টরেটক্কা টরন্টো-সমকালীন বিশ্ব

এপ্রিল ৯, ২০২০

কাজী সাব্বির আহমেদ

আমরা যে বছর টরন্টোতে আসি, সে বছর ছিল ‘নাইন-ইলেভেন’ ঘটনার পাঁচ বৎসর পূর্তির বছর। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের এগারো তারিখে যখন এই নজীরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটে আমরা তখন সিঙ্গাপুরে। টুইন টাওয়ারে যখন প্রথম বিমানটি আঘাত হানে সিঙ্গাপুরে তখন প্রায় মধ্যরাত। ঘুমের আয়োজন করছি, এমন সময় আমার এক সিনিয়র বন্ধু ফোন করে আমাকে টিভি খুলতে বললেন। ভেঙ্গে কিছুই বললেন না, শুধু বললেন ‘দেখ তোমাদের মুসলমানদের কান্ড’। ব্যক্তিগতভাবে তিনি তার নিজ ধর্ম ইসলামের প্রতি খুব একটা অনুরক্ত ছিলেন না, কিন্তু নির্বিচারে তিনি জঙ্গি মুসলমানদের কাতারে আমাকে কেন ফেললেন, সেই মুহূর্তে তার সাথে আর সেই বিতর্কে যাইনি। টিভি খুলে মনে হচ্ছিল আমি যা দেখছি কিংবা শুনছি তা যেন বাস্তবের কোন ঘটনা নয়, সুরিয়েলিষ্টিক কোন কিছু। আমার দূরতম কল্পনাকেও হার মানিয়ে দ্বিতীয় বিমানটি টুইন টাওয়ারের অপর টাওয়ারটিকে আঘাত করল যা আমি টিভিতে সরাসরি দেখতে পেলাম। যদিও আমেরিকান মিডিয়াতে কিংবা সরকারী ভাষ্যমতে তখনও কোন মিলিট্যান্ট ইসলামিক  গ্রুপকে এই হামলার জন্য দায়ী করা হচ্ছিল না, তবে আমরা সবাই বুঝতে পারছিলাম যে এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। আর একই সাথে এটাও বুঝতে পারছিলাম যে পৃথিবী আর আগের মতন থকবে না। আর সেটা টের পেলাম পরদিন আমার কর্মস্থলে যাওয়ার পরপরই। দীর্ঘদিনের পরিচিত সহকর্মীদের চেহারা কেমন যেন অপরিচিত লাগল, তাদের সবার চোখেমুখে সেই একই অভিব্যক্তি – ‘দেখ তোমাদের মুসলমানদের কান্ড’। তবে আমি একা নই, সারা বিশ্বে আমার মতন সব সাধারণ মুসলিমকেই এই তীর্যক চাহনিকে সইতে হয়েছে। হিজাবী কিংবা নিকাবী মহিলাদের ক্ষেত্রে অবস্থা ছিল আরো ভয়ানক, পথেঘাটে তাদেরকে অমানবিক হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বে। যেন তাদের ‘নিকাব’-ই ঘটিয়েছে এই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ।

‘ইসলামোফোবিয়া’ আর ‘হেইটরেড’ নামক শব্দদু’টির লক্ষ্যনীয় আধিক্য দেখা দিল তখনকার সংবাদ মিডিয়াতে। অথচ সপ্তাহ খানেক আগেও অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সময় সাউথ আফ্রিকার ডারবান শহরে অনুষ্ঠিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স এগেইস্ট রেসিজম’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স যাকে সংক্ষেপে ‘ডারবান-১’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই কনফারেন্সে-এর একটি প্রতিবেদনে জায়ানবাদকে বর্ণবাদের সমার্থক বলে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ইসরাইল এবং আমেরিকা এবং পরবর্তীতে কনফারেন্সে আগত ডেলিগেটদের ভোটে এই প্রতিবেদনটি কনফারেন্সের প্রসিডিংস থেকে বাদ পড়লেও খবরের কাগজের শিরোনাম হয়ে জায়গা করে নেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয় কারণ বর্ণবাদ বিরোধী এই জাতীয় কনফারেন্স ছিল সারা দুনিয়ার জন্য অভূতপূর্ব। তবে কনফারেন্স পরবর্তী অনেক পদক্ষেপই চাপা পড়ে যায় কনফারেন্স শেষ হওয়ার ঠিক তিন দিন পর ঘটে যাওয়া নাইন-ইলেভেনের তান্ডবলীলায়। পরবর্তী কালে বর্ণবাদ বিরোধী এই কনফারেন্স আর কখনই সফলতার মুখ দেখেনি। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলি এই কনফারেন্স থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়। ২০০৯ সালে জেনেভায় এবং ২০১১ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘ডারবান-২’ এবং ‘ডারবান-৩’-কে বয়কট করে যথাক্রমে দশটি এবং চৌদ্দটি পশ্চিমা দেশ।

তবে পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই আমেরিকানদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে নাইন-ইলেভেনের বিপর্যয়ের সময়। দূর্ঘটনার পরদিন ফ্রান্সের বিখ্যাত সংবাদ পত্র ‘লে মন্ডে’-এর হেডলাইন ছিল ‘উই আর অল আমেরিকানস’। আমেরিকার সাধারণ জনগণ এই সময়ে ধৈর্যের পরিচয় দিলেও কিছু রেডনেক সহিংস প্রতিশোধের সূচনা করে। তবে দূর্ভাগ্যক্রমে সেই প্রতিশোধের প্রথম শিকার আরিজোনার গ্যাস স্টেশনে কর্মরত বলবীর সিং নামের একজন নিরীহ শিখ। বেচারার দাঁড়ি টুপির কারণে তাকে মুসলিম ভেবেছিল দুর্বৃত্তরা। সেই প্রতিশোধের ধারাবাহিকতায় টেক্সাসের দিনমজুর মার্ক ষ্ট্রংম্যান গুলি করে বাংলাদেশ থেকে আগত রইস ভুঁইয়ার মুখে। ঘটনার সময় রইস একটা কনভিনিয়েন্স ষ্টোরে ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করছিল যেখানে মার্ক এসেছিল ক্যাশ লুট করতে। রইস ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলে তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি। আর ওদিকে আরও কয়েকজন নিরীহ অভিবাসীকে খুনের পর মার্ক ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। জেলে বসে সে অবশ্য নিজেকে একজন সত্যিকারের খাঁটি দেশপ্রেমিক আমেরিকান বলে দাবী করে। একসময় বিচারের রায়ে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। তখন রইস তার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিলের জন্য ফেডারেল কোর্টে আপীল করে। কিন্তু সেই আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয় এক সময়। দশ বছর পর ২০১১ সালের জুলাই মাসের ২০ তারিখে মার্কের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কয়েক ঘণ্টা আগে মার্কের সাথে রইসের কথা হয় টেলিফোনে। রইস মার্ককে জানায় যে সে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে এবং মার্কের প্রতি তার কোন ঘৃণা নেই। প্রত্যুত্তরে মার্ক বলে, আমার অন্তর থেকে তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি আমার হৃদয় স্পর্শ করেছ তোমার মহানুভবতা দিয়ে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে মার্ক উল্লেখ করে যে ইসলামের গভীর মূল্যবোধ থেকেই রইস তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে তার ক্ষমার অযোগ্য কর্মকে।

রইস ভূঁইয়ার এই মানবিক প্রচারণা মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও সাধারণ আমেরিকানরা পলিটিশিয়ানদের রেটোরিকের ফাঁদ থেকে সহজে বেরুতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশের ‘হয় তুমি আমাদের সাথে, নয় টেরোরিষ্টদের একজন’ নীতি তখন দুনিয়াকে দুইভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিল এবং সেই সাথে সাধারণ মানুষকেও। এই সময় বিপুল জনপ্রিয়তা পায় স্যামুয়েল হান্টিংটনের রচিত ‘দি ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ নামক থিসিসটি যেখানে বলা হয়েছে যে ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে দেশের বিরুদ্ধে দেশের নয় বরং সভ্যতার বিরুদ্ধে সভ্যতার। সেই ধারণার সাথে মিল রেখে আমেরিকা তার ‘ওয়ার অন টেরর’ নামক যুদ্ধ ঘোষণা করে বিশেষ কোন দেশের বিরুদ্ধে নয় বরং ‘মিলিট্যান্ট ইসলামিষ্ট’  কিংবা ‘জঙ্গি ইসলামবাদী’দের বিরুদ্ধে যারা নাকি আস্তানা গেড়ে বসে আছে আফগানিস্তানের ‘তোরা বোরা’ নামক পাহাড়ের গুহায়। সেই সময় ওসামা বিন লাদেন নামক এক ধনকুবের আরব ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে ‘এনিমি নাম্বার ওয়ান’ হিসেবে। সে নাকি আমেরিকার সিআইএ-এর একজন ‘রানএওয়ে’ এজেন্ট যাকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল আফগানিস্তানের মুজাহিদদেরকে নিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। এই মুজাহিদরা ছিল তখন পক্ষের শক্তি, যাদেরকে নিয়ে হলিউড মুভিষ্টার সিলভেষ্টার ষ্ট্যালোন তার ‘র‌্যাম্বো’ সিরিজের তিন নম্বর ছবিটি তৈরী করেন। কিন্তু ইরাকের কুয়েত দখলের পর আমেরিকা যখন ১৯৯১ সালে সৌদী সরকারের সহায়তায় ইরাক আক্রমন করে তখন থেকে আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ওসামা বিন লাদেন। তাকে বেছে নিতে হয় এক পলায়নপর জীবন। তখন থেকেই নাকি সে আস্তানা গেড়েছে তোরা বোরা পাহাড়ের গুহায়। তার পরিবারের অনেকেই অবশ্য থেকে গিয়েছিল আমেরিকায়। নাইন-ইলেভেনের পরপরই তাদেরকে নাকি গোপনে আমেরিকা ত্যাগের ব্যবস্থা করে দেয় খোদ আমেরিকার সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এই নিয়ে ‘ক্রেগ উনজার’ নিউইয়র্ক টাইমসে ‘দি গ্রেট এসকেপ’ শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেন ২০০৪ সালের পহেলা জুনে। এই সময় ওসামার পৃষ্ঠপোষক মোল্লা ওমরের চেহারা উঠে আসে মিডিয়াতে। তালিবান এই নেতা উপযুক্ত প্রমাণের সাপেক্ষে ওসামাকে তৃতীয় কোন দেশের হাতে সমার্পন করতে রাজী হলেও আমেরিকা তাতে রাজী হয় না। ‘ডেইজী কাটার’ নামক বিশেষ এক ধরণের বোমা দিয়ে আক্রমণ করে তারা তোরা বোরা পাহাড়। আমেরিকার এই বিমান আক্রমণের জন্য সব ধরণের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় পাকিস্থানের সামরিক সরকারের প্রধান পারভেজ মুশাররফ। নেওয়াজ শরীফকে ক্যু-এর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে তিনি তখন মাত্র ক্ষমতার মসনদে বসেছেন। এই সময় মার্কিন সেনাবাহিনীকে আফগানিস্থান আক্রমণের সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পারভেজ মুশাররফ প্রকারান্তে নিজের গদীকে পাকাপোক্ত করে তুলেন। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ইন দি লাইন অব ফায়ার’-এ উল্লেখ করেন যে মার্কিন সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারী অব ষ্টেট পাকিস্থানের গোয়েন্দা প্রধানকে টেলিফোনে হুমকি দেয় যে

মার্কিন সেনাবাহিনীকে সহায়তা না করলে পাকিস্থানকে বোমা মেরে ‘ষ্টোন এইজ’ বা প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ফলে ইসলামাবাদকে অনেকটা বাধ্য হয়েই ওয়াশিংটনের দেয়া শর্ত মেনে নিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে সম্মত হতে হয়। আর এরই মাধ্যমে আমেরিকা সূচনা করে তালিবানদের বিরুদ্ধে তার দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ। বুশ অবশ্য নিশ্চিত করেন যে এই যুদ্ধ কোনভাবেই ইসলাম কিংবা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়, বরং র‌্যাডিকেল মুসলিম এবং তাদের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। তবে তিনি এই যুদ্ধকে ‘ক্রুসেড’-এর সাথে তুলনা করে এবং নিজেকে ‘বর্ন এগেইন খ্রীষ্টান’ দাবী করে সমালোচনার জন্ম দেন, সেই সাথে এভেনজেলিক্যাল খ্রীষ্টান গ্রুপকে খবরের শিরোনামে নিয়ে আসেন।

যুদ্ধের এই ডামাডোলের মাঝে ইসলামের মূল্যবোধ এই সভ্যতার জন্য কতখানি উপযোগী সেই নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয় একাডেমিকদের মাঝে। পত্রিকার সম্পাদকীয়তে, নিউজ চ্যানেলের নিউজে, টিভির টক-শোতে সর্বত্রই একটাই টপিক, মিলিট্যান্ট ইসলাম। যার ফলে ইসলাম ধর্মের স্বরূপ কী তা জানার বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। বইয়ের দোকানগুলিতে বেড়ে যায় ইসলাম বিষয়ক বইয়ের কাটতি। ইন্টারনেটের মাধ্যমেও অনেকেই জানার চেষ্টা করে ইসলামকে। তবে খুব কম মানুষই খোলা মন নিয়ে ইসলামকে বুঝতে চেষ্টা করে, তদের লক্ষ্যই থাকে ইসলাম যে জঙ্গিবাদ প্রচার করে সেটা প্রমাণ করা। তারপরও অনেকেই খুঁজে পায় ইসলামের মূল মন্ত্র যেখানে বলা হয়েছে যে একজন নিরাপরাধী মানুষকে হত্যা গোটা মানবজাতিকে হত্যার সামিল। জঙ্গি ইসলাম যে অল্প কিছু উগ্রপন্থী মুসলমানদের ‘হাইজ্যাক’ করা ইসলাম সেটা খোদ প্রেসিডেন্ট বুশ তার ভাষণে উল্লেখ করেন। কিন্তু তাতে মুসলমানদের প্রতি সাধারণ আমেরিকান কিংবা পশ্চিমাদের মনোভাবের কোন রকমভেদ হয় নি। ‘সব মুসলমানই টেরোরিষ্ট নয়, কিন্তু সব টেরোরিষ্টই মুসলমান’ এই রেটোরিক ব্যাপকভাবে প্রচার হতে থাকে। সারা দুনিয়াতে মুসলমানরা তখন এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি। তাকে আগ বাড়িয়ে প্রমাণ করতে হয় যে সে জঙ্গি মুসলিম নয়, বরং ‘মডারেট’ মুসলিম। মজার ব্যাপার হলো, পশ্চিমারা এই সময় ‘মডারেট মুসলিম’ নামে নতুন এক ধারার মুসলিমের ধারণা তৈরি করে যারা কিনা পশ্চিমের সভ্যতার মাপকাঠিতে গ্রহণযোগ্য। অমুসলিমদের পাশাপাশি অনেক নন-প্র্যাক্টিসিং কিংবা সন্দিহান মুসলমানরাও এই সময় ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে। হংকং-এ বসবাসরত আমার এক সিনিয়র বন্ধু ইসলামকে নতুন করে আবিস্কার করেন এই সময়। তিনি তাঁর মোটা বেতনের চাকরি এবং পশ্চিমা ধারার জীবন-যাপন ছেড়ে ফিলিপিনো স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি তাঁর পৈত্রিক নিবাস টাঙ্গাইলে একটি মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেটার সার্বিক দেখাশুনাতে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

প্রেসিডেন্ট বুশ তার ‘ষ্টেট অব দি ইউনিয়ন’ বক্তৃতায় উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং ইরাক এই তিন দেশকে একত্রে ‘এক্সিস অব ইভল’ বা ‘শয়তানের চক্র’ নামে অভিহিত করেন, যা ছিল ইরাক আক্রমনের প্রাথমিক ইঙ্গিত। এর পরপরই ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে ‘উইপন অব মাস ডেষ্ট্রাকশন’ সংক্ষেপে ‘ডাব্লিও এম ডি’-এর অবৈধ মওজুদের। মাত্র কিছুদিন আগে আমেরিকা তালিবান কিংবা আফগানিস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। একই সাথে দুইটি যুদ্ধ চালানোটা যে ইকোনোমিক্যালি এবং লজিষ্টিক্যালি বাস্তবসম্মত নয় সেটা অনুধাবন করে তাই সে এবার ইরাকের যুদ্ধটা জাতিসংঘের মাধ্যমে করার চেষ্টা নেয়। জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের মীটিং-এ আমেরিকার ‘সেক্রেটারী অব ষ্টেইট’ কলিন পাওয়েল কম্পিউটারের মাধ্যমে কৃত্তিমভাবে তৈরী ‘মোবাইল বায়োলজিক্যাল উইপন ল্যাব’-এর ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চান যে সাদ্দামের কাছে ‘উইপন অব মাস ডেষ্ট্রাকশন’-এর বিশাল ভান্ডার রয়েছে। পরবর্তীতে ইরাক যুদ্ধ শেষে যখন এই ভান্ডারের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি, তখন বলা হলো যে তাদের সোর্স রফিদ আহমেদ, জার্মান অভিবাসী এক ইরাকী যাকে ‘কার্ভবল’ কোডনেমে ডাকা হত, তাদেরকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এই ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার একজন উল্লেখযোগ্য পার্টনারের ভূমিকা পালন করেন এই সময়ে। সাদ্দাম হোসেনের কাছে যে অস্ত্র মজুদ আছে তা দিয়ে ইরাক পয়তাল্লিশ মিনিটের ভিতর ব্রিটেনকে আক্রমণ করতে সক্ষম, এই ‘জুজুবুড়ি’র ভয় দেখিয়ে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইরাক যুদ্ধের বিল পাশ করিয়ে নেন। পরবর্তীতে ‘ঘোষ্ট রাইটার’ নামক একটি হলিউড মুভিতে তাকে ‘সিআইএ’-এর এজেন্ট হিসেবে দেখানো হয়। যদিও মুভিকে কখনই বাস্তব সত্যের প্রমাণ হিসেবে ধরা হয় না, তারপরও এই মুভিটি অনেকের মনেই টনি বেøয়ার  যে ‘সিআইএ’-এর এজেন্ট সেই সন্দেহটি ঢুকিয়ে দেয়। আমেরিকাকে অবশ্য পরে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট ছাড়াই ইরাকের যুদ্ধ শুরু করতে হয়। সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিল শুধু ব্রিটেন, অষ্ট্রেলিয়া আর পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীকে। যদিও আফগানিস্থানের কান্দাহার শহরে কানাডা তার সৈন্য মোতায়েন করেছে আমেরিকার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি, তারপরও তখনকার কানাডার লিবারেল পার্টির প্রধানমন্ত্রী জঁ ক্রাইটিয়ান ইরাকের যুদ্ধে কানাডিয়ান সৈন্য পাঠাতে সম্মত হননি। কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে ইরাক যুদ্ধের জন্য জাতিসংঘের অনুমোদন একটি জরুরী উপাদান। ভাগ্যের পরিহাসে কানাডার সৈন্যদেরকে অবশ্য ইরাকের যুদ্ধে পরোক্ষভাবে অংশ নিতে হয় ‘নর্থ আমেরিকান এরোস্পেস ডিফেন্স কমান্ড’-এর সাথে চুক্তির কারণে।

দ্রুততম সময়ে ইরাক যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামলেও আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে আরেকটি অন্তহীন যুদ্ধে। সময়ের সাথে সাথে বেড়িয়ে আসতে থাকে ‘আবু গরীব’ কারাগারের ভয়ঙ্কর সব অমানবিক নির্যাতনের ছবিসহ সংবাদ যা পুরো পৃথিবীর মানুষকে থমকে দেয়। সেই সাথে জানা যায় প্রাইভেট আর্মি ‘ব্ল্যাক ওয়াটার’-এর কীর্তিকলাপ আর বিভিন্ন দেশে থাকা সিআইএ-এর গোপন টর্চার সেলের খবর। সেই রকম এক টর্চার সেলে দীর্ঘদিন বন্দী থাকেন সিরিয়ার বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক মাহের আরার। চালু হয় ‘গুয়ান্তানামো বে’-র কারাগার যেখানে বন্দী করে রাখা হয় সারা পৃথিবী থেকে সন্ত্রাসী সন্দেহে আটককৃত মুসলমানদের। সেই কারাগারে আটক হয় আরেক কানাডিয়ান নাগরিক ওমর ক্বাদর। পরবর্তীতে মাহের আরার এবং ওমর ক্বাদর এই দুইজন কানাডিয়ান রাজনীতির এক উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ান।

(চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ, টরন্টো।