টরেটক্কা টরন্টো-সমকালীন বিশ্ব

মে ১৮, ২০২০

কাজী সাব্বির আহমেদ

নাইন-ইলেভেনের নারকীয় ঘটনার পর পুরো পৃথিবীতে এক টালমাতাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গী আক্রমণের আতংক। সেই আতংকের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলে লাগাতার আরো বেশ কয়েকটি আক্রমণ। প্রথম যে আক্রমণটি প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ঝড় তুলে সেটি ছিলো জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক রিচার্ড রেইডের একটি ব্যর্থ আক্রমণ। প্যারিস থেকে মিয়ামীগামী আমেরিকান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে রিচার্ড তার নিজের জুতার ভিতর লুকানো একটি বোমাকে ডিটোনেট করার চেষ্টা চালানোর সময় সহযাত্রীদের হাতে সে ধরা পড়ে। সে কোর্টে নিজেকে আল-কাইদার একজন সদস্য বলে স্বীকার করে। তবে তার অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে চুরির দায়ে ব্রিটিশ পুলিশের খাতায় তার নাম ছিল। একজন ভিন্নধর্মী ছিঁচকে চোর ইসলামের কোন মহিমা দেখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা মাত্রই ইসলামের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে উদ্যত হবে, এখানে নিশ্চয়ই মনস্তাত্তি¡কবিদদের জন্য ভাববার উপাদান রয়েছে। তবে এই ঘটনা চাপা পড়ে যায় যখন ২০০২ সালের ১২ই অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার বালি শহরের একটি নাইট ক্লাবে বোমা বিস্ফোরণে দুইশত এরও বেশী লোক নিহত হয়। নিহতদের ভেতর অষ্ট্রেলিয়ার নাগরিক ছিল অষ্টাশি জন। এই আক্রমণের দায় স্বীকার করে নেয় ‘জেমা ইসলামিয়া’ নামক স্বল্প পরিচিত এক আঞ্চলিক মুসলিম টেরোরিষ্ট দল। আমেরিকার ‘ওয়ার অন টেরর’ আর ‘ইষ্ট তিমুর’ বিদ্রোহে অষ্ট্রেলিয়ার ইন্ধন, এই দুইয়ের প্রতিশোধ নিতেই নাকি তাদের এই বোমা হামলা। তথাকথিত মুসলিম টেরোরিষ্টরা যখন তাদের কোন নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয় তখন সাধারণ মুসলমানদের কাছে সেটা কখনই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে না। কারণ পবিত্র কোরানের সুরা মাইয়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে যে কেউ যদি নিরপরাধ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। আর ইসলামের দৃষ্টিতে বিনা কারণে নিরপরাধ মানুষ হত্যা একটি অমার্জনীয় অপরাধ যা কিনা ‘করিরা গুনাহ’-এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের এই দৃষ্টিভঙ্গি মিডিয়ার আলোচনায় তেমন স্থান করে নিতে পারে না বরং উল্টো তারা কতটা জোর গলায় নিন্দা করছে তা প্রতিটি টেরোরিষ্ট ঘটনার পরপরই যাচাই করাটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে উঠে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিমদের এই নিন্দা জানানোর কোন মাত্রা কিংবা ভাষাই যেন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে না নন-মুসলিমদের কাছে। মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের প্রত্যাশা যেন আরো বেশী। কিন্তু সেই আরো বেশী টা যে কী তা কখনই পরিস্কার করে বলা হয় না। বরং ‘মডারেট মুসলিম’-এর সংজ্ঞাটাই তখন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এমনভাবে আলোচনায় আনা হয় যেন এটাই মুসলমানদের দায়মুক্তির একমাত্র উপায়। একজন নন-মুসলিম সহপাঠীর কাছ থেকে এরকম এক ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী হেরা হাশমি মুসলমানেরা যে বিভিন্ন টেরোরিষ্ট আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে তার একটা তালিকা সংগ্রহ করার কাজে লেগে যান। পরবর্তীতে ‘গুগল ডক’ নামক এক সফটওয়্যারে ৭১২ পাতার একটি তালিকা তৈরী করে টুইট করেন। মুসলিমরা যেন এই তালিকারই অপেক্ষায় ছিল, তাই সেই টুইটটি চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর পনের হাজার বার রি-টুইট হয়। ২০১৭ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে গার্ডিয়ান পত্রিকা এই খবরটি গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে।

নাইন-ইলেভেনের পর পশ্চিমা দেশগুলির অনুকরণে চাইনিজ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিঙ্গাপুর সরকারও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে। সরকারী প্রচার মাধ্যমগুলিতে প্রচার হতে থাকে অ্যান্টি-টেরোরিজম এবং কাউন্টার-টেরোরিজমের উপর বিশদ আলোচনা। সিঙ্গাপুর যেহেতু একটি ‘মাল্টি রেসিয়াল’ এবং ‘মাল্টি কালচারাল’ দেশ, তাই সরকার তার ‘রেসিয়াল হারমনি’ নীতির উপর জোর দিয়ে প্রচার করতে থাকে যে কোন অবস্থাতেই নাইন ইলেভেনের ঘটনা যেন এদেশের রেসিয়াল হারমনিকে ব্যাহত কিংবা নষ্ট করতে না পারে। এই ‘রেসিয়াল হারমনি’-কে সুসংঘত রাখতে গণমাধ্যমে অনেকেই মত প্রকাশ করেন যে স্কুল ড্রেস থেকে ‘টুডোং’ (হেড স্কার্ফ বা হিজাব) তুলে দেয়া হোক। কারণ এই টুডোং বা হিজাব কেবলমাত্র সংখ্যালঘু মালেয় এবং অল্পকিছু তামিল মুসলিম ছাত্রীরা পরিধান করে থাকে যা সংখ্যাগরিষ্ঠ চাইনিজদের থেকে তাদেরকে আলাদা করে রাখে। কিন্তু হুট করে এই ধরণের একটা সিদ্ধান্ত নেয়াটা ছিলো সিঙ্গাপুরের সংবিধান বিরোধী কারণ সেখানে উল্লেখ আছে যে মালেয় ট্র্যাডিশনকে পরিবর্তন করা যাবে না। হয়ত সংবিধানে কোন পরিবর্তন আনার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী গো-চক-থং মিশরের কায়রোস্থ আল-আজহার ইউনিভার্সিটির গ্র্যান্ড ইমাম শেখ মুহাম্মদ সাইয়িদ তানতাউয়ি-এর সাথে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাছ থেকে এই মর্মে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে আসেন যে সিঙ্গাপুরের অধিকার আছে তার দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করার। তবে এই টুডোং বিরোধী আলোচনা স্বভাবতই সংখ্যালঘু মালেয়দেরকে কোণঠাসা করে ফেলে। এই সময়ে সরকারের মুসলিম বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মালেয় বংশোদ্ভূত ডঃ ইয়াকুব ইব্রাহিম সরকারের পক্ষেই অবস্থান নেন এবং পশ্চিমা নীতির আদলে ‘মডারেট মুসলিম’-এর সিঙ্গাপুরিয়ান ভার্সন ‘মালেয় বারু’ কিংবা ‘নতুন মালেয়’-এর ব্যাখ্যা নিয়ে মেতে রইলেন। তবে মালেয়দের এই ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসেন রেডিও সাংবাদিক জুলফিকার মুহাম্মদ শরীফ যিনি কিনা সেই সময় ‘ফাতিহা’ নামে একটা ইয়াহু group চালাতেন। তিনি তার group এ  সরকারের সমালোচনা করা শুরু করেন এবং অচিরেই তার ফল স্বরূপ ইন্টারনাল সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট (আইএসডি)-এর হয়রানির শিকার হন। এক সময় পুলিশ তার বিরুদ্ধে বিনা অনুমতিতে থানায় প্রবেশের কারণে মামলা ঠুকে দেয় এবং সেই মামলাতে তার জেল হয়। সেই জেল-টার্ম এড়াতে তিনি সিঙ্গাপুর ছেড়ে অষ্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

দেশবাসীকে আঞ্চলিক জঙ্গী সংঘঠনগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার জন্য কিংবা দাবার পরবর্তী চালের অংশ হিসেবে সিঙ্গাপুর সরকার এই সময়ে মঞ্চে নিয়ে আসে শ্রীলংকান বংশোদ্ভূত প্রফেসর রোহান গুনারত্নকে। সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির এই প্রফেসর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন আল-কাইদার মিশন এবং ভিশন নিয়ে আর সতর্ক করে দেন বিভিন্ন আঞ্চলিক জঙ্গী সংঘঠনগুলির তৎপরতা সম্পর্কে। তবে এই সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে তার আলোচনায় তামিল টাইগারদের উল্লেখ ছিলো না। আল-কায়েদা সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞানের কারণেই হয়ত মার্কিন সরকার তাকে এক সময় আল-কায়েদার অবকাঠামো সম্পর্কে ‘৯-১১ কমিশন’-কে অবহিত করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তবে ২০১১ সালে তিনি ‘কানাডিয়ান তামিল কংগ্রেস’-কে তামিল টাইগারদের সংঘটন বলে দাবী করলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ওন্টারিও সুপিয়র কোর্টে। সেই মামলায় প্রফেসর রোহান গুনারন্তের এই দাবী ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং সেই সাপেক্ষে তাকে ‘কানাডিয়ান তামিল কংগ্রেস’-কে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। একবার ইউএন-এর ‘টেরোরিজম প্রিভেনশন ব্রাঞ্চ’-এর ‘প্রিন্সিপাল ইনভেষ্টিগেটর’ বলে ভুয়া দাবী করে নিজেকে ‘খেলো’ এবং ‘বিতর্কিত’ করে তুলেন রোহান গুনারত্ন। যাই হোক, সিঙ্গাপুর সরকার নাইন-ইলেভেনের সময়কালে তাকে একজন অ্যান্টি-টেরোরিজম এক্সপার্ট হিসেবে তার বক্তব্যকে গুরুত্বের সাথে গণমাধ্যমে প্রচার করে। হয়ত সরকার তাকে তাদের নিজস্ব ‘মাউথপিস’ হিসেবে ব্যবহার করে এবং তার মাধ্যমে ‘আবু সাইয়াফ গ্রæপ’, ‘জেমা ইসলামিয়া’ নামক জঙ্গী সংঘঠনগুলির সাথে দেশবাসীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফিলিপাইন ভিত্তিক ‘আবু সাইয়াফ group’ নাইন-ইলেভেনের কিছু আগে পালাওয়ান দ্বীপের এক রিসোর্ট থেকে তিন জন আমেরিকান সহ মোট বিশ জনকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। নাইন-ইলেভেনের সময় পুরো পৃথিবীর মনোযোগ যখন শুধু ‘আল-কায়েদা’র উপর, তখন তারা এই তিন আমেরিকান নাগরিকের জন্য এক মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবী করে আল-কায়েদার পাশাপাশি নিজেদেরকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করে তুলে। কিন্তু ‘জেমা ইসলামিয়া’ groupকে তখনও কেউ চিনত না। এই সময় তেরো জন মালেয় সদস্যকে গ্রেফতার করে সিঙ্গাপুর সরকার ‘জেমা ইসলামিয়া’ groupকে আলোচনায় নিয়ে আসে। তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন দূতাবাসে হামলার চক্রান্তের অভিযোগ আনা হয়। অনেক বিশ্লেষকের মতে এই গ্রেফতার নাটক ছিলো মালেয় মুসলিম নাগরিকদের মার্জিনালাইজ করার সিষ্টেমেটিক কৌশলের একটি অংশ মাত্র। এই গ্রেফতারের কয়েকমাস পরে বালিতে বোমা ফাটিয়ে সত্যিকারের ‘জেমা ইসলামিয়া’-র আত্মপ্রকাশ ঘটে বিশ্বমঞ্চে। সেই সাথে সিঙ্গাপুরিয়ানরাও আতংকিত হয়ে উঠে এই বুঝি জঙ্গীরা আক্রমণ করে বসে। আর সেই আতংককে জিইয়ে রাখতে সরকার আয়োজন করে অনেকটা ফায়ার ড্রিলের আদলে নিয়মিত কাউন্টার টেরোরিজমের ড্রিল।

নাইন-ইলেভেনের পরপরই আমেরিকাতে ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’ আইন পাশ হয় যা মূলত মুসলমানদের জন্য ছিল একটা বিভীষিকা। অনেক মুসলিম অভিবাসী বিশেষ করে যাদের আমেরিকাতে থাকার বৈধ কাগজের ঝামেলা ছিল তারা তখন আমেরিকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন এবং তাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই ছিল প্রতিবেশী কানাডা। কারণ তখনকার কানাডার লিবারেল পার্টির প্রধানমন্ত্রী জঁ ক্রাইটিয়ান আমেরিকার ‘হকিশ’ বা যুদ্ধবাজ পররাষ্ট্রনীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলেন নি। এতে যদিও কানাডার সাথে আমেরিকার মধ্যকার বানিজ্যিক সম্পর্কে বেশ টানাপোড়নের সৃষ্টি হয়। সেই একই ভাবে সিঙ্গাপুরিয়ান মালেয়রা আগ্রহী হয়ে উঠে পাশের দেশ মালেয়শিয়াতে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে। ইতিহাস ঘাঁটলে সহজেই জানা যাবে যে আদতে সিঙ্গাপুর এক সময় মালেয়শিয়ারই অংশ ছিলো এবং মালেয়রা ছিলো এই অঞ্চলের ভূমিপুত্র। চাইনিজ এবং ইন্ডিয়ান সিঙ্গাপুরিয়ানরা এদেশে অধিবাসী হিসেবে এসেছে। সিঙ্গাপুর যখন তার ফাউন্ডিং

ফাদার লি-কুয়ান-ইউ-এর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করে তখন সংবিধানে মালেয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ফলে সিঙ্গাপুরের জাতীয় ভাষা ‘মালেয়’ এবং তাদের জাতীয় সংগীত ‘মাজুলা সিঙ্গাপুরা’ মালেয় ভাষায় গাওয়া হয়। এমনকি তাদের মিলিটারীর কম্যান্ডও দেয়া হয় মালেয় ভাষায়। সরকার চাইলেও এগুলোকে পরিবর্তন করতে পারবে না। কিন্তু সরকার তাদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসকে বিকৃতি করে মালেয়দেরকেও সিঙ্গাপুরের অভিবাসী করে উল্লেখ করে নতুন তত্তে¡র অবতরণা করে যা নিয়ে অবধারিতভাবেই মালয় কমিউনিটিতে এক চাপা অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। সরকারের ভেতর থাকা বিভিন্ন মালেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সরকারের এই ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে কোন প্রকার বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকেন যার কারণ অবশ্য সহজেই অনুমেয়। কারণ তাদেরকে নিয়োগই দেয়া হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্তকে মালেয়দের উপর চাপিয়ে দেয়ার এক অলিখিত চুক্তিতে। আর যারা সরকারের কোন সমালোচনা করেছেন তাদের প্রত্যেককেই হতে হয়েছে বিভিন্ন রকমের হয়রানির শিকার। আর যে সব বিদেশী ম্যগাজিন সিঙ্গাপুর সরকারের সমালোচনা করে আর্টিকেল ছাপিয়েছে তাদেরকে হতে হয়েছে সিঙ্গাপুর হাইকোর্টের মামলার সম্মুখীন। হংকং থেকে প্রকাশিত ‘ফার ইস্ট ইকোনিক রিভিউ’-এর বিরুদ্ধে এ রকম একটা মামলা সেই সময় মিডিয়াতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যেখানে এই ম্যাগাজিনকে দিতে হয়েছিল বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ। এই রকম এক জিরো টলারেন্সের সরকারের কোপানলে পড়ে মালেয়দের অবস্থা বেশ কোণঠাসা হয়ে পরে। ফলে এই সময় অনেকেই অপেক্ষাকৃত মালেয় ফ্রেন্ডলি দেশ মালেয়শিয়াতে স্থায়ীভাবে পাড়ি জমান।

নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে মালেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মালেয়শিয়ার অবস্থান ছিলো সিঙ্গাপুরের ঠিক বিপরীত। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ছিলেন ইসলামী জঙ্গীবাদের আদি কারণ অনুসন্ধানের ব্যাপারে বিশেষভাবে সোচ্চার। এই আদি কারণ যে বিশেষ এক দেশটির জন্মের সাথে জড়িত তা আকারে ইঙ্গিতে তিনি সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এই সময়ে মালেয়শিয়ার কুয়ালালুমপুরে অনুষ্ঠিত দশম ও-আই-সি সম্মেলনে তিনি খোলাখুলিভাবে ইসরাইলের সমালোচনা করে বলেন যে ইসরাইল অন্যকে দিয়ে পৃথিবী শাসন করছে এবং অন্য দেশের লোকেরা ইসরাইলের যুদ্ধে প্রাণ দিচ্ছে। পরদিন সিএনএন সহ পশ্চিমা বিশ্বের সব সংবাদপত্রে মাহাথিরের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং তাকে এন্টি-সেমেটিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইটালি, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশই ক‚টনৈতিকভাবে মাহাথিরের এই বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করলেও বুশ প্রশাসন আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থেকেছিল। তারা তার সাথে সরাসরি বাকযুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে বরং ক্ষমতা থেকে তার আসন্ন বিদায়ের দিনটির অপেক্ষায় থাকাটা বেশী বুদ্ধিমানের বলে বিবেচনা করেছিল। কারণ তিনি ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন এবং সেই সাথে সক্রিয় রাজনীতি থেকেও। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে যে কোন কথা নেই, সেটা প্রমাণ করতেই হয়ত দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে দূরে থেকেও প্রতিদ্ব›দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে জোট করে স¤প্রতি মাহাথির মোহাম্মদ বিরানব্বই বছর বয়সে আবারও মালেয়শিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন।

নাইন-ইলেভেনের ঘটনা যখন ঘটে আমি তখন সিঙ্গাপুর পলিটেকনিকে কর্মরত। চারিপাশের এই বদলে যাওয়া পরিবেশে মালেয়দের মতন আমারও মনে উঁকি দেয় অন্য কোথাও পাড়ি জমানোর চিন্তা। তবে আমি একা নই, আমার মতন অন্যান্য  বাংলাদেশীরা যারা সিঙ্গাপুরে নাগরিকত্ব কিংবা পার্মানেন্ট রেসিডেন্সশীপ নিয়ে বসবাস করছেন তাদের অনেকেরই মনে একই চিন্তা। কিন্তু অষ্ট্রেলিয়া না কানাডা, এই নিয়েই সংশয়। শীতের জন্য কানাডাতে মাইগ্রেট করতে অনেকেরই অনীহা, আবার ওদিকে অষ্ট্রেলিয়ার রয়েছে অভিবাসীদের প্রতি মেইন ষ্ট্রীম জনগণের বিরূপ আচরণের রেকর্ড। এই দোটানার ভেতর কেন জানি কানাডাতেই অ্যাপ্লাই করতে আগ্রহী হলাম। আমার বন্ধুবান্ধবদের ভেতর অনেকেই ইতিমধ্যে কানাডাতে পাড়ি জমিয়েছে সেটাও হয়ত একটা কারণ। ওয়েবসাইট থেকে ফর্ম ডাউনলোড করে দেখি যেসব ঘরে আমাদের নাম ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য দিতে হবে সেই ঘরগুলি আকারে বেশ ছোট। আগে যারা এই ফর্ম পূরণ করেছে তাদের একজনের পরামর্শ অনুসারে অতি সূ² নিবের একটা কলম কিনে নিয়ে বসে পড়লাম এই ফর্ম পূরণে। তার ভাষ্যমতে ফর্ম পূরণ করতেই যা কষ্ট, একবার জমা দিয়ে দিলে দেখবে সবকিছু জলের মতন সোজা। কথা সত্য, কারণ নির্দিষ্ট সময়েই সিঙ্গাপুরস্থ কানাডিয়ান হাইকমিশন থেকে আমাদেরকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পেলাম। সেই ইন্টারভিউতে আমাদেরকে বলা হলো যে তারা খুব শীঘ্রই মেডিক্যাল ফর্ম পাঠাবে এবং এক বছরের ভিতর কানাডাতে ল্যান্ড করতে হবে। সবাই সাধারণত এই মেডিক্যাল ফর্ম দু’তিন সপ্তাহের ভিতরই পেয়ে যায়।

আট মাস কেটে যাওয়ার পরও যখন সেই মেডিক্যাল ফর্মের দেখা নেই, মনে মনে তখন ধরে নিলাম যে কোন কারণে হয়ত তারা আমাদেরকে তাদের মনোনয়নের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। ঠিক সেই সময়ে এই মর্মে একটা চিঠি পেলাম যে আমাদের ওয়ার্ক এক্সপেরিন্স নিয়ে তাদের কিছু প্রশ্ন আছে তাই আমাদেরকে আবারো হাইকমিশনে যেতে হবে। নির্ধারিত দিনক্ষণে উপস্থিত হতেই আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে আলাদা আলাদা রুমে নিয়ে বসানো হলো আলাদাভাবে ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। প্রথমেই আমার পালা। আমাকে হচকিত করে প্রথম প্রশ্ন ছিলো চাইনিজ গভর্মেন্ট কীভাবে আমার সাথে যোগাযোগ রাখে। আমি প্রশ্নের কারণ সহজেই অনুধাবন করতে পারলাম তাই তেমন বিচলিত হলাম না। কারণ আমি এবং আমার স্ত্রী দু’জনেই আমরা আমাদের গ্রাজুয়েশন করেছি চাইনিজ গভর্মেন্টের স্কলারশীপ নিয়ে চীনের দু’টি নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে। আর গ্রাজুয়েশন কোর্স শুরুর আগে চাইনিজ ভাষা শিখেছি ‘বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনষ্টিটিউট’ থেকে যা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচার ইউনিভার্সিটি’ হয়। যেহেতু তারা ‘বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনষ্টিটিউট’ নামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুঁজে পায়নি তাতেই তারা সন্দিহান হয়ে উঠে। আমার সরল উত্তর ছিলো যে চাইনিজ গভর্মেন্ট কখনই আমার সাথে কোন ব্যাপারেই যোগাযোগ করেনি। তাদের দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিলো বেশ অস্বস্থিকর, আমি কোন ইসলামিক টেরোরিষ্ট দলের সাথে যুক্ত কী না। যাই হোক, আমার স্ত্রীকেও আলাদাভাবে একই ধরণের প্রশ্ন করার পর তারা আবার আমাদেরকে একসাথে ডেকে বলল যে আমাদের ব্যাপারে তাদের কিছু সিকিউরিটি সংক্রান্ত প্রশ্ন ছিলো যা তারা ইতিমধ্যেই আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছে। এবার তারা আমাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি মেডিক্যাল ফর্ম পাঠাবে।

এরপর যথা সময়ে মেডিক্যাল ফর্ম হাতে এলো। ২০০৩ সালের অগাস্ট মাসের শেষের দিকে পাঁচদিনের এক সফরে আমরা ভ্যানকুভারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেই পাঁচদিনের ভিতর ল্যান্ডিং পেপারের আনুষ্ঠিকতা এবং সেই সাথে সোস্যাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বারের জন্য আবেদন করে আবার সিঙ্গাপুরে ফেরত আসলাম। তারও প্রায় তিন বছর পর ২০০৬ সালের কানাডা দিবসে অর্থাৎ জুলাইয়ের প্রথম দিনে তল্পিতল্পাসহ টরন্টোর পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টে এসে হাজির হলাম।

ঝা ঝকঝকে সিঙ্গাপুর ছেড়ে খানিকটা বিবর্ণ টরন্টো শহরে এসে প্রথম প্রথম আমাদেরকে মানিয়ে নিতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে স্কারবোরো এলাকার ওয়ালমার্ট কিংবা নো-ফ্রিলসে লম্বা লাইন এবং ধীরগতিতে কাষ্টমারকে সার্ভিস দেয়া দেখে আমাদেরকে বারবার সিঙ্গাপুরের ঝটপটে সার্ভিসের কথা মনে করিয়ে দিত। যেদিন প্রথম প্যাসেঞ্জার ভরা টিটিসি-র বাস থামিয়ে ড্রাইভারকে টিম-হর্টনে কফি আনতে লাইন দিতে দেখলাম সেদিন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে ধীরে ধীরে সবকিছুই আমাদের গা সওয়া হয়ে গেল আর সিঙ্গাপুরের স্মৃতিও ফিকে হয়ে আসল। কিন্তু আমাদের ছেলের কাছে সিঙ্গাপুর মানে তার শৈশবের স্মৃতি। বিশেষ করে সিঙ্গাপুরের কিছু লোকাল খাবারের কথা সে সব সময়ই মনে করে। তাই ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে চারদিনের ষ্টপ-ওভার নিলাম। প্রায় এক যুগ পরে আমাদের সিঙ্গাপুরে আবার আসা। পুরো দেশটাকে আর আগের মতন মনে হলো না, অনেক কিছুই বদলে গেছে। পুরানো জায়গাগুলোকে চিনতে পারছিলাম না, নতুন নতুন অনেক ষ্ট্রাকচার গড়ে উঠে যেন একটা কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। তবে আমার ছেলের প্রিয় ফুড কোর্টের ‘নাসি আয়্যাম’ (চিকেন রাইস)-এর ষ্টলটা এবং সেই সাথে স্বাদটাও ঠিক আগের মতন আছে, যা কিনা আমাদের সিঙ্গাপুরের ভ্রমণকে অনেকখানি আনন্দপূর্ণ করে তুলেছিল। আর সেই মালেয় পরিবার যারা আমাদের ছেলেকে দেখাশুনা করত, তাদের সাথে দেখা হওয়াটা ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তবে সিঙ্গাপুরের এই ভ্রমণ শেষে আমার মনে হয়েছে, টরন্টোতে মাইগ্রেট করাটা আমাদের জন্য একটি ভালো সিদ্ধান্ত ছিলো। টরন্টোকে আমরা যতটা আপন করতে পেরেছি, সিঙ্গাপুরকে তা কখনই করতে পারতাম না। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ। টরন্টো।