বেহায়াপনা অব্যাহত রাখেন এবং ক্রমাগত মিথ্যা দাবী করতেই থাকেন এই বলে যে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে।

ঐ সময় ওয়াশিংটন পোস্ট ও মিয়ামি হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে তার মন্ত্রীপরিষদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, বাকি সময় ক্ষমতায় থাকার অযোগ্য ট্রাম্প।

পরে মার্কিন হাউস অব কমনসে সৃষ্টি হয় এক ইতিহাস। প্রথমবারের মতো কোনও প্রেসিডেন্টকে দু’বার ‘ইমপিচ’ করা হয়। কংগ্রেস ভবনে হিংসা ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভোট চুরির মিথ্যে দাবি এবং কংগ্রেস ভবনে হিংসাত্মক হামলার ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর দায়ভারও ট্রাম্পের ওপরেই পড়ে। আমেরিকার হাউসে ভোটাভুটিতে ইমপিচমেন্টের পক্ষে ফল দাঁড়ায় ২৩২-১৯৭। দায়িত্ব ছাড়ার পর মার্কিন সিনেটে ট্রাম্পের বিচার শুরু হবে বলে বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হয়।

উল্লেখ্য যে, এর আগে ২০১৯ সালে প্রথমবার ইমপিচমেন্ট হয়েছিল ট্রাম্পের। সেবার অভিযোগ দায়ের হওয়ার তিনমাস পর বিচারসভা বসেছিল। কিন্তু এবার হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার সাতদিন পর এবং অভিযোগের মাত্র দু’দিন পরেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

আশংকার বিষয় হলো, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বিশ^ বেহায়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে অনেক কানাডিয়ানও সমর্থন ব্যক্ত করেছেন ইতিপূর্বে। গত নির্বাচনের কিছুদিন আগে ‘Léger poll’ এর এক জরিপে দেখা গেছে শতকরা প্রায় ১৭ জন কানাডিয়ান ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। এদের বেশীরভাই অবশ্য কানাডার কনজার্ভেটিভ পার্টির সমর্থক। তাদের মধ্যে সমর্থনের হার ছিল ৪১%। অন্যদিকে লিবারেল পার্টির সমর্থকদের মধ্যে ট্রাম্পের প্রতি অনুমোদন ছিল ৭% এবং এনডিপি’র মধ্যে ৬%।

আর প্রাউড বয়েস এর যারা সদস্য তাদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন পুরোটাই। কংগ্রেস ভবনে হামলার সময় সেখানে কানাডার পতাকা হাতে নিয়ে তাদের কয়েকজনকে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কারা এই প্রাউড বয়েস?

প্রাউড বয়েস এর জন্ম কানাডায়। এর জন্মদাতাও একজন কানাডিয়ান যার নাম গ্যাভিন ম্যাকিনেস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে এদের শাখা। চরম ডানপন্থী, ইমিগ্রেন্ট বিরোধী এবং নারী বিদ্বেষী এই গ্রুপের সদস্যরা সবাই পুরুষ। কানাডিয়ান মিলিটারীর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে “এই প্রাউড বয়েস একটি চরম রক্ষণশীল গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রকাশ্যেই ইসলাম বিরোধী এবং নারী বিদ্বেষী।” গ্লোবাল নিউজ এ সংবাদ জানায়।

গ্লোবাল নিউজের রিপোর্টে আরো বলা হয়, গত ৬ জানুয়ারী কংগ্রেস ভবনে যে হামলা হয় তাতে অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে এই প্রাউড বয়েস এর সদস্যরাও যোগ দেন। এদের হাওয়ায়ী (Hawaii) শাখার নেতাকে অভিযুক্ত করা হয় হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে। অন্যদিকে তাদের জাতীয় নেতা এনরিক টারিও-কেও গ্রেফতার করা হয়।

কিন্তু এর পরও তাদের তৎপরতা থেমে থাকেনি। প্রাউড বয়েস এর ‘টেলিগ্রাম’ চ্যানেলে তারা কংগ্রেস ভবনে হামলা চালানোর বিষয়টিকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রকাশ করেন। এর আগে প্রাউড বয়েস এর জাতীয় নেতা এনরিক টারিও হামলার পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করে বিবৃতি দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় প্রাউড বয়েস নামের সংগঠনটি প্রথমে সবার নজরে আসে ২০১৭ সালে। ঐ সময় রয়েল কানাডিয়ান নেভী’র কয়েকজন সদস্য নোভা স্কশিয়া প্রভিন্সের রাজধানী হ্যালিফেক্সে আদিবাসীদের একটি প্রতিবাদ সমাবেশকে পন্ড করার জন্য সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। দিনটি ছিল কানাডা ডে। ঐ দিন হ্যালিফেক্সের স্থানীয় আদিবাসীদের পক্ষ থেকে নোভা স্কাসিয়ার সাবেক গভর্নর এ্যাডওয়ার্ড কর্নওয়ালিস এর (১৭৪৯-১৭৫২) মানবতা বিরোধী অতীত কর্মকান্ডের নিন্দা জানানোর জন্য এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।

এই কর্নওয়ালিস তার সময়ে স্থানীয় অনেক আদিবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন যেটা ছিল গণহত্যার সামিল। স্থানীয় নগর কর্তৃপক্ষও ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে ডাউনটাউনের পার্ক থেকে কর্নওয়ালিস এর একটি ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলে মানবতা বিরোধী তার অতীত কর্মকান্ডের জন্য।

দি কানাডিয়ান প্রেস এর খবরে বলা হয়, কানাডা ডে-তে ঐ সেনা সদস্যরা যখন হ্যালিফেক্সে আদিবাসীদের সমাবেশ পন্ড করার জন্য গিয়েছিলেন তখন তাদের পরনে ছিল কালো রঙ এর পলো সার্ট যাতে ছিল হলুদ রেখা। এই সময় তারা কানাডার আদিকালের Red Ensign Flag হাতে নিয়ে “God Save the Queen” গান গাইতে গাইতে সমাবেশস্থলে হাজির হয়েছিলেন। এরা নিজেদেরকে কানাডার প্রাউড বয়েস (মেরিটাইম চেপ্টারের) এর সদস্য বলে পরিচয় দেন।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় প্রাউড বয়েস এর বেশ কয়েকটি শাখা রয়েছে বিভিন্ন প্রভিন্সে। দি কানাডিয়ান প্রেস এক খবর থেকে জানা যায়, টরন্টো, মন্ট্রিয়ল, মেনিটোবা, সাস্কাচুয়ান ও ক্যালগারী-সহ বিভিন্ন স্থানে ৮টি শাখা বা চেপ্টার রয়েছে তাদের।

কানাডার সাবেক সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এর বিশ্লেষক জেসিকা ডেভিস গ্লোবাল নিউজকে বলেন, “প্রাউড বয়েস এখন সম্ভবত সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তভুক্ত হওয়ার পর্যায়ে চলে এসেছে। তাদের কিছু কিছু হামলা রাজনৈতিক বা বিশেষ কোন আদর্শের বিশ্বাস থেকে পরিচালিত হয়েছে এমন সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে।”

উল্লেখ্য যে, গত ৬ জানুয়ারী মার্কিন কংগ্রেস ভবনে বিভিন্ন চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপের সম্মিলিত হামলার পর Parler নামের একটি আমেরিকান নেটওয়ার্কিং সার্ভিসকে আমাজন, এ্যাপল ও গুগুল বিচ্ছিন্ন করে দেয়। Parler নামের এই নেটওয়ার্কিং সার্ভিসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর সমর্থক বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপের খুব পছন্দের জায়গা। প্রাউড বয়েস এর ৭ টি চেপ্টারকেও হোস্টিং করতো Parler নামের এই নেটওয়ার্কিং সার্ভিসটি।

ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ কানাডার প্রাউড বয়েস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গত ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে।

কানাডার প্রাউড বয়েস নামের সংগঠনটিকে সন্ত্রাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না বা করা উচিৎ কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠায় সরকারী মহলেও আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়ে আসছিল।

কানাডার পাবলিক সেফটি মিনিস্টার বিল ব্লেয়ার এর মুখপাত্র ‘মেরী-লিজ পাওয়ার’ দি কানাডিয়ান প্রেস কে বলেন, “প্রাউড বয়েস আদর্শিকভাবে অনুপ্রাণিত একটি চরমপন্থী গোষ্ঠি। আর এই জাতীয় সংগঠনগুলোর উপর সরকার নিবিড়ভাবে নজর রাখছে শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদকে মোকাবেলা করার জন্য।”

মেরী-লিজ আরো বলেন, “আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো খুব সক্রিয়ভাবে এই গোষ্ঠিগুলোর কার্যক্রমের উপর নজর রাখছে এবং এগুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত করা যায় কি না তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহ করছে।”

কিন্তু আমরা দেখেছি হ্যালিফেক্সে যে কজন সেনা সদস্য আদিবাসীদের একটি সমাবেশ পন্ড করার জন্য গিয়েছিলেন প্রাউড বয়েজ এর পরিচয় নিয়ে, তাদের কারো বিরুদ্ধেই বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছড়ানোর অপরাধে তেমন কোন বিচার করা হয়নি। বিচার যতটুকু করা হয়েছে তা হলো, প্রবেশন। এই প্রবেশনের সময়ে তাদেরকে নজরদারিতে রাখা হবে। যদি একই অপরাধ তাদের মধ্যে আবার কেউ করেন তবে তাকে চাকরীচ্যুত করা হবে।

কিন্তু ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো অথবা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিচার আরো কঠোর হওয়া উচিৎ নয় কি? তাদেরকে আদর করে একটু কান মলে দিলেই কি বিচার হয়ে গেল?

স্মরণ করা যেতে পারে যে, বিগত কনজারভেটিভ সরকার বিল সি-২৪ নামে একটি আইন পাশ করেছিল। ঐ আইনে বলা হয়েছিল যদি কানাডার কোন দ্বৈত নাগরিক কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হন বা কানাডার জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কোন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হন তবে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে। কিন্তু ঐ আইনটি ছিল বাড়াবাড়ি রকমের বিদ্বেষপ্রসূত। নির্দিষ্ট একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল আইনটি। নাগরিকত্ব হরণ যে মানবাধিকার হরণ সেই বিবেচনাটুকু তখনকার কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের ছিল না। তাছাড়া তিনি মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন এমন অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য জাস্টিন ট্রুডো’র লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় এসে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের আইনটি সংশোধন করেন। সংশোধিত আইনে বলা হয়, দ্বৈত নাগরিকদের কেউ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অভিযুক্ত হলে নাগরিকত্ব বাতিল না করে কানাডার প্রচলিত আইনেই তার বিচার হবে। জাস্টিন ট্রুডোর ভাষায় “A Canadian is a Canadian is a Canadian”।

সন্ত্রাসবাদ মানবতার বিরুদ্ধে এক জঘন্য অপরাধ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান যে কোন ধর্মালম্বী ব্যক্তি বা গোষ্ঠি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটালে তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। এমনকি রাষ্ট্রিয় মদতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হলেও সেই অপরাধের বিচার করা জরুরী। কিন্তু মানব জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিচার সাধারণত হয় না।

আর শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের কেউ কোন সন্ত্রাসী হামলা চালালে বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ার লোকেরা এবং রাজনীতিকরা তেমন সবর হয়ে উঠেন না যেমনটা সরব হয়ে উঠেন অন্যদের বেলায়। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীও কতকটা যেন ধীর গতিতে অগ্রসর হয় শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদেরকে আইনের আওতায় আনার বেলায়।

স্মরন করা যেতে পারে যে ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে কুইবেক সিটির একটি মসজিদে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক শে^তাঙ্গ যুবক যখন অতর্কিতে বন্দুক হামলা চালিয়ে ৬ জন মুসল্লিকে হত্যা করেন তখন সেই হামলার ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা বলতে যথেষ্ট সময় নিয়েছিলেন মিডিয়ার লোকেরা এবং রাজনীতিকরাও। জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য তাৎক্ষনিকভাবে ঐ ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসাবে অভিহিত করেছিলেন এবং তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য যে, আলেকজান্ডারকে মানসিক রোগী হিসাবে চিহ্নিত করারও চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে তার সাজা কম হয় বা জেল থেকে তিনি মুক্তি পান। পরে আমরা দেখেছি আদালতের বিচারক তাকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন এবং ৪০ বছর কোন প্যারলের সুযোগ পাবেনা এ কথাও বলা হয়েছে রায়ে। সেই সাথে এও বলা হয়েছিল যে, “আলেকজান্ডার কুসংস্কার থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তার মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা আছে।”

পরবর্তীতে আলেকজান্ডারের পক্ষে এই রয়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে আপিল কোর্ট আলেকজান্ডারের সাজা ১৫ কমিয়ে দেন। আলেকজান্ডারের আইনজীবী চার্লস অলিভিয়ার এতে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “কুইবেক এবং কানাডায় মানবাধিকারের সম্মানের জন্য এ রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।”

বিচারকের রায়ে সেদিনের হামলার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অনেকেই হাতাশা প্রকাশ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, যে মাত্রায় অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, রায়ে তার প্রতিফলন ঘটেনি। তাদের মতে, আলেকজান্ডারের আইনজীবী মানবাধিকারের কথা বলেছেন। কিন্তু সেদিন যারা নির্মম ভাবে খুন হয়েছেন এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের মানবাধিকার কি রক্ষা হয়েছে? ৬ জন নারী তাদের স্বামী হারিয়েছেন। বিভিন্ন বয়সের ১৭ জন সন্তান চিরতরে হারিয়েছেন তাদের পিতাকে। তাদের মানবাধিকার কি আপিল কোর্ট রক্ষা করেছে?

আলেকজান্ডার নিজে একজন শ্বেতাঙ্গ। এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে ঐ নির্মম হত্যাকান্ড ঘটায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আদর্শগুরু। প্রাউড বয়েস-রাও তার মত একই চিন্তায় ও আদর্শে বিশ্বাসী।

মার্কিন কংগ্রেস ভবনে সম্প্রতি যে হামলার ঘটনা ঘটেছে তাতে অংশ নিয়ে তারা তাদের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সন্ত্রাসী পরিচয়কে আরো উন্মুক্ত করেছেন। রক্ষণশীল দল ‘প্রগ্রেসিভ কনর্জাভেটিভ পার্টি অফ অন্টারিও’র নেতা হিসাবে ড্যাগ ফোর্ড প্রিমিয়ার নির্বাচিত হওয়ার পর এই প্রাউড বয়েসের পক্ষ থেকে তাকে “Proud Boy of the month,” হিসাবে উপাধি দেয়া হয়েছিল। তাদের স্বপ্ন হলো, ফোর্ড ‘Will Make Ontario Great Again’। এ জাতীয় স্লোগান নির্বাচনের আগে দিয়ে আসছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় প্রাউড বয়েস’দের চিন্তা-চেতনা ও কর্মকান্ডে।

কানাডার সাবেক জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী র‌্যাল্ফ গুডেল ইতিপূর্বে বলেছিলেন, “ডানপন্থী, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও নব্য নাৎসি গ্রুপগুলো কানাডীয়দের জন্য ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। এসব গ্রুপ ইহুদি-মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উস্কে দেয় যা সহিংসতা এবং অন্য ধরনের অপরাধের মধ্যে পরিস্ফুট।”

আমরা লক্ষ্য করেছি, সাম্প্রতিককালে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের কার্যক্রম যথেষ্ট পরিমাণে বিস্তার লাভ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম অর্গানাইজেশন অব টরন্টো’র মসজিদের সামনে গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর ঘটে এক নৃশংস হত্যার ঘটনা। ঐ মসজিদের স্বেচ্ছাসেবক এক মুসল্লিকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সমর্থক Guilherme ‘William’ Von Neutegem নামের এক ব্যক্তি। নিহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আসলিম জাফিস। ৫৮ বছর বয়স্ক আসলিম জাফিস ঐ দিন সন্ধ্যায় রেক্সডেল এবং কিপলিং এ্যাভিনিউর (৬৫ রেক্সডেল) নিকটবর্তী ঐ মসজিদের সামনে একটি চেয়ারে বসেছিলেন। ভিডিওতে দেখা গেছে খুনী Von Neutegem চেয়ারে বসে থাকা আসলিম জাফিস এর পিছন দিক থেকে এসে সহসা আক্রমণ করেন। আসলিম জাফিস আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেই অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়। Von Neutegem কে পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং তার

বিরুদ্ধে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার এর অভিযোগ আনা হয়। কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্কের তথ্য থেকে জানা যায়, Von Neutegem ব্রিটেনের একটি বিদ্বেষী গ্রুপের অনুসারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে একটি শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদী গ্রুপেরও অনুসারী সে।

এদিকে সিটিভি নিউজে প্রকাশিত নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু প্লাটফর্মে ৬৬০০-র বেশি অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে রক্ষণশীল কানাডীয়রা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং এ ধরণের অন্যান্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়লগ (ISD)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ও গত বছর ১২ জুন প্রকাশিত গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আয়রন মার্চ, ফেসিস্ট ফোর্জ, ফোরচ্যান ও গ্যাব (4chan and Gab) এর মত বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে কানাডার বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গবাদী উগ্র সম্প্রদায় সক্রিয়।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, গবেষকরা দেখেছেন, প্রান্তিক সাইট ফোরচ্যান-এর “পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট” নামের একটি বিশেষ মেসেজ বোর্ডে রক্ষণশীল কানাডীয়রা ১৬ লাখেরও বেশি পোস্ট দিয়েছেন।

আইএসডির সিনিয়র রিসার্চ ম্যানেজার এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টের অন্যতম লেখক জ্যাকব ডাভে সিটিভি নিউজ -কে বলেন “এর ফলে মনে হচ্ছে এটি সত্যিই এমন একটি বিষয় যেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে ব্যবহারকারীদের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে লক্ষ্য করে চরম নোংরা কায়দায় ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছে।”

প্রাউড বয়েস ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডার আরো যে সব শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী দলের অপতৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে তাদের মধ্যে আছে Soldiers of Odin  এবং La Meute। এরা কট্টরভাবে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় ও ইমিগ্রেন্ট বিরোধী। এবং একই সাথে চরমভাবে মুসলিম বিরোধী। মুখে অবশ্য তারা এসকল অভিযোগ স্বীকার করেন না। তবে তাদের কার্যক্রম প্রমাণ করে যে তারা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শে বিশ্বাসী।

কানাডায় সন্ত্রাসীদের তালিকায় আছে বেশ কিছু চরমপন্থী মুসলিম সংগঠনের নাম যার মধ্যে আছে আল-কায়দা, বোকো হারাম, হিজবুল্লাহ এবং ইসলামিক স্টেট। মুসলিম সংগঠন ছাড়াও সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় আছে চরম ডানপন্থী ‘ব্লাড এ্যান্ড অনার’ যেটি একটি আন্তর্জাতিক নব্য নাজী-পন্থী নেটওয়ার্ক এবং এর সশস্ত্র শাখা ‘কমবেট ১৮’। আরো আছে ইন্ডিয়ান মুজাহেদীন, লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলাম, প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান, ওয়ার্ল্ড তামিল মুভমেন্ট। ‘পাবলিক সেফটি কানাডা’র ওয়েবসাইটে এরকম অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম আছে। কিন্তু প্রাউড বয়েস এর নাম নেই। নাম নেই Soldiers of Odin এবং La Meuteএর নামও।

পার্লামেন্টে প্রাউড বয়েস এর নাম সন্ত্রাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এখন আরো কয়েকটি ধাপ বাকি রয়েছে তাদেরকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্ত্রাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।

আমাদের বিশ্বাস এই সন্ত্রাসীদেরকে (যে কোন সম্প্রদায়েরই হোক) সরকার শুধু তালিকাভুক্ত করেই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। এরা যাতে ভবিষ্যতে কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম না চালাতে পারে সে দিকেও কড়া নজর রাখবে।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ