টরেটক্কা টরেন্টো – আগমন

জানুয়ারী ৭, ২০২০

কাজী সাব্বির আহমেদ

 (পূর্ব প্রকাশের পর)
হাবিব ভাইয়ের ফ্ল্যাটে সপ্তাহ দুয়েক থাকার পর চলে আসি আমার ইউনিভার্সিটি শহর বাংগি-তে। দূর্ভাগ্যবশতঃ ‘ফিংগার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন’ গবেষণা প্রকল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশন থেকে গ্রান্ট পেতে ব্যর্থ হয় – ফলে আমার স্কলারশীপ হয়ে পড়ে অনিশ্চত। সেই সময়ে মালেয়শিয়ার সব চাইতে পুরানো ইউনিভার্সিটি, ‘ইউনিভার্সিটি অব মালায়া’র কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রভাষক ইফতেখার ভাই এগিয়ে আসেন আমাকে সাহায্য করার জন্য। ‘ক্যাটালগিং অব বায়ো-ডাইভার্সিটি ইন মালেয়শিয়া’ নামক সেখানকার এক গবেষণা প্রকল্পের গবেষণা সহকারীর পদ পাইয়ে দেন আমাকে। এই পদে যোগ দেয়ার কিছুদিন পর আমি সেই ডিপার্টমেন্টেই ‘মাস্টার্স বাই রিসার্চ’ কোর্সে ভর্তি হই – এবারে আমার গবেষণার বিষয় ‘কম্পিউটার সিকিউরিটি’। মাস্টার্স শেষে সাইবারজায়াতে ‘ইনফরমেন টেকনলজী’ বিষয়ক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ইচ্ছা।
ডিপার্টমেন্ট সংলগ্ন ছাত্রাবাস কলেজ যাবা’-তে রুম নিয়ে উঠে পড়লাম – ক্যান্টিনে তিন বেলার খাবারসহ রুম ভাড়া অতি সামান্য। শুক্রবার লাঞ্চে আবার স্পেশাল ডায়েট – ‘নাসি বিরিয়ানি’ (আমাদের পোলাউ মাংসের মালেয়শিয়ান সংস্করণ)। সারাদিন ডিপার্টমেন্টে কাটিয়ে এসে বিকেলে ক্রিকেট খেলাও শুরু করলাম। রাতে ছাত্রাবাস চত্বরে খোলা আকাশের নীচে পাকিস্তানি, মরক্কো ও বাংলাদেশী সহপাঠি ছাত্রদের সাথে বসে বসে ‘তে-ও-আইস-লিমাও’(আইস-লেমন-টি) সহযোগে আড্ডা অথবা হলের টিভি রুমে বসে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সিতি-নূরহালিজার গান শোনা। কোনো কোনো উইকএন্ডে আমাদের লালমাটিয়ার ওবায়েদ ভাই আসেন – তার গাড়ীতে করে চলে যাই থিয়েটারে মূভি দেখার জন্য, কখনো বা ঘরোয়া কোনো গজলের আসরে। ঠিক এই সময়টায় পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসন এসে কনসার্ট করে গেল কুয়ালালুমপুরের অদূরে শাহ-আলম স্টেডিয়ামে। দূর্ভাগ্যবশতঃ আমার যাওয়া হয়নি সেই কনসার্টে। এর পরপরই আই-সি-সি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসলো কুয়ালালুমপুরে। ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ যে ইতিহাস গড়েছিল সেটা অবশ্য স্বচক্ষে উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে মালেয়শিয়ার জীবনটা মন্দ চলছিল না।
কিন্তু মাস কয়েক যেতে না যেতেই শুরু হলো মালেয়শিয়াসহ এশিয়ার একটা অংশ জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। মন্দা শুরুর ঠিক আগে আগে ইসরাইলী ছাত্রদের একটি ক্রিকেট টিমকে কুয়ালালুমপুরে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে পড়তে হয়েছিলো রাজনৈতিক তোপের মুখে। মতপার্থক্যের কারনে মন্দা যখন শুরু ঠিক সেই সময়টায় তিনি তার ডেপুটি আনোয়ার ইব্রাহিমকে করলেন পদচ্যুত। সাথে সাথে পুলিশ আনোয়ার ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করল ‘সডোমি’ (সমকামিতা) এবং দূর্নীতির অভিযোগে। মামলা যখন কোর্টে উঠল, আনোয়ার ইব্রাহিমের চোখে-মুখে পুলিশী অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট। স্বাভাবিক ভাবেই ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার’ জোরাল অভিযোগ উঠল মাহাথিরের বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য হাইকোর্ট আনোয়ার ইব্রাহিমকে নির্যাতন করার অভিযোগে পুলিশ বিভাগকে দায়ী করেন এবং পরবর্তীতে পুলিশের আই.জি. আব্দুল রহিম নূর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সব মিলিয়ে মালেয়শিয়ার অবস্থা তখন টালমাটাল। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মার্কিন ইনভেস্টর ‘জর্জ সরোজ’-কে দায়ী করলেন অর্থনৈতিক এই মন্দার মূল হোতা হিসেবে এবং দৃঢ় হাতে আই. এম. এফ.এর ঋণ ছাড়াই মন্দাকে কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হলেন। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নেয়া হলো ‘বেল্ট টাইটেনিং’ নীতি। এর ফলে আমাদের ‘ক্যাটালগিং অব বায়ো-ডাইভার্সিটি ইন মালেয়শিয়া’ প্রকল্পের অবস্থা হলো ‘হালুয়া টাইট’ – গ্রান্ট বন্ধ, আমার পদ হয়ে গেলো অবৈতনিক। চলমান অনেক উন্নয়ণ প্রকল্পেরও ভাগ্য হলো অনিশ্চত, কর্মচ্যুত হলো অনেকে। ঠিক এই সময় ইন্দোনেশিয়ার ফরেস্ট ফায়ার-এর কারণে কুয়ালালুমপুর শহর ঢাকা পড়ল ‘হেইজ’ (Haze)-এ। দু’হাত দূরের জিনিষও চলে গেলো দৃষ্টিসীমার আড়ালে। সবাই মুখে মাস্ক লাগানো শুরু করল অসহনীয় মাত্রার এয়ার পলুশনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির ‘অপারেশন হেইজ’ নামে ফায়ার ব্রিগেডের এক বিশেষ টীম পাঠালেন ইন্দোনেশিয়ায়, তাতে অবশ্য কুয়ালালুমপুরের ‘হেইজ’-এর কোন প্রকার উনিশ-বিশ হলো না। পুরো শহরটার চেহারা পাল্টে যেতে শুরু করল। মালেয়শিয়ার সম্ভবনাময় আলোকিত ভবিষ্যত যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ঘন কুয়াশার চাদরে। আমিও চিন্তিত হলাম আমার নিজের ভবিষ্যত নিয়ে।
পত্রিকাতে বিজ্ঞাপণ দেখে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির এক গবেষণা প্রকল্পের ‘গবেষণা প্রকৌশলী’র পদে অ্যাপ্ল­াই করি। গবেষণার বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘ই-লার্নিং’ এবং লক্ষ্য হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির শিক্ষা পদ্ধতিতে বাস্তব সম্মতভাবে কিভাবে ই-লার্নিং-কে সম্পৃক্ত করা যায় সেই বিষয়ে অনুসন্ধান ও সুপারিশমালা প্রণয়ন। গবেষণা প্রকৌশলীর পদে আসলে একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলীকে খোঁজা হচ্ছিল যার কাজ হবে সুপারিশমালার ‘প্রæফ অব কনসেপ্ট’ তৈরি করা – ইন্টারনেট ভিত্তিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে। আপ্ল­াই করার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ইন্টারভিউ-এর ডাক এলো ই-মেইলের মাধ্যমে – এটাও উল্লেখ করা হলো যে এ বাবদ কোন প্রকার টি. এ. / ডি. এ. দিতে তারা অপারগ। ইতিপূর্বে ট্রেনে করে কুয়ালালুমপুর থেকে সিঙ্গাপুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়েছে একবার। সেটাকে পুঁজি করে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে কুয়ালালুমপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম রাত দশটায়। এসি দেয়া বগি, নরম গদীর সিট। সকাল সাতটায় সিঙ্গাপুরের ‘তাংজং পাগার’ স্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে ‘কমফোর্ট’ কোম্পানীর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম ‘ডোভার’ রোডে – পুরনো কিছু বন্ধু-বান্ধব পাঁচ বেডরুমের বিশাল এক অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকে সেখানে। দু’দিন পর নির্ধারিত সময়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির নির্ধারিত কক্ষে এসে উপস্থিত হলাম ইন্টারভিউ-এর জন্য – পাঁচ জনের বোর্ড, ফ্যাকাল্টি ডীনও উপস্থিত। কিছুটা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম আমার চাইনিজ ভাষাজ্ঞান বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্যকে প্রভাবিত করল। ইন্টারভিউ শেষে উনারা আমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পর রুমে ডেকে নিয়ে হাতে অফার লেটার ধরিয়ে দিলেন। মাস খানেক পর ডোভার রোডের পাঁচ বেডরুমের সেই অ্যাপার্টমেন্টের এক বেডরুম সাব-লেট নিয়ে শুরু করি আমার নতুন কর্মজীবন।
কর্মক্ষেত্রে আমার বসার জায়গা হলো মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের একটি ল্যাবে। বিশাল ল্যাবের এক কোণায় নতুন কম্পিউটার ও প্রিন্টার সহ ছিমছাম একটি কিউবিকল। কাজে যোগ দেয়ার পর জানতে পারলাম যে ‘ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া’র প্রফেসর ব্রায়ান স্টোন এবং তাঁরই প্রাক্তন ছাত্র ডঃ নেইথান স্কট নামক দুজন একাডেমিশিয়ানও এই গবেষণা প্রকল্পের সাথে জড়িত। ডঃ স্কট তাঁর পি-এইচ-ডি প্রজেক্টে তৈরি করেছেন ‘জেলী ফিশ’ নামের একটি সার্ভার-বেইজড ‘অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং সিস্টেম’ যা কিনা সেকেন্ড ইয়ার ‘ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স’ কোর্সে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হবে। ছাত্ররা যখন ‘জেলী ফিশ’ সিস্টেমে লগ-ইন করবে, তখন তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স-এর একটি অংক সমাধান করতে দেয়া হবে। সে যদি সমাধান করতে পারে তবে পরবর্তী অংকটি হবে অধিকতর জটিল। অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং সিস্টেম এর মূলকথা হলো শিক্ষার্থীর মেধানুসারে তাকে ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধান করতে দেয়া হয়। প্রফেসর ব্রায়ান স্টোন এক সেমিস্টারের জন্য ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স কোর্স পড়াতে এলেন এবং সফলভাবে জেলী ফিশ সিস্টেম ব্যবহার করলেন। আমার কাজ ছিলো জেলী ফিশ সিস্টেমকে আমাদের সার্ভারে ইনস্টল করা এবং সার্বক্ষণিকভাবে তাকে চালু রাখা। এই কাজ করতে গিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে প্রফেসর স্টোনকে জানার সুযোগ হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ক্যান্টিনে আমরা প্রায়ই একসাথে লাঞ্চ করতাম – মাঝে মাঝে আমাদের সাথে যোগ দিতেন প্রফেসর মান্নান যিনি এই প্রজেক্টের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর।
আমার কাজের ব্যাপারে আমাকে সরাসরি রিপোর্ট করতে হতো প্রফেসর মান্নানকে। আমি যেদিন প্রথম তাঁর কাছে রিপোর্ট করতে যাই, সেদিনই তিনি আমাকে রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ারের চাকুরীর পাশাপাশি ‘পার্টটাইম মাস্টার্স বাই রিসার্চ’ করার জন্যে প্রবলভাবে উৎসাহিত করেন। আমার পদবীর কারণে আমাকে কোন টিউশন ফি দিতে হবে না। তিনি আমাকে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর আশরাফ কাসিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তীতে আমি প্রফেসর আশরাফের তত্ত্বাবধানে আবারও স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হই। জেলী ফিশ সিস্টেম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি আমার গবেষণার প্রস্তাবনা জমা দিলাম – ‘ইন্টিলিজেন্ট টিউটরিং সিস্টেম’। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে দীর্ঘ তিন বছর পর আমি অবশ্য এবার স্নাতকত্তোর ডিগ্রী সফলভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ হই। এই তিন বছরে আমাকে চারটি কোর্সওয়ার্ক, দুইটি জার্নাল পেপার এবং সবশেষে থিসিস লেখা শেষ করতে হয়। আমার দীর্ঘদিনের মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জনের আকাংখা পূরণ হয় অবশেষে।
দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুর মালেয়শিয়ারই ক্ষুদ্র সংস্করণ, তবে জনসংখ্যার অনুপাতে চাইনিজদের তুলনায় মালেয়দের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। সিঙ্গাপুরের মোট জনসংখ্যার জাতিগত অনুপাত হচ্ছে – চাইনিজ শতকরা ৭০ ভাগ, মালেয় ২০ ভাগ এবং ইন্ডিয়ান ও অন্যান্যরা হচ্ছে বাকী ১০ ভাগ। ১৯৬৫ সালের অগাস্ট মাসে মালেয়শিয়ান ফেডারেশন থেকে বহিস্কৃত হয়ে স্বাধীন সিঙ্গাপুরের জন্ম হয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঠিক বছর খানেক আগে জুলাই মাসের ২১ তারিখে সংঘটিত মালেয় এবং চাইনিজদের মাঝে হয় এক নৃশংস জাতিগত দাঙ্গা। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৬৯ সালে কুয়ালালুমপুরেও সংঘটিত হয় একই ধরণের দাঙ্গা যা ছিল আরও ভয়াবহ। এই দুইটি দাঙ্গা পরবর্তীকালে দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুরের গঠন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
হঠাৎ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সিঙ্গাপুরের অবকাঠামো ছিল খুবই নাজুক – শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাৎপদ, আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাং-দের দৌরাত্ব্য, পানি ও বিদ্যুতের অভাব এইগুলো ছিল প্রাথমিক সমস্যা। আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত ‘লি কুয়ান ইউ’-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই সমস্যাগুলি একে একে কাটিয়ে উঠে সিঙ্গাপুর এক সময় পরিণত হয় প্রথম বিশ্বের সমমানের একটি দেশে।
জাতিগত দাঙ্গা থেকে শিক্ষা নিয়ে সিঙ্গাপুর সরকার গ্রহন করে ‘রেসিয়াল হারমনি’ নীতি, যার মূল লক্ষ্য হলো দেশের মোট জনসংখ্যার জাতিগত আনুপাতিক হার অনুসারে সুযোগের বন্টন। সরকারী আবাসন প্রকল্পের ফ্লাট বরাদ্দ থেকে শুরু করে সরকারী ও আধা-সরকারী চাকুরীর নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বত্রই এই নীতি অনুসরন করা হয়। তবে আমি চাকুরীর ক্ষেত্রে কখনোই মালেয়দের কোঠা পূরণ হতে দেখিনি।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরপরই সিঙ্গাপুর তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শুরু করে, আর এইক্ষেত্রে ইসরাইলী মিলিটারি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এই তিন বাহিনী নিয়ে গঠিত ‘সিঙ্গাপুর আর্মস ফোর্সেস’। এর সাথে আছে সিভিল ডিফেন্স ফোর্স যা কিনা মূলত ফায়ার সার্ভিস ও এম্বুলেন্স সার্ভিস-এর সেবা প্রদান করে। সিঙ্গাপুরের প্রত্যেক পুরুষ নাগরিকের জন্য দুই বছরের সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং চল্লিশ বছর বয়স অবধি সবাইকে বছরে অন্তত একবার রিপোর্ট করতে হয় তার সামরিক ইউনিটে। ফলে রেগুলার ফোর্সের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের প্রতিটি পুরুষ নাগরিকই হচ্ছে একজন পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিংপ্রাপ্ত রিজার্ভ সৈনিক। হাতে গোনা কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া মালেয় পুরুষদের যে শুধুমাত্র ‘সিভিল ডিফেন্স ফোর্স’-এ নিয়োগ দেয়া হয়, সেই বিষয়টি অল্পদিনের ভেতরই আমার নজরে পরে। ফলে রেসিয়াল হারমনি নীতি আমার কাছে মালেয়শিয়ায় প্রচলিত ‘ভূমিপুত্রা’ নীতিরই ‘সুগারকোটেট’ রূপ বলেই মনে হয়েছে। ‘ভূমিপুত্রা’ নীতির কারণে মালেয়শিয়াতে সরকারী চাকুরীসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মালেয়দেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়ে থাকে।
আমি ধীরে ধীরে সিঙ্গাপুরের জীবনযাত্রার সাথে খাপ খাওয়াতে শুরু করি। ইতিমধ্যে ‘ফরেন ট্যালেন্ট’ ক্যাটাগরীতে সিঙ্গাপুরের পার্মানেন্ট রেসিডেন্সশীপ পেয়ে যাই। দুই বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেই ‘বুকিত পানজাং’ এলাকায়। সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী ঢাকা থেকে এসে উঠে সেই অ্যাপার্টমেন্টে। আমি এবং আমার স্ত্রী, আমরা দু’জনেই অবশ্য একই ব্যাচে গণচীনে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়তে যাই, তার বিষয় ছিল মেডিকেল সায়েন্স। সিঙ্গাপুরে আসার কিছুদিন পরই আমার স্ত্রী ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মলিউকুলার বায়োলজী ডিপার্টমেন্টে ‘রিসার্চ স্কলার’ হিসেবে যোগ দেয়, তার গবেষণার বিষয় হলো ‘ক্যান্সার সেল’।
আমাদের দুজনের কর্মস্থল একই জায়গায় হওয়াতে আমরা সকালে একসাথে ঘর থেকে বের হতাম, প্রায়ই দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করতাম ক্যান্টিনে, আবার দিন শেষে এক সাথে ঘরে ফিরতাম। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমাদের একমাত্র সন্তানের জন্ম হলো সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত ‘কানডাং কারবাও’ হসপিটালে। ঐতিহ্যবাহী এই হসপিটালের নাম পরবর্তীকালে ইংরেজীতে রাখা হয় ‘কে. কে. উইমেন্স এন্ড চিল্ড্রেন’স হসপিটাল’। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম যে কালের প্রবাহে সিঙ্গাপুরের মালেয় ঐতিহ্যগুলি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের অনেকের কাছেই আজ অজানা যে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ হচ্ছে ‘মালেয়’ – অথচ এই ভাষাকে ধীরে ধীরে করা হয়েছে গুরুত্বহীন। সিঙ্গাপুরের জাতীয় সংগীত হচ্ছে মালেয় ভাষাতে। আমি সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন সেই জাতীয় সংগীতের সুরের পরিবর্তন আনা হয় – আবার অনেক ক্ষেত্রেই যন্ত্রসংগীতের আকারে জাতীয় সংগীত বাঁজাতে শুনেছি।
আমাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রায় দুইমাস পর আমার স্ত্রী আবার তার রিসার্চের কাজ শুরু করে। আমাদের সন্তানের দেখাশোনার জন্য স্মরণাপন্ন হই প্রতিবেশী এক একান্নবর্তী মালেয় পরিবারের কাছে। দিনের শুরুতে কাজে যাওয়ার সময় আমাদের সন্তানকে রেখে যাই সেই মালেয় পরিবারের কাছে, আর দিন শেষে তাকে নিয়ে আসি আমাদের কাছে। কয়েকদিনের মাঝেই আমরা যেমন সেই মালেয় পরিবারকে আপন করে নিয়েছিলাম, তারাও তেমনি আমাদের সন্তানসহ আমদেরকে তাদেরই একজন করে নিয়েছিলো। এতটাই আপন হয়েছিলাম যে সেই পরিবারের ছোট মেয়ের বিয়ের মেন্যুতে তাদের অনুরোধে আমি যোগ করেছিলাম শশা, টমাটো, কাঁচা মরিচ আর ধনিয়া পাতা দিয়ে বানানো একটি সালাদ। কোন এক অজানা কারণে আমার তৈরী অতি সাধারণ এই সালাদের বিশেষ ভক্ত ছিল তারা।
আমাদের সন্তানও তাদেরকে একান্ত আপনজন জেনেই বড় হতে লাগলো এবং ধীরে ধীরে তার মুখে মালেয় ভাষা ফুটতে শুরু করলো। তার সাথে সাথে আমার স্ত্রীও মালেয় ভাষা শিখা শুরু করলো। যার ফলে পানাস (গরম), বান্তাল (বালিশ), সুসু (দুধ), গিগি (দাঁত), মান্ডি (গোসল), মাকান (খাওয়া), মিনুম (পান করা) ইত্যাদি মালেয় শব্দ ধীরে ধীরে আমাদের মুখে বাংলার সাথে মিশে যাওয়া শুরু করল।
সিঙ্গাপুরের অফিসিয়াল ভাষা হলো চারটি – ইংরেজী, ম্যান্ডারিন, মালেয় এবং তামিল। মজার ব্যাপার হলো সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যার শতকরা সত্তুর ভাগ হচ্ছে চাইনিজ, অথচ তাদের কারোরই ন্যাচরাল ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যান্ডারিন নয়। কারণ তাদের বেশীর ভাগই দক্ষিণ চীন থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসা চাইনিজদের বংশধর। মূলত তাদের ভাষা হক্কেইন, হাক্কা অথবা ক্যান্টনিজ, যা কিনা ম্যান্ডারিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠার পর এবং চীনের ‘ওপেন ডোর পলিসি’ গ্রহণের ফলে সিঙ্গাপুরের চাইনিজরা তাদের শিকড়ের সন্ধানে আগ্রহী হলো এবং সেটার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা তাদের কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যান্ডারিন শিখতে এগিয়ে এলো। ‘ম্যান্ডারিন ইন, ডায়ালগস আউট’ ছিল ১৯৮৩-তে সিঙ্গাপুর সরকারের নেয়া ‘স্পিক ম্যান্ডারিন ক্যাম্পেইন’-এর সেøাগান। ২০০০ সালে সরকার চালু করে নোতুন সেøাগান – ‘স্পিক ম্যান্ডারিন? নো প্রোব্লেম’।
স্কুলের কারিকুলামে ইংরেজীর পাশাপাশি চালু হলো ‘মাদার টাংগ’ – চাইনিজদের জন্য ম্যান্ডারিন, মালেয়দের জন্য মালেয় এবং ইন্ডিয়ানদের জন্য তামিল অথবা মিনিস্ট্রি অব এডুকেশন কর্তৃক অনুমোদিত অন্য কোন ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ। মজার ব্যাপার হলো বাংলা সেই অনুমোদিত ল্যাঙ্গুয়েজ লিস্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল, ফলে আমার সন্তানের বাংলায় হাতেখড়ি হয়েছিলো সিঙ্গাপুরের প্রাইমারী স্কুলে।
উত্তর চীনের ন্যাচরাল ল্যাঙ্গুয়েজ হচ্ছে ম্যান্ডারিন, যা কিনা সমস্ত চীনের জন্য সরকারী ভাষা হিসেবে বিবেচিত। সিঙ্গাপুর সরকার বিশুদ্ধ ম্যান্ডারিন শেখানোর লক্ষে উত্তর চীন থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষককে নিয়োগ দিলো বিভিন্ন প্রাইমারী স্কুলে এবং টিচার্স ট্রেনিং প্রোগ্রামগুলোতে। একই সময়ে সিঙ্গাপুরে চাইনিজ জনসংখ্যার আনুপাতিক হার যাতে কোনক্রমেই শতকরা সত্তুর ভাগের নীচে না নেমে যায় সেই লক্ষে হাতে নেয়া হলো ‘স্টাডি মা-মা’ নামের একটি বিশেষ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে চীন থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী লেভেলের ছাত্রদেরকে সিঙ্গাপুরের স্কুলগুলিতে পড়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। ছাত্রদের সাথে তাদের মা-দেরকেও কাজের অনুমতিসহ সিঙ্গাপুরে বসবাসের সুযোগ দেয়া হয়। সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা হলো যে এই শিশু ও কিশোর ছাত্ররা একদিন বড় হয়ে সিঙ্গাপুরের মেইন স্ট্রীমের সাথে মিশে যাবে। কিন্তু বাচ্চাদের সাথে আসা মায়েদের শিক্ষাগত এবং ভাষাগত দূর্বলতার কারণে তাদের জন্য উপযুক্ত কাজের অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হতে লাগল। ফলে অনেকেই ম্যাসাজ পার্লারের মতন জায়গায় কাজ করা শুরু করল এবং নানাবিধ সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে লাগলো। এই সময় ‘স্টাডি মা-মা’ প্রকল্পের অধীনে পড়তে আসা ‘হুয়াং না’ নামক আট বছরের একটি মেয়ের অন্তর্ধাণ এবং তিন সপ্তাহ পর তার লাশ উদ্ধারের ঘটনা তখন পুরো সিঙ্গাপুর জুড়ে তুমুল আলোড়নের সৃস্টি করে। ‘হুয়াং না’-র হত্যাকারী মালেয়শিয়ান নাগরিক ‘টুক লেং হৌ’-কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে। যদিও সিঙ্গাপুরের ‘ক্রাইম রেইট’ উল্লেখ করার মতন কম, তারপরও সর্বত্র পুলিশ ফোর্সের সতর্কবানী – ‘লো ক্রাইম ডাজ নট মিন নো ক্রাইম’। (চলবে)
– কাজী সাব্বির আহমেদ, টরন্টো।