টরেটক্কা টরন্টো – সন্তান প্রতিপালন

অক্টোবর ৮, ২০২০

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বাংলাদেশের স্কুল বোর্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্ট্রিমিং বলতে বুঝায় ক্লাস নাইনে শিক্ষার্থীদেরকে সায়েন্স, আর্টস কিংবা কমার্স, এগুলোর মাঝে যে কোন একটিকে বেছে নেয়া। এই সময় সায়েন্স না নিলে পরবর্তীতে মেডিক্যাল অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার আর সুযোগ থাকে না। তাই শিক্ষার্থীদের মাঝে সায়েন্স নিয়ে পড়ার আগ্রহ বেশী থাকায় বেশীর ভাগ স্কুলেই সায়েন্স নিয়ে পড়ার সুযোগ দেয়ার জন্য স্কুলের নিজস্ব একটা মাপকাঠি থাকে। সাধারণত বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি বিষয়ের ফলাফলের উপর নির্ভর করে সায়েন্সে পড়ার সুযোগ। স্কুল ভেদে আবার এই মাপকাঠিরও তারতম্য থাকে, ফলে অনেকে কোন এক স্কুলে সায়েন্সে সুযোগ না পেলে অন্য আরেক স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়। অনেককে দেখেছি ঢাকা ছেড়ে মফস্বলে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে চলে যেতে শুধুমাত্র সায়েন্সে পড়ার জন্য। আবার অনেক শিক্ষার্থীর প্রথম চয়েসই থাকে আর্টস কিংবা কমার্স। তবে সায়েন্স, আর্টস কিংবা কমার্স যেই শাখা নিয়েই পড়ুক না কেন, সব শিক্ষার্থীই কিন্তু ইণ্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পাসের পর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবে। যদিও ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগের জন্য ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজাল্ট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ক্লাস নাইনের সায়েন্স কিংবা আর্টস, এই স্ট্রিমিং-এর কারণে কোন শিক্ষার্থীর জন্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় না।

পক্ষান্তরে সিঙ্গাপুরে দেখেছি এক ভিন্ন চিত্র। সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাইমারী স্কুল থেকে সেকেন্ডারী স্কুলে উঠার সময়েই অর্থাৎ ক্লাস সিক্সেই ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আলাদা করে ফেলা হয় কারা ইউনিভার্সিটিতে পড়বে আর কারা পলিটেকনিকে যাবে। সিঙ্গাপুরে আবার ইউনিভার্সিটির চেয়ে পলিটেকনিকের সংখ্যা বেশী। একটি দেশের শিক্ষানীতিই ঠিক করে দেয় সমাজের কোন শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা এই ‘নেতৃত্বদানকারী’ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। এ সম্পর্কে সিঙ্গাপুরের অবসরপ্রাপ্ত ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট ‘কিশোর মাহবুবানি’ বেশ খোলাখুলিভাবেই বলেছেন তার ‘সিক্রেট অব সিঙ্গাপুর সাকসেস’ বক্তব্যে। এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি তার ডিপ্লোম্যাট ক্যারিয়ার থেকে অবসর নেয়ার পর দীর্ঘ তেরো বছর ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’-এর অধীনস্থ ‘লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসি’-এর ডীনের দায়িত্বও পালন করেন। হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া এবং হতদরিদ্র সিঙ্গাপুরে বেড়ে উঠা কিশোর মাহবুবানি তার নিজের জীবনের সাথে সিঙ্গাপুরের তুলনা করে বলেন যে তার জীবদ্দশাতেই তৃতীয় বিশ্ব থেকে সিঙ্গাপুরের প্রথম বিশ্বে রূপান্তর হচ্ছে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা। আর এই আশ্চর্যজনক ঘটনা কোন যাদুবলে ঘটেনি, বরং ঘটেছে সঠিক নেতৃত্বের কারণে। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী ‘লি কুয়ান ইউ’ তিনটি মূলমন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে পরিচালনা করেছিলেন বলেই আজকে সিঙ্গাপুর একটি ‘ফিশিং ভিলেজ’ থেকে প্রথম বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এই তিনটি মূলমন্ত্রকে তিনি তিনটি ইংরেজী আদ্যাক্ষরের মাধ্যমে ‘এমপিএইচ’ নামে অভিহিত করেছেন। ‘এম’ হচ্ছে ‘মেরিটোক্রাসি’, ‘পি’ হচ্ছে ‘প্র্যাগমেটিজম’ এবং ‘এইচ’ হচ্ছে ‘অনেস্টি’। সিঙ্গাপুরে সরকারি সকল পদে ‘মেধা’র ভিত্তিতে যে সব চাইতে বেশী যোগ্য তাকেই নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। তিনি এই পদ তালিকার ভেতর প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর পদও উল্লেখ করেছেন। তিনি এর যৌক্তিকতা দেখিয়েছেন ‘প্র্যাগমেটিজম’-এর মাধ্যমে। মজার ব্যাপার এই যে তিনি ‘প্র্যাগমেটিজম’ শব্দটিকে একটি পাশ্চাত্য ঘরনার শব্দ বলে উল্লেখ করেছেন যার সঠিক প্রতিশব্দ প্রাচ্যের শব্দভান্ডারে পাওয়া মুশকিল, অথচ এই শব্দটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন চীনের প্রয়াত নেতা ‘দেং শিয়াও পিং’ বিখ্যাত সেই উক্তিটি দিয়ে – “বিড়াল সাদা না কালো সেটা বড় নয়, সে ইঁদুর ধরতে সক্ষম কিনা সেটাই বিবেচ্য”। অর্থাৎ সরকারের বিভিন্ন ক্রিটিক্যাল পদে অর্থাৎ যে পদ্গুলি সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে নেতৃত্ব দিবে সেই পদগুলিতে মেধাসম্পন্ন যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ করাটাই হচ্ছে সিঙ্গাপুরের ‘সাকসেস স্টোরি’-এর ‘সিক্রেট’। কিশোর মাহবুবানি অনেকটা অভিযোগের সুরে বলেছেন যে তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিপরায়ণ সরকারেরা এই সকল পদে তাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। কথাটা যে অমূলক তা কিন্তু নয়। তবে সিঙ্গাপুরে সেই মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি বিশেষদের কিভাবে গ্রুম করা হয় সেটা বুঝতে হলে আপনাকে খতিয়ে দেখতে হবে তাদের শিক্ষানীতিকে। এই শিক্ষানীতি কি সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য সমান ভাবে কল্যান বয়ে আনছে, নাকি কোন এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক বলয়কে একচোখা ভাবে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে? সিঙ্গাপুরের শিক্ষানীতি অনুযায়ী ক্লাস ফোরের যে স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে একদল শিশুকে যে ইউনিভার্সিটি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়, দেখা যায় তাদের সিংহভাগই হচ্ছে সমাজের নিম্ন-আয়ের শ্রেণীভূক্ত। কারণ সেই শ্রেণীর অভিভাবকেরা তাদের শিশুদের জন্য আলাদা টিউশন তো দূরের কথা, লেখাপড়ার উপযুক্ত পরিবেশই দিতে অক্ষম। হয়ত শিশুটি স্কুল শেষে তার বাবা-মার সাথে তাদের দোকানে বসে থাকে অনেক রাত অবধি, যেখানে ধনী পরিবারের শিশুটি বাড়তি শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে কোন এক গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ধনী পরিবারের শিশুটিই এগিয়ে যাবে ‘মেধাবৃত্তিক’ প্রতিযোগিতার প্রথম ধাপেই। এরপর রয়েছে শিক্ষা কারিকুলামে ভাষাভিত্তিক প্রতিযোগিতা যেখানে ঝরে যাবে মালয় কিংবা ইন্ডিয়ান ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রীরা। ফলে দিনশেষে কোন বিড়াল যে আসলে ইঁদুর ধরবে সেটা কিন্তু সহজেই অনুমেয়। অথচ সরকার কিন্তু ‘মেধাবৃত্তিক’ নিয়োগই দিচ্ছে সরকারের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় পদে। শুধুমাত্র শিক্ষানীতির কিছু কৌশলগত কারণে একটি ‘প্রিভিলেজড’ গ্রুপের সন্তানেরাই দেশের কর্ণধার বনে যাচ্ছে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সিঙ্গাপুরের শিক্ষানীতির একটি প্রকল্পে দীর্ঘ তিন বছর কাজ করেছি। আর সেই সুবাদে এই শিক্ষানীতি কিভাবে দেশের জন্য ‘নেতৃত্বদানকারী’ এক শ্রেণী তৈরিতে ভূমিকা রাখে তা বেশ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার প্রকল্পের প্রিন্সিপাল ইনভেষ্টিগেটর প্রফেসর ‘অ্যালেন লূক’ সিঙ্গাপুরের ‘আর্লি স্ট্রিমিং’-এর সমালোচনা করে বলেন যে এই পদ্ধতিতে ‘লেইট ব্লুমার’দের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু তার এই মন্তব্য সরকারের মনপূত না হওয়াতে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাকে ফিরে যেতে হয় অস্ট্রেলিয়ার এক ইউনিভার্সিটিতে যেখান থেকে তিনি এসেছিলেন। আর আমিও আমার ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সিঙ্গাপুর ছেড়ে কানাডাতে আসার সিদ্ধান্ত নেই। আমি আমার এই লেখার প্রথম পর্বে (আগমন পর্ব) এ কথাটি যদিও উল্লেখ করেছি, আজ এখানে তা প্রসঙ্গক্রমে পুনরুল্লেখ করলাম। অতি সম্প্রতি সিঙ্গাপুর সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে এই ‘আর্লি স্ট্রিমিং’ ব্যবস্থাকে তারা ২০২৪ সাল থেকে তুলে দিবে।

ইদানিংকালে ইংল্যান্ড ভিত্তিক গার্ডিয়ান পত্রিকাতে বেশ কিছু উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে সেই দেশের ‘এ-লেভেল’ এবং ‘জিসিএসই’ পরীক্ষার মার্কিং সিস্টেমকে সমালোচনা করে। সম্প্রতি সেদেশে কমপিউটার বা ‘এলগোরিদম’ ভিত্তিক মার্কিং সিস্টেম বাদ দিয়ে শিক্ষকদের দিয়ে মার্কিং সিস্টেমকে পুনর্বহাল করা হচ্ছে যা ‘ইউ-টার্ন’ নামে পরিচিত। এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানানো হলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে যে এই ‘ইউ-টার্ন’ আদতে কতখানি সত্যিকারের ‘মেরিটোক্রাসি’র প্রতিফলন ঘটাবে। কারণ ‘সাটোন ট্রাস্ট’ নামক বিখ্যাত শিক্ষা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভাষ্যমতে, প্রাইভেট কিংবা ইনডিপেন্ডেন্ট স্কুলের ছাত্রদের জন্য অক্সফোর্ড কিংবা ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ অন্যান্য স্কুলের ছাত্রদের তুলনায় সাতগুণ বেশী। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে যে অর্ধেকের বেশী মেধাবী কিন্তু নিম্ন-আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীরা ‘জিসিএসই’ পরীক্ষায় টপ স্কোর করতে ব্যর্থ হয়। অনেক সমাজ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে এমন এক ভগ্নদশায় উপনীত হয়েছে যে সেখানে অনৈতিকভাবে সুযোগ দেয়া হচ্ছে সমাজের ধনী শ্রেণীর বাচ্চাদের যারা পুরো সমাজের মাত্র শতকরা সাতভাগ। তবে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার এই যে বাকী সাতানব্বই ভাগ তা মেনে নিয়েছে।

‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এই আপ্তবাক্যটি যে কোন সভ্য দেশের জন্য প্রযোজ্য। একটি দেশের শিক্ষানীতির মাধ্যমে সেই দেশের ভবিষ্যৎ প্রতিফলিত হয়, বোঝা যায় কারা সেই দেশের চালকের আসনে আসীন হবে। কানাডার শিক্ষানীতিও এর বাইরে কিছু নয়। ‘শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার’ – কম্যুনিষ্ট ঘরানার এই শ্লোগানকে বাস্তবায়িত করার জন্য কানাডাতে আবার ‘কে-টুয়েলভ’ অর্থাৎ কিন্ডারগার্টেন থেকে গ্রেড টুয়েলভ পর্যন্ত শিক্ষাকে আবশ্যিক এবং পাবলিক স্কুলগুলোতে তা অবৈতনিক করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা কারিকুলামে সিঙ্গাপুরের আদলে বেশ কিছু ‘স্ট্রিমিং’ সিস্টেম চালু করে আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পরা গোষ্ঠীর বাচ্চাদের জন্য দারিদ্রতার বলয় ভেঙে বেড়িয়ে আসার সুযোগকে সংকীর্ণ করে দিয়েছে।

আশ্চর্যজনকভাবে কানাডাতে প্রথম স্ট্রিমিং শুরু হয় সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থার মতন গ্রেড ফোর-এ, ‘গিফটেড প্রোগ্রাম’-এর মাধ্যমে। সাধারণত ক্লাস টিচারের রিকমেন্ডেশনের ভিত্তিতে এই প্রোগ্রামের জন্য ছাত্রছাত্রীদেরকে সিলেক্ট করা হয়ে থাকে। তবে গার্ডিয়ান যদি মনে করেন তার সন্তানকে কোন কারণে টিচার সিলেক্ট করেননি তবে তিনি তার সন্তানের জন্য শিক্ষাবোর্ডের অনুমোদিত টেষ্ট সেন্টারে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে এক্সামের ব্যবস্থা করতে পারেন। ‘গিফটেড প্রোগ্রাম’-এ চান্স পাওয়ার যোগ্যতা হচ্ছে কগনিটিভ ইন্টিলিজেন্স-এ স্কোর থাকতে হবে শতকরা পঁচানব্বই ভাগ। এছাড়াও ‘ভার্বাল কমপ্রিহেনশন’, ‘পারসেপ্টচুয়াল রিজনিং’, ‘ওয়ার্কিং মেমরি’ এবং ‘প্রসেসিং স্পিড’ এইগুলির জন্যও আলাদাভাবে টেস্ট করা হয়। অথচ যে ছাত্রটিকে টিচার রিকমেন্ড করবে, তাকে কিন্তু এই টেস্টের ভিতর দিয়ে যেতে হবে না। অর্থাৎ স্পষ্টতই বোঝা যায় যে ‘গিফটেড প্রোগ্রাম’-এর সিলেকশন প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ।

‘গিফটেড প্রোগ্রাম’কে বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে ‘গিফটেডনেস’কে। এখানে অনেকেই ভুল করে ‘গিফটেডনেস’কে ‘প্রডিজি’-এর সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। যারা স্টিফেন কিং-এর ‘ইনষ্টিটিউট’ বইটি পড়েছেন কিংবা জোডি ফস্টারের অভিনীত ‘লিটল ম্যান টেট’ সিনেমাটি দেখেছেন তারা সহজেই বুঝতে পারবেন ‘প্রডিজি’ বলতে কি বুঝানো হয়। আমরা মাঝে মাঝে নিউজপেপারে কিংবা কোন সংবাদ মিডিয়াতে দেখে থাকি যে আমেরিকাতে অনেক শিক্ষার্থী বারো বছর বয়সেই কিংবা তার চাইতেও কম বয়সে ইউনিভার্সিটি ডিগ্রী অর্জন করে ফেলে। সাধারণত সেই সব শিক্ষার্থীদের এই বিশেষ সক্ষমতাকে ‘প্রডিজি’ বলে থাকে। কানাডাতে এই বিশেষ সক্ষমতা বা ‘প্রডিজি’ সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোন কার্যক্রম আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে ‘গিফটেডনেস’ বলতে কোনভাবেই ‘প্রডিজি’কে বুঝানো হয় না এখানে। ওন্টারিও মিনিস্ট্রি অব এডুকেশন ‘গিফটেডনেস’-এর সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে -“An unusually advanced degree of general intellectual ability that requires differential learning experiences of a depth and breadth beyond those normally provided in the regular school program to satisfy the level of educational potential indicated”। ‘গিফটেড প্রোগ্রাম’-এ চান্স পাওয়াটাকে একজন গিফটেট স্কুলের প্রিন্সিপাল ‘গোল্ডেন টিকেট’ বলে উল্লেখ করেছিলেন এই সংক্রান্ত কোন এক ওপেন হাউজ অনুষ্ঠানে। কারণ শতকরা দুই দশমিক ছয় ভাগ ছাত্রছাত্রী কেবল এই প্রোগ্রামে চান্স পেয়ে থাকে। তবে জরীপে দেখা গেছে যে এই ‘গোল্ডেন টিকেট’ কিন্তু সাদা ছাত্রছাত্রীদের কপালে আনুপাতিক হারের চেয়ে অনেক বেশী জুটে, অনেক যোগ্য কালো কিংবা অন্য রেসিয়াল গ্রুপের ছাত্রছাত্রীর বেলায় তা জুটে না। অনেক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে টিডিএসবি ‘গিফটেড প্রোগ্রাম’-এ ভর্তির জন্য গ্রেড থ্রি-এর সমস্ত ছাত্রছাত্রীর জন্য তিন পর্বের এক টেস্ট চালু করেছে। এই পদ্ধতি বর্তমানের বৈষম্যকে কতখানি দূর করতে পারবে সময়ই তা কেবল বলতে পারবে। তবে অনুরূপ পদ্ধতি গ্রহণের কারণে ফ্লোরিডাতে এই ধরণের গিফটেট প্রোগ্রামে কালো এবং হিসপ্যানিক বাচ্চাদের চান্স পাওয়া প্রায় তিনগুণ বেড়ে গিয়েছিল। যদিও কার্লস জেমস নামক ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন’-এর একজন প্রফেসর মনে করেন যে, এই তিন পর্বের ইউনিভার্সাল টেস্ট হয়ত তেমন কার্যকরী হবে না যদি না যারা এই টেস্টের মূল্যায়ন করবেন তাদের ভিতর স্বচ্ছতা এবং সততার অভাব থাকে।

আমাদের ছেলে যখন ক্লাস ফাইভের মাঝামাঝি তখন আমরা বাসা কিনে এজ্যাক্সে চলে যাই। সেই বাসার একেবারে লাগোয়া ‘ক্যারোথ্রাস ক্রিক পাবলিক’ স্কুলে তাকে ভর্তি করানো হলো। এই স্কুল গ্রেড এইট পর্যন্ত অর্থাৎ মিডল স্কুলের জন্য আমার ছেলেকে আলাদা কোন স্কুলে যেতে হবে না। নতুন স্কুল কেমন লাগছে তা জানতে চাইলে সে বলত যে খুব ‘নয়েজি’ অর্থাৎ হট্টগোলে ভরা। কারণ জানতে গিয়ে আবিস্কার করলাম যে সে এমন এক ক্লাসে যাচ্ছে যেখানে গ্রেড ফাইভ এবং গ্রেড সিক্সের ছাত্রছাত্রীরা একত্রে ক্লাস করে। এজ্যাক্সে আসাতে আমাদের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তনগুলো হলো তাদের মাঝে একটি ছিল ‘ডেমোগ্রাফী’র পরিবর্তন। ক্যারাবব কোর্টে আমাদের জীবন ছিল অন্যান্য নতুন ইমিগ্র্যান্টদের ঘিরে আর এজ্যাক্সের জীবন শুরু হল ক্যানাডিয়ান প্রতিবেশীদের নিয়ে। স্কুলে সাদা ক্যানাডিয়ানদের পাশাপাশি ক্যারাবিয়ান ক্যানাডিয়ানদের সংখ্যাও কম নয়। এক এক করে বছর পার হয়ে আমার ছেলে ক্লাস এইটে স্কুল থেকে নির্বাচিত হয়ে ওয়াটার লু ইউনিভার্সিটি আয়োজিত ‘গস ম্যাথ কন্টেস্ট’-এ অংশ নেয়। এখানে উল্লেখ্য যে কারিকুলামের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের কন্টেস্ট রয়েছে যেখানে ছাত্রছাত্রীরা স্কুল থেকে নির্বাচিত হয়ে কিংবা নিজ উদ্যোগে অংশ গ্রহণ করতে পারে। ক্লাস এইটের গন্ডি পেরিয়ে আমার ছেলে এক সময় এজ্যাক্স হাই স্কুলে ভর্তি হয়। হাই স্কুলে ভর্তির সময় আরো একটা স্ট্রিমিং রয়েছে যেটা দ্বারা নির্ধারিত হয় কে ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারবে আর কে যাবে কম্যুনিটি কলেজে। যারা ক্লাস এইটে অপেক্ষাকৃত ভালো রেজাল্ট করবে তারা পাবে ‘অ্যাকাডেমিক’, যা কিনা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করার যোগ্যতা অর্জনের পূর্বশর্ত। আর যারা ‘অ্যাকাডেমিক’ পাবে না, তাদের জন্য রয়েছে ‘অ্যাপ্লাইড’ স্ট্রিমিং। এই স্ট্রিমিং সিস্টেম নিয়েও বেশ বাকবিতণ্ডা রয়েছে। ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মাত্র শতকরা তিপ্পান্ন জন কালো ছাত্রছাত্রী অ্যাকাডেমিক স্ট্রিমে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, অথচ সাদা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সেখানে শতকরা একাশি জন। অতি সম্প্রতি ওন্টারিও শিক্ষাবোর্ড গ্রেড নাইন থেকে অ্যাপ্লাইড ও অ্যাকাডেমিক স্ট্রিমিং পদ্ধতি তুলে দিয়েছে। তারপরও ভবিষ্যতই শুধু বলতে পারবে শিক্ষার ক্ষেত্রে এই বৈষম্য কখনও দূর হবে কিনা।

এজ্যাক্স হাই স্কুল বাসা থেকে অনেকটা দূরে হওয়াতে আমি অফিসে যাওয়ার সময় আমার ছেলেকে মাঝে মাঝে নামিয়ে দিয়ে যেতাম। তখন আমার চোখে পড়ে যে স্কুল গেটের সামনে একদল ছেলেমেয়ে জটলা পাকিয়ে ধূমপান করছে। প্রিন্সিপালের সাথে গার্ডিয়ানদের মিটিং-এর সময় আমি এ বিষয়ে কথা বলার আগেই দেখি অন্য এক সাদা মহিলা প্রিন্সিপালকে এ নিয়ে প্রশ্ন করছে। আমি মনে মনে খুশী হলাম যে দৃশ্যটা শুধু আমার প্রাচ্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে বেমানান নয়, পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গির কাছেও অনুরূপ বেমানান। কিন্তু প্রিন্সিপালের উত্তরে আমি যত না আহত হলাম, তার থেকে বেশী কষ্ট পেলাম তার অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে। তার উত্তর ছিল ছাত্রছাত্রীরা স্মোক করবেই, তারা যাতে তার নজরদারির ভেতরে করতে পারে সে জন্য তিনিই স্কুলের গেটের সামনে তাদের ধূমপানের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। একসময় টের পেলাম যে এজ্যাক্স হাই স্কুল আমার ছেলের জন্য উপযুক্ত নয়, তাই গ্রেড টেনে আমরা বাসা বিক্রি করে নর্থ ইয়র্কের এক টাউন হাউজ কমপ্লেক্সে বাসা ভাড়া করে উঠে গেলাম। আর আমার ছেলে ভর্তি হলো ‘জর্জ ভ্যানিয়ে হাই স্কুল’-এ। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো