টরেটক্কা টরেন্টো – আগমন

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০

কাজী সাব্বির আহমেদ

ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরে আমার বসবাসের বেশ কিছু বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। যে বিশেষ ব্যাপারটি আমাকে সব সময় উদ্দীপ্ত রেখেছে সেটা হলো এখানকার সমাজ আমাকে তাদেরই একজন হিসেবে স্থান করে দিয়েছে। আমার মাঝেও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে বিশেষ করে ভাষাগত ব্যাপারে। বিশুদ্ধ ম্যান্ডারিন আমি এবং আমার স্ত্রী সেই বেইজিং-এ পড়াকালীন সময় থেকে বলতে পারি, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ করে কাঁচা বাজারে চাইনিজদের সাথে আমরা ম্যান্ডারিনে কথা বলতাম। কাজ চালানোর মতোন মালেয় আমাদের শেখা হয়ে গেছে ততদিনে। ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরের ‘কলোকিয়াল’ ইংরেজীতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি আমরা। ইংরেজীর সাথে মালেয় এবং ‘হক্কেইন’ শব্দ জুড়ে দিয়ে সাবলীলভাবে ‘সিঙ্গলিশ’ ভাষায় আমার কথা বলা দেখে একবার এক বাংলাদেশী শ্রমিক ভাই আমাকে সিঙ্গাপুরিয়ান ভেবে বসেছিলো। এদিকে দেখতে দেখতে আমাদের ‘পার্মানেন্ট রেসিডেন্সশীপ’-এর নবায়নের সময় চলে এলো। সিঙ্গাপুর সরকার যদি ‘ডুয়েল সিটিজেনশীপ’-এর অনুমোদন দিত, তাহলে হয়ত এই সময়ে সিঙ্গাপুরের সিটিজেনশীপটা নিয়ে নিতাম। তার বদলে অনেকটা ‘দেখি কি হয়’ এই মনোভাব নিয়ে পরিচিত অনেক বাংলাদেশী পরিবারের দেখাদেখি আমরাও কানাডার ইমিগ্রেশন ভিসার আবেদন পত্র জমা দিলাম। সিঙ্গাপুর যদিও শক্ত একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তারপরও দুইটি বিশেষ কারণে কানাডা যাবার চিন্তা আমার মাথায় ঢুকেছিল। এক, প্রো-চাইনিজ শিক্ষা ব্যবস্থা; দুই, আমার চুক্তিভিত্তিক চাকুরীর নিয়োগ।

সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক শক্তির মূলে প্রধানত যে তিনটি সেক্টরের অবদান উল্লেখযোগ্য সেগুলো হলো – সার্ভিস (এয়ারপোর্ট, সি-পোর্ট), ইলেক্ট্রনিক্স (সেমিকন্ডাক্টর ফ্রেব্রিকেশন ইন্ডাস্ট্রি) এবং কেমিক্যাল (অয়েল রিফাইনারী)। তখন সিঙ্গাপুরের ‘চাংগি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ র‌্যাঙ্কিং-এ পৃথিবী সেরা আর আধুনিক সব বিমান নিয়ে সজ্জিত সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স বিশ্বের প্রথম সারির একটি এয়ারলাইন্স। সিঙ্গাপুরে বিশ্বমানের সি-পোর্টের পাশাপাশি রয়েছে বেশ কয়েকটি শিপইয়ার্ড, যার মধ্যে ‘জুরং’ এবং ‘সেমবাওয়াং’ শিপইয়ার্ডের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানীর জাহাজ এসে ভীড় করে এই দুই শিপইয়ার্ডে সার্ভিসিং-এর উদ্দেশ্যে। ১২০ বছর আগে সিঙ্গাপুরের ‘পুলাউ বুকম’ দ্বীপে বিখ্যাত ‘শেল’ কোম্পানীর প্রতিষ্ঠিত কেরোসিন ডিপো আজ পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম অয়েল রিফাইনারী-তে। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্রিয়েটিভ’ নামক সামান্য এক কম্পিউটার রিপেয়ারিং শপ ‘সাউন্ড কার্ড’ তৈরী করে পরিণত হয় বিশাল এক গ্লোবাল কোম্পানীতে। ‘ক্রিয়েটিভ’-এর এই অভাবনীয় সাফল্যে সিঙ্গাপুর সরকার সচেষ্ট হয় ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে, ফলে গড়ে উঠে সেমিকন্ডাক্টর ফ্রেব্রিকেশনের বিশাল বিশাল প্ল্যান্ট যা সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে রাখে বিশেষ অবদান।

অর্থনীতিকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যে এই তিনটি সেক্টরের বাইরে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠে ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানী ‘তেমাসেক হোল্ডিংস’। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্র্রদের কাতারে নিয়ে আসতে ‘তেমাসেক হোল্ডিংস’-এর অবদান অপরিসীম।

অর্থনৈতিক উন্নতির ধারাকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরকার হাতে নেয় ‘নলেজ ইকোনমি’ প্রকল্প যার চালিকা শক্তি হিসেবে নির্ধারিত হলো ‘লাইফ লং লার্নিং’। নলেজ ইকোনমি-র অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে ‘ইনোভেশন’ – তাই সরকার একটি ‘ইনোভেটিভ নেশন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বরাদ্দ করে বিশাল অংকের বাজেট। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে আয়োজন করা শুরু হলো ‘ইনোভেটিভ আইডিয়া’-র উপর সেমিনার আর ওয়ার্কশপ, যার বেশীর ভাগই পরিচালনা করতেন বিশ্বের নামকরা সব এক্সপার্টরা। এই সময় ‘ব্রেইন ডান্সিং’ খ্যাত দীলিপ মুখার্জী সহ অন্যান্য খ্যাতনামা লোকদের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশ গ্রহণের সুযোগ হয় আমার। তবে আমার দৃষ্টিতে ‘ইনোভেশন’ একটি ন্যাচরাল ‘ইনস্টিংক্ট’ যা কাউকে শিখানো যায় না, যেমন কবিতা লেখা। আর একটি জাতি তখনই ইনোভেটিভ হয়ে উঠে যখন তারা তাদের দৈনিন্দন জীবনে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয় এবং সেগুলোর সমাধান তাদেরকেই বের করতে হয়। যেহেতু সিঙ্গাপুর একটি ‘সমস্যাবিহীন’ দেশ, তাই জাতি হিসেবে সিঙ্গাপুরিয়ানদের ইনোভেটিভ হওয়ার সুযোগ অনেক কম। সরকার হয়ত এই সত্যটি অনুধাবন করে সচেষ্ট হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ উপাদানটি যোগ করার জন্যে। ঠিক এই সময়ে মিনিস্ট্রি অব এডুকেশন-এর অর্থায়নে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন-এর অধীনে গঠিত হলো একটি নতুন রিসার্চ উইং – ‘সেন্টার ফর রিসার্চ ইন পেডাগজী অ্যান্ড প্রাকটিস’ অথবা সংক্ষেপে সি. আর. পি. পি.। এই রিসার্চ উইং-এর অন্যতম লক্ষ্য হলো সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান মান বিশ্লেষণ করে তাতে কিভাবে ক্রিটিক্যাল থিংকিং উপাদান যোগ করা যায় তা খতিয়ে দেখা।

আমি তখন সিঙ্গাপুর পলিটেকনিকের ওয়েব বেইজড এডুকেশন প্রকল্পের সিস্টেম অ্যানালিস্টের পদ ছেড়ে দুই বছরের চুক্তিতে যোগ দিলাম সি. আর. পি. পি.-তে সিনিয়ার সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে। আমার কাজ হলো কমপিউটিশনাল লিঙ্গুইস্টিক টেকনোলজীর মাধ্যমে ক্লাশরুম টিচিং-এর মান বিশ্লেষণ করা। এই সময় আমি সি. আর. পি. পি.-এর ডীন প্রফেসর অ্যালেন লূক-এর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসি। সেকেন্ড জেনারেশন চাইনিজ-আমেরিকান প্রফেসর লূক-এর জন্ম ও বেড়ে উঠা লস এঞ্জেলিসের চায়না টাউনের পাশে ইকো পার্ক এলাকায়, পি. এইচ. ডি. করেছেন কানাডার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটি থেকে কিন্তু স্থায়ী হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এডুকেশনাল পলিসির একজন বিশ্বখ্যাত অথরিটি হিসেবে বিবেচিত প্রফেসর লূক সিঙ্গাপুর সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণে এই রিসার্চ সেন্টারের সর্বোচ্চ পদবী গ্রহণ করেন।

প্রফেসর লূক-এর বিশেষ আগ্রহে সি. আর. পি. পি.-তে তখন প্রায়ই বিশ্বের নামকরা এডুকেশনালিস্ট-রা এসে সেমিনার করতেন। সেই সব সেমিনারে নিয়মিত যোগ দিয়ে এডুকেশনাল পলিসি সম্পর্কে আমার তাত্বিক জ্ঞানের পরিধি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। এডুকেশন হচ্ছে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা কিনা সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণীকে তাদের দারিদ্রের বৃত্ত ভেঙ্গে বের হয়ে আসার সুযোগ করে দেয়। বৃত্ত ভাঙ্গার এই শক্তিশালী হাতিয়ারকে তাই প্রতিটি রাষ্ট্রই করতে চায় নিয়ন্ত্রণ, সেই জন্যে প্রবর্তন করে তার নিজস্ব এডুকেশনাল পলিসি। সিঙ্গাপুর সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়, ফলে সরকারের শিক্ষা নীতিতে মূলতঃ প্রাধান্য পায় কিভাবে দেশের নেতৃত্বের ধারা বজায় রাখার জন্যে পরবর্তী নেতা শ্রেণী এবং কিভাবে দেশের প্রতিটি কর্ম খাতের জন্য দক্ষ কর্মী শ্রেণী তৈরী করবে। ফলে সিঙ্গাপুরের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে চালু রয়েছে ‘স্ট্রিমিং’ – যা প্রাইমারী লেভেলেই নির্ধারণ করে দেয় একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না তাকে টেকনিক্যাল লাইনে পড়তে হবে। এই ‘আর্লি স্ট্রিমিং’ পদ্ধতির সমালোচনা করায় সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেন প্রফেসর লূক। তাই তাকে ফেরৎ যেতে হয় চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই।

প্রফেসর লূক-এর সাথে আমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাঝে তাকে আমি জানিয়েছিলাম আমার কানাডা অভিবাসনের কথা। তিনি আমাকে সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটিতে পি. এইচ. ডি. করার জন্য উৎসাহিত করে পরোক্ষভাবে আসলে উৎসাহিত করেছেন কানাডাতে পাড়ি জমাতে। হয়ত তিনি বুঝতে পারতেন যে সিঙ্গাপুরের প্রো-চাইনিজ শিক্ষা পদ্ধতি একজন নন-চাইনিজ নাগরিকের পূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার জন্যে একটি বড় অন্তরায়।

প্রফেসর লূক-এর এই হঠাৎ চলে যাওয়াতে সি. আর. পি. পি.-এর কার্যক্রমে আসে নানাবিধ পরিবর্তন। আমারও উৎসাহে ভাটা পড়ে, তাই চুক্তির মেয়াদ পূরণ হওয়ার আগেই পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে দেই হিউম্যান রিসোর্স বরাবর। তারপর একদিন তল্পিতল্পা বেঁধে পরিবারসহ রওনা হয়ে যাই টরেন্টো অভিমুখে।

ঠিকানা ধরে এক সময় মাইক্রোবাসটা এসে থামে আমার সহপাঠী বন্ধুটির বাসার সামনে। আমার বন্ধুর গাড়ি তখনও এসে পৌঁছায়নি। ভাড়া মিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি তাদের অপেক্ষায়। এভাবেই সূচনা হয় টরেন্টোতে আমার নতুন জীবন।

টরন্টোতে আমাদের নতুন জীবন শুরু হয় নিরাপদ আর সুবিধাজনক লোকালয়ে একটা বাসস্থানের সন্ধানের মাধ্যমে। ক্যাডেট কলেজের এক প্রাক্তন সহপাঠী এয়ারপোর্ট থেকে আমাদেরকে রিসিভ করে নিয়ে আসে তার উইটবির বাসাতে। আসার পরদিন থেকেই খোঁজ নেয়া শুরু করি এখানকার হোম রেন্টাল সিস্টেম সম্পর্কে। চটজলদি কোথায় এবং কিভাবে আমাদের জন্য মানানসই একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া পাওয়া যাবে সেটা মাথায় রেখেই নেমে পড়ি ‘বাড়ী ভাড়া’ অভিযানে।

প্রথমেই জানা গেলো জেন অ্যান্ড ফিঞ্চ নামক স্থানের কুখ্যাতি। সেখানে নাকি মানুষজন দিনে দুপুরেও যেতে ভয় পায়। আরও জানা গেলো যে কিছু কিছু এলাকাতে রয়েছে সরকারের অনুদানে চালিত অ্যাপার্টমেন্ট, সেখানকার অবস্থাও নাকি তথৈবচ। একেক এলাকার ডেমোগ্রাফীর চেহারা একেক রকম। বাংলাদেশ থেকে আসা ইমিগ্র্যান্টরা যেমন ড্যানফোর্থ নামক এলাকাতে জড়ো হয়েছেন বেশী, তেমনি মেইনল্যান্ড চায়না থেকে আগতেরা ভীড় জমিয়েছেন মারখামে, ইন্ডিয়ার শিখেরা ব্র্যামটনে, সোমালিয়ানরা ইটোবিকোকে, পাকিস্থানীরা মিসিসাগাতে, ফিলিপিনোরা কেনেডী-অ্যান্ড-এগলিংটনে আর রাশিয়ানরা হাই-পার্ক এলাকায়। পুরানো ইমিগ্র্যান্ট গ্রীক কিংবা ইটালিয়ান, তারাও তাদের নিজস্ব পকেট তৈরী করে নিয়েছে অনেক আগেই। অর্থাৎ একেক দেশ থেকে আগত অভিবাসীরা একেক এলাকাকে অনেকটা অলিখিতভাবে দখল করে নিয়েছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে এই দখলদারী ব্যপারটা যে খুব সহজেই হয়েছে, তাও কিন্তু নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্টদের জন্য গ্রীক অধ্যুষিত ড্যানফোর্থের একাংশ দখল করা ছিল বেশ ঝামেলাপূর্ণ এবং সংঘাতময়। কথা প্রসঙ্গে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আসা ড্যানফোর্থ এলাকার এক বাংলাদেশী দোকানীর কাছ থেকে জেনেছিলাম এই তথ্য।

টরন্টোতে প্রধানত হাউজ, কন্ডো এবং অ্যাপার্টমেন্ট এই তিন ধরণের বাসস্থান রয়েছে। নতুন ইমিগ্র্যান্টরা, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আগত নতুন ইমিগ্র্যান্টরা সাধারণত প্রথমেই অ্যাপার্টমেন্টের খোঁজ করেন। অনেককে অবশ্য হাউজের বেসমেন্ট ভাড়া নিতে দেখেছি। হাউজ, টাউন হাউজ কিংবা কন্ডোর কথা চিন্তা করেন না। এদেশে আসার পরপরই নিজস্ব কোন গাড়ী থাকে না বলে বাস ষ্ট্যান্ড কিংবা সাবওয়ের কাছাকাছি অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে নতুন ইমিগ্র্যান্টদের ভীড় লক্ষ্যণীয়। যেহেতু নিদেন পক্ষে এক বছরের চুক্তিতে বাসা ভাড়া নিতে হয়, তাই ভালো না লাগলে হুট করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার উপায় থাকে না। তাই হেঁটে যাওয়ার দূরত্বের ভেতর স্কুল আর গ্রোসারী শপের অবস্থান নিশ্চিত করেই তবে তারা পছন্দের অ্যাপার্টমেন্টটি বেছে নেন। তবে একথা ঠিক যে, বর্তমান সময়ে টরন্টোতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া পাওয়া মোটেই চাট্টিখানি কথা নয়। তবে ২০০৬ সালের অবস্থা ছিল অনেকটাই সহনীয় – সহজেই অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পাওয়া যেত এবং ভাড়াও ছিল সাধ্যের মধ্যেই।

টরন্টোর অ্যাপার্টমেন্টগুলি সাধারণত পরিচালিত হয় বিভিন্ন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর মাধ্যমে। বেশ কিছু বড় বড় প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী রয়েছে এখানে। একেকটা কোম্পানীর অধীনে থাকে বেশ কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর জন্য থাকে একজন সুপারিনডেন্ট যাকে সহজ করে ‘সুপার’ ডাকা হয়। সুপারকে সাহায্য করার জন্য আরো কিছু লোক থাকে যাদের কাজ ‘মেইনটেনেন্স’। আপনার রান্না ঘরের সিঙ্ক কাজ করছে না অথবা ফ্রিজ নষ্ট হয়ে গেছে, সুপারের কাছে রিপোর্ট করলে মেইনটেনেন্সের লোক এসে ঠিক করে দিয়ে যাবে, আপনাকে আলাদা কোন পয়সা দিতে হবে না। কোন কোন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী এইসব মেইন্টেনেন্সের কাজ করে দেয় খুব ঝটপট, কোন কোন কোম্পানী আবার ঢিলেঢালা। সেটাও মাথায় রাখতে হয় পছন্দের অ্যাপার্টমেন্টটি বেছে নেয়ার সময়। তারপর আছে নিরাপত্তার ব্যাপার। দিন দুপুরে ঘরে ঢুকে ডাকাতি হওয়ারও নজীর আছে অনেক এলাকাতে। তাই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ভেতর সিকিউরিটি ক্যামেরার সুবিধা আছে কিনা সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বাসা খোঁজার ব্যাপারে প্রথম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন সিঙ্গাপুর থেকে আসা আমাদের পূর্ব পরিচিত শফিক ফ্যামিলি। উনারা আমাদেরকে নর্থ ইয়র্ক এলাকাতে কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট দেখাতে নিয়ে যান। কোনটাই আমাদের মনপূতঃ হচ্ছিল না। মনপূতঃ না হওয়ার প্রথম কারণ ছিল আশাভঙ্গ। অ্যাপার্টমেন্টগুলির বেশীর ভাগই হলো কয়েক দশকের পুরানো, সেই অনুপাতে সংস্কার তেমন হয়েছে বলে মনে হয়নি। কম বেশী সব অ্যাপার্টমেন্টগুলিতে আবার তেলাপোকার রাজত্ব। কোন কোন এলাকার অ্যাপার্টমেন্টগুলির ব্যালকনি আবার পায়রাদের দখলে – সেখানে তাদেরকে বাচ্চা ফুটাতেও দেখেছি। লিফটের (এলিভেটর) অপ্রতুলতার কারণে অনেক অ্যাপার্টমেন্টে আবার লম্বা লাইন পড়ে যায়, বিশেষ করে সকাল বেলার রাশ আওয়ার-এর সময়। ফলে মনের মতন একটা অ্যাপার্টমেন্ট পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো।

(চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ, টরন্টো।