বিয়ে একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয়!

ডিসেম্বর ৯, ২০১৯

খুরশিদ আলম

কানাডার সিংহভাগ মানুষ মনে করেন বিয়ে একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয়! দাম্পত্য জীবন নির্বাহ করার জন্য বিয়ে করাটা নাকি এখন আর জরুরী নয়। শুধু তাই নয়, এখন বিয়ের সংজ্ঞা-ও পাল্টে গেছে! কানাডায় পুরুষের সঙ্গে পুরুষের এবং নারীর সঙ্গে নারীর বিয়েও এখন বৈধ! এবং তা হচ্ছেও অহরহ। এখানেই শেষ নয়, কানাডায় বর্তমানে প্রতি ১০ জনে একজন মানুষ বন্ধনহীন সম্পর্ককে (এমন এক ধরণের বিয়ে বা সম্পর্ক যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়েই সম্মত থাকেন যে তারা পরস্পরকে ছাড়াও অন্য কারো সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হতে পারবেন) গুরুত্ব দিচ্ছেন অথবা এধরণের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদিকে কানাডায় অসবর্ণ বিয়ে অর্থাৎ এক বর্ণের মানুষের সঙ্গে অন্য বর্ণের মানুষের বিয়ে অথবা এক ধর্মের মানুষের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের বিয়ের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কানাডায় সিংহভাগ মানুষ বিয়েটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন এই তথ্য উঠে এসেছে Angus Reid Institute এর এক সাম্প্রতিক জরীপে। ঐ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৩ শতাংশ বলেছেন, কোনও দম্পতি সারাজীবন একসঙ্গে কাটাতে চাইলে তাদের বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াটা জরুরী নয়। আর প্রতি ছয়জনে একজন বলেছেন, তারা বিয়ের ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহী নন। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব মতে কানাডিয়ান ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছেন বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে। ২০১৬ সালের আদম শুমারীর হিসাব অনুযায়ী দেখা গেছে কানাডায় ২৮.২% মানুষ বিয়ে না করে একাই থাকছেন। বিগত দেড়শত বছরের মধ্যে এই হার সর্বোচ্চ।

Angus Reid Institute এর নির্বাহী পরিচালক শাচি কার্ল-এর মতে এই পরিবর্তিত মানসিকতার একটি কারণ হলো বিয়ে না করেও একজন সঙ্গীর সঙ্গে বসবাস করাটা (লিভ-টুগেদার) এখন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। স্টার ভ্যাঙ্কুভার পত্রিকাকে তিনি বলেন, “এক প্রজন্ম আগেও বিয়ে না করে কারও সঙ্গে বসবাস করাটা ছিলো পাপের মধ্যে বসবাসের সামিল।”

পাপ-পূণ্যের বিষয়টি আসলে আপেক্ষিক। এক দেশে বা এক সমাজে যা পাপ বলে বিবেচিত হয়, অন্য দেশে বা অন্য সমাজে সেই একই কর্ম পাপ বলে নাও বিবেচিত হতে পারে। অথবা অতীতে যা পাপ বলে গণ্য হতো সেটি আজকের যুগে পাপ বলে নাও বিবেচিত হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে মুসলিম নারীদের পর্দা প্রথার কথাই বলা যেতে পারে। এই পর্দা প্রথা পৃথিবীর একেক দেশে একেক রকম। এমনকি মুসলিম দেশ সৌদিতে যে পর্দা প্রথা রয়েছে সেই পর্দা প্রথার সঙ্গে অন্যান্য অনেক মুসলিম দেশের মিল নেই। বিয়ে, লিভ টুগেদার, বিয়ের আগে প্রেম ইত্যাদিতেও রয়েছে একেক দেশের একেক সংস্কৃতি।

বলা হচ্ছে, কানাডিয়ান সমাজে লিভ টুগেদার বা বিয়ে না করে এক সঙ্গে বসবাস করাটা এক প্রজন্ম আগেও পাপ বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু এখন আর তা করা হচ্ছে না। এই প্রথা এখন দেশটিতে অধিক মাত্রায় গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং দিন দিন তা আরো বেশী মাত্রায় গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। ২০১৬ সালের কানাডীয় পরিসংখ্যান বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, দম্পতিদের এক-পঞ্চমাংশই বর্তমানে অলিখিত আইনের আওতায় (বিয়ে বহির্ভূত) বসবাস করেন। ১৯৮১ সালের তুলনায় এই হার তিনগুণ বেশি। পাশাপাশি এও দেখা যাচ্ছে যে, বেশি সংখ্যক মানুষ এখন একাকী বসবাস করছেন। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো একক ব্যক্তির পরিবার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত বিষয় হিসাবে দেখা দেয়।

সামাজে এই পরিবর্তনগুলো বেশ দ্রæতই ঘটছে বলা যায়। দাম্পত্য জীবন নির্বাহ করার জন্য বিয়ে করাটা আর জরুরী নয় বা বিয়ের বিষয়টি অপ্রয়োজনীয়, এরকম কথা এক বা দুই প্রজন্ম আগে কেউ প্রকাশ্যে বলার সাহস করতো না। কিন্তু এখন তা শুধু বলাই নয়, বাস্তব জীবনে তা অনেকে করেও দেখাচ্ছেন।

কিন্তু কেন? বিয়েটা কেন জরুরী নয় বলে মনে করছেন সিংহভাগ মানুষ! এবং শুধু মনে করাই নয়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষই কেন বিরত থাকছেন বিয়ে করা থেকে? বয়স তিরিশের কোঠা পার হয়ে চল্লিশে পা রাখার পরও কেন অনেকে বিয়ে করছেন না?

এর পিছনে কারণ অনেকই থাকতে পারে। অর্থনৈতিক কারণ থেকে শুরু করে নগর জীবনের নানান জটিলতা, বিশ্বাসের ঘাটতি, দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা এরকম আরো কিছু কারণ থাকতে পারে। কেউ কেউ বিয়ে করাটাকে বোকামীও মনে করেন। বিয়ে ও বোকামী বিষয়ে একটি কৌতুকও আছে। কৌতুকটি এরকম –

“এক লোক ও তার ছেলে ছুটির দিনে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গেলো। এক খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে ছোট ছেলেটি প্রশ্ন করলো : বাবা, ঐটা কী প্রাণী?

বাবা : ঐটা একটা গাধী।

ছেলে : বাবা, গাধী কী?

বাবা : গাধী হলো গাধার স্ত্রীলিঙ্গ। সহজ করে বললে গাধার বউ গাধী।

ছেলে : বাবা, গাধারা কি বিয়ে করে?

বাবা : (বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) হ্যাঁ খোকা, একমাত্র গাধারাই বিয়ে করে।”

কৌতুকের পিছনে কি কোন সত্য লুকানো থাকে? এর সুষ্পষ্ট কোন জবাব নেই। সত্য লুকানো থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কানাডার অধিকাংশ মানুষ বিয়ে করাটাকে আর বুদ্ধিমানের কাজ মনে করছেন না। এই মানুষগুলো শুধু পুরুষ নন, নারীরাও আছেন এই বিয়ে না করার দলে। যে সকল নারী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছেন তাদের মধ্যে বিয়ে করার গরজ কম বা বিয়ে করলেও দেরীতে করছেন।

Angus Reid Institute এর রিপোর্টে বলা হয়, “আরও কিছু বিষয়, যেমন আর্থিক অবস্থা এবং বিয়ের খরচ ইত্যাদিও গত শতকের শেষদিকে জন্মানো লোকদের কাছে উদ্বেগের বিষয় এবং সম্ভবত এ কারণেও তারা বিয়ে ঠেকিয়ে রাখছেন বা একেবারেই বাদ দিচ্ছেন।”

জরীপ সংস্থা Ipsos এর তথ্যমতে কানাডিয়ানরা ২০১৭ সালে গড়ে ৮৯৩৭.০০ ডলার খরচ করেছেন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে। তবে প্রাপ্ত তথ্যে এমনো দেখা গেছে এই খরচের পরিমান কোন কোন ব্যক্তির বেলায় ৩০ হাজার থেকে এক লক্ষ ডলারও হয়েছে।

পরিবার সম্পর্কিত ভ্যানিয়ার ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নোরা স্পিঙ্কস বলেন, মূল্যবোধের পরিবর্তন বিয়ের ব্যাপারে মানুষের মনোভাবের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এর আগে স্পিঙ্কস টরন্টো স্টার পত্রিকাকে বলেছিলেন, অতীতে যেসব বিষয় মানুষকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করতো যেমন, ধর্মবিশ্বাস, আর্থিক প্রয়োজন এবং বিয়ে-বহির্ভূত যৌনতা নিষিদ্ধ মনে করা, ইত্যাদি আজকের দিনে আর প্রাসঙ্গিক নয়।

নোরা স্পিঙ্কস এর এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল রয়েছে সন্দেহ নেই। আমরা দেখেছি, কানাডায় মূলধারার মানুষজন এখন আগের মত ধার্মিক নন। সিবিসি নিউজের বনি অ্যালেন এর তৈরী অতিসাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগামী এক দশকের মধ্যে কানাডার ৯০০০ গীর্জা হারিয়ে যাবে। এই সংখ্যাটি কানাডায় বিদ্যমান গীর্জার মোট সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর কানাডা রিজেনারেশন প্রজেক্টের নেতা রবার্ট প্যাজট বলেন, কানাডার প্রতিটি কমিউনিটিই পুরনো গির্জা ভবনগুলো বন্ধ করে দেওয়া, বিক্রি করা অথবা ধ্বংস করে দেওয়ার ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।

মানুষের বিশেষত মহিলাদের আর্থিক প্রয়োজনের বিষয়টিও এখন আগের মত নয়। তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই মেয়েই এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। জীবনধারণের জন্য তাদেরকে এখন আর পরনির্ভর হতে হয় না। অন্যদিকে বিয়ে-বহির্ভূত যৌনতার বিষয়ে মানুষের মধ্যে যে বিরুদ্ধ মনোভাব বজায় ছিল অতীতে তাও এখন অনেকটাই বদলে গেছে বা বদলে যাচ্ছে।

তরুণ প্রজন্ম কর্তৃক বিয়েটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করার পিছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া। কানাডায় সার্বিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের হার প্রতি দশজনে চার জন। স্ট্যাটিসটিকস্ কানাডার ভবিষ্যতবাণী হলো ২০০৪ সালে সংঘটিত বিয়ের শতকরা ৩৮ টি ভেঙ্গে যাবে ২০৩৫ সালের মধ্যে।

অন্যদিকে বিয়ের হারও হ্রাস পাচ্ছে কানাডায়। ‘ডিভোর্স কেস ইন সিভিল কোর্ট, ২০১০/১১’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে থেকে জানা যায় ২০০৮ সালে মোট বিয়ের সংখ্যা ছিল ১৪৭,২৮৮টি। আর ২০০৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৫০,৫০৫টি। ঐ প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, কানাডায় ফ্যামিলি স্ট্রাকচার বা পারিবারিক কাঠমোতে পরিবর্তন ঘটছে। দেখা গেছে গত দুই দশকে বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে কমন ল ইউনিয়ন বা অবিবাহিত দম্পতির (লিভ টুগেদার) সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত শতকের ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে লোন (একক) প্যারেন্ট ফ্যামিলির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ পরিবারে শুধু মা অথবা বাবার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা হ্রাস পেলেও এখনো তা কমন ল দম্পতির চেয়েও সংখ্যায় বেশী।

মার্কিন পত্রিকা ‘ইভলিউশনারি সাইকোলজিকাল সায়েন্স’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক লিসা ফায়ারস্টোন জানান, ছেলেদের ‘সিঙ্গল’ থাকার পেছনে প্রধান ছ’টি কারণ রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ২০ হাজারেরও বেশি ‘সিঙ্গল’ পুরুষের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে তাদের মতামত সংগ্রহ করে যে উত্তরগুলো পাওয়া গিয়েছে সেগুলোকে ৪৩টি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করে মনোবিজ্ঞানীরা প্রধান ছ’টি কারণ জানতে পারেন। কারণগুলোর মধ্যে আছে –

“ আত্মবিশ্বাস : ছেলেদের সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে মূলত আত্মবিশ্বাসের অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমীক্ষা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এই আত্মবিশ্বাসের অভাবে অনেকে একা থাকতে চান।

সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা : সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেরা খুব বেশি মাথা ঘামাতে চান না। আর এ থেকেই সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত  নেন তারা।

ইচ্ছে : সম্পর্ক গড়তে ছেলেদের কোনও রকম ইচ্ছেই নেই। এ কথা বলেছেন কেউ কেউ। তবে এই সংখ্যাটা অনেক কম।

হীনমন্যতা : সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশের উত্তর ছিল- তারা দেখতে ভাল নয় বলে একা থাকতে চান। অর্থাৎ, আত্মবিশ্বাসের অভাব বা হীনমন্যতার কারণে এই সব ছেলেরা কোনও রকম সম্পর্কে জরাতে চান না।

বিশ্বাস : অনেকে বলেছেন, মেয়েদের বিশ্বাস করতে পারেন না তারা। কারণ হিসেবে তারা তাদের ভেঙে যাওয়া সম্পর্ককে দেখিয়েছেন।

ইন্ট্রোভার্ট বা অন্তর্মূখী স্বভাব : এটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অনেকে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে জড়তা অনুভব করেন। এরা খুব অন্তর্মূখী ও লাজুক স্বভাবের। আর এ জন্যই তারা একা থাকতেই পছন্দ করেন।”

প্রবাসে আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটিতেও ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে করার বিষয়ে ধীর গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা হয়তো বিয়ে করাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন না। কিন্তু সময়মত বিয়ের কাজটাও তারা সম্পন্ন করছেন না। কেউ বলছেন আগে ক্যারিয়ার গড়ে নেই তারপর বিয়ে, কেউ বলছেন উপযুক্ত পাত্র বা পাত্রি খুঁজে পাচ্ছি না। আবার বিয়ে ভেঙ্গে যাবার আশংকাও কাজ করে কারো কারো মধ্যে। সে কারণেও বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ হ্রাস পেয়ে থাকতে পারে।

২০১০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায় কানাডাও ও আমেরিকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছে শতকরা ৩১.১৪ ভাগে। ঐ সময়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ বিবাহবিচ্ছেদের যে হার ছিল তার চেয়েও এটি ছিল প্রায় তিন গুণ বেশি। মিশর এবং তুরস্কে এই হার ছিল ১০%। সাউন্ড ভিশন এর পক্ষে গবেষণাটি পরিচালনা করেন নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক সমাজবিজ্ঞানী ইলিয়াস বাই ইউনুস। গত দুই দশকে উত্তর আমেরিকায় এই পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। এখানকার আইনজীবী, কাউন্সিলর এবং ইমামগণ অব্যাহতভাবেই বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছেন। প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে iqra.ca.

ঐ জরীপের ফলাফলে আরো দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বিয়ে টিকে ছিল দুই থেকে পাঁচ বছর। একচতুর্থাংশের বিয়ে টিকে ছিল এক বছরেরও কম সময়। ২০% এর বিয়ে টিকে ছিল ছয় থেকে দশ বছর। ১৬% এর বিয়ে টিকে ছিল এগার থেকে বিশ বছর পর্যন্ত। অর্থাৎ বেশীর ভাগ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল বিয়ের প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে।

উত্তর আমেরিকায় বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ইমোশনাল এবিউজ সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখে এমন তথ্যই জানায় সাউন্ড ভিশন। তাদের জরীপে যারা অংশ নেন তাদের মধ্যে শতকরা ৩২.৩২ ভাগ নারী-পুরুষ জানান বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের মধ্যে তারা ইমোশনাল এবিউজ বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বেশী।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, এই ইমোশনাল এবিউজের শিকার পুরুষরাই বেশী হচ্ছেন বলে জরীপে উঠে এসেছে। শতকরা ৩৭.৭০ ভাগ পুরুষ জানিয়েছেন তারা ইমোশনাল এবিউজের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে শতকরা ৩১.২৬ ভাগ নারী জানিয়েছেন যে তারা ইমোশনাল এবিউজের শিকার হয়েছেন। ভারবাল বা মৌখিক নির্যাতনের বেলায়ও দেখা গেছে পুরুষরাই বেশী শিকার হচ্ছেন। জরীপ রিপোর্টে দেখা যায় শতকরা ২৪.৫৯ ভাগ পুুরুষ দাবী করেন যে তারা কোননা কোনভাবে মৌখিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর নারীদের মধ্যে শতকরা ২১.৪৯ জন দাবী করেছেন তারা মৌখিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

কিন্তু লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, ইদানিংকালে মহিলারাই বিবাহবিচ্ছেদের উদ্যোগ ও প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় বহুদুর এগিয়ে আছেন। সাউন্ড ভিশন তাদের জরীপে দেখতে পায়, আমেরিকা ও কানাডায় মুসলিম কমিউনিটিতে (যেখানে বাংলাদেশীরাও রয়েছেন) বিবাহবিচ্ছেদের যে সকল ঘটনা ঘটছে তার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই প্রথম উদ্যোগ ও প্রক্রিয়াটি শুরু করেন মহিলাগণ। পুরুষ উদ্যোক্তাদের মধ্যে এই হার এক তৃতীয়াংশ।

তবে কৌতুহলের বিষয় হলো, কানাডায় ব্যাপক সংখ্যক মানুষ বিয়েটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করলেও  এখানকার মুসলিম কমিউনিটিতে কেউ কেউ এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়েও করছেন! কানাডীয় আইনে এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন না। কিন্তু ইসলামী আইনে একজন পুরুষ তা পারেন কতিপয় শর্ত মেনে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কানাডার মুসলিম কমিউনিটিতে কেউ কেউ এই কাজটি করছেন। টরন্টো সান পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ইতিপূর্বে। ঐ পত্রিকার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যারা এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করছেন তারা মনে করছেন এটি তাদের অধিকার। তারা কানাডার আইন এবং একই সঙ্গে ইসলামী আইনও ভঙ্গ করছেন এ কথা স্বীকার করতে নারাজ। এদের মধ্যে কয়েকজন ইমাম-ও আছেন। তারা নিজেরাও দ্বিতীয় বিয়ে করেই ক্ষান্ত নন, সাধারণ কোন মুসলিম দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে তাকে নানানভাবে সহায়তা করছেন। কেউ কেউ এমন পরামর্শও দিচ্ছেন যে, ‘পারিবারিক শান্তি’ বজায় রাখার প্রয়োজনে প্রথম স্ত্রীর কাছে দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা গোপন রাখা অন্যায় নয়!

কানাডায় বিয়ে সম্পর্কিত কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য যা weddingbells.ca নামের একটি ওয়েবসাইটে বর্ণনা করা হয়েছে।

– ৬৭% বিয়ের অনুষ্ঠান হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। বিয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাস হলো আগস্ট। মোট বিয়ের ২৩% অনুষ্ঠিত হয় এই মাসটিতে।

– ১৪% বিয়ের অনুষ্ঠান হয় কানাডার বাইরে।

– কানাডায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে খরচ হয় সাধারণত ৩০ হাজার ডলার। খরচের এই হিসাব হানিমুন সহ।

– কানাডায় কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গড়ে ১২৯ জন অতিথি উপস্থিত থাকেন। তবে বাঙ্গালীদের হিসাব আলাদা। গড়ে ৫শত অতিথি উপস্থিত থাকেন।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ