করোনার দিনগুলো

করোনার প্রকোপ কমে আসছে, ভ্যাকসিন গতি পেয়েছে!


জসিম মল্লিক


(দ্বাদশ পর্ব)
অর্থনীতির সাথে তাল মেলাতে অনেক ক্ষেত্রেই কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের প্রিমিয়ার, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং নীতিনির্ধারকদের অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে। করোনা মহামারীর এই সময়ে অনেকেই বাড়িতে বসে কাজ করেছেন। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর গতি আগের মত তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। লকডাউনের শিথিলতায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসা গুলো খুলতে শুরু করলেও তেমন ব্যবসা করতে পারছে না। ক্ষুদ্র আকারের অনেক ব্যবসায়ই স্তিমিত হয়ে আছে এবং অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার কালো থাবায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এয়ারলাইনস ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা গুলো। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ঘাটতি পূরণে যদি ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকার এগিয়ে না আসে তাহলে মূলধনী প্রকল্পগুলো হয় বাতিল করতে হবে। যদি তা না হয় তবে প্রকল্পগুলো পিছিয়ে দিতে হবে এবং রিজার্ভ তহবিল থেকে অর্থ ধার করতে হবে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত লকডাউনের কারণে স্টোর খোলা রাখা সম্ভব না হওয়ায় কানাডাজুড়ে ৬০০ কর্মীকে স্থায়ীভাবে ছাঁটাই করতে যাচ্ছে হাডসন’স বে কোম্পানির। এই তথ্য জানিয়ে খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র টিফানি বৌর বলেন, কোম্পানির প্রায় অর্ধেক স্টোরই বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।’
উল্লেখ্য, কানাডার সরকার করোনা মহামারীর প্রথম থেকেই নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অব্যাহত করোনার এই সময়ে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। অন্যদিকে, শুরু হওয়া ভ্যাকসিন প্রয়োগও ধীরে ধীরে কানাডিয়ানদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ভূমিকা রাখবে। ভ্যাকসিনের দেওয়ার মাত্রাও গতি পেয়েছে। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে নতুন ভ্যারিয়েন্ট। তাই হয়তো এতো তাড়াতড়ি সব কিছু স্বাভাবিক হবে না। আরো সতর্কতার প্রয়োজন আছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মকর্তারা।
এদিকে করোনাভাইরাসের টিকার সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, এখন পর্যন্ত মোট টিকার ৭৫ শতাংশ গেছে মাত্র ১০টি দেশের হাতে। অথচ ১৩০টি দেশ টিকার একটি ডোজও পায়নি। বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে টিকাদানের ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্ব সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, এ মহামারি নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় বৈষম্যের এই বিরাট ফারাক গোটা বিশ্বকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। যুক্তরাজ্যের আহ্বানে করোনার টিকা নিয়ে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভার্চ্যুয়াল অধিবেশন। এতে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশ নেন। বৈঠকে বলা হয়, এই মহামারি প্রতিরোধে বিশ্বকে একসঙ্গে কাজ করা একটি নৈতিক দায়িত্ব। সারা বিশ্বে ইতিমধ্যে ২৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনায়।
বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস বলেন, বিশ্বে জরুরি ভিত্তিতে একটি বৈশ্বিক টিকাদান পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। যাতে ক্ষমতা, বৈজ্ঞানিক দক্ষতা, উৎপাদন ও অর্থনৈতিক সক্ষমতাসম্পন্ন সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এক কাতারে নিয়ে আসা যায়।

ফেসবুকের ভাল দিক মন্দ দিক
ফেসবুকের ভাল দিক যেমন আছে মন্দ দিকও আছে। আনন্দের ব্যাপার যেমন আছে বিব্রতকর ব্যাপারও আছে। প্রত্যেকেই ফেসবুককে নানাভাবে ব্যবহার করে। সেটাই স্বভাবিক। কেউ ফেসবুক লাইভ করে, কেউ বিজনেস করে, কেউ মজাদার সব খাবারের ছবি পোষ্ট করে, কেউ রাজনীতি করে, কেউ গল্প কবিতা লেখে, কেউ নিজের আঁকা ছবি পোষ্ট করে, কেউ সুন্দর সুন্দর পোশাক পড়ে, সুন্দর সেজে ছবি পোষ্ট করে, সেখানে এক লাইন দু ‘লাইনের আকর্ষনীয় কথা থাকে। অনেকের সন্তান, মা বাবা ,আত্মীয়, বন্ধুদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। ফেসবুক দুঃখের বার্তাও নিয়ে আসে, মৃত্যুর খবর, অসুস্থ্যতার খবর,আইসিউতে ভর্তির খবর থাকে। সাফল্যের খবর থাকে, জন্মদিন মৃত্যু দিবসগুলো জানতে পারি। কষ্টের কথা থাকে, আনন্দের কথাও থাকে। প্রেম, পরিণয়, পরকীয়া থাকে। অনৈতিক ব্যাপার স্যাপারও ঘটে। মিথ্যা থাকে, ফাঁদ থাকে, বিপদ থাকে, প্রতারনা থাকে, অন্যকে হেয় করা থাকে। আবার অনেক অর্জণও থাকে। ফেসবুকে কি না থাকে! সবই থাকে।
আমিও ফেসবুকার। দিনের অনেকটা সময় চলে যায় ফেসবুকের পিছনে। মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল হচ্ছে, মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল মানুষের সাথে সম্পর্ক করছি। ভুলের জন্য অনুশোচনা হয়। সময় অপচয়ের জন্য মনোবেদনায় ভুগি। নিজর উপর রাগ হয়, বিরক্তি আসে। ফেসবুক ডিএক্টিভেট করি। কিন্তু আবার ফেসবুকের কাছে ফেরত আসি। এ এক কঠিন নেশা। কিছুতেই নেশা ছাড়ে না। আমার ছেলে মেয়ে ফেসবুক করে না। কেমন করে পারে জানি না। একদিন জেনে নেবো। আমি নিজের অনুভূতিগুলো সবসময় শেয়ার করি। লেখা পোষ্ট করি, সাথে ছবি থাকে। ফেসবুকের লেখা নিয়ে আমার এ পর্যন্ত সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাই ফেসবুকের সবটাই লস না, অর্জণও আছে।
ফেসবুকে লোক দেখানো ব্যাপারও থাকে, শো অফ থাকে, নিজেকে ভুলভাবে উপস্থাপন থাকে, প্রচুর মিথ্যা থাকে। অনেকে এসব লাইক করে, কমেন্টস করে। অনেকে লাইক কমেন্টস কিছুই করে না। হাই প্রোফাইলরা সাধারণদের ব্যাপারে নির্বিকার থাকে। তারা তাদের লেভেলের সাথে সখ্যতা করে। অনেকে আবার বুঝে বুঝে লাইক কমেন্টস করে। এটাই স্বাভাবিক। মানুষের অবচেতনেই থাকে নানা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, দেখানেপনা। এ থেকে কেউই মুক্ত না, আমিও না। আমাকে নিয়ে কে কি ভাবে সেটা যেমন আমি বুঝতে পারি, আমিও অন্যের মনোভাব টের পাই।
এক সময় নিয়মিত পত্রিকায় লিখত এমন অনেকেই এখন আর লেখেন না। তারা ফেসবুকে লেখেন। আমিও আগের চেয়ে অনেক কম পত্রিকায় লেখার জন্য সময় দেই। ফেসবুক সংবাদপত্রের ভূমিকা পালন করছে। আগে যেমন ডাকবিভাগের মাধ্যমে হাতে লেখা চিঠির প্রচলন ছিল। এখন ইনবক্সে খবর আদান প্রদান হচ্ছে। ইনবক্সে লুকিয়ে আছে অনেক হাসি, কান্না, ব্যাক্তিগত গল্প। পত্রিকায় সংবাদ হওয়ার আগেই ফেসবুকের নিউজ ফীডে চলে আসছে। কখনো কখনো অতি উৎসাহীরা এডভান্স খবরও পরিবেশন করে, পরে দেখা যায় সেটা সঠিক না। গসিপ, পরচর্চা, পরনিন্দা এসবও ফেসবুকের নিয়মিত ঘটনা। ট্রল আর ভাইরাল হচ্ছে নানা ঘটনা, নানা মানুষ। কারো সামান্য ত্রুটি পেলেও ঝাঁপিয়ে পড়ার মানুষের অভাব নাই। ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীতে, আন্দোলন, সংগ্রাম হয়েছে, সরকারের পতন পর্যন্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পতো টুইটার আর ফেসবুকের মাধ্যমেই চার বছর দেশ চালিয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের চেয়েও ফেসবুক পোষ্ট বেশি কার্যকর। বইমেলায় আমার ফেসবুক বন্ধুরাই আমার বইয়ের মূল ক্রেতা।
ফেসবুকে মিথ্যে প্রলোভনও আছে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আছে। প্রেমের অভিনয় যেমন আছে, সত্যিকার প্রেমে পড়াও আছে, আলগা বন্ধুত্ব যেমন আছে আবার ভাল বন্ধুত্বও তৈরী হচ্ছে। গোপন সম্পর্ক যেমন আছে তেমনি আছে প্রকাশ্য সম্পর্ক। ফেসবুক গ্রুপ আছে, এডমিন আছে। অনেক লেখার গ্রুপে এডমিনরা রবীন্দ্রনাথ নজরুলের মতো এক্ট করেন। যেনো তারাই লেখক তৈরী করেন। লেখক তৈরী হচ্ছেও। অনেক ট্রাশ লেখায়ও হাজার হাজার লাইক পাওয়া যায়, আবার অনেক ভাল লেখায় বিশ তিরিশ জনে লাইক দিচ্ছে। একটু রগরগে লেখা, খুল্লাম খুল্লা টাইপ ছবিতে বেশি ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষ। আবার রুচি সমৃদ্ধ ছবি বা ভাল লেখা মানুষ ভালবাসছে। ফেসবুকের কারণে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আলগা হয়ে যাচ্ছে। পর নারী বা পর পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে, সংসার ভাঙছে অহ রহ। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডদের অনেকের সংসারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সবাই বাংলাদশের। সেপারেশন একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। যাদের তারকা খ্যাতি আছে স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতি বেশি ঝুঁকছে মানুষ। খ্যাতিমানরা নীল ব্যাজ পাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার তাদের। সুন্দর চেহারা, সুন্দর হাসি, সুন্দর পোশাক দেখেও অনেকে তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
ফেসবুকের কল্যানে আমারও মজার মজার অভিজ্ঞতা আছে। দুটি ঘটনা বলি। বেশ কয়েক বছর আগে একজন ধনাঢ্য নারী এড করল আমাকে। সে একসময় আমার পেনফ্রেন্ড ছিল। দেখাও নাকি হয়েছে আমাদের। আমি অবশ্য কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। তারপর যথারীতি আমাদের কথা হয় ফেসবুকে। বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকে। সে আমাকে নানা আশ্বাস দেয়, স্বপ্ন দেখায়, আমাকে সব দেবে সে। বাড়ি দেবে, গাড়ি দেবে, বিজনেসে দেবে। আমিও মহা খুশী। নিজেকে গাড়ি, বাড়ির মালিক ভাবছি, উত্তরমুখী ঘরে বসে ধানমন্ডির লেক দেখব আর উপন্যাস লিখব এমন স্বপ্ন দেখছি। বিএমডব্লিউ নিয়ে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে থাকবে, ঢাকা ক্লাবে ব্রেকফাষ্ট খেয়ে, চলে যাব মতিঝিলে নিজের অফিসে। তারপর একদিন সত্যি সেই স্বপ্নের বন্ধুর সাথে আমার দেখা হলো। প্রথম দেখা। আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন বাড়ির চাবিটা দেবে, ড্রাইভার এসে সালাম ঠুকবে, বলবে স্যার গাড়ি রেডি। প্রথম দিন একটা মধ্যম মানের রেষ্টুরেন্টে এককাপ কফি খাওয়া পর্যন্ত এগিয়েছে স্বপ্ন..।
দ্বিতীয় ঘটনাটা বলি। কয়েকমাস আগের ঘটনা। একজন খুব সুবেশি মেয়ে আমাকে ফেসবুকে এড করেছে। আমি তার প্রোফাইল ঘেটে দেখলাম সে আমেরিকায় থাকে। খুবই মড মেয়ে। বয়স পঁচিশ। সাজু গুজু নানা পোজের ছবি। প্রতিটায় চমৎকার ইংরেজিতে এক দু লাইনের কথা। ছবিতে কড়া মেকাপ। প্রকৃত চেহারা হারিয়ে গেছে মেকাপের আড়ালে। স্যাক্সফিফথ এভিনিউ থেকে কেনা কসমেটিকস। সেসবের ছবিও আছে। আমি একটু বিভ্রান্ত, তাও তার রিকোয়েষ্ট একসেপ্ট করলাম। পরে জানলাম সে ঢাকায় জব করে। আমেরিকান কোম্পানীর জব। ভাল বেতন পায়। সে আমাকে বলল, আমি দেখেছি আপনি বরিশালে একটা লাইব্ররি করতে চান। আমি আপনার পাশে আছি। আমাকে বাজেট দেন আমি লাইব্রেরি করে দেবো।
আমি মহাখুশী। কৌতুহল বশত জানতে চাইলাম সে কেমন বেতন পায়। বলল পঞ্চাশ হাজার ইউএস ডলার।
আমি বললাম বছরে!
সে বলল না মাসে।
আমি একটু ভিড়মি খেলাম। তবে অসম্ভব নাও হতে পারে।
তারপর দিন যায়, মাস যায়, প্রতিশ্রুতির পাহাড় জমে। একদিন হঠাৎ চ্যারিটির নাম করে সে নিজেই আমার কাছে টাকা চেয়ে বসল। আমি আবার বিভ্রান্ত। আমি বললাম, আমি আমার মতো চ্যারিটি করি। কিন্তু সে নাছোড় বান্দা। এক পর্যায়ে আমি টাকা পাঠাতে রাজী হলাম, যাকাত বাবদ তো দিতেই পারি। কিন্তু আমার মনে দ্বিধা হলো, কু ডাক দিল। আমি ঠিক টের পাই কোনটা সঠিক হবে কোনটা হবে না। এসব কারনে আমি অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পাই।
ফেসবুকের সবচেয়ে ব্রিবতকর যেটা সেটা হচ্ছে কেউ কেউ রিকোয়েষ্ট পাঠিয়েই আর্থিক সাহায্য চায়। মফস্বলের ফিচকা মেয়েরাই বেশি টাকা চায়। অনেকের সত্যি সাহায্যের দরকার আছে। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের জন্য ডোনেশন চায়, কেউ অসুস্থ্যতায় চিকিৎসার জন্য চায়। কেউ অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে টাকা চায়। চেনা মানুষ যেমন চায়, অচেনা মানুষেরাও চায়। যতটা সম্ভব আমি সাহায্য করিও, ডোনেশন দেই। কিন্ত সবসময় পারা সম্ভব হয় না। কিন্তু যখনই কাউকে সাহায্য করতে অপারগ হই তখনই বন্ধুত্ব ছুটে যায়। আনফ্রেন্ড করে আমাকে। আমি নিজে থেকেও আনফ্রেন্ড করি। কিন্তু আমি ব্রিবত হই। ফেসবুকের ভাল দিক যেমন আছে আবার বিব্রতকর ঘটনাও আছে। এটাই জীবন।

আমি শুধু নিঃস্ব হাটুরিয়া
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব আজগুবি লাগে। কেউই বুঝবে না সেই অনুভূতির কথা, কাউকে বোঝানো যাবে না। এসব বোঝা যায় না। নিজেকে ঠিক চিনতে পারি না অনেক সময়। অচেনা একজন হয়ে যাই। বুঝতে পারি না কি চাই, কাকে চাই, কেমন করে চাই। হতাশা ভর করে। ভোম্বলদাশ হয়ে যাই তখন। নিজেকে নিজে চিমটি দিয়ে দেখি, এই আমি কে! কোথা থেকে এসেছি! কোথায় যাব! আজব আজব সব চিন্তা মাথায় ভর করে। তখন কোনো কিছুর প্রতি আর আগ্রহ অনুভব করি না। কোনো কিছু করতে ইচ্ছে করে না। তখন প্রেম ভাল লাগে না, চুম্বন বিস্বাদ লাগে। নিজেকে শূন্য মনে হয়। অর্থহীন মানুষ মনে হয়। মনে হয় আমার কিছু নাই, কেউ নাই, স্ত্রী নাই, সন্তান নাই, আত্মীয় নাই, বন্ধু নাই। নিজেরই কোনো অস্তিত্ব নাই। মায়ার বন্ধন না থাকলে কি হয়! কে বানিয়েছে এসব! আচ্ছা মানুষ কোনো গাছ হয়ে যায় না! মানুষ কেনো পাথর হয়ে যায় না! পাখী হয়ে যত্রতত্র উড়ে যেতে পারে না! মানুষ কেনো পহাড়ের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে না! অথবা সমুদ্রের মতো আদিগন্ত, সীমাহীন, দিগন্তহীন!
এই রকম মুহূর্তে কিছুই ঠিকমতো ঘটে না। ঠিকমতো হতে চায় না। লাগসই হয় না কোনোকিছু। পৃথিবী জুড়েই হতাশায় জর্জরিত মানুষ এখন। তার মধ্যে ভাল থাকা সত্যি কঠিন। এই রকম পরিস্থিতিতে মনের উপর ভিষন চাপ পড়ে আমার। মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে যায়, চিন্তা জট পাকায়, পাগল পাগল লাগে। তখন কোনো কিছুই আর গুছিয়ে করতে পারি না, গুছিয়ে বলতে পারি না, গুছিয়ে ভাবতে পারি না, গুছিয়ে লিখতে পারি না। পরিকল্পনামতো কিছু ঘটে না। তখন সুন্দর কথাও বিষময় লাগে। ভাল কথার ভুল অর্থ করি। ভাল কথা বললেও অসহ্য লাগে, সংসার অসহ্য লাগে।
আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গেই জেসমিনকে বললাম, রাত্রে একটা আজগুবি স্বপ্ন দেখলাম।
কি স্বপ্ন!
দেখি একটা ঘরের মধ্যে অনেকগুলো হাতের কব্জী পড়ে আছে, কাটা। রক্ত মাখা কাটা কব্জী থর থর করছে!
চুপ করো! স্বপ্ন দেখার আর সাবজেক্ট পাওনা। সারাক্ষন ভায়োলেন্স মুভি দেখোতো তাই এসব উল্টা পাল্টা স্বপ্ন দেখো।
রবীন্দ্রনাথ টাইপ ঘুম পারানি মুভি আমি দেখি না।
ক্রিয়েটিভ হও বুজছ!
আবার কি স্বপ্ন দেখলাম শোনো না, অনেক উপর থেকে সাগরে ঝাপ দিয়েছি, মনে হলো উঁচু কোনো ব্রিজ থেকে। বিশাল সাগরের নীল জল কাঁপছে, কাকের চোখের মতো গভীর। আদিগন্ত মিশে গেছে। আমি নিশ্চিত জানি ডুবে গেলে আর উঠতে পারব না, নিশ্বাস নিতে পারব না। হঠাৎ প্রচন্ড কষ্টে ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে।
হইছে এসব ফালতু স্বপ্নের কথা বলতে হবে না।
আমার একটু মন খারাপ হলো। হঠাৎ অপ্রসাঙ্গিকভাবে ব্রেকফাষ্ট খাওয়া নিয়ে কিছু বললাম। জেসমিন স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল, সবসময় যেমন দেয়। স্ত্রীরা ইচ্ছে করেই স্বামীর কথার উত্তর মিষ্টি করে দেয় না, একটু ঝাঁজ থাকে। তেমনই হালকা ঝাঁজ ছিল জেসমিনের কথায়।
কিন্তু আমার মাথায় খট্ করে লেগে যায়। সকাল সকাল বিষাদে ভরে উঠে মন!
আমি বললাম, সাধারণ কথাটার উত্তর এতো কড়া করে দিচ্ছ কেনো! আরও তো সুন্দর করে বলা যায়, নাকি! এতো উচ্চস্বরে কথা আমার পছন্দ না।
জেসমিন বলল, আমি ঠিকমতোই বলেছি। সমস্যা তোমার। জটিল সমস্যা। সবকিছু তোমার কাছে খারাপ লাগে আজকাল। তোমার মতো মিন মিন্না স্বভাবের না আমি। নিজের কথা নিজেই শুনতে পাওনা। মাথা খারাপ মানুষ।
সেই থেকে বিষময় মনে হচ্ছে দুনিয়াটাকে।
জেসমিন রেগে বলল, তোমার ডায়াবেটিস আছে। সকালে ওটমিল, সিরিয়াল, দুধ, ডিম এসব খাবা। কয়দিন থেকে ব্রেড, বাটার, চিনি এসব খাচ্ছ দেখতেছি।
কিন্তু কথাগুলো শুনতে একদম সুন্দর লাগল না আমার কাছে, রুড মনে হচ্ছে কেনো!
আমি বললাম প্রতিদিন ওষুধ টাইপ খাবার খেয়ে আমি টায়ার্ড। অন্যকিছু করো। নতুন নতুন আইডিয়া বের করো! কয়দিন আর বাঁচব! সবকিছু একঘেয়ে লাগছে।
তুমি আইডিয়া বের করে নিজেই করে নাও। এই বলে জেসমিন কিচেনে চলে গেলো।
আমি লেখার টেবিলে চলে আসলাম। আজকাল ছোট খাট ব্যাপারে ঝগড়া হচ্ছে, আমি আপসেট হচ্ছি, অভিমানে বুক ভরে যাচ্ছে। টলারেন্স কমে গেছে আমার। শিশুসুলভ আচরন করছি। কিন্তু জেসমিন এসব বুঝতে পারে না।
কিছুক্ষন পরই ডাক আসল, খেতে আসো।
কিন্তু আমি যাচ্ছি না। বারবার ডাকছে। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। গিয়ে দেখি টেবিলে হাতে বানানো লাল আটার পরোটা, ধোঁয়া উড়ছে, একটু মনে হয় ঘীর প্রলেপ আছে, ঘ্রাণ পাচ্ছি যে! মিক্সট ভেজিটেবল, গরম ডিম সিদ্ধ, সাথে একটা রসগোল্লাও! এবং জেসমিনের বানানো ঘন দুধের চা। বিষাদ কেটে যাওয়ার জন্য এসব যথেষ্ট কিন্তু তবুও ভোম্বলদাশ ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না!

সেই খোঁজা আজও শেষ হয়নি
আমার শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। সেই জীবন যেমন অনেক সংগ্রাম মুখর ছিল তেমনি পুষ্পের ঘ্রানে ভরা ছিল, আনন্দের ছিল। স্বপ্ন কাজল মাখা ছিল সেই দিনগুলি। অভাব, অনটন, অপ্রাপ্তি আর টানাপোড়েন ছিল আবার অনেক মাধুর্য্য মাখা ছিল। সেই সব মায়ার কাজল পরানো দিনগুলোর কথা কখনো ভোলা যায় না। কৈশোর উত্তীর্ণ সময়টা আলো আঁধারিতে ভরা থাকে। শরীরে স্বেদ গন্ধ পাওয়া যায়। সে রকম বয়সে আমার বেশ কিছু মানুষের সাথে সখ্যতা হয়েছিল। নারী পুরুষ দুই ধরণের মানুষ। বন্ধুরাই আমার জীবনে সব। তারাই প্রেরনা, তারাই আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল। আজীবন বন্ধুরা আমাকে ভালবাসা দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, আনুকল্য দিয়েছে। আমার কষ্টের দিনে পরম মমতায় পাশে থেকেছে।
পরবর্তীকালে কেমন করে জানিনা অনেকের সাথেই বিচ্ছিন্নতা এসেছে। হতে পারে আমার ব্যস্ততা বা বিদেশ চলে আসার কারনে এমনটা হয়েছে। সব দোষ আমার। তবে আমার দিক থেকে চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হয়নি। এইসব মানুষেরা আমার জীবনে ভালবাসার ডালি নিয়ে এসেছিল। আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছিল, ভালবাসা শিখিয়েছিল, বন্ধুত্ব আর প্রেমের স্বরুপ চিনেছিলাম। কখনো সেটা চিঠি পত্রের মাধ্যমে, কখনো ব্যাক্তিগতভাবে। আজকে যেটা ভার্চুয়াল সেটা একসময় ঘটত পত্রের মাধ্যমে। চিঠি পত্রের আবেদন আমার জীবন ব্যাপক ছিল।
ফেলে আসা স্মৃতিগুলো আমাকে সবসময় আবেগ তাড়িত করে। রাতের গভীরে ঘুম ভেঙ্গে যায়, দু’চোখ জলে ভিজে উঠে। চোখের সামনে সেলুলয়েডের ফিতার মতো একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠে। কখনো মা সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘুমের মধ্যে কিছুতেই মায়ের কন্ঠস্বর থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। যেনো মা জসিম জসিম বলে ডাকছে। বরিশালের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি রাস্তা ঘাট, প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, অলি, গলি, তার আনাচ কানাচ ,প্রতিটি মানুষ আমাকে শুধু পিছু টানে। পরিচিত, স্বল্প পরিচিত সব মানুষ সামনে এসে ভীড় করে। তখন অস্থির হয়ে উঠি। ঘুম আসে না। যারা চলে গেছেন তারাও সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি মনকে আন্দোলিত করে।
বরিশালে আমাদের বাড়িটার কথা না বললেই নয়। খুব বৈচিত্রময় ছিল। বিশাল বড় ফ্যামিলি আমাদের। এতোটাই বড় যে চারটা ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অনেক গাছগাছালি, ফলফলাদি গাছ, ঘন সবুজ বন জঙ্গল, বাঁশঝাড়। রাতে শেয়াল ডাকে, জোনাকি পোকারা টিপ টিপ আলো ফেলে, নিঝুম দুপরে যখন বাড়ির মহিলারা ভাতঘুম দেয় তখন ঝিঁ ঝিঁ পোকারা একটানা ডেকে যায়, ঘুঘুর মন কেমন করা ডাক শোনা যায়। পুকুর আছে দশ বারেটা, তাতে ভরভরন্ত পানি আর মাছেরা সাঁতার কাটে। অনেক মানুষ বাড়িতে। গোনাগুনতি নাই। আমিও তারমধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি। জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই একলা, কালো জাম কুড়াই, ঢেকির শাঁক খুঁজি। কাটা ঘুড়ির পিছনে দৌঁড়াই। নানা অনুষ্ঠান হতো আমাদের বাড়িকে কেন্দ্র করে। আমরা কয়েকজন নেতৃত্ব দিতাম। আমার বড়রা বাৎসরিক নাটক করতেন মঞ্চ করে। সেটা ছিল একটা উৎসবের মতো। শহরজুড়ে লোকজন ছুটে আসত নাটক দেখতে। আমরা রাতের পর রাত রিহার্সেল দেখতাম।
মল্লিক বাড়ির পুল ছিল বিখ্যাত। শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে রিক্সাওয়ালাকে বললেই নিয়ে আসত। নাটক ছাড়াও আমরা ফুটবল, হাডুডু, হকি টুর্নামেন্টের আয়োজন করতাম। শীতের বিকেলে আমাদের মাঠে নেট টাঙ্গিয়ে ভলিবল খেলা হতো এবং রাতে লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন। বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। ইকবাল পাঠাগার এন্ড ক্লাব ছিল আমাদের। রেজিস্টার্ড ক্লাব। ক্লাবের উদ্যোগেই এসব করতাম আমরা। এলাকার সববয়সী শিশু কিশোরদের এনগেজ রাখতাম খেলাধুলায়। কেরাম প্রতিযোগিতা হতো, বই পড়ার প্রতিযোগিতা করতাম। বাৎসরিক নৌকা বাইচ, সাঁতার, ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা পর্যন্ত হতো আমাদের পরিবারের উদ্যোগে। যাত্রাপালা হতো। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত যাত্রাপালা দেখত। অনেক বড় বড় জাম গাছ ছিল আমাদের বাড়িতে। অত্র অঞ্চলের লোকজন জাম পেরে নিয়ে যেতো। ছিল লিচু, কুল, আমলকি, জলপাই, কামরাঙ্গা, ডউয়া, গাব, জাম্বুরা,
আমলকি, সফেদা, নইল সহ নানা ফলের গাছ। আম কাঠাল তো ছিলই।
এখন সে সব আর নেই তেমন। মানুষ গুলোই শুধু আছে কিন্তু সেই সুন্দর দিনগুলো আর নেই। এখন সবাই বৈষয়িক। টাকা পয়সা, ব্যবসা বাণিজ্য, কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। মানিসক বিকাশের কোনো সুযোগ আর নেই। নেতৃত্বের অভাবে সব বন্ধ হয়ে গেছে। খালে বিলে ঝাপ দেওয়া নেই, পুলের গোড়ায় ছোট্ট টং রেষ্টুরেন্টে সকালে পরোটা আর ভাজি খাওয়া নেই, দুপুরে ডুবা তেলে ভাজা গুলগুল্লা খাওয়া নেই। সেই জাম গাছ নেই। পুকুরে সাঁতার কাটা নাই, শেঁওলা জমে গেছে পুকুরে। খালগুলো মরে গেছে। সেই জোয়ারের ঘোলা পানির স্রোত নেই , খেলার মাঠে কেউ খেলতে নামে না, পাঠাগার বন্ধ হয়ে গেছে কবেই। এখন কেউ চিঠিও লেখে না। পত্রমিতালি নেই। ডাক পিয়নের সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে চিঠি নিয়ে আসা নেই। নাটক নেই, ভলিবল খেলা নেই, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নেই, যাত্রাপালা নেই, নৈাকা বাইচ নেই। কারো হাতে বই নেই।
এসবের মধ্যেই আমি বেড়ে উঠেছিলাম। আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছিল। বরিশালের অপরূপ নৈসর্গ, সবুজ প্রকৃতির মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। কৈশোরে আমি অনেক দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম। আমার দূরন্তপনার জন্য আমার মাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আমি রাস্তার ছেলেদের সাথে চারা খেলতাম, মার্বেল খেলতাম, স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতাম, গাছে চরতাম, সাইকেলের রিং চালাতাম, ঘুড়ি ওড়াতাম, সাইকেল চালিয়ে শহর দাপরে বেড়াতাম।
আমি ছিলাম প্রথাবিরোধী এক কিশোর। আমাদের পরিবারটি ছিল একটু সামন্তবাদী। আমি ওসবের তোয়াক্কা করতাম না। তাই একটু বড় হয়ে যখন আমার তেরো চৌদ্দ বছর বয়স আমি আকস্মিক নির্জন হয়ে গিয়েছিলাম। দলছুট হয়ে গেছিলাম। প্রকৃতির সাথে সখ্যতা গড়ে তুললাম। গাছেদের সাথে, পোকামাকরের সাথে, কীট পতঙ্গের সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো। আমার ভিতরে এক অন্য আমির আবির্ভাব ঘটেছিল। আমার মা, আমার খেলার সাথীরা অবাক হয়েছিল। তখন আমি বইয়ের জগতে নিজেকে খুঁজতে শুরু করি। সেই খোঁজা আজও শেষ হয়নি।

জসিম মল্লিক, সাংবাদিক ও লেখক। টরন্টো