মহাদুর্যোগকালে কানাডায় গোড়াপন্থী ‘এ বাঞ্চ অব ইয়াহুজ’ দের অপতৎপরতা

অক্টোবর ৮, ২০২০

খুরশিদ আলম

গত এপ্রিল মাসে অন্টারিও পার্লামেন্ট এর সামনে একদল লোক সমবেত হয়ে মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন। এ সময় তাদের হাতে কিছু ব্যানারও ছিল। ব্যানারে লেখা ছিল- End the lockdown, Save our children no more poison, Practice media distancing they are lying to you. পুলিশের উপস্থিতিতেই সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে তারা এই সমাবেশ করেন। তাদের দাবী, ‘কোভিড-১৯’ একটি ধাপ্পাবাজী ছাড়া আর কিছুই নয়।

সরকার ঘোষিত কভিড-১৯ এর আইন ভঙ্গকারী এই লোকগুলো কারা? কি তাদের পরিচয়?

প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড এর ভাষায়,  “A bunch of yahoos”. অর্থাৎ অভদ্র, গোলমাল সৃষ্টিকারী বা হিংস্র ব্যক্তিদের একটি দল তারা। আইন ভঙ্গ করে তারা সবাইকে বিপদে ফেলছেন। তারা নিজেরাও নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন। ড্যাগ ফোর্ড তাদেরকে দায়িত্বজ্ঞানহীন, বেপরোয়া ও স্বার্থপর বলে আখ্যায়িত করেন।

এই ‘বাঞ্চ অব ইয়াহুজ’রা শুধু অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনেই নয়, কানাডার অন্যান্য অঞ্চলেও সমাবেশ করেছেন এবং এখনো করছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিয়লে কয়েক হাজার লোক মিলে এক সমাবেশ ও পদযাত্রার আয়োজন করেন কভিড-১৯ এর আইনের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে ছিলেন হরে কৃষ্ণ সংগঠনের কিছু লোক, খ্রিষ্টান মৌলবাদী দলের সদস্যরা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর সমর্থকরা। সমাবেশে ‘QAnon’ নামের একটি চরম ডানপন্থী গ্রুপের পতাকাও উড়াতে দেখা যায়। এই দলের সদস্যরা বিশ্বাস করেন একটি শয়তানী ও শিশুদের প্রতি কামাতুর গুপ্ত চক্রান্তকারী দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই দলের সদস্যরা আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের জোর সমর্থক। যে কোন ভেক্সিনেরও চরম বিরোধী তারা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এই সংগঠনটিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকী হিসাবে চিহ্নিত করেছে।

মন্ট্রিয়লের ঐ সমাবেশে বক্তাগণ বলেন কুইবেক সরকার কভিড-১৯ এর বিষয়ে অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এবং এই রোগের বিপদ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। তাদের আরো বলেন, আমরা যদি অন্ধভাবে সরকার ঘোষিত অতিমাত্রার আইন মানতে যাই তবে সমগ্র মানবজাতি বিপদের মুখে পড়বে। সমাবেশে ভাষণ চলা কালে মঞ্চে ‘QAnon’ এর বিশাল পতাকা দোলানো হচ্ছিল।

কভিড-১৯ আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই দলের সদস্যরা শুধু যে রাজপথে সমাবেশ ও মিছিল করে বেড়াচ্ছেন তা কিন্তু নয়, তারা আদালতেরও আশ্রয় নিচ্ছেন। আর এই প্রক্রিয়ায় খোদ প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুুডোর বিরুদ্ধেও মামলা ঠুকে দিয়েছেন তারা।

সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে এবং মাস্ক না পরে একদল লোক অন্টারি পার্লামেন্ট ভবনের সামনে সমাবেশ করেন। তাদের দাবী, ‘কোভিড-১৯’ একটি ধাপ্পাবাজী ছাড়া আর কিছুই নয়। ছবি : টরন্টো সান

সিবিসি’র বারাত দিয়ে ফক্স নিউজের এক খবরে বলা হয়, অন্টারিও ভিত্তিক একটি ভেক্সিন বিরোধী সংগঠন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে ১১ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করেছে। ‘ভেক্সিন চয়েজ কানাডা’ নামের এই সংগঠনটি এবং সাথে আরো ৭ জন ব্যক্তি মিলে কানাডা সরকার, অন্টারিও সরকার এবং সিটি অব টরন্টোর বিরুদ্ধে মামলা করেন। জনাকয়েক রাজনীতিক, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং সিবিসি নিউজ এর বিরুদ্ধেও তারা মামলা করেন। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ফেডারেল, প্রভিন্সিয়াল ও স্থানীয় সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা এই মামলা করেন। মামলা করার পিছনে যে বিষয়গুলো তাদেরকে প্ররোচিত করেছে তার মধ্যে আছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আইন, পাবলিক প্লেসে মাস্ক ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সরকারী সিদ্ধান্ত। অথচ এ সবই করা হয়েছে দেশের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে। কিন্তু মামলাকারীদের অভিযোগ, সরকার কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে যে চরম, অযাচিত এবং অযৌক্তিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তা বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিতও নয়। তারা আরো দাবী করেন, মাস্ক ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা মানুষের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।

চরম গোড়াপন্থী বা মৌলবাদী এই গোষ্ঠির মুখে কভিড-১৯ প্রতিহত করার উদ্যোগগুলো ‘বিজ্ঞানসম্মত নয়’ কথাটি শুনতে একদিকে যেমন অস্বাভাবিক লাগে অন্যদিকে তেমনি হাস্যকরও লাগে। কোনটা বিজ্ঞানসম্মত আর কোনটা বিজ্ঞানসম্মত নয় তা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদেরকে শিখতে হবে ঐ ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্নদের কাছ থেকে! এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে জনগণের জীবন বাচাঁনোর জন্য?

সংখ্যায় তারা কতজনই বা হবেন? এদের সংকীর্ণ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা ভাবনার কাছে আত্মসমর্পন করার অর্থ যে গোটা মানব জাতিকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া এই বোধটুকু কি তাদের আছে?

না, নেই। থাকলে তারা এমন বিচারবুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিতেন না। গোড়াপন্থী ও পশ্চাদপদ চিন্তাধারার এই মানুষগুলো যুগে যুগে মানব সমাজকে কেবলি পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আজো করছেন। কভিড-১৯ নামক এরকম একটি বাস্তব ও চরম মহাদুর্যোগকে তারা মনে করছেন ধাপ্পাবাজী!

এই বিচারবুদ্ধিহীনদের গুরু হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি মাস্ক পরার বিষয়ে শুরু থেকেই বিরোধীতা করে আসছেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্বের সব দেশের নেতারা যেখানে মাস্ক পরাকে বাধ্যতামূলক করছেন সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প হাঁটছেন উল্টো পথে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আজ ট্রাম্প নিজেই করোনায় আক্রান্ত!

ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি সবাইকে মাস্ক পরাতে বিভিন্ন রাজ্য ও স্থানীয় নেতাদেরকে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। মাস্ক পরাকে সত্যিকার অর্থেই খুব গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেছিলেন, সবারই এটা ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন বলেছিলেন শনাক্ত রোগী ও মৃত্যু বাড়তে থাকলেও করোনা সংক্রমণ রুখতে মার্কিনিদের বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নির্দেশ দেয়া হবে না। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সবাইকে মাস্ক পরতে বাধ্য করার ভাবনার সঙ্গে আমি একমত নই। নাগরিকদের কিছুটা স্বাধীনতা থাকা উচিত।’

বিচারবুদ্ধিহীনতায় এবং পশ্চাদপদ চিন্তাধারায় পালের সেরা এই মহা মিথ্যুক প্রেসিডেন্টের কাছে এর চেয়ে বেশী কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তার এই মূর্খতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে কভিড-১৯ সংক্রমণের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এ পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করেন দুই লাখেরও বেশী আমেরিকান। এর দায় কে নিবেন?

যুক্তরাষ্ট্রে করোনার প্রাদুর্ভব শুরু হওয়ার পর ট্রাম্প নিজেও দীর্ঘদিন মাস্ক পরেননি। তবে কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন ডিসির কাছে একটি সামরিক চিকিৎসা কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে প্রথমবারের মতো তাকে স্বাস্থ্যগত নির্দেশনা মেনে চলতে দেখা গেছে। কিন্তু পরে আবার সেই আগের মতই অবস্থা। মাস্ক না পরে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখেই তিনি বিভিন্ন সমাবেশে যাচ্ছেন। তার আয়োজিত নির্বাচনী সমাবেশে উপস্থিত লোকজনকেও মাস্ক পরতে দেখা যায় না। সামাজিক দূরত্বও কেউ বজায় রাখেন না।

জরিপেও দেখা গেছে করোনা মোকাবেলায় মার্কিন নাগরিকরা তাদের প্রেসিডেন্টের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। গত জুলাইতে প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্টের জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩৮ শতাংশ মানুষ এ সংকট মোকাবেলায় ট্রাম্পের ভূমিকায় আস্থা রেখেছেন। তার আগে মার্চ মাসের জরিপে এ হার ছিল ৫১ শতাংশ।

করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে মাস্ক পরার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কাছে। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সঠিক ভাবে মাস্ক ব্যবহার করা হলে করোনা প্রতিরোধে এটি যথেষ্ট সাহায়ক ভূমিকা রাখে। সেই সাথে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল এই ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষের নিজেকে সুরক্ষিত রাখার এখনো পর্যন্ত কর্যকরী উপায় হচ্ছে- পারস্পরিক শারীরিক দূরত্ব ৬ ফুট বজায় রেখে চলা এবং সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করা। সেই সাথে নির্দিষ্ট সময় পরপর অথবা যখনই প্রয়োজন হয়ত তখন সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধোয়া। করোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য এই তিনটি বিষয় এখন খুবই জরুরী। আর এই নিয়মগুলো মেনে চলায় গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট ভাল অবস্থায় ছিল কানাডায়। কিন্তু এ অবস্থায় আত্মতুষ্টিতে ভোগে কিছু লোক নিয়ম না মানার নীতি গ্রহণ করেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে তাদের মধ্যে যথেষ্ট শিথিলতা দেখা যায়। বাড়িতে বাড়িতে পার্টির আয়োজন করার ঝোঁক বৃদ্ধি পায়। আইন অমান্য করে দুই শতেরও অধিক লোককে দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে পার্টি করছেন এমন নজীরও দেখা গেছে সম্প্রতি। বীচে বা পার্কে শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে লোকজন দেদার মেলামেশা করছেন।

এবং ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে এসে হঠাৎ করে করোনায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং তা আগের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যায়। বলা হচ্ছে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে অন্টারিওতে। অন্টারিওর প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, এখনি সচেতন না হলে করোনার সুনামীও আসতে পারে আগামী কিছুদিনের মধ্যে।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে বিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সী লোকের সংখ্যাই বেশী। শতকরা প্রায় ষাট জন। অর্থাৎ করোনা প্রতিহত করার নিয়ম বেশী মাত্রায় ভাঙ্গছেন এই বয়সী লোকেরাই। আর এদের মধ্যে আছেন ঐ  ‘বাঞ্চ অব ইয়াহুজ’রাও।

অবশ্য সিংহভাগ কানাডিয়ানই জনসমাগমস্থলে মাস্ক পরার পক্ষে। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে ৮৩% কানাডিয়ান মনে করেন সরকারের উচিৎ ইনডোর পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা। Leger and the Association for Canadian Studies এর যৌথ জরিপে এই তথ্য পাওয়া যায়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২১% অবশ্য বলেছেন এরকম আদেশ মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে।

কিন্তু এই স্বাধীনতা যে মানুষের জীবনকে চরম হুমকীর মুখে ঠেলে দেয় সে ব্যাপারে তাদের ন্যূনতম কোন উৎকণ্ঠা নেই। আবার একশ্রেণীর মানুষ আছেন যারা যে কোন সংবাদকেই লুফে নেন। নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে কোন কিছু বিচার করেন না বা সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখেন না। এর একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে ভারতের একটি ঘটনা থেকে। বিবিসি’র এক খবরে ইতিপূর্বে বলা হয়, ‘ভারতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ যত বাড়ছে, ততই নানা দিকে গোমূত্র এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারে – এমন প্রচার চালাচ্ছেন কিছু ব্যক্তি এবং সংগঠন। আর এই প্রচারে প্ররোচিত হয়ে শিবু নামের এক যুবক গোমূত্র পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন আগে এক বোতল গোমূত্র দিয়ে তৈরি গো-আরক কিনেছিলাম। চারদিকে এত করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে, অনেকেই দেখছি গোমূত্র খাওয়ার কথা বলছে। তাই আমিও এক ছিপি খেয়েছিলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই গলা, বুক, পেট পুরো জ্বলে যাচ্ছিল। জল খেয়েও স্বস্তি পাই নি। তাই হাসপাতালে যেতে হয়েছিল।’

অন্যদিকে আমরা দেখেছি করোনা শুরু হওয়ার প্রথম দিকে একদল অতি ধার্মীক মুসলমান মনে করতেন এই রোগ তাদের স্পর্শ করবে না।

এরকমভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর অনুসারী ঐ ‘বাঞ্চ অব ইয়াহুজ’রাও হয়তো মনে করেন করোনা তাদের স্পর্শ করবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা এই তথ্য ছড়াচ্ছে যে, কভিড-১৯ সাধারণ ফ্লু-র চেয়ে বেশী বিপজ্জনক নয়। তাই মাস্ক পরার কোন প্রয়োজনীয়তা তারা দেখেন না। দেখেন না সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোন প্রয়োজনীয়তাও। এরা আবার জাল বা ভুয়া সনদও বিলি করছেন। ঐ সনদ দেখিয়ে এন্টি ভেক্সার বা এন্টি মাস্কার’রা জনসমক্ষে মাস্ক না পরে ঘুরাফেরা করছেন। অন্টারিওর মাস্ক আইনে বলা আছে যাদের এ্যাজমা বা শ^াস-প্রশ^াসজনিত অন্য কোন মেডিকেল সমস্যা আছে তারা মাস্ক ছাড়া দোকানে বা  অন্যকোন জনাকীর্ণ স্থানে যেতে পারবেন চিকিৎসকের সনদ নিয়ে।

এন্টি ভেক্সিন বা এন্টি মাস্ক গ্রুপের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী না হয়েও আরেক দল আছেন যারা জনসমক্ষে সঠিকভাবে মাস্ক পরেন না এবং শারীরিক দূরত্বও বজায় রাখেন না। এরাও সমানভাবেই চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন এবং কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করছেন নিজেদের জন্য, সেই সাথে অপরের জন্যও।

করোনার কারণে মানুষের যে কেবল শারীরিক ক্ষতি বা সমস্যা হচ্ছে তা নয়, বিপুল সংখ্যাক মানুষ মানসিক সমস্যায়ও ভুগছেন। সিবিসি’র এক খবরে বলা হয়, করোনার প্রভাবে কানাডায় অর্ধেক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনিত ঘটেছে। চাকরি হারানোর ঘটনা বেড়ে যাওয়া এবং স্বেচ্ছা বিচ্ছিন্নতা অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে কানাডার অর্ধেক মানুষই বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারির সময় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। আর ১০ শতাংশ বলেছেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের “যথেষ্ট” অবনতি হয়েছে। নতুন এক সমীক্ষায় এসব তথ্য জানা গেছে। অ্যাঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউটের অনলাইনে করা সমীক্ষার এই রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। তাতে ওইসব তথ্য দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কভিড-১৯ এর কারণে মানুষ শরীরিক ও মানসিক উভয়দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রিয়ভাবেও। অনেকে হারাচ্ছেন অতি প্রিয়জনকে। আর এই সমস্যাকে আশংকাজনকভাবে বাড়িয়ে তুলছেন  এই এন্টি ভেক্সার, এন্টি মাস্কার এবং অন্য যারা সঠিকভাব মাস্ক না পরে এবং সঠিক দূরত্ব বজায় না রেখে জনসমক্ষে চলাফেরা করছেন তারা। এগুলো করে তারা একদিকে যেমন চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন, অন্যদিকে তেমনি পরিচয় দিচ্ছেন চরম স্বার্থপরতারও। তারা নিজেদের স্বাধীনতার নাম করে গোটা মানব জাতির সর্বনাশ করার ব্যবস্থা পাকাপাকি করছেন। এই দায়িত্বহীন ও কান্ডজ্ঞানহীনদের কারণেই কানাডাসহ পৃথিবীর অনেক দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে কানাডার কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় সরকারগুলোর উচিৎ এদের বিষয়ে আরো কঠিন হওয়া। কারণ, এরা মানুষের জীবন নিয়ে খেলছেন।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ