‘নো ওয়ান ইজ ইল্লিগ্যাল’
জুলাই ১৩, ২০২০
খুরশিদ আলম
মানুষ কি কখনো ইল্লিগ্যাল বা অবৈধ হয়? অথবা এলিয়েন? মানুষ তো মানুষই। মানুষ অবৈধ হিসাবে জন্মায় না। আর এলিয়েন তো ভিন গ্রহের কাল্পনিক প্রাণী। তা হলে পশ্চিমা দেশগুলোতে বৈধ কাজগপত্রহীন ইমিগ্রেন্টদেরকে কেন ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘ইল্লিগ্যাল এলিয়েন’ বলা হয় যা পক্ষপাতদুষ্ট পরিভাষা?
হলোকাস্ট সারভাইভার ও নোবেল বিজয়ী এলি উইজেল বলেন, জগতে কোন মানুষই অবৈধ নয়।
বাংলার মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ কবি বড়– চন্ডীদাস একদিন উচ্চারণ করেছিলেন মানবতার অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ বাণী – ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।
চন্ডিদাসের যুগ পার হয়েছে বহুকাল আগে। তখনকার মানুষ এখনকার মানুষদের মতো আধুনিক ছিলেন না। দেশে দেশে তখন রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, শোষণ, বর্ণবাদ, দাস প্রথা ছিল প্রথাসিদ্ধ বিষয়। রাজ পরিবারের সদস্যরা এবং অন্যান্য ক্ষমতাধর ও ধনিক শ্রেণীর অনেকেই সাধারণ মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করতেন না। নিজেদেরকে ইশ^রের প্রতিনিধি বলেও ভাবতেন কেউ কেউ। শুধু ভাবা নয়, তা প্রচারও করতেন। মানুষকে পদানত করে রাখার জন্য মানুষের মধ্যে শ্রেণীবিভেদ তারাই সৃষ্টি করেছেন। তাদের ভাষায় ‘নিম্ম শ্রেণী’র মানুষেরা সমাজে ছিলেন অস্পৃশ্য। এরা বঞ্চিত থাকতেন সমাজের অনেক কিছু থেকেই। এদেরকে অবহেলা করা, অপমান করা, নির্যাতন করা, শোষণ করা সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোকদের জন্য বৈধ ছিল।
কিন্তু সেই চিত্র কি বদল হয়েছে আজকের এই আধুনিক যুগেও? না হয়নি। মানুষ আধুনিক হয়েছে কিছু যান্ত্রিক উন্নয়ন ঘটিয়ে। কিন্তু আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান বা সমাজের সুবিধাভোগী অধিকাংশ মানুষের মনন বা চিন্তাধারায় উন্নয়ন ঘটেনি, ঘটেনি তার যথাযথ অধুনিকীকরণ। আর সেটি উন্নত ও অনুন্নত সব দেশের বেলায়ই সত্যি। দেশে দেশে ক্ষমতাবান ও বিশেষ সুবিধাভোগকারী অধিকাংশ মানুষ এখনো তথাকথিত ‘নিম্ম শ্রেণী’র মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করেন না। এদেরকে নানান উপায়ে অপমান করা ও নির্যাতন করাটাকে তারা অপরাধ বলে গণ্য করেন না। বরং অধিকার মনে করেন।
আজকে পাশ্চাত্য দেশসমূহে শরণার্থী বা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদেরকেও অনেকে মানুষ বলে গণ্য করেন না বা নিম্ম শ্রেণীর মানুষ মনে করেন। তাদের প্রতি একটা তাচ্ছিল্য মনোভাব পোষণ করেন সবসময়। আর সে কারণেই এদেরকে ‘ইল্লিগ্যাল’ বা ‘এলিয়েন’ বলতে ভালবাসেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, মানুষের প্রতি মানবতা আজো, এই আধুনিক যুগেও অনেক ক্ষেত্রেই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষ আধুনিক হয়েছে, উন্নতি লাভ করেছে, কিন্তু সভ্য হয়নি অনেকেই। সবার উপরে মানুষকে স্থান দিতে শিখেননি তারা। আর সে কারণেই আমরা দেখি বর্তমান যুগে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে পরিচিত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতেও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এইসব দেশগুলোতে যারা অভিবাসী, বিশেষ করে যে সকল অভিবাসীর গায়ের রঙ কালো বা বাদামী তারা প্রতিনিয়তই প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে শিকার হচ্ছেন বর্ণবাদ ও বৈষম্যের। এইসব দেশে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য যাদের কোন অনুমোদন নেই তাদেরকে বলা হচ্ছে ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’। অর্থাৎ অবৈধ ইমিগ্রেন্ট বা ভিনগ্রহ থেকে আসা কেউ।
সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্ণবাদী ও অমার্জিত এবং রুঢ় প্রকৃতির একজন প্রেসিডেন্ট হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এই ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিকট ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’ পরিভাষাগুলো বেশ পছন্দের। তিনি প্রতিনিয়তই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনুমোদনহীন ইমিগ্রেন্টদেরকে গালাগাল করেন এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে। এমনকি বৈধ ইমিগ্রেন্টদেরকেও তিনি যাচ্ছেতাই ভাবে গালাগাল করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইমিগ্রেন্টদের একটা বড় অংশ ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আগত। ডোনাল্ড ট্রাম্প এদেরকে জানোয়ার বলে আখ্যায়িত করেন। আজকের যুগে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট এর মুখে এই ধরণের মন্তব্য ভাবনারও অতীত। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিনিয়তই এই সব চরম অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করে আসছেন ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে।
ইতিহাসবিদ ও জর্জ ওয়াশিংটন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক টেইলার আনবিন্দার ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক কলামে উল্লেখ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইমিগ্রেন্টদের প্রতি সবচেয়ে বেশী ঘৃণা ছড়িয়েছেন এই ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার আগে অন্যান্য প্রেসিডেন্টদেরও কেউ কেউ ঘৃণা ছড়িয়েছেন ইমিগ্রেন্টদের প্রতি। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি ইমিগ্রেন্টদের যে ভাবে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন এবং আক্রমণ করেছেন তা ইতিপূর্বে আর কেউ করেননি।
অধ্যাপক টেইলার আরো বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো করা হতো বা এখনো করা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দশটি হলো : “তারা অপরাধ এনেছে; তারা দারিদ্র্য আমদানি করে; তারা রোগ ছড়ায়; তারা আমেরিকার সমাজে অঙ্গীভূত হয় না; তারা আমাদের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে; তারা আমাদের কাজ চুরি করে; তারা আমাদের কর বাড়িয়ে তোলে; তারা নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ; তাদের ধর্ম আমেরিকান মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; তারা কখনই ‘সত্যিকারের আমেরিকান’ হতে পারে না।”
ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে এই জাতীয় বিষোদ্গারগুলো প্রথমে করেন রক্ষণশীল রাজনৈতিক নেতাগণ। তাদের মুখে এসকল অভিযোগ শুনতে শুনতে একসময় সাধারণ মানুষও ভাবতে থাকেন ইমিগ্রেন্টরা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী বিষবাষ্প ছড়ানোর পুরো দায় মূলত রক্ষণশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের। অথচ বাস্তবতা হলো, এই ইমিগ্রেন্টরাই আজকের উত্তর আমেরিকা গড়ে তুলেছেন। তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার যত উন্নতি। এবং আরো বাস্তবতা হলো, আদীবাসী সম্প্রদায় ছাড়া কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠিই ইমিগ্রেন্ট। পার্থক্য শুধু, কেউ আগে এসেছেন এবং কেউ পরে এসেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্বপুরুষও মাইগ্রেট করে আমেরিকায় এসেছেন জার্মানী থেকে। সে সময় তারা ভিসা নিয়ে আমেরিকায় আসেন নি। আমেরিকায় স্থায়ীভাবে থাকার জন্য কোন বৈধ কাজগপত্রও ছিল না তাদের। এখন তারা যদি ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট না হয়ে থাকেন, তারা যদি এলিয়েন না হয়ে থাকেন তবে আজকের দিনে যারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আমেরিকায় আছেন তারা কেন ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট হবেন বা এলিয়েন হবেন?
‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’ শব্দগুলো কানাডায়ও ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও। আর এই শব্দগুলোর মূল টার্গেট হলো এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা বিভিন্ন এথনিক গোষ্ঠির সদস্যরা। এরা পাশ্চাত্যের এই দেশগুলোতে নানানভাবে বর্ণবাদ, বৈষম্য ও বঞ্চণার শিকার হন। তারপরও তাদের কপালে জুটে ‘ইল্লিগ্যাল’ বা ‘এলিয়েন’ এর মতো অবমাননাকর পরিভাষাগুলো।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রায় দুই দশক আগে কানাডায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে একটি আন্দোলন শুরু হয়েছিল যার নাম ছিল ‘নো ওয়ান ইজ ইল্লিগ্যাল’। এর শুরুটা হয়েছিল জার্মানীতে ১৯৯৭ সালে। পরে আরো কয়েকটি দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পাশ্চ্যাত্য দেশগুলোতে আসা অনুমোদনহীন বা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ইমিগ্রেন্টদের উদ্যোগে এই আন্দোলনের শুরু। অবশ্য সেই আন্দোলন তেমন জোরদার হয়ে উঠতে পারেনি কোথাও। কানাডায়ও না।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি কয়েকটি রাজ্যে এই ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’ শব্দগুলো ব্যবহারের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে নিউইয়র্কে। এনবিসি নিউয়র্ক এর খবরে বলা হয়, গত মে মাসে নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল অমানবিক ও আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে একটি বিল পাশ করে। এর ফলে এখন থেকে ঐ সিটির কোন কর্মকর্তা বা পুলিশ সদস্য ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ ও ‘এলিয়েন’ শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারবেন না কোন কাগজপত্রহীন ইমিগ্রেন্ট এর বেলায়। ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’ শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করতে হবে ‘ননসিটিজেন’ বা ‘নাগরিক নন’।
নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের সদস্য ফ্রন্সিসকো মোয়া বলেন, ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’ এই শব্দগুলো মান্ধাতার আমলের এবং তা মানুষকে হেয় করার জন্য ব্যবহার করা হতো। শব্দের অনেক ক্ষমতা আছে। আমরা যে শব্দ ব্যবহার করি তার শক্তি আছে এবং আছে পরিনতিও।
এনবিসি আরো জানায়, গত বছর নিউইয়র্ক সিটির হিউম্যান রাইটস কমিশন এক গাইডলাইন ইস্যু করে যেখানে বলা হয়, কোন ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা বা হয়রানী করার অভিপ্রায়ে ‘ইল্লিগ্যাল এলিয়েন’ বা ‘ইল্লিগ্যাল’ শব্দ ব্যবহার করা বেআইনী। গাইডলাইনে আরো বলা হয়, কেউ ইংরেজী ছাড়া অন্য ভাষা ব্যবহার করলে বা ইংরেজীতে কারো দক্ষতা কম থাকলে তাকে হয়রানী করা যাবে না বা তার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। করলে সেটি হবে বেআইনী।
সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ শব্দ দুটি প্রথম ব্যবহার করে বৃটিশরা যখন ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরা নাৎসিদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পালিয়ে এসে প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করেন অনুমতি ছাড়া। এই শব্দ দুটি তখন ইহুদীদের হেয় করার জন্য বা তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করার জন্য বৃটিশরা ব্যবহার করতেন।
ইউনির্ভার্সিটি অব মেমফিস এর অধ্যাপক থমাস হার্চ একটি জরিপ চালিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমগুলো কাগজপত্রহীন ইমিগ্রেন্টদেরকে কি ভাবে চিহ্নিত করে তা দেখার জন্য। এ জন্য তিনি ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০১০ সালের মধ্যে প্রকাশিত বার লক্ষ দুই হাজার সংবাদ পরীক্ষা করে দেখেন। তাতে তিনি দেখতে পান এই সময়ের মধ্যে ৮৯% সংবাদে সংবাদ কর্মীগণ পক্ষপাতদুষ্ট পরিভাষা ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ এবং ‘ইল্লিগ্যাল এলিয়েন’ ব্যবহার করেন।
সংবাদ মাধ্যম সিএনএন এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রতিবেদক চার্লস গার্সিয়া বলেন, “অনেকেরই একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, অধিকাংশ মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার রাতের আঁধারে সীমান্ত পার হয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এদের প্রায় অর্ধেকই আসেন বৈধ ভ্রমণ ভিসায় অথবা ওয়ার্ক ভিসায়। পরে তাদের অনেকেই ওভার স্টে করেন। কেউ কেউ স্কুলে ভর্তি হন, কেউ একটি চাকরী যোগার করে নেন। অনেকে বিয়ে-থা করে সংসারও শুরু করেন। এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আবার নৌবাহিনী বা সেনাবাহিনীতেও যোগ দেন। একজন সেনা সদস্য ইরাকে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান। পরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে মরনোত্তর নাগরিকত্ব প্রদান করে। প্রায় ৩৮ হাজার নন-সিটিজেন আছেন আমেরিকার সেনাবাহিনীতে যাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন বৈধকাগজপত্র ছাড়া ইমিগ্রেন্ট। এবং এরা দেশ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন।”
এখন এদেরকে ‘ইল্লিগ্যাল’ বলা বা ‘এলিয়েন’ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত বা শোভন সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। এরা তো কোন অপরাধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত নন। আমেরিকার চীফ জাস্টিস জন রবার্টস, এসোসিয়েট জাস্টিস এন্থনী কেনেডি সহ আরো কয়েকজন জাস্টিস এর অভিমত হলো, সাধারণ নিয়মে এটি কোন ক্রাইম বা অপরাধ নয় যদি অপসারণযোগ্য কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যান। তারা আরো বলেন, এই অপসারণযোগ্য ব্যক্তিদের কেউ যদি কোন অননুমোদিত কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হন তাহলেও তা ক্রাইম হিসাবে বিবেচ্য নয়।
পক্ষপাতদুষ্ট পরিভাষা ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’ ব্যবহারের বিষয়ে কানাডা সরকারও সম্প্রতি সজাগ হয়েছে। কানাডার ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট তাদের ওয়েবসাইটে শরণার্থীদের চিহ্নিত করার জন্য ‘ইল্লিগ্যাল’ শব্দটি বাদ দিয়েছে বছর দুই আগে। এখন ‘ইল্লিগ্যাল’ এর পরিবর্তে ‘ইরেগুলার’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’র (এনডিপি) ‘ইমিগ্রেশন ক্রিটিক’ জেনী কওয়ান এই পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। জেনী দীর্ঘদিন ধরেই পক্ষপাতদুষ্ট এই ‘ইল্লিগ্যাল’ পরিভাষাটি ব্যবহার না করার জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহŸান জানিয়ে আসছিলেন। তিনি সিবিসি নিউজকে বলেন, আমরা যখন শরণার্থীদেরকে ‘ইল্লিগ্যাল’ বলি তখন আসলে আমরা তাদেরকে অপমান বা কলঙ্কিত করি।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে এক ঘরোয়া আড্ডায় উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ঐ আড্ডায় কথা প্রসঙ্গে একজন বলেছিলেন, শরণার্থীরা কানাডায় ‘ইল্লিগ্যালী’ প্রবেশ করে এখানকার আইন ভঙ্গ করছেন। তখন আরেকজন বলেন, শরণার্থীরা যদি ‘ইল্লিগ্যালী’ কানাডায় প্রবেশ করে আইন ভঙ্গ করে থাকেন তবে অতীতে ইউরোপীয়রা যখন দলে দলে নর্থ আমেরিকায় আসতে থাকেন এবং আদীবাসীদের জায়গা ও সম্পত্তি জোর করে দখলে নিতে থাকেন তখন সেটা কি আইন ভঙ্গ ছিল না? ইউরোপীয়রা তো সে সময়ে নর্থ আমেরিকায় এসে গণহত্যার মত ঘটনাও ঘটিয়েছে আদীবাসীদের জমি ও সম্পদ দখল করার জন্য। তারা তো ভিসা নিয়ে আসেননি। বা বৈধ কাগজপত্রও নিয়ে আসেননি। আজকে তাদের অনেকেই জাতীয় বীর উপাধি নিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।
আলোচনা সেদিন আর এগুয়নি। কারণ, অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। সবাই যার যার বাড়িতে ফেরার জন্য উঠে পড়েছিলেন।
তবে সেই ‘জাতীয় বীর’দের কারো কারো মূর্তি বা ভাষ্কর্য অতি সম্প্রতি ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এর আন্দোলনের মুখে পড়ে ভাঙ্গচুড়ের শিকার হয়েছে। কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী যাকে কানাডার জাতির পিতাও বলা হয়ে থাকে, সেই স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড এর মূর্তিও অনেক স্থানে ভাংচুর এর শিকার হয়েছে ইতিপূর্বে। গত বছর মে মাসের ১৭ তারিখে মন্ট্রিয়লে Brigade de solidarité anticolonial Delhi-Dublin নামে উপনিবেশবাদ বিরোধী একটি দল এই ভাংচুর এর ঘটনা ঘটনায়। তারা একই সময় রাণী ভিক্টোরিয়ার একটি মূর্তির উপরও হামলা চালায়।
কানাডায় রাণী ভিক্টোরিয়ার মূর্তির উপর হামলা এই প্রথম নয়, অতীতে এরকম ঘটনা আরো ঘটেছে। ইতিপূর্বে মন্ট্রিয়লের ম্যাক্গিল ইউনিভার্সিটিতে বসানো রাণী ভিক্টোরিয়ার ব্রোঞ্জ মূর্তির উপর সবুজ রং লেপ্টে দেয়া হয়। Delhi-Dublin Anti-Colonial Solidarity Brigade নামে একটি সংগঠন এই কাজটি করে। যারা রাণীর মূর্তিতে রং লেপ্টে দিয়েছে তাদের ভাষ্য হলো, উপনিবেশবাদ এর বিরোধীতা করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
উল্লেখ্য যে, অতীতে যারা অবৈধভাবে এবং জোর করে বিভিন্ন দেশ দখল করে উপনিবেশবাদী শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন আজ তারাই নিজ নিজ দেশে ‘ইললিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’ পরিভাষাগুলো ব্যবহার করছেন কাগজপত্রহীন ইমিগ্রেন্টদের বেলায়। কিন্তু তারা যখন জোর করে অন্যের দেশ দখল করেছিলেন তখন কি তারা নিজেদেরকে ‘ইল্লিগ্যাল’ বা ‘এলিয়েন’ বলতেন? নিশ্চই না। বরং নিজেদেরকে বীর হিসাবে পরিচয় দিতেন। অবৈধভাবে অন্যের দেশ দখল করাটা ছিল তাদের কাছে বীরত্ব। আর দখলকৃত দেশে লুটপাট চালিয়ে এবং শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়াটা ছিল তাদের কাছে ‘পবিত্র রাজকর্ম’। অন্যের দেশ দখল ও লুটপাটে যারা সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অনেকের সুদৃশ্য ভাস্কর্য আজ শোভা পাচ্ছে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে। তারা হয়ে উঠেছেন প্রাত:স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব!
আর অবাক হওয়ার বিষয় হলো, প্রবাসে কোন কোন বাংলাদেশীকেও দেখেছি বৈধ কাগজপত্রহীন ইমিগ্রেন্টদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে। এক ধরণের সুপরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগার কারণে তারা এই ধরণের আচরণ করেন। কিন্তু সুপরিয়রিটি কমপ্লেক্স যে আসলে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স বা হীনমন্যতা সেটা বোধ হয় তাদের জানা নেই।
মানুষকে শ্রদ্ধা করা মহানুভবতারই পরিচয়। অপরকে শ্রদ্ধা করলে নিজেও শ্রদ্ধা পায় মানুষ। সেই কবির ভাষায়, সবার উপরে মানুষ সত্য… এ কথা যারা বিশ^াস করেন তারা নিজেরাও সবার উপরেই থাকেন। আর যারা হীনমন্যতায় ভোগেন, অন্য মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে জানেন না, তারা তখন নিজেরাও অসম্মানের পাত্র হয়ে উঠেন। আজকে যাদের ভাস্কর্য ভাঙ্গা হচ্ছে, যাদের ভাস্কর্যের মুখে চুন-কালি মেখে দেয়া হচ্ছে তারাও একদিন মানুষকে অসম্মান করেছিলেন। আজকে তার প্রতিদান পাচ্ছেন তারা।
সুতরাং ‘ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট’ বা ‘এলিয়েন’ এ জাতীয় অশোভন ও অপমানজনক পরিভাষা পরিহার করে পরিমার্জিত ভাষা ব্যবহার করা উচিৎ সকলের। আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রেন্ট বা ইরেগুলার ইমিগ্রেন্ট বা নন-সিটিজেন এ জাতীয় পরিভাষা ব্যবহার করলে কাউকে অসম্মান করা হয় না। আবার সত্যটাও বলা হয়।
আমরা দেখেছি ইমিগ্রেশনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে যারা একদিন ডকুমেন্টেড এবং এক পর্যায়ে সিটিজেন হন তারা সকলেই সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রিয় কর্মে অবদান রাখেন। সোমালী বংশোদ্ভূত কানাডার সাবেক ইমিগ্রেশন মিনিস্টার ও বর্তমান ফ্যামিলিজ, চিল্ড্রেন এ্যান্ড সোসিয়াল ডেভলাপমেন্ট মিনিস্টার আহমদ হোসেনও একসময় আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রেন্ট ছিলেন। আজকে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। এরকম নজীরের অভাব নেই কানাডা-সহ পাশ্চাত্যের দেশ সমূহে। সুতরাং কাউকে অবহেলা নয়, কারো প্রতি অশোভন আচরণ নয়। মানুষকে স্থান দিতে হবে সবার উপরে। মনে রাখতে হবে, মানুষ কখনো অবৈধ বা ইল্লিগ্যাল হয় না।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ