DON CHERRY – ‘You people’ এবং তার পতন

ডিসেম্বর ৭, ২০১৯

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

কানাডা মানে হকি। হকি মানেই কানাডা। হকি কানাডার শীত মৌসুমের জাতীয় খেলা। আইস হকি কানাডার হকি পাগল মানুষের উত্তপ্ত হ্নদ স্পন্দন। শীতের শনিবার রাতে লক্ষ কোটি কানাডিয়ান তাদের প্রাণপ্রিয় খেলা আইস হকি উপভোগ করেন মাঠে, রেস্টুরেন্টে -পানশালায় অথবা ঘরের ফ্যামিলি রুমের টিভির পর্দায়। হকির মূহুর্তে-

মূহুর্তে চরম উত্তেজনায় তারা কাঁপতে থাকেন উল্লাসে আনন্দে ভেঙ্গে পরে বার -বার। কখনো নিজ দলের খেলা হারার মনবেদনায় চোখে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করে, আবার দল জয়ী হলে তীব্র উল্লাসে,আনন্দে জয়ধ্বনিতে মাতোয়ারা হন ।

ডন চেরী। একটি নাম। একটি প্রতিষ্ঠান। কানাডার আইস হকির সাথে তার নাম নিবিড় ভাবে জড়িত। ২০০৪

সালে CBC (কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন) তাদের এক দর্শক জরিপে সপ্তম The Greatest Canadian হিসেবে ডন চেরী সন্মান অর্জন করেন। অন্টারিওর কিংস্টনে শহরে একজন সৌখিন খেলোয়ার/ ইলেক্ট্রিসিয়ান বাবার ঘরে জন্ম। আমেরিকান হকি লীগ খেলায় তার খেলোয়ার জীবন শুরু। ডন চেরী NHL লীগের খেলোয়ার ছিলেন। প্রায় বিশ বছর খেলেছেন আইস হকি। পরে বোস্টোন ব্রুইন্সের কোচ ছিলেন পাঁচ বছর। CBC হকি নাইট ইন কানাডা ‘কোচ কর্নার’ হকি ভাষ্যকার হিসেবে ১৯৮৬ সালে যোগ দেবার পর থেকে চেরী কানাডা হকি জগতে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কানাডার হকির ইতিহাসে চেরীর নাম ভালবাসা নন্দিত এক নাম । তার সম্পূর্ণ নিজস্ব ফ্যাশন সমৃদ্ধ অত্যন্ত ঝকমকে রংয়ের কোট (কখনো -কখনো কানাডার জাতীয় প্রতীক সম্বলিত-) হাই নেক সার্ট ছিল এক ভিন্নমাত্রার সংযোজন।

আইস হকিতে খেলোয়ারদের শারীরিক বল প্রয়োগ করা ছিল ডন চেরীর কোচ থাকাকালীন অন্যতম বিতর্কিত জয়ী কৌশল। খেলার বিরতির সময় খেলা সম্বন্ধে বিভিন্ন কৌশল খেলোয়ারদের দক্ষতা, ক্ষিপ্রতা খেলোয়ারদের ইতিহাস এগুলো নিয়ে তার আলোচনা,পর্যালোচনা এবং বিতর্কিত মন্তব্য ছিল হকি প্রেমিকদের এবং হকি বোদ্ধাদের অন্যতম আকর্ষন। দীর্ঘ ৩৫ বছরের হকি নাইট কানাডার কোচ কর্ণারের কো হোস্ট হিসেবে চেরী অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। চেরী তার বেপোরোয়া, বিদ্বেষপূর্ণ অপমানকর ,রক্ষণশীল এবং রাজনৈতিক কথাবার্তার জন্য বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছেন। চেরী Climate Change এর বিপক্ষে ছিলেন। ২০০৩ সালে ইরাক অভিযানে আমেরিকার সাথে কানাডার যুদ্ধে যাবার পক্ষে তিনি সরব ছিলেন ‘কোচ কর্ণারে’।

ডন চেরী – ফ্রেঞ্চ, সুইডিস এবং রাশিয়ান হকি খেলোয়ারদের সমন্ধে বিভিন্ন সময় অত্যন্ত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অপমানকর মন্তব্য করেছেন। চেরী ছিলেন জাতীয়তাবাদের সরব কন্ঠ।এবং কানাডার সামরিক বাহিনীর প্রতি ছিল তার প্রচন্ড ভালবাসা এবং সমর্থন। বিভিন্ন চ্যারেটি কাজে চেরী মিলিয়ন- মিলিয়ন ডলার তোলার কাজে সমাজে নন্দিত প্রশংসিত হয়েছেন। সবশেষে গত শনিবার CBC কোচ কর্ণারে তার প্রচন্ড বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যে সবকিছু ভেংগে পরে। চেরী তার স্বভাবসুলভ সরব অমার্জনীয় ভংগীতে বলেন “Hey people” You come here , whatever it is, you love our way of life, you love our milk and honey. At least you could pay couple of bucks for poppies or something like that. These guys paid for your way of life, that you enjoy in Canada”

বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। কিন্তু ৮৫ বছরের প্রবীন বর্ণবাদী মূর্খ ডন চেরী সময়ের সাথে নিজেকে বদ্লে নিতে পারেনি। ডন চেরীর ৩৫ বছরের বর্ণাঢ্য হকি আইকন কেরিয়ার এক কলংকিত দাগে সমাপ্তি ঘটে।

ডন চেরী। ছবি : সিটিনিউজ

তার পর শুরু হয় নিন্দার ঝড়। মিডিয়ায় নামে প্রচন্ড সাইক্লোন। এই ঝড়ের কবলে পরে ডন চেরী তার ৩৫ বছরের অত্যন্ত সফল হকি আইকন হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থান থেকে বিধ্বস্ত ভাবে ধসে পরেন। কানাডার এশিয়ান ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে Remembrance Day প্রতীক ‘পপি’ ফুল নিয়ে এমন বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যে তার কোন অনুশোচনা ছিল না। স্পোর্সনেট প্রেসিডেন্ট বার্ট ইয়েবসলী তাকে কোচ কর্ণারের কো হোস্টের চাকুরী থেকে অপসারন করেন। তিনি তার বিবৃতিতে জানান হকি খেলা আমাদের সকলে একত্রিত করে বিভাজন নয়। এন ডি পি দলের নেতা জাগমিত সিং এক পোস্টে তার গ্রেইট গ্রেন্ড ফাদাররের ছবি দিয়ে চেরীকে জানান যে তার প্রপিতামহ বৃটিশ সেনাদলের পক্ষে প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একজন সৈনিক ছিলেন। কানাডার সৈনিক হিসেবে প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কালো, সাদা, হলুদ, বাদামী সকল রংয়ের মানুষ। ইতিহাস সমন্ধে অত্যন্ত অজ্ঞ হাইস্কুল ড্রপআউট চেরীর জানা ছিলনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১.৪ মিলিয়ন ভারতীয় সৈনিক বৃটিশ সেনাদলের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। অস্ট্রেলিয়া,নিউজিলেন্ড, সাউথ আফ্রিকা এবং কানাডার সন্মিলিত সৈনিকদের চেয়ে বেশি। ফ্রান্সের ফ্লেন্ডারস ফিল্ডে কানাডার সৈনিকদের সাথে কাধেঁ কাধঁ রেখে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য ভারতীয় সৈন্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ২.৫ মিলিয়ন ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। হংকং থেকে ইটালী পর্যন্ত ছিল তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের বিস্তির্ণ পরিধি। জাপানের রাজকীয় সেনাদলের হংকং পরাজয়ের জন্য ঐতিহাসিক বীরত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল ভারতীয়দের সৈন্যদলের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বীরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকার জন্য যূদ্ধের সর্ব উত্তম খেতাব ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিলেন ৩০জন ভারতীয় সৈনিক। আর সেই যুদ্ধে ভারতীয়দের ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ সেচ্ছাসেবক সেনাদল।

যুদ্ধের এক শতাব্দীর পর ২০১৯ সালে এই নভেম্বর মাসেই জানা গেল কানাডার এক অজানা ইতিহাস। ১৯১৭ সালে কানাডার এক ক্যাপ্টেনের অধীনে ৮১ হাজার চীনা শ্রমিকদের গোপনে নিয়ে আসা হয় কানাডায়। তাদেরকে জাহাজে করে নিয়ে আসা হয় প্রথমে কানাডার ভেঙ্গুভারের বন্দরে। সেখান থেকে পাঠানো হয় হেলিফেক্সে, তার পর জাহাজে উঠিয়ে আটলান্টক পাড়ি দিয়ে পাঠানো হয় ইউরোপের যুদ্ধ ক্ষেত্রে। চিনা শ্রমিকদল প্রথম মহাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বাংকার তৈরী, লাশ দাফন , রাস্তাঘাট পুননির্মাণ এবং অন্যান্য কাজের জন্য। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যুদ্ধ শেষে চীনা সৈনিকদলের সাথে গ্রেট বৃটেন চুক্তি অনুযায়ী তাদেরকে যথাথভাবে মুল্যায়ন করেনি।

এখানে স্মরণ থাকা প্রয়োজন, যে সকল ভারতীয় এবং আফ্রিকান সেনাদল ইউরোপ আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন এবং বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন কিন্তু তাদের নিজ মাতৃভূমিতে তখনও বৃটিশ রাজের সৈনিকেরা অন্দলনকারীদের হত্যা করে যাচ্ছিল। বৃটিশ ভারতে ভারতীয়দের জন্য তখনো গণতন্ত্র ছিল অধরা স্বপ্ন। নেটিভ এবঅরিজিনাল কানাডিয়ানদের অনেক সৈনিক যুদ্ধে বীরের মতন অংশ নিয়েছেন কিন্তু তারপরও তারা ছিল অধিকার বঞ্চিত জনগোষ্ঠি। যুদ্ধের সময় ভেনকুভারে জাপানী ইমিগ্রেন্টদের সকল সম্পদ ব্যবসা বাণিজ্য বাড়ী ঘর বাজেয়াপ্ত করে তাদের কেম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমেরিকায় ছিল একই রকম চিত্র, অথচ অনেক জাপানী ইমিগ্রেন্টদের সন্তানরা যারা ছিল জন্মগত ভাবে কানাডিয়ান তাদের অনেকে যুদ্ধ করেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে কানাডার সেনাদলে। প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুধুমাত্র শ্বেতাংগ সৈনিকদের যুদ্ধ ছিল না সেগুলো ছিল সাদা কালো হলুদ বাদামী সকলের। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের।

বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী অনেক বদলে গেছে কিন্তু ৮৫ বছরের প্রবীন রেসিষ্ট মূর্খ চেরী সময়ের সাথে নিজেকে বদলিয়ে নিতে পারেনি। ডন চেরীর ৩৫ বছরের বর্ণাঢ্য হকি আইকন কেরিয়ার এভাবেই এক কলংকিত দাগে সমাপ্তি ঘটে গত ১১ই নভেম্বর/২০১৯ সালের Remembrance Day এর দিনে।

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

১৩ ই নভেম্বর২০১৯

টরন্টো, কানাডা