মায়ের ডাকে
জুন ১৬, ২০২০
উইং কমান্ডার (অব: ) আব্দুল জলিল
মা বাবা যতদিন বেঁচে থাকেন, তা সন্তানদের জন্য আশীর্বাদ বলে আমার পূর্ণ বিশ্বাস। বাবা নব্বই বছর বয়সে গত হয়েছেন, বেঁচে আছেন মা। বাবা-মা দুজনেই জানতেন আমি বিদেশে (কানাডা) থাকি। মা এখন নব্বইয়ের কোঠায়। মার সাথে প্রতিনিয়ত ফোনে কথা হয়। মা জানেন তার ছেলেরা বিদেশে থাকে এবং কে কোন দেশে। ফোন করলে কোন ছেলের ফোন তা বোঝেন।
হঠাৎ করেই মার শরীরের অবনতি হয়। সবাই শঙ্কিত, কখন কি হয়। মা বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন, বিশেষ করে শরীরে লবণ কমে যাওয়ার সমস্যা লেগেই আছে। আগে মার সাথে কথা বললে বোঝা যেত তিনি সুস্থ, কিন্তু এবার তার কথা ও কণ্ঠস্বরে মনে হয় সময় বুঝি শেষ। এমনি সময় মা আমাকে বলেন, “বাবা, আর একবার এসে দেখে যা।”
কানাডা থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনায় আর চার সপ্তাহ বাকি এবং টিকিট কেনা হয়ে গেছে। মার ডাক পাবার পর থেকে সর্বদা মনে বলতে থাকে চার সপ্তাহ পরে গিয়ে মাকে যদি দেখতে না পাই ? মনে হতেই মন আঁতকে উঠত। মায়ের ডাকে সাথে সাথে সাড়া না দিলে মার শেষ ইচ্ছা (আমাকে দেখা) পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা চিরকালের জন্য আমার বুকে শেল হয়ে বিঁধে থাকত।
টরন্টো-ঢাকা বিমান ভ্রমণ বেশ ভাল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘর থেকে রওনা দিয়ে ঢাকা পৌছা যায়। তবে একজন সত্তর ঊর্ধ্ব মানুষের জন্য যাত্রা শেষে শারীরিক ধকল একজন যুবার চাইতে অনেক বেশী। যাত্রার প্রাক্বালে আমার আমেরিকা থাকা সাত বছর বয়সী নাতনি রায়দা ফোন করে আমাকে বলে দেয় তিনটি কথাঃ “যাত্রা শুভ হোক, ভাল খাবার খাবে, এবং সুপেয় পানি পান করবে।”
অবশেষে টরন্টো থেকে ঢাকা পৌঁছাই। ঢাকা থেকে মার কাছে আসার সময় আমার সঙ্গী হয় আমার সবচেয়ে আদরের ছোট বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডাক্তার আফরোজা হোসেন। আমাদের বগুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়। গিয়েই আমরা মার সামনে হাজির হই। আমাদের দেখেই মা আমাদের বলেন, “বড় জন এবং ছোট জন, একসাথে দেখতে এসে ভাল করেছো।” দুদিন মার সাথে ভাল কাটল এবং কথা হল। তারপরই মা অঘোরে ঘুমানো শুরু করলেন, ডাকলে হ্যাঁ, হু ছাড়া খুব একটা কথা বলছেন না।
আজ ছয় বছর আগে বাবা গত হবার পর থেকে মার অসুস্থতা বাড়তে থাকে এবং একনাগারে বিছানায় তিনি স্থায়ী হন। দেখাশোনা ও পরিচর্যায় আমার ছোট ভাই এর বউ আঙ্গুর, তার সহযোগী তার দুই মেয়ে মিষ্টি ও তৃপ্তি, আর এক ভাইয়ের বউ লিপি। সার্বিক দেখাশোনায় আমাদের বড় বোন ফজিলাতুননেছা। সাথে আছে দুই ভাই মিলু ও দুলু। আর এক ভাই ফুলু মার নিউট্রিশন বাড়ানোর জন্য অনেক আয়ুর্বেদীয় সাপ্লিমেন্ট নিয়ে ঢাকা থেকে মার কাছে প্রায়ই যেত। এরা আমাদের বাবা ও মায়ের পরিচর্যা টিম। এদের পরিচর্যা দেখে আমার সর্বদা মনে হয়েছে এবং হয়, এমন সেবা প্রদান আমার পক্ষে সম্ভব হত কি ?
আমার ভাই মিলু গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। তার বয়স আজ সত্তরের কাছাকাছি। বিগত বিশ বছর ধরে বাবা এবং মায়ের সেবা দিয়ে আসছে নিরলস ভাবে। বাবা যখন বিছানায় পড়া, তার পেশাব-পায়খানার কাপড় বার বার বদলে দেয়া এবং দিনের বেলা নিজ হাতে পরিষ্কার করা অতুলনীয় কাজ। সেদিন আমার সামনে দিয়ে মিলু মার পেশাব-পায়খানার কাপরগুলি নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিয়ে আসে। এ দৃশ্য দেখে আমার মনে হয় এ যেন মহানবীর আমলে কোন মহান সাহাবী যিনি মায়ের সেবার জন্য বেহেস্ত পাবেন বলে মহানবী বলেছিলেন।
বাবা-মায়ের অনেক সন্তান থাকে, নানাজন নানাভাবে সফল হয়। আমার ভাই মিলু ইহজীবনে মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান, আর তার পরিবার শ্রেষ্ঠ পরিবার। মিলুর বউ আঙ্গুর আমার মায়ের সেবা করে নিরলস ভাবে মায়ের যে কোনো মেয়ের চেয়ে কম নয়, বরং সে আমার মার “মা” হতে পেরেছিল। কিছুদিন আগে মা অসুস্থ হয়ে ঢাকায় তার ছোট মেয়ের বাসায় থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সর্বদা মা গ্রামের বাড়ি যাইতে চাইতেন। এক পর্যায়ে মাকে জিজ্ঞেস করা হল গ্রামে গেলে কে দেখাশুনা করবে? মা এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন আমার সামনে, “মুন্নীর মা”, অর্থাৎ আঙ্গুর দেখবে। এদিনে একজন শাশুড়ির ছেলে বউয়ের উপর এমন ভরসা সত্যি বিরল। মা যতক্ষণ আছেন, তার সেবা চলতে থাকবে। সে সেবার শ্রেষ্ঠত্ব বারে বারে আমার মানস পটে ভেসে উঠবে। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে তাদের প্রতি যারা প্রতিনিয়ত মাকে সেবা দান করছে এবং করতে থাকবে।
আমি মাকে দেখতে এসেছিলাম, দেখে চলে যাব কদিন পরেই। আমার আগমনে মা প্রাণ ভরে তার বড় ছেলেকে দেখলেন। দেখা হলেই মা জিজ্ঞাসা করে, “খেয়েছ বাবা?”
আমি কানাডায় ফিরে গিয়ে বার বার মার কথা মনে করব। যেহেতু আমি হাজার হাজার মাইল দূরে থাকি, তাই বারে বারে ভাবতে থাকব, মার সাথে আর কি দেখা হবে? মা কি আর একবার বলবে, বাবা এসে একবার দেখে যা? মা জানে আমি চলে যাব সুদূর কানাডায়। আমি জানি আমার থাকার সময় সীমিত। মা না বললেও মনে মনে হয়ত চায় তার বড় ছেলে তার মৃত্যুশয্যায় পাশে থাকুক। জীবন প্রবাহে সকল মায়ের প্রত্যাশা এমনি, মৃত্যুকালে সন্তানরা মায়ের পাশে থাকুক। নিয়তিই বলে দেবে মা-ছেলের মন বাসনা পূর্ণ হবে কিনা! সর্বশেষ মায়ের ডাকে আসতে পেরেছিলাম সেটাই আমার পরম পাওয়া।
বগুড়া, বাংলাদেশ
৭ জুন, ২০১৬
বিঃদ্রঃ আশ্চর্যজনকভাবে মার মৃত্যুশয্যায় পাশে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে দেখা করে আসার পর পূর্বনির্ধারিত টিকিটে আমি আবার দেশে যাই। কিন্তু সেসময় আর কথোপকথন হয়নি, তিনি তখন অচেতন। সৌভাগ্যবশত পাশে বসে থাকায় মার কণ্ঠে শুনেছিলাম, “পানি খাব,“এবং তাকে পানি খাইয়ে দিতে পেরেছিলাম। এরপর মা বলেন তাকে ওজু ও গোসল করিয়ে দিতে। মাকে ওজু ও গোসল করিয়ে দেয়া হয়, সেই শেষ ওজু – গোসল করা পবিত্র অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উইং কমান্ডার (অব:) আব্দুল জলিল। টরন্টো