টরেটক্কা টরন্টো – সন্তান প্রতিপালন

ডিসেম্বর ৩, ২০২০

কাজী সাব্বির আহমেদ

প্রাচীন চীনের প্রখ্যাত দার্শনিক কনফিউশাস মনে করতেন যে, শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে উত্তম মানসিক গুণাবলী অর্জনের আগ্রহ হচ্ছে মানুষের একটি জন্মগত বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ উপযুক্ত শিক্ষা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে উন্নত থেকে উন্নততর নৈতিক গুণাবলীর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। একটি সুষ্ঠু পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্র গঠন করার ক্ষেত্রে সামাজিক স্তর অনুযায়ী মানুযের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন কনফিউশাস। তিনি উল্লেখ করেছেন পাঁচ প্রকার সম্পর্কের কথা। সম্পর্কগুলি হচ্ছে, রাজার সাথে প্রজার, পিতার সাথে পুত্রের, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সাথে কনিষ্ঠ ভ্রাতার, স্বামীর সাথে স্ত্রীর এবং বন্ধুর সাথে বন্ধুর। এখানে বন্ধুর সাথে বন্ধুর সম্পর্ক ব্যতীত অন্য সব সম্পর্কই হচ্ছে কর্তৃত্বের। কনফিউশাসের মতে, প্রজার উপর রাজার কর্তৃত্ব না থাকলে যেমন একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্র গঠন করা যায় না, তদ্রূপ পুত্রের উপর পিতার, কনিষ্ঠ ভ্রাতার উপর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কিংবা স্ত্রীর উপর স্বামীর কর্তৃত্ব না থাকলেও একটি কার্যকরী পরিবার গঠন করা যায় না। এই কর্তৃত্বের সাথে যখন পারস্পরিক সম্মানবোধ এবং ভালোবাসার মিশ্রণ ঘটবে তখন আমরা একটি আদর্শ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র পাব। এখানে শর্ত হচ্ছে যে সবাইকে তার নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে তার প্রতি অর্পিত দায়িত্বকে সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে আমরা একটি কার্যকরী পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারি। এটাই কনফিউশাসের শিক্ষা।

আমি উচ্চশিক্ষার জন্য দীর্ঘ সাত বছর গণচীনের বেইজিং শহরে কাটিয়েছি। এছাড়া ক্যারিয়ারের কারণে মালেয়শিয়ার কুয়ালালুমপুরে দুই বছর এবং সিঙ্গাপুরে প্রায় দশ বছর থেকেছি। এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কারণে চীনের চাইনিজ সমাজ এবং মালেয়শিয়া, সিঙ্গাপুরের অভিবাসী চাইনিজ সমাজকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে  দেখেছি এই উভয় প্রকার চাইনিজ সমাজে কনফিউশাসের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। দেখেছি কিভাবে তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক তথা সামাজিক জীবনে কনফিউশাসের বানীকে বেদবাক্যের মতন করে পালন করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি চাইনিজরা তাদের জীবনযাত্রায় বেশ সংযমী এবং ডিসিপ্লিন্ড। তারা তাদের পিতামাতাকে মেনে চলে এবং ভক্তি করে। তারা তাদের নেতাকে মেনে চলে। এগুলো হচ্ছে কনফিউশাসের শেখানো সামাজিক স্তরভেদে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের স্বরূপ কেমন হবে তারই প্রতিফলন। তাদের এই ভালো গুণাবলীগুলো কিন্তু আমাদের জন্য অনুকরণীয়। কারণ আমাদের ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে,যে কোন প্রাচীন জ্ঞান যা কিনা সমাজের জন্য উপকারী তাকে গ্রহণ করতে হবে এমনভাবে যেন হারানো কোন মূল্যবান বস্থুকে ফেরত পাওয়া গেছে।

একটি সুস্থ এবং স্বাস্থ্যকর পারিবারিক পরিবেশের নিশ্চিতকরণ হচ্ছে সন্তানের সুস্থ মানসিক বিকাশের প্রাথমিক শর্ত। আবার একটি সুস্থ পরিবার গঠনের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রথমেই চলে আসবে পিতামাতার দায়িত্বের প্রশ্ন। একটি সফল এবং কার্যকরী পরিবার গড়ে তোলার ভিত্তিমূল হিসেবে যে সব বিষয়গুলির উপর নজর দেয়া আবশ্যক তা হচ্ছে, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব পোষণ করা, মতবিরোধ দূরীকরণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করা, গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত স্বচ্ছতা অবলম্বন করা, একতরফা ভাবে কোন সিদ্ধান্ত কারো উপর চাপিয়ে না দেয়া, ইত্যাদি। এই সব নানাবিধ খুঁটিনাটি এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই একটি সফল এবং কার্যকরী পরিবার গড়ে তোলা সম্ভব। সাথে থাকতে হবে পারস্পরিক সম্মানবোধ এবং পরিবারের প্রতি নিজ দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠাবান আচরণ। আর অবশ্যই এসবের সাথে যোগ করতে হবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দপূর্ণ সময় কাটানোর মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদেরকে অবসাদ থেকে হাঁফ ছাড়ার সুযোগ করে দেয়া। যখন কোন পরিবারে এই উপাদানগুলির ঘাটতি দেখা দেয় তখন সেই পরিবারটি হয়ে উঠে একটি অকার্যকরী কিংবা ডিসফাংশনাল পরিবার। বলা হয়ে থাকে যে সন্তানদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটি ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে একটি ডিসফাংশনাল ফ্যামিলি বেশী নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। আর সেজন্য একটি কার্যকরী পরিবার গঠন অতীব জরুরী যদি আমরা আমাদের সন্তানদেরকে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে চাই। আমরা সবাই জানি যে একটি সুস্থ সমাজ তখনই গড়ে উঠবে যখন সেই সমাজের পরিবারগুলি হবে সুস্থ স্বাভাবিক এবং কার্যকরী। সে জন্য বলা হয়ে থাকে যে বাড়ী করার আগে সেই এলাকার প্রতিবেশীরা কেমন তার খবর নেয়াটা জরুরী। কারণ আমাদের সন্তানেরা তার চারপাশের পরিবেশ থেকে অনেক কিছুই শিখবে যার উপর হয়ত আমাদের তেমন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাই পরিবেশ এবং কাদের সাথে আমাদের সন্তানেরা মেলামেশা করছে সেটার দিকে নজর রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ।

টরন্টো শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আমরা যখন প্রথম আসি তখন আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে আমাদের পরিচিত জনের অভাব ছিল না। ফলে নিজেদেরকে কখনই এই শহরে একা মনে হয়নি। এছাড়াও ক্যারাবব কোর্টে আমাদের সাথে পরিচয় হয় সদ্য বাংলাদেশ থেকে আসা দু’টি পরিবারের সাথে, সেই সাথে পাকিস্তান থেকে আসা আরও একটি পরিবারের সাথে। এই পরিবার তিনটির সাথে আমাদের এখনও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। পাকিস্তানী পরিবারের দু’টি ছেলের ভেতর বড় ছেলে ফারায ছিল আমার ছেলের সমবয়সী, আর ছোট ছেলে উমের ছিল তাদের চেয়ে দুই বছরের ছোট। আমাদের ছেলের সাথে খুব সহজেই তাদের বন্ধুত্ব হয়ে যায় যা আজ প্রায় পনেরো বছরেও অটুট রয়েছে। আমাদের ছেলেকে এখন প্রায়ই দেখি ফারায উমেরের সাথে তার ছেলেবেলার দুরন্তপনার ঘটনাগুলো স্মৃতিচারণ করতে। সামাজিক পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটা বিষয়ে আমরা বিশেষ মনোযোগী ছিলাম যে যাদের সাথে মননে, রুচিতে এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে মিলে শুধু তাদের সাথেই আমাদের মেলামেশার বন্ধনটা শক্ত করব। কারণ আমরা সচেষ্ট ছিলাম যাতে আমাদের ছেলের উপর এর কোন প্রভাব না এসে পড়ে। তাই সপ্তাহান্তে দাওয়াত দেয়া কিংবা দাওয়াত রক্ষা করার চক্র থেকে অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে মনোযোগী হলাম খেলাধূলা, থিয়েটারে গিয়ে ভালো মুভি দেখা কিংবা লাইব্রেরী থেকে ভালো কোন বই এনে পড়ায়। নিজেদের আমোদ-আহ্লাদের পিছনে ঢালাওভাবে সময় ব্যয় না করে আমাদের ছেলের বেড়ে উঠার বয়সগুলিতে পর্যাপ্ত সময় দেয়ার চেষ্টা করেছি তাকে।

প্রাক সক্রেটিস যুগের গ্রীক দার্শনিক থালেস বলেছেন, ‘মেনস সানা ইন করপোরো সানো’ যার অর্থ হচ্ছে ‘সুস্থ দেহে সুন্দর মন’। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রবলভাবে বিশ্বাস করি এই আপ্তবাক্যে। ব্রাজিলে কিশোর অপরাধ যখন প্রতিরোধের বাইরে তখন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সকার ক্লাব কমিয়ে এনেছিল সেই অপরাধের মাত্রা। কারণ খেলাধূলার সুযোগ হাতের কাছে সহজলভ্য হওয়াতে অনেক কিশোরই আর অপরাধমূলক কাজে জড়াতে আগ্রহী হয়ে উঠেনি। খেলাধূলা মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম। আমি ছোটবেলা থেকেই খেলাধূলার পরিবেশে বড় হয়েছি তাই জীবন গঠনে এর ভূমিকা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। টরন্টোতে এসে প্রথম সুযোগেই আমি নিজেকে আবার খেলাধূলার সাথে যুক্ত করেছিলাম ড্যানফোর্থস্থ ‘বাংলা ক্রিকেট ক্লাব’-এ নাম লিখিয়ে। এই দলের সাথে আমার সুযোগ হয়েছিল এখানকার বিভিন্ন ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলার এবং সেই সাথে পরিচয় হয়েছিল দলের ভেতর থাকা বেশ কিছু তারকা খেলোয়াড়দের সাথে যারা একসময় বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনকে মাতিয়ে রাখতেন। ক্রিকেট ছাড়াও আমি ‘রয়্যাল বেঙ্গল ফুটবল ক্লাব’-এর ব্যবস্থাপনায় ইনডোর সকারেও নিয়মিত অংশ নিতে শুরু করি। সেই সাথে আমাদের ছেলেকেও বিভিন্ন ধরণের খেলাধূলাতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করি। সে মিডল স্কুল এবং হাইস্কুলে ব্যাডমিন্টন খেলাতে নিয়মিত অংশ নেয়। ব্যাডমিন্টন খেলার প্রতি তার আগ্রহ দেখে আমরা তাকে এক সময় ভর্তি করিয়ে দেই একজন কোচের কাছে যার কাছ থেকে সে এই খেলাটির বিভিন্ন খুঁটিনাটি কৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া তাকে সাঁতার শেখানোর জন্যেও আরেকজন কোচের কাছে নিয়ে যেতাম। এছাড়াও নিয়মিত হাঁটাহাঁটি এবং ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্যেও প্রচুর উৎসাহ দিয়েছি তাকে, যা আজ তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এই অভ্যাস ধরে রাখতে পারলে সে ‘সুস্থ দেহে সুন্দর মন’-কেও ধরে রাখতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

খেলাধুলা ছাড়াও তার সাথে সব সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছি তার বেড়ে উঠার সময়গুলোতে। কথা বলে বোঝার চেষ্টা করতাম সে কোন কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন কিনা, কোন কিছু তার চিন্তার জগতে বিরক্তির কারণ হচ্ছে কিনা। ছোট বয়সে বাচ্চাদের চিন্তার জগত থাকে খুব নির্মল, জটিল কোন কিছু নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয় না, তাদের বেশীর ভাগ প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ কিংবা না-এর ভেতর সীমাবদ্ধ। তারা দুনিয়াকে বিচার করে ভালো এবং খারাপ এই দুইটি মানদণ্ডে। তাদের জগতে স্পাইডারম্যান হচ্ছে ভালো, গ্রীন গবলিন হচ্ছে খারাপ। ব্যাটম্যান হচ্ছে ভালো, জোকার হচ্ছে খারাপ। চেহারায় কিংবা আচরণে এই ভালো এবং খারাপের কনট্রাস্ট এত প্রবলভাবে তাদের সামনে ধরা হয় যে মাথা খাটিয়ে আর বের করতে হয় না কে ভালো আর কে খারাপ। কিন্তু এই ভালো এবং খারাপ কিংবা হ্যাঁ এবং না-এর বাইরে যে একটা পূর্বসূত্র বলে একটা ব্যাপার আছে অর্থাৎ কি কারণে কোন জিনিষটা ভালো এবং কোন জিনিষটা খারাপ সেটা কিন্তু তাদের শিশুমননে সহজে ধরা পড়ে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের পরিচিত পৃথিবী এক সময় বদলে যেতে শুরু করে। তাদের প্রশ্নের উত্তর আর হ্যাঁ কিংবা না-এর সীমাবদ্ধ না থেকে এই দুইয়ের মাঝে বিস্তৃত এক বিশাল গ্রে এরিয়ায় লুকিয়ে থাকে। এই সময় তারা নিজ থেকে তাদের মাথায় লুকিয়ে থাকা প্রশ্ন নিয়ে আর কথা বলতে চায় না, কিছুটা বিব্রত বোধ করা শুরু করে। তখনই তাদের সাথে প্রচুর কথা বলার প্রয়োজন হয়। বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে তাদের মনের ভেতর থেকে বের করে আনতে হয় সেই জটিল প্রশ্নগুলো আর তাদেরকে উৎসাহিত করতে হয় প্রাসঙ্গিক জ্ঞানার্জনে যার সাহায্যে তারা নিজেরাই সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নিতে পারবে, ভালো থেকে মন্দকে আলাদা করতে সক্ষম হবে। একটা সময় যখন তারা বুঝতে পারবে যে এই সমাজে তারা হচ্ছে সংখ্যালঘু, তারা হচ্ছে ‘সিস্টেমিক রেসিজম’-এর প্রথম সারির ভিকটিম, তখন তাদের চিন্তার জগতে এক বিরাট পরিবর্তন আসবে। এবং এই পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদেরকে নজর রাখতে হবে তারা যেন এই সময়টাতে উপযুক্ত সাপোর্ট পায় আমাদের কাছ থেকে। যাতে তারা নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারে কিভাবে এই বৈরী পরিস্থিতিকে সামাল দিতে হয় সেই কৌশল এবং জ্ঞান নিয়ে। তারা যেন কোনভাবেই নিজেদেরকে গুটিয়ে না ফেলে, সমাজ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন না করে ফেলে।

টরন্টোর নর্থ ইয়র্ক এলাকাতে অবস্থিত ‘আবু হুরাইরা’ মসজিদের তরুণ ইমাম শেখ মুউতাসিম হামিদি তার শুক্রবারের খুতবাতে অসংখ্যবার উল্লেখ করেছেন কিভাবে আমাদের সন্তানদেরকে উৎসাহিত করতে হবে নিজের ধর্মকে বিসর্জন না দিয়ে যে পশ্চিমা সমাজে আমরা বাস করি সেই সমাজেরই একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ইসলামের আদর্শ আর এই পশ্চিমা সমাজের মূল্যবোধ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। ফলে ইসলামের আদর্শকে ধরে রেখে এই পশ্চিমা সমাজের মূলধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করাটা কোন সহজ কাজ নয়। আমরা যারা প্রথম জেনারেশন ইমিগ্র্যান্ট তাদের জন্য যেমন নয়, তেমনি আমাদের সন্তানেরা যারা দ্বিতীয় প্রজন্মের ইমিগ্র্যান্ট তাদের জন্যও নয়। এই জন্য দরকার প্রচুর হোম ওয়ার্ক  যার সাহায্যে বদলে ফেলতে হবে আমাদের কিছু স্টেরিও টাইপ দৃষ্টিভঙ্গি, সেই সাথে উপযুক্ত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে নিজেদেরকে হালনাগাদ করে নিতে হবে। আমরা যখন পশ্চিমা সমাজের বিশেষ কোন দৃষ্টিভিঙ্গিকে বিরোধিতা করব সেটা যেন কোনভাবেই আবেগতাড়িত না হয়, বরং সেটা হতে হবে যুক্তি সঙ্গত এবং তথ্য নির্ভর। সেই জন্য আলজাজিরার সাংবাদিক মেহেদি হাসান যখন অক্সফোর্ড ইউনিয়নে ‘ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম’ নিয়ে বিতর্কে তার যুক্তি ও তথ্য তুলে ধরেন তখন কিন্তু তার পশ্চিমা প্রতিপক্ষ পাল্টা যুক্তি দিতে পারে না। আমাদেরকে সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। আমরা যদি তা না করে নিজেদেরকে একটি ‘কোকুন’ বা বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলি, তবে সেটা আমাদের জন্য এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কখনই সুফল বয়ে আনবে না। তাহলে যে সমাজে আমরা বাস করি সেই সমাজের সাথে আমরা কখনও অ্যাসিমিলিটেড হতে বা মিশতে পারব না যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এই মিশতে না পারার মনোভাবের ক্ষতিকর প্রভাব কিন্তু সুদূর প্রসারী যা আজকে আমরা ইউরোপের কিছু দেশে বেশ প্রকট আকারেই দেখতে পাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে ইমাম মুউতাসিমের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত পোষণ করি।

কিছুদিন আগে ফ্রান্সে ইতিহাসের শিক্ষক সাতচল্লিশ বছর বয়স্ক স্যামুয়েল প্যাটিকে গলা কেটে হত্যা করে আঠারো বছর বয়স্ক চেচনিয়ান বংশোদ্ভূত আব্দুল্লাখ আনজোরভ। শ্রেণীকক্ষে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’-এর বাস্তব উদাহরণ দিতে গিয়ে শিক্ষক প্যাটি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর বিতর্কিত ‘কেরিকেচার’ প্রদর্শন করেন, যা স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু মুসলিম ছাত্রকে এবং তাদের গার্ডিয়ানদেরকে মর্মাহত করে। ধারণা করা হয় সেই কারণে আনজোরভ খুন করে শিক্ষক প্যাটিকে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন অবশ্য এই খুনের ঘটনা ঘটার কিছুদিন আগে ইসলাম ধর্ম নিয়ে একটি নেতিবাচক মন্তব্য করে বেশ তোলপাড়ের সৃষ্টি করেন। তিনি সেই মন্তব্যে বলেন, ইসলাম আজ বিশ্বব্যাপী গভীর সংকটের সম্মুখীন। তারপর তিনি এই খুনের ঘটনাকে পাশ্চাত্যের বাক স্বাধীনতার প্রতি ইসলাম ধর্মের মনোভাবের সাথে তুলনা করেন এবং সেই সাথে এই মনগড়া হুমকীকে খাটো করে দেখানোর জন্য ফ্রান্সের বড় বড় অট্টালিকাতে বৃহৎ পরিসরে আবারও সেই বিতর্কিত কেরিকাচারের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এই রকম কোন ঘটনা যখন বিশ্বব্যাপী আলোচনার সৃষ্টি করে তখন কিন্তু আমাদের স্কুল-কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া সন্তানদেরকেও ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক সেই আলোচনাতে অংশ নিতে হয়। এই সব স্পর্শকাতর বিষয়ে তাদের নিজস্ব মতামত কী হবে তা কিন্তু অনেকাংশেই নির্ভর করবে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির উপর। ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে কিন্তু এই একই বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ এবং নেতাদের অবস্থান ছিল ভিন্ন। যেমন ফ্রান্সের লিয়ন মসজিদের রেক্টর এবং সেখানকার একজন প্রভাবশালী মুসলিম লিডার কামেল কাবতানি বলেছেন, শিক্ষক প্যাটি তার শিক্ষকতার অংশ হিসেবেই এই বিতর্কিত কেরিকাচারটি প্রদর্শন করেছেন এবং প্রদর্শনের পূর্বে তিনি তার ক্লাসের মুসলিম ছাত্রদেরকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়ে যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয়ও দিয়েছেন। কাবতানি আরও যোগ করেন, টেরোরিস্টরা ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতা লাভের লোভে। অন্যদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে বলে নিজেই বিশ্বের কাছে বিতর্কিত হয়ে উঠেন। মুসলিম বিদ্বেষী এক শ্রেণীর মিডিয়া আবার মালেয়শিয়ার বর্ষীয়ান নেতা মাহাথির মোহাম্মাদের বক্তব্যের আংশিক উদ্ধৃতির মাধ্যমে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য সচেষ্ট হয়। তারা প্রচার করে যে মাহাথির বলেছেন, মুসলমানদের অধিকার আছে ফ্রান্সের জনগণকে হত্যা করার। অথচ মাহাথির তার এই উক্তির সাথে এও বলেছেন যে, কারণ অতীতে ফ্রান্স আলজেরিয়ার মুসলমানদেরকে যেভাবে বিনা উস্কানীতে কচুকাটা করেছে, তার প্রতিশোধ নেয়ার অধিকার নিশ্চয় তাদের আছে কিন্তু মুসলমানরা উদার বলেই তারা এই কাজ থেকে বিরত আছে। বিশ্বের বড় বড় নেতারা যখন ফ্রান্সে এই ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বিবৃতি এবং পাল্টা বিবৃতি দিচ্ছিলেন তখন কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থেকেছে সৌদি আরবের নেতৃবর্গ। তবে বেশ কিছু আরবদেশ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কোন ঘৃণাবাচক বিবৃতি না দিয়ে ফ্রান্সের পণ্য পরিহার করার আহ্বান জানিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের এক এমপি বলেছেন যে, তিনি  ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে তিনি ফাঁসিতে ঝুলতে রাজী। তার এই বালখিল্যসূলভ বক্তব্য যে নিছক রাজনৈতিক স্টান্টবাজী তা সহজেই অনুমেয়। তবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার বক্তব্যে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বলেন যে, কানাডা সব সময়ই বাক স্বাধীনতার পক্ষে, তবে বাক স্বাধীনতার একটি সীমা থাকা বাঞ্ছনীয়। অতএব, দেখা যাচ্ছে যে ফ্রান্সের এই ঘটনা কোনভাবেই কোন সহজ সমীকরণে ফেলে বিচার করার মতন ঘটনা নয়, বরং বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ না করলে এই ঘটনার সঠিক কারণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। প্রতিকার তো আরও পরের ব্যাপার।

আমরা যদি আমাদের সন্তানদেরকে এই ধরণের জটিল পরিস্থিতিকে ইতিহাসের সম্পৃক্ততা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এই তিনটি মৌলিক উপাদানের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করার জন্য উৎসাহিত করি, তবে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের বিচারবোধকে শাণিত করতে পারবে। এই বিচারবোধের দ্বারাই তারা একদিন শিখে যাবে কিভাবে ঘটনার পেছনের ঘটনাকে সামনে এনে, মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব পাশ কাটিয়ে এবং উপযুক্ত তথ্যকে সমীকরণে যুক্ত করে আড়াল করা সত্যকে বের করে আনতে হয়। তখন তারা তাদের বক্তব্যকে বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করতে পারবে সমাজের যে কোন ধরণের ডিসকোর্স বা আলোচনায়। এই বিশ্লেষণ ক্ষমতা তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে এবং তারা আর নিজেদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করবে না। আর যদি তা না করি, তবে তারা হয় পশ্চিমা ন্যারেটিভ বা দৃষ্টিভঙ্গিকেই গ্রহণ করে নিজেকে একজন রেগুলার ক্যানাডিয়ান ভেবে সমাজের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিবে, নতুবা শুধুমাত্র

কট্টরপন্থী ধর্মীয় দৃষ্টিকোণকে বেছে নিয়ে সমাজ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এর কোনটিই কিন্তু আমাদের কাম্য নয়।

আবু হুরাইরা মসজিদের ইমাম মুউতাসিমের খুতবা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা আমাদের সন্তানকে সময়ের সাথে সাথে ইসলামের সঠিক ইতিহাস, ইসলাম সম্পর্কে প্রাচ্যবাদী তথা ওরিয়েন্টালিস্টদের ধারণা এবং সেই ধারণার গলদ সম্পর্কে সচেতন করে তুলি। সেই সাথে তাকে এ বিষয়ে আরও গভীরভাবে জানার জন্য অনুপ্রাণিত করি। ইসলামের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা যেমন শিয়া সুন্নীর দ্বন্দ্ব, চার মাহযাবের সাথে আহলে সুন্নাহের বিরোধ কোথায় এগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি আমাদের ছেলের সাথে। কারণ আমরা যদি তাকে এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল না করি, সে যখন একদিন অন্য ধর্মের মানুষের কাছ এগুলো শুনবে তখন সে বোকা হয়ে যাবে। তাই আমাদের উচিৎ আমাদের সন্তানদেরকে এই সমাজে তারা কি ধরণের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবে সেটা আগেভাগেই অনুধাবন করে তাদেরকে সেভাবেই প্রস্তুত করা। এই বিষয়গুলিকে ট্যাবু বা নিষিদ্ধ বিবেচনা করে এড়িয়ে গেলে আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করব। সে জন্য আমরা সব সময়ই আমাদের ছেলেকে উৎসাহিত করেছি যে কোন বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলার জন্য। সেই অভ্যাস আজও বহাল রেখেছি বলেই আজ সে যখন ইউনিভার্সিটির শেষ প্রান্তে তখন আমরা টিম হর্টন্সে বসে কফি খেতে খেতে বন্ধুর মতন আলোচনা করতে পারি প্রাচ্যবাদ বা ওরিয়েন্টালিজম বনাম পাশ্চাত্যবাদ বা অক্সিডেন্টালিজম নিয়ে। আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত এই ভেবে যে সে এখন তার নিজের যুক্তি, জ্ঞান এবং মেধা দিয়ে কোনটা ভালো কিংবা কোনটা মন্দ সেটা বুঝতে সক্ষম।

(চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ। টরন্টো

(২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশী কম্যুনিটির তেরো জন তরতাজা তরুণ আত্মহত্যা করেছেন। যে বয়সে জীবন হবে উচ্ছল ও দীপ্তিময়, অথচ সেই বয়সে কীসের কারণে তারা তাদের জীবন প্রদীপকে নিজ হাতে নিভিয়ে দিচ্ছেন, এর জন্য অভিভাবক হিসেবে আমাদের কি করণীয় -আগামী সংখ্যায় এই নিয়ে আলোচনা থাকবে।)