করোনার দিনগুলো

করোনা ভ্যাকসিন শুরু হয়েছে কিন্তু সরবরাহে গতি নেই

ফেব্রুয়ারী ৪, ২০২১

জসীম মল্লিক

করোনা প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকাদান শুরু হয়েছে। কানাডায়ও শুরু হয়েছে। আমাদের আগের লেখায়ই সেটা উল্লেখ করেছি। এদিকে কোভিডের নতুন উপসর্গ শুরু হয়েছে। সাউথ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্যের নতুন ভেরিয়েন্ট নিয়ে শঙ্কিত পুরো বিশ্ব। কানাডায়ও এটা সনাক্ত হয়েছে। দ্রুত বিস্তার লাভ করে নতুন ভেরিয়েন্ট। এদিকে হঠাৎ করেই ফাইজার তাদের টিকার সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। কানাডায় বিশেষত অন্টারিওতে ভ্যাকসিন কার্যক্রম কার্যত স্লথ হয়ে পড়েছে। এ লেখা যখন প্রকাশিত হবে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তে ভ্যাকসিন পূর্ণ মাত্রায় গতি পাবে বলে জানানো হয়েছে।

এদিকে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে, এ নিয়েও দেখা গেছে আতঙ্ক। এর মধ্যে টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান মডার্না জানায়, তাদের টিকা দুই বছর পর্যন্ত কার্যকরী থাকবে। যদিও এই তথ্যের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ দেয়নি মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। তাহলে কি একবার করোনার টিকা নেওয়াই যথেষ্ট নয়, এমন প্রশ্ন ওঠেছে। মডার্নার সিইও স্টেফান বানসেল সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেন, করোনার টিকা কয়েক মাস পর্যন্ত কার্যকর থাকে, কিছুদিন আগে এমনটা প্রকাশ হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে। তারপর ফের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে ভাইরাস। মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। স্টেফানের দাবি, তাদের ভ্যাকসিন দুই বছর পর্যন্ত সক্রিয় থাকবে। তবে তিনি নিজেই জানিয়েছেন, এই বক্তব্যের পক্ষে তার কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। বাস্তবে টিকার সক্রিয়তা কতদিন থাকবে, তা দেখতে হবে।

অন্যান্য টিকার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য মডার্নার টিকাও দিচ্ছে মানুষকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও মডার্নার টিকা ছাড়পত্র পেয়েছে। এর আগে ফাইজারের টিকা ছাড়পত্র পেয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে। যুক্তরাষ্ট্রে ফাইজারের টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অক্সফোর্ডের টিকাতেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে। ফলে অক্সফোর্ডের টিকার সঙ্গে এখন প্যারাসিটামলও দেওয়া হচ্ছে। কারণ, এ টিকা নেওয়ার পরে অনেকেরই জ্বর হচ্ছে।

কোনো কোনো চিকিৎসকের বক্তব্য, করোনার টিকায় স্বাভাবিক ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতায় সমস্যা হচ্ছে। তবে কোনো কিছুই পরীক্ষিত নয়। যে রোগীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তাদের চিকিৎসা করতে গিয়ে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি ভারতের টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা ভারত বায়োটেক জানিয়েছে, সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি অক্সফোর্ডের টিকার কার্যকারিতা এক বছরের বেশি নয়। যদিও সেরাম এই বক্তব্য মানতে চায়নি। তবে তাদের টিকার কার্যকাল কতদিনের সে বিষয়েও তারা স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি। ভারত বায়োটেকও তাদের টিকার কার্যকাল বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি। মডার্না অবশ্য দাবি করেছে, তাদের টিকা কভিড ঠেকাতে ৯৪ দশমিক এক শতাংশ কার্যকর। যদিও এটা নিয়েও কোনো তথ্যপ্রমাণ দেননি মডার্নার সিইও।

বইমেলা এবং একটি সঠিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়

বইমেলার সাথে আমাদের আবেগ জড়িত। বইমেলা হচ্ছে প্রাণের মেলা। ১৯৮৩ সাল থেকে আমি বইমেলার সাথে জড়িত । আমি বরিশাল ছেড়ে ঢাকা এসেছিলামও লেখালেখি করব, লেখকদের দেখব সামনে থেকে সেই প্রত্যাশায়। তখন বাংলা একাডেমি চত্তরে শুধু বইমেলা হতো। আমরা কয়েকজন মিলে বিচিত্রার জন্য বইমেলার রিপোর্ট করতাম। লেখক, প্রকাশক, পাঠকের সাথে কথা বলতাম। ভাল বইয়ের তালিকা করতাম। সেগুলো বিচিত্রায় ছাপা হতো। পাঠকরা বিচিত্রার কাটিং হাতে নিয়ে সেইসব বই খুঁজত। ২০০৩ সালে কানাডা আসার পরও প্রতিবছর বইমলোয় গিয়েছি।

আমার মতো প্রবাসে বসবাসরত আরো অনেক লেখক প্রতিবছর মেলায় অংশ নেন। বইমেলাকে কেন্দ্র করেই সব আয়োজন। লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকের অপেক্ষা থাকে বছরজুড়ে। নতুন নতুন বইয়ের ঘ্রাণে ম ম করে বইমেলা। প্রতিবছর মেলার পরিসর বাড়ছে। লেখক বাড়ছে, প্রকাশক বাড়ছে, বই প্রকাশনা বাড়ছে, বিক্রি বাড়ছে পাশাপাশি বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাদের ব্যস্ততাও বাড়ছে। একমাস তাদের ঘুম হারাম। আগের চেয়ে মেলা বহুগুন বড় হয়েছে। শুধু ঢাকার মানুষই না সারাদেশ থেকে বইপ্রেমিরা ফেব্রুয়ারী মাসে মেলায় আসেন। আমিও যেতে চাই।

২০২১ এর বইমেলা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরী হয়েছে। কোভিড পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থা চলছে এখন সারা পৃথিবীতে। এই অবস্থায় বইমেলা করা হবে বিরাট ঝুঁকিপূর্ন। বই বিক্রীর চেয়েও জীবন অনেক মূল্যবান। বইমেলায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসেন। এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই সোশ্যাল ডিসট্যান্স মানা সম্ভব হবে না। বইমেলা ফ্রেব্রুয়ারির ১ তারিখই শুরু হতে হবে এমন না। সরকার জনস্বাস্থ্যটাই আগে দেখবে বলে আশা করা যায়। সেক্ষেত্রে বইমেলা কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হলে আয়োজন করাই ভাল হবে। পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ভার্চুয়াল বইমেলার কোনো ইমপ্যাক্ট নাই। অবশেষে সরকার ১৮ মার্চ থেকে মাসব্যাপী বইমেলা করার অনুমতি দিয়েছে।

মনে রাখা দরকার যে প্রকাশনা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে হাজার হজার মানুষের রুটি রুজি। তাই আমি আশা করি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি এবং মেলার অংশীজন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি ও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতি সঠিক সিদ্ধান্তটাই নেবেন।

চিঠিপত্র দিয়ে আমার লেখালেখির শুরু। বিচিত্রায় ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন দিতাম আমি। পয়সার বিনিময়ে চার পাঁচ লাইনের একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হতো আর প্রবল আলোড়ন উঠত। আলোড়ন যত না আমার চার লাইনের লেখার জন্য উঠত তারচেয়ে বেশি বিচিত্রায় জনপ্রিয়তার জন্য। বিচিত্রা বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর হয়েছে অথচ এখনও আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে আপনি কি বিচিত্রার সেই জসিম মল্লিক! আপনার বিজ্ঞাপন গুলো খুব সুন্দর ছিল। সুন্দর সুন্দর কথা থাকত। খুব মনে পড়ে। একসময় আমার অসংখ্য পত্রবন্ধু ছিল। এখনও কেউ কেউ তাদের কাছে লেখা চিঠির ছবি তুলে আমাকে পাঠায়। আমি অবাক হয়ে সেইসব দেখি। ভাবি এতো বছর কেউ কারো চিঠি সংরক্ষন করে! তাও আমার মতো এলেবেলে মানুষের চিঠি! এরা সবাই মেয়ে। মেয়েরা সবসময় আমাকে পক্ষপাত দিয়েছে। আমার পক্ষে থেকেছে!

এটা ঠিক যে আমি নিজের আনন্দের জন্য লিখি। আমি শৈশবকাল থেকেই খুব একলা ছিলাম, নির্জন ছিলাম তাই লেখা হয়ে উঠেছিল আমার সঙ্গী। আমার ভিতরে অনেক আবেগ আছে। আবেগের তাড়নায়ও আমি কাগজ কলম নিয়ে বসি। লেখালেখি নিয়ে আমার কোনো আদিখ্যেতা নাই। প্রতিযোগিতা নাই। ইদুর দৌড় নাই। মঞ্চ মাতানোর সবিশেষ কোনো ইচ্ছাও নাই। আমি নিভৃতের মানুষ, নিভৃতেই থাকতে চাই। আমি কখনো ভাবিনি আমার লেখা পত্রিকায় ছাবা হবে, আমি কখনো গল্প, উপন্যাস লিখব তাও ভাবিনি, আমার বই প্রকাশিত হবে বা লেখার জন্য রয়ালটি পাওয়া যায় কে ভেবেছে! অবাক কান্ড সব! দেখতে দেখতে কেমন করে প্রায় ৪০ টি বই প্রকাশিত হয়েছে আমার।

চিত্রালী, পূর্বানী, বেগম, ইত্তেফাক, সংবাদ, সন্ধ্যানী এই সব পত্রিকায় লিখতাম। তারমধ্যে বিচিত্রাও ছিল। ঢাকা আসার আগে আমি কোনোদিন কোনো পত্রিকা অফিস দেখিনি, কোনো সম্পাদক দেখিনি। সম্পাদক, সাংবাদিক বা লেখক দেখতে কেমন তাও জানি না। কিন্তু মনের আগোচরে ঘুরাফিরা করে অনেক নাম। ছাপার অক্ষরে দেখা নাম। ঢাকায় আসার পরও আমি লেখা নিয়ে কোনো সম্পাদকের টেবিলে যাইনি। লেখা পাঠিয়ে কখনো ফোন করিনি বা বলিনি আমার লেখা ছাপেন। লেখক, সাংবাদিকদের সাথে যে চেনা পরিচয় হতো তাতেই আমি বিস্মিত, মুগ্ধ। নিজের লেখা নিয়ে কখনো কথা বলি না কারো সাথে। কে কি ভাবে! আমি একটু ভীতু, একটু লাজুক তাই লেখা লেখা ছাপানোর জন্য কাউকে অনুরোধ করি নি কখনো। নিজের জন্য কিছু চাইতে পারি না সহজে।

লিখে যে টাকা পাওয়া সেটা অনেক পরে জেনেছি। বিচিত্রায় কাজ করার সুবাদে জেনেছি। সেটা ছিল রোমাঞ্চকর। লেখক হওয়ার গোপন ইচ্ছা সবসময়ই ছিল কিন্তু কোন এক ফাঁকে সাংবাদিক তকমাও লেগে গেলো নামের সাথে। যখনই কোথাও আমার লেখা ছাপা হতো আমাকে অবাক করে দিয়ে লেখার বিল দিত। এখনও দেশে গেলে টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিলে একটা খাপ ধরিয়ে দেয় প্রযোজক। সেটার মধ্যে কিছু সম্মানী থাকে। লেখার জন্য সম্মানী দেওয়া বা পাওয়া দুটোই খুব সুন্দর, আনন্দের। ফ্রীতে লেখা চাওয়া বা ফ্রী লেখা দুটোই নন প্রফেশনাল কনসেপ্ট। আমি নিজেও যে বিনে পয়সায় লিখিনি তা না। বিদেশের পত্রিকায় অনেকই লিখেছি। তারমধ্যে ব্যাতিক্রম প্রবাসী কন্ঠ নামে টরন্টো থেকে প্রকাশিত একটি মাসিক নিউজ ম্যাগাজিন। তারা লেখার জন্য সম্মানী দেন। এই তো কাল একটা হুলুদ খাম এসেছে বাড়ির ঠিকানায়। তার মধ্যে পাঁচটা পত্রিকা এবং পাঁচশ ডলারের চেক। এ বছর এই নিয়ে দুবার পাঁচশ ডলারের চেক এসেছে। খারাপ কি! খারাপ নাতো! প্রবাসী কন্ঠের সাফল্য কামনা করি।

সেদিন ছিল ৪ জুলাই, শনিবার। কাজ থেকে ঘরে ফিরে শাওয়ার নিলাম, ডিনার খেলাম। ডিনার খাওয়া শেষ হতে না হতেই মাথাটা কেমন টলে উঠল। প্রথমে খুব একটা পাত্তা দিলাম না। মনে করেছি অনেকদিন বাদে লম্বা সময় কাজ করেছি, খুব গরমও ছিল সেদিন, পানিও খাওয়া হয়নি তাই হয়ত ডিহাইড্রেশনের জন্য এমন লাগছে। এর আগে কোভিডের প্রথম ওয়েভে ভয়ে আতঙ্কে তিন মাস ঘর থেকেই বের হয়নি। ঢাকা থেকে ফিরেছি মার্চের শেষে। মাথা ঘোরা অবস্থায় ইশার নামাজ পড়লাম। অর্ক ও খাতিজা তখন আমার বাসায়। ওরা নানা কিছু করছে। কোকোনাট ওয়াটার খেতে দিল। মনে করেছে সুগার ফল করেছে। এদিকে ঘরে প্রেসারের মেশিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রেসার সমস্যাও হতে পারে। আমি বিছানায় লুটিয়ে পড়েছি, আমার পৃথিবী দুলছে।

সেই থেকে টানা প্রায় আড়াই মাস ভুগেছি ভার্টিগো আর ডিজিনেসে। অদ্ভুত এক কষ্টের অনুভূতি হয়েছিল আমার। সারাক্ষন স্পিনিং হতো। সপ্তাহখানেক পর সানিব্রুক হাসপাতালের ইর্মাজেন্সিতে প্রথমবার গেলাম। সেখানে ব্রেনের সিটিস্কান করল। তারপর ইএনটি স্পেশালিষ্ট দেখল, হীয়ারিং টেষ্ট করা হলো। সাধারণতঃ কানের ইনার প্রবলেম থেকেই ভার্টিগো হয়। তাই মাইকেল গ্যারন হাসপতাালে ব্যালেন্স টেষ্ট করলাম। সবগুলো রিপোর্ট ভাল আসল। তারপরও ডিজিনেস যায় না। রেফার করা হলো নিউরোলোজিষ্টের কাছে। অবাক কান্ড হচ্ছে কোভিডের মধ্যেও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি এদেশে।

আমার ফ্যামিলি ডাক্তারের নাম শারমিন হো। চাইনীজ ডাক্তার। তিনি প্রতি সপ্তাহে আপডেট নিতেন। এদেশে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানই সবকিছু। তিনিই সব জায়গায় রেফার করেন। নিজে নিজে স্পেশালিষ্টের কাছে যাওয়া যায় না। সৌদী রাজ পরিবারের চিকিৎসক আরিফ ভাইকে ফোন দিতাম যখন তখন। তিনি অসীম ধৈর্য্য নিয়ে আমার সমস্যা শুনতেন। অন্যান্য স্পেশালিষ্টদের সাথে আমার ব্যাপার নিয়ে কথা বলেছেন। লন্ডন, আমেরিকায় তার বন্ধু ডাক্তারদের সাথে আলোচনা করেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন। বন্ধুদের সারাক্ষন ব্যাতিব্যস্ত রেখেছি। যাদেরই এই ধরণের সমস্যা হয়েছে তাদের সাথেই কথা বলতাম। বন্ধু সিনা এক্সারসাইজ দেখিয়ে দিত, নিউইয়র্ক থেকে বন্ধু সেলিনা ইয়োগার কোর্স করিয়েছে কয়েকটা। নানা পদের অষুধ খেয়েছি। যে যেটা বলেছে সেই ওষুধই সংগ্রহের চেষ্টা করতাম। ফ্যামলি ডাক্তার ছাড়াও ওয়াকিং ক্লিনিকে গিয়ে ডাক্তার লাম্বারডিকে দেখিয়েছি। রিটন ভাই ফোন করে সাহস দিতেন। মজার মজার কথা বলে আমাকে ডাইভার্ট করতে চাইতেন।

রুমানার কাছ থেকে বাংলাদেশী ওষুধের নাম নিয়েছি। তাকে বার বার ফোন করেছি। আমার একজন বন্ধু তখন ঢাকায় ছিলেন। কল্পনা নাম তার। তিনি আমার জন্য কিছু ওষুধ নিয়ে আসলেন। মুক্তার ভার্টিগো হয়েছিল। যে ওষুধ খেয়ে সে ভাল হয়েছে সেই প্রেসক্রিমশন ডাক্তারের কাছ থেকে লিখিয়ে এনে তারপর আমাকে পাঠাল। সোমা ওষুধের ব্যপারগুলো ভাল বোঝে। ওকেও জ্বালিয়েছি অনেক। ক্যাপ্টেন শামস এবং জামান ভাই ওষুধ এনে দিয়েছে ঢাকা থেকে কিন্তু কেউই ওষুধের দাম নেয়নি, কি আজব কথা! মাইকেল গ্যারন হাসপতালে আমার আর এক বন্ধু চাকরি করে তাকেও যখন তখন ম্যাসেজ দিতাম। সেও ধৈর্য্য নিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দিত।

কিন্তু আমার ডিজনেস কমছে না। পরিস্থিতি খারাপ। অতঃপর আগষ্টের ১ তারিখ ৯১১ কল করতে হলো। সেদিন ছিল শনিবার সন্ধ্যা এবং কাকতলীয়ভাবে সেদিনও অর্ক আমার বাসায় ছিল। অর্কই কল করল ৯১১। সেই প্যারামেডিকসের সাথে কথা বলেছে। কানাডায় আঠারো বছরের জীবনে এই প্রথম নিজের জন্য এম্বুলেন্স কল করতে হলো। দশ মিনিটের মধ্যে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের চার পাঁচ জন আসল। তাদের তদারকি শেষ হতেই ঢুকল প্যারামেডিকসের লোকজন। তারা টুকিটাকি কথা শেষ করে দ্রুততার সাথে হাসপাতালে নিয়ে গেলো আমাকে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে লেগেছে মাত্র ২৮ মিনিট! এম্বুলেন্সে যখন বেডে শুয়ে আমি তখন একজন অতিশয় রুপসী নার্স আমার পাশে বসে নানা মিষ্টি মিষ্টি গল্প করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার কন্ডিশন কতটা খারাপ সেটা বোঝার জন্যই কথা বলছিল। আমার কষ্ট হলেও সুন্দরী নারী কথা বলছে আর আমি চুপ করে থাকব তাত হতে পারে না!

এবার ভাল খরবটা বলি। এদেশে কোনো একটা সমস্যা হলে সবধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। দুইবার সিটিস্কান, ব্লাড টেষ্ট, ব্যালেন্স টেষ্ট করেও সন্তুষ্ট হতে পারছিল না ডাক্তার। তাই নিউরোলোজিষ্ট ব্রেন এবং কানের ডীপ ইনার অংশের এমআরআই দিলেন। ৬ ডিসেম্বর এমআরআই ছিল। যেদিন মাইকেল গ্যারন হাসপাতালে গেলাম এমআরআই করতে দেখি কেমন সুন সান সবকিছু, যেনো কবরের নিরবতা। কোভিডের জন্য হাসপাতালে কোনো ভিজিটর নাই, খাবারের দোকানগুলো বন্ধ, শুধু পেশেন্ট আছে তাও যখন যার সিরিয়াল তখন সে আসছে। টেকিনিশানও একজন মাত্র। অতিরিক্তি একজন মানুষ নাই। সারাক্ষন ডিসইনফেক্ট করা হচ্ছে। যাইহোক। গতকাল ডাক্তার রুসেফের সাথে আমার ফোন এপয়নমেন্ট ছিল। আমি দুরু দুরু বক্ষে ফোন রিসিফ করলাম। তখন দুপুর ১.৪০। প্রথমে আমি কেমন আছি, ডিজনেস আছে কিনা সে সব জানতে চাইলেন। আমি বললাম যে কিছুদিন থেকে একটু লাইট ডিজিনেস হচ্ছে। সবশেষে তিনি বললেন তোমার এমআরআই’র রিপোর্ট ভাল। ব্রেন বা কানে কোনো সমস্যা নাই।

ভয় ভীতির মধ্যে সবই হচ্ছে বাংলাদেশে। কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে, ভ্যাকসিন নিয়ে নানা প্রচারনা চলছে। আমার চেনা জানার মধ্যে আশিভাগের ইতিমধ্যে কোভিড হয়ে গেছে। এসবের মধ্যেই বেড়ানো হচ্ছে, পিকনিক হচ্ছে, আড্ডা হচ্ছে, বই প্রকাশ হচ্ছে, প্রকাশনা উৎসব হচ্ছে, বিয়ে শাদি হচ্ছে, জমায়েত হচ্ছে, জাহাজ ভরে সেন্টমার্টিন যাওয়া হচ্ছে। কক্সবাজার আর কুয়াকাটা যেতে বাসে বা প্লেনের সীট খালি নাই, হোটেল আর রিসোর্টগুলো টইটুম্বুর। কি হচ্ছে না! সবই হচ্ছে। ফেসবুক খুললে বোঝা যায় কোথাও কোনো সমস্যা নাই। মৃত্যু এবং উৎসব হাত ধরাধরি করে চলছে। এইসব দেখে আমার মন খারাপ লাগে। আমি ওসবের অংশীদার হতে পারছিনা। এই সময় আমার দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু এবার কিছুই হচ্ছে না। বইমেলা হলেও না হয় একটা কথা ছিল। এখন যে কেউই সম্মতি দিচ্ছে না যাওয়ার। অর্ক, অরিত্রি না, জেসমিন না। রিটন ভাই বলছেন যাইতে চাইলে যান মিয়া, আজিমপুরের কাছে থাইকেন। এমনকি বাংলাদেশের বন্ধুরাও না বলছে।

কানাডায় ভ্যাকসিন শুরু হয়েছে কিন্তু খুবই শ্লথ গতি। আগামী স্প্রিংয়ের আগে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী আশা করছেন সেপ্টেম্বরের মধ্যে সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে পারবেন। এখন কড়া লকডাউন চলছে। রাত আটটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত ইমারজেন্সির আওতায়। কোথাও কিছু হচ্ছে না। রাস্তাঘাট ফাঁকা, শপিংমল বন্ধ, হোটেল বন্ধ, সিনেমা হল বন্ধ, স্কুল বন্ধ, জীম বন্ধ। কফি শপের শুধু ড্রাইভ থ্রু খোলা। অর্ক, অরিত্রি, সাদ, খাতিজা সবাই হোম অফিস করছে। আমি গত অক্টোবর থেকে কোনো বন্ধু বা আত্মীয়র মুখ দেখিনি। চারদিন কাজে যাই, এ ছাড়া কোথাও যওয়া নাই। বাইরে যাওয়ার অভ্যাসই নষ্ট হয়ে গেছে।

শুধু বন্ধু আলম আর আমি দু’জন গাড়ি নিয়ে দেখা করি। গাড়ির মুখ দু’জনের দু’দিকে পার্ক করি যাতে প্যাসেঞ্জার সীট পাশাপাশি করা যায়। সোশ্যাল ডিসট্যান্স। গাড়িতে হীটিং চালিয়ে গ্লাস খুলে কথা বলি, হোম মেইড চা খাই। চা আলম ভাই বানিয়ে আনেন। কখনো কখনো মুড়ি থাকে চায়ের সাথে বা টোষ্ট বিস্কিট। এই হলো জীবন। লেখালেখির কোনো মন নাই। বেঁচে যে আছি তাই বিশ্বাস হয় না। কত বন্ধু যে চলে গেছে! আপনজন চলে গেছে!

নিতিশ তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী হায়দারাবাদের ছেলে। পঁচিশ বছরের যুবক। ২০১৯ এ আমি একবার হায়দারাবাদ গিয়েছি। আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। আমাদের সাকিব আইপিএলে হায়দারাবাদে খেলে। ঐতিহাসিকভাবেই হায়দারাবাদ অনেক বিখ্যাত স্থান। ফিল্ম সিটি, টেকনোলজি সিটি সহ গোলকোন্ডা ফোর্ট, চারমিনার, মেক্কা মসজিদ ছাড়াও অনেক কিছুর জন্য বিখ্যাত হায়দারাবাদ। সবচেয়ে বড় হচ্ছে অর্ক বিয়ে করেছে হায়দারাবাদের অভিজাত মুসলিম ফ্যামিলির মেয়ে খাতিজাকে। নিতিশ হিন্দী বোঝে কিনা জানিনা তবে হায়দারাবাদের মানুষ উর্দু ভাল বোঝে। কিন্তু নিতিশকে আমি তেলেঙ্গানা ভাষায় কথা বলতে শুনেছি। সর্ব ভারতীয় কমিউনিকেশেনের ভাষা হচ্ছে ইংরেজি।

আমার অনেক ইন্ডিয়ান বন্ধু এবং সহকর্মী আছে। ভারতীয়দের দুটো জিনিস আমাকে মুগ্ধ করে, চোখে পানি এসে যায়, সেটা হচ্ছে তাদের দেশপ্রেম এবং গুনীজনের প্রতি সম্মান। এমনিতেই ইন্ডিয়ানরা জাতিগতভাবেই ট্যালেন্ট। দ্রুত যে কোনো কিছু আয়ত্ত্ব করে ফেলে। ঠান্ডা মাথার এবং নির্ভরশীল। বহু বছর আগে আমার বস মি. এইচ আর খান বলেছিলেন, জসিম কোনো দিন যদি বিদেশে যাও চেষ্টা করবা ইন্ডিয়ানদের প্রতিবেশি হতে। কাকতলীয়ভাবে সত্যি সত্যি আমি বিদেশে এসে আমার প্রতিবেশি ইন্ডিয়ান পেয়েছি। একজন বয়স্ক দম্পতি থাকেন আমার নেক্সট ডোরে। আহমেদাবাদ রাজ্যের মানুষ। মূলতঃ গুজরাটের। জেসমিনের সেকেন্ড মা যেনো। যখন যা রান্না করেন পাঠিয়ে দেন।

নিতিশের সাথে কাজ করছি সাত আট মাস হবে। কিন্তু কখনো ওর ফেস দেখিনি। কারণ সবাই মাস্ক পড়ে থাকি। কেউ কাউকে দেখতে পাইনা। নতুন যারা কাজে জয়েন করেছে তাদের যদি মাস্ক ছাড়া দেখি চিনব না, আমাকেও চিনবে না কেউ। আমাদের বস এতোটাই চুপচুপ মানুষ যে কখনো এলে পুরনোরা ছাড়া নতুনরা তাকে হঠাৎ চিনতে পারে না। তিনিও মাস্ক পরে থাকেন বলে নতুনরা বুঝতেই পারে না বস তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তিনিও কখনো জানান দেন না। মানুষটাই এমন। কোনো বসিং নাই, হম্বি তম্বি নাই। মানবিক মানুষ। হেসে কথা বলেন সবসময়।

এমনিতে আমি হঠাৎ কাউকে দেখে চিনতে পারি না। আমার মেমোরিতে পৌঁছাতে দেরি হয়। চেনা মানুষ সামনে দিয়ে হেঁটে যায় আমি অবাক হয়ে ভাবি কোথায় যেনো দেখেছি! এতো চেনা লাগছে! কিন্তু কখনো সামনে পড়ে গেলে আমি ভোম্বলদাশের মতো তাকিয়ে থাকি। চিনতে পারি না, নাম ভুলে যাই। অনেকেই অভিযোগ করেছে দেখেও না দেখার ভান করতেছো যে! তাই আমি পারতপক্ষে মানুষের সামনে যাই না। দূর থেকে কাউকে দেখলে এড়িয়ে যাই। আবার চিনলেও বাক্যের অভাব দেখা দেয়। কি কথা বলব! আমারতো বেশি কথা নাই। আমাকে কথা না বলতে বললে আমি খুশী। সবাই বলবে আমি শুনব। এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না।

সেদিনের ঘটনা..

কি খবর!

নিতিশ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো একটু।

এতো দেরিতে লাঞ্চ খাচ্ছ যে! বিজি ছিলা!

নিতিশ আবারও মাথা নাড়ল।

আজকে খুবই ঠান্ডা বাইরে। উইন্ডচিল সহ মাইনাস বারো!

নিতিশ এবার বোবার মতো আমার মুখের দিকে তাকালো।

আচ্ছা নিতিশ আমার কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে না কেনো! সমস্যা কি! ভাবলাম ওর কথা বলার মুড নাই। আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। একটু পর আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারলাম! আসলে আমি নিতিশকে একজন বাঙালি কাজ করে আমাদের সাথে ওকে মনে করে বাংলায় কথা বলেছি, তাই উত্তর দিচ্ছিল না। দুজনের একই বয়স, একই গঠন, একই রঙ। বস্তুতঃ দুজনের কারোরই আমি এখনও মুখ দেখেনি। তাই এই বিভ্রাট!

মাস্ক এখন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মাস্ক পরে থাকতে থাকতে নিশ্বাস বন্ধ আসে আমার। তখন একটু বাইরে গিয়ে ফ্রেস বাতাস নিয়ে আসি। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এখন দুই মিটারে সীমাবদ্ধ। হাত মেলোনো নাই, হাগ করা নাই, চুমু খাওয়া নাই। একটু পর পর হাত স্যানিটাইজ করতে হয়, প্রতিদিন টেম্পারেচার মাপতে হয়, যারা চশমা পরেন তাদের জন্য আরো ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে চশমা ফগি হয়ে যাওয়া। বাইরে ঠান্ডা, ঘরে হিটিং তাই এটা হয়।

আমাদের ঘরের দরজার সামনেই অন্ততঃ দশ প্রকারের কোভিড সুরক্ষার জিনিস এনে রেখেছে অরিত্রি। হ্য্যান্ড গ্লভস পড়তে হয়। প্রতিদিন বাইরে থেকে এসেই কাপড় চোপড় দ্রুত ওয়াশিং মেশিনে ফেলতে হয়, ফেস ওয়াশ থেকে শুরু করে নানা রকম স্প্রে করতে হয়। পার্সেল বা চিঠিপত্র আসলে তিন দিন টাচ করা যাবে না। নগদ টাকা পয়সার কোনো লেনদেন নাই। অরিত্রির সর্বশেষ নির্দেশ হচ্ছে বাবা, বাইরে গেলে এখন থেকে দুটো মাস্ক পরবা, একটা ওয়াশেবল একটা ডিসপোসেবল।

হায় আল্লাহ আর কত কাল এমন চলবে!

টরন্টো ২৪ জানুয়ারী ২০২১