টরেটক্কা টরন্টো – সন্তান প্রতিপালন

আগস্ট ৬, ২০২০

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছি তারা জানুয়ারীতে স্কুল ইয়ার শুরু হতে দেখে অভ্যস্থ। বছরের মাঝামাঝি অর্থাৎ জুন মাসে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা আর বছরের শেষে নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর জানুয়ারীতে নতুন ক্লাসে প্রমোশন। সিঙ্গাপুরের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু নর্থ আমেরিকাতে এই হিসাব কিছুটা ভিন্ন। এখানে স্কুল ইয়ার শুরু হয় ‘ফল’-এ অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। আমরা যখন জুলাই মাসের ঠিক এক তারিখে টরন্টোতে আসি তখন আমাদের ছেলে সিঙ্গাপুরের ‘বুকিত পানজাং প্রাইমারী স্কুল’-এ ক্লাস ওয়ানের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা মাত্র শেষ করেছে। পুরো জুলাই এবং অগাষ্ট মাস গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের পাঁচ তারিখে ‘ট্যামো-শেনটার জুনিয়র পাবলিক স্কুল’-এর গ্রেড টু-তে শুরু হয় তার নতুন শিক্ষা জীবন। আজ প্রায় চৌদ্দ বছর পর সে এখন ইউনিভার্সিটির আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্সের শেষ বর্ষ শুরু করতে যাচ্ছে। অর্থাৎ সে তার একাডেমিক শিক্ষাজীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত। যদিও ‘নলেজ বেইজড ইকোনমি’ আর ‘লাইফ লং লার্নিং’-এর যুগে ‘শিক্ষার কাল দোলনা থেকে কবর পর্য্ন্ত’ বিস্তৃত। তার এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার সাথে সাথে আমাদেরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নানা খুঁটিনাটি দিক। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সাথে শেয়ার করব এই আশায় যে অনেকেই হয়ত তা থেকে উপকৃত হবেন।

কানাডাতে ‘লেবার ডে’-এর ছুটি পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার। তার ঠিক পরদিনই শুরু হয় স্কুলের নতুন শিক্ষাবর্ষ। গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটির পর প্রথম দিনের স্কুলে যাওয়ার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকের মাঝে। এই দিনে রাস্তায় স্বাভাবিক দিনের চেয়ে অতিরিক্ত ট্রাফিক হয় বলে আগে থেকেই টেলিভিশন এবং রেডিও-এর সংবাদ বুলেটিনগুলিতে সতর্কবার্তা প্রচার হতে থাকে যাতে সবাই হাতে কিছুটা অতিরিক্ত সময় নিয়ে বেরোয়। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট যেহেতু স্কুল লাগোয়া তাই ধীরে সুস্থে নাস্তা সেরে সবাই মিলে রওনা দিলাম স্কুলের উদ্দেশ্যে। এলিভেটরে বেশ ভীড় লক্ষ্য করলাম, কারণ অন্যান্য বাচ্চারাও তাদের বাবা-মা সহ রওনা দিয়েছে একই স্কুলের উদ্দেশ্যে। এদেশে স্কুল শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটায় আর শেষ হয় বিকেল সাড়ে তিনটায়। মাঝে থাকে এক ঘণ্টার ব্রেক। এই ব্রেক টাইমে বাচ্চারা লাঞ্চ-রুম সুপারভাইজারের নজরদারীতে বাসা থেকে আনা লাঞ্চ খায়, তারপর স্কুল সংলগ্ন প্লে-গ্রাউন্ডে খেলাধূলা করে। শীত কিংবা গ্রীষ্ম, সব ঋতুতেই একই রুটিন অর্থাৎ আউটডোর এক্টিভিটিসের কোন তারতম্য হয় না। আমরা যারা আগে কখনও তুষারপাত দেখিনি, আমাদের শিশুদের স্কুলের এই ব্রেক টাইমে তুষারের ভিতর খেলতে দেখে আতংকিত হয়ে পড়ি তাদের ঠাণ্ডা লেগে যাবে এই আশংকায়। কিন্তু এটাই এদেশের নর্ম – তুষারপাতকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে শেখা। কারণ বছরের একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে এই তুষারের সাথেই হবে আমাদের বসবাস। তাই তুষারপাতকে পাশ কাটিয়ে চলা নয় বরং তাকে আলিঙ্গন করাই হচ্ছে এদেশের রীতি, রয়েছে হরেক রকম উইন্টার স্পোর্টস। আর এই রীতিতে তাড়াতাড়ি অভ্যস্থ উঠার মধ্যেই রয়েছে আমরা যারা এদেশে নতুন অভিবাসী তাদের মঙ্গল। কারণ প্রকৃতিকে আমরা বদলাতে পারব না, প্রকৃতির সাথে সাথে নিজে খাপ খাইয়ে নেয়াটাই হচ্ছে প্রকৃতিকে জয় করার মূলমন্ত্র। তারপরও এদেশে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক ‘উইন্টার ব্লু’-তে ভুগে। সেটা নিয়ে আগামী কোন এক পর্বে বিশদভাবে লেখার ইচ্ছে আছে।

বাচ্চারা স্কুলে কি ধরণের লাঞ্চ নিয়ে যাবে তার একটা গাইডলাইন দেয়া হয় স্কুল বোর্ডের পক্ষ থেকে। ‘কি ধরণের খাবার নিবে’ -তার চেয়ে বেশী জোর দেয়া হয় কি তারা নিতে পারবে না অথবা নিলে লাঞ্চরুম সুপারভাইজারকে রিপোর্ট করতে হবে। কারণ সেই খাবারে অন্যদের এলার্জি থাকতে পারে। এদেশে আসার আগে আমার ব্যক্তিগতভাবে জানা ছিল না যে বাদাম জাতীয় খাবারে অনেকেরই মারাত্মক এলার্জি থাকতে পারে। লাঞ্চরুমের শিষ্টাচারের সাথে অভ্যস্থ হয়ে উঠার পাশাপাশি বাচ্চারা একে অন্যের প্রতি সম্মানশীল ও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠে যা পরবর্তী জীবনে বিশেষ কাজে আসে।

ট্যামো-শেনটার জুনিয়র পাবলিক স্কুল। ছবি : লেখক

এদেশের এলিমেন্টারী স্কুলের সামনে কমলা অথবা হলুদ জ্যাকেট পরিহিত ‘ষ্টপ’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে থাকে ‘ক্রসিং গার্ড’ যারা স্কুল শুরু এবং ছুটির সময় বাচ্চাদের নিরাপদে রাস্তা পারাপার নিশ্চিত করে। আবার এই দুই সময়ে থাকে হলুদ রঙের স্কুল বাসের ছড়াছড়ি, নির্দিষ্ট দূরত্বের ছাত্রছাত্রীরা এই বাসে করে স্কুলে যাওয়া আসা করে। সব মিলিয়ে স্কুল সংলগ্ন এলাকা থাকে সগরম। গাড়ী চালকেরা এই সময়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে স্কুল এলাকার রাস্তাতে গাড়ী চালান। প্রচলিত ট্রাফিক আইন অনুসারে স্কুল বাস যখন রাস্তাতে বাচ্চাদের উঠানো কিংবা নামানোর জন্য থামবে, সমস্ত গাড়ীও তখন থেমে যাবে। না থামলে স্কুল বাস ড্রাইভার রিপোর্ট করে দিতে পারে। আর সেই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে আইন অমান্যকারী ড্রাইভারের হবে বড় অংকের জরিমানা সেই সাথে ড্রাইভিং হিষ্ট্রিতে যোগ হবে ডিমেরিট পয়েন্টস। সবাই আইনের প্রতি ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় শ্রদ্ধাশীল, ফলে বাচ্চারা নিরাপদে নিজেরাই হেঁটে হেঁটে কিংবা তাদের বাবা-মার সাথে স্কুলে যাতায়াত করতে পারে। দিনের পর দিন এই ‘ক্রসিং গার্ড’ কিংবা স্কুল বাস ড্রাইভারদের সাথে ইন্টারঅ্যাকশন করতে করতে বাচ্চারা সোশ্যাল কমিউনিকেশনে অভ্যস্থ হয়ে উঠে। তবে নর্থ আমেরিকাতে বাচ্চারদেরকে শেখানো হয় ‘নেভার টক টু অ্যা ষ্ট্রেঞ্জার’। এর অবশ্য সঙ্গত কারণ রয়েছে। টরন্টোর অদূরে অবস্থিত উডস্টক শহরের আট বছর বয়সী টোরি স্ট্যাফোর্ড নামের ফুটফুটে এক মেয়েকে মর্মান্তিকভাবে জীবন দিতে হয় কারণ সে একজন ষ্ট্রেঞ্জারকে বিশ্বাস করেছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১০ সালে। নিখোঁজের প্রায় তিন মাস পর যেদিন টোরির দেহাবশেষ গভীর জংগল থেকে উদ্ধার করা হল টোরির বাবা মায়ের সাথে পুরো কানাডাবাসী সেদিন কেঁদেছিল। টোরির মতো নিষ্পাপ বাচ্চারা কেন এই সমাজে এত ভালনারেবল সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদেরকে আমলে নিতে হবে অনেক কিছু। সেই অনেককিছু ঘাঁটাঘাঁটি করলে শেষমেশ তলানিতে এসে ঠেকবে মরালিটি এবং এথিক্স, এদেশের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলামে যা অনুপস্থিত। অবশ্য এদেশের ‘ফেইথ বেইজড’ শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলামের কথা আলাদা। এই ফেইথ বেইজড শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যথা সময়ে বিশদ আলোচনা থাকবে।

স্কুল চত্বরে পৌঁছে জানা গেলো যে আমার ছেলের ক্লাস টিচার হচ্ছেন মিসেস বোস। পরবর্তীতে মিসেস বোসের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে জানতে পারি যে তিনি কলকাতার বাঙালী। তাকে আমরা একজন নিষ্ঠাবান এবং সংবেদনশীল টিচার হিসেবে পেয়েছি। তিনি তার ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীকে সাথে করে ক্লাসে ঢুকে গেলেন। সেই সাথে শুরু হল আমার ছেলের কানাডায় তার প্রথম স্কুল দিবস। এই স্কুলের সিংহভাগ ছাত্রছাত্রীই হচ্ছে ক্যারাবব কোর্টের বাসিন্দা। এই ক্যারবব কোর্টে রয়েছে পাঁচটি হাই রাইজ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, যার একটিতে আমাদের বাস। ফলে সবাই সবাইকে চিনে। তাছাড়া আমি যেহেতু আমার ছেলেকে নিয়ে আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট সংলগ্ন প্লে-গ্রাউন্ডে প্রায় বিকেলেই সকার কিংবা ক্রিকেট খেলতাম, সেই খেলার সূত্র ধরে ইতিমধ্যেই আমার ছেলের বেশ কিছু বন্ধু তৈরি হয়েছে। দেখা গেল তাদের ভিতর বেশ কয়েকজন আবার তার একই ক্লাসে পড়েছে। সব মিলিয়ে স্কুলের প্রথম দিনটি ছিল একটি সুখকর অভিজ্ঞতা। তবে এটাও সত্য যে অনেক কিছুই ছিল আমাদের জন্য নতুন যা বাংলাদেশের কিংবা সিঙ্গাপুরের স্কুলিং সিস্টেমে আগে কখনও দেখেনি। যেমন স্কুল শুরুর আগে আউটডোর অ্যাসেম্বলি। বাংলাদেশ এবং সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতাতে দেখেছি ক্লাস শুরুর আগে প্রতিদিন স্কুলের মাঠে সব ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস অনুসারে লাইন ধরে দাঁড়ায়, একত্রে জাতীয় সংগীত গায় তারপর সবাই যার যার নির্ধারিত ক্লাসরুমে চলে যায়। প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় কিছু রুব্রিক্স নির্ধারণ করে যা তার নিজস্ব জাতি গঠনের দিক নির্দেশনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেই রুব্রিক্সগুলির একটি অন্যতম রুব্রিক্স হচ্ছে দেশপ্রেম। দিনের পর দিন একটি শৃংখলার ভিতর জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে শিশুমনে প্রচ্ছন্নভাবে এক ধরণের জাতীয়তাবোধের জন্ম নেয় যা কিনা হয়ত প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় প্রকাশিত হয় না, কিন্তু জাতির ক্রান্তিকালে ঠিকই উজ্জীবিত হয়ে উঠে। সেই কারণেই হয়ত বলা হয়ে থাকে যে ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। আমি ব্যক্তিগতভাবে সিঙ্গাপুর সরকারের শিক্ষানীতির গবেষণার সাথে জড়িত ছিলাম কানাডাতে আসার ঠিক আগে আগে। ফলে ‘দেশপ্রেম’ এলিমেন্টটি কীভাবে সেদেশের স্কুল কারিকুলামের ভিতর অন্তর্ভূক্ত কিংবা ব্লেন্ড করা হয়েছে তা খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যেহেতু সিঙ্গাপুর দেশটি ‘মাল্টি রেসিয়াল এন্ড মাল্টি কালচারাল’, তাই দেশের প্রতিটি জাতিসত্ত্বার আনুগত্য নিশ্চিত করা বেশ জটিল। আর সেজন্য এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য সরকার শিক্ষা-গবেষণা খাতে মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে থাকে। অপরদিকে আমাদের দেশে যেহেতু মাল্টি রেসিয়াল ব্যাপারটা অনুপস্থিত, তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘দেশপ্রেম’ উপাদানটি যোগ করার জন্য কারিকুলামে

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ ধরণের দেশাত্ববোধক কবিতা সংযোজনই যথেষ্ঠ মনে করা হত এক সময়। কিন্তু এখন আমাদের শিক্ষানীতিকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে যা নিয়ে দেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি ইতিমধ্যেই তাদের উৎকন্ঠা ব্যক্ত করেছেন। দেশ-সেরা মেধাবীদের একটি বিরাট অংশ পেশাগত উৎকর্ষতার দোহাই দিয়ে পাড়ি জমান বিদেশে, দেশমাতৃকার ঋণ তাদের অনেকেই আর কখনই শোধ করেন না। এই ঋণ কিন্তু বিভিন্নভাবে শোধ করা যায়। নায়ক শাহরুখ খান অভিনীত বলিউড মুভি ‘স্বদেশ’ একটি দেশপ্রেমমূলক সিনেমা যেখানে দেখানো হয় একজন ‘নাসা’র সায়েন্টিষ্টের ভারত প্রত্যাবর্তন। এই সিনেমা নিশ্চয়ই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইন্ডিয়ান প্রফেশনালদেরকে ভারতমাতার প্রতি তাদের ঋণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ ভারত হচ্ছে তাদের কাছে ‘সারা জাহান মে আচ্ছা’, এই আপ্তবাক্যটি তাদের অন্তরের গভীরে গেঁথে আছে যা তারা সেই ছোট বেলায় তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিখেছিল। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনুরূপ কার্য্যকরী ‘দেশপ্রেম উপাদান’ যোগ করাটা বিশেষ জরুরী হয়ে পড়েছে। অতি সম্প্রতি (২৭ জুলাই, ২০২০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন বিভাগের প্রভাষক আসিফ ইমতিয়াজ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় ‘নীতিহীন মেধাবী নিয়ে বাংলাদেশ কী করবে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেন যেখানে উনি উল্লেখ করেন যে বর্তমানকালে বাংলাদেশের শীর্ষ দূর্নীতিবাজের সিংহভাগই হচ্ছে শিক্ষিত মেধাবী শ্রেণীর অন্তর্গত যারা অবশ্যই সমাজে বিষবৎ পরিত্যাজ্য। এই প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয় যে সেই দূর্নীতিবাজ মেধাবীদের ভেতর একজন নাকি কানাডাতে পাড়ি জমিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের দূর্নীতির ঢেউ এখন কানাডার তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। আর টরন্টোর ‘বেগম পাড়া’র কথা তো আজ সর্বজনবিহিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং সেই সাথে পারিবারিক পরিবেশে নৈতিকতা শিক্ষাকে জোরদার করে কীভাবে একটি ন্যায় পরায়ণ শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তোলা যায় বাংলাদেশ সরকার আশা করি সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দেবে।

কানাডার স্কুল ব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসরুমে যাওয়ার পর জাতীয় সংগীত বাজানো হয় স্পীকারে। তবে জাতীয় সংগীত চলাকালীন সময়টুকু তাদেরকে দাঁড়িয়ে থেকে সম্মান জানাতে হয়। এহেন ব্যবস্থার কথা জানতে পেরে প্রথমেই আমার মনে উঁকি দিয়েছিল আমাদের সময়কার বাংলাদেশের সিনেমা হলের দৃশ্য। সিনেমা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে বড় পর্দায় ভেসে উঠত জাতীয় পতাকা আর সেই সঙ্গে বেজে উঠত জাতীয় সংগীত আর দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাত। জানিনা আমাদের দেশের হলগুলিতে এখনও সেই সিস্টেম বলবৎ আছে কিনা। আমার ছেলে সিঙ্গাপুরের জাতীয় সংগীত ‘মাজুলা সিঙ্গাপুরা’ (এগিয়ে চলো সিঙ্গাপুর)-এর বদলে কানাডার ‘ওহ ক্যানাডা’-তে ধীরে ধীরে অভ্যস্থ হয়ে পড়ল। তবে সে এই দুই জাতীয় সংগীতেরই পরিবর্তন দেখেছে। আমরা সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন সেদেশের জাতীয় সংগীতের সুর পরিবর্তন করা হয় কারণ আগের সুর নাকি গাওয়ার জন্য কঠিন। আর ২০১৮ সালে কানাডার জাতীয় সংগীতের কথা পরিবর্তন করে জেন্ডারের সমতা আনা হয়।

এদেশের পাবলিক স্কুলগুলিতে নির্দিষ্ট কোন ইউনিফর্ম না থাকার ব্যাপারটিও আমাদের কাছে নতুন লেগেছিল। এই ব্যাপারে ‘ট্যামো-শেনটার জুনিয়র পাবলিক স্কুল’-এর প্রিন্সিপাল মিষ্টার হার্ভিকে প্রশ্ন করলে উনি আমাকে বলেন যে অনেক ছাত্রছাত্রীই ইউনিফর্ম এফোর্ড করতে পারে না বলেই ইউনিফর্ম নেই। আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম তার উত্তর শুনে। বাংলাদেশের মতন অন্যতম দরিদ্র দেশের সরকারী স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যদি ইউনিফর্ম এফোর্ড করতে পারে তবে এদেশের ছাত্রছাত্রীরা কেন পারবে না সেটা আমার মাথায় ঢুকেনি। তবে বুঝতে পেরেছিলাম যে ব্যাপারটি যত না আর্থিক তার চেয়ে বেশী দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। ইউনিফর্মের পক্ষে এবং বিপক্ষে হয়ত নানা যুক্তি রয়েছে, তবে এটা সত্য যে ইউনিফর্ম না থাকলে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ‘ড্রেস কম্পিটিশন’-এর একটা ব্যাপার কাজ করে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। আর আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছি তারা স্কুল ইউনিফর্মকে শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য্য অংশ হিসেবে দেখে অভ্যস্থ এবং এটাকে আমরা ডিসিপ্লিন বা শৃংখলার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে মনে করে থাকি। সিঙ্গাপুরের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও আমি একই নিয়ম দেখেছি। সিঙ্গাপুরের পুলিশ যদি স্কুল আওয়ারে ইউনিফর্ম পরিহিত কোন ছেলে অথবা মেয়েকে স্কুলের বাইরে যেমন ফুড কোর্ট কিংবা মলে দেখতে পায় তবে তাকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসে। সিঙ্গাপুর দেশটাই কঠিন আইন দ্বারা চালিত, পান থেকে চুন খসবার জো নেই। আইনের বেড়াজালে ঘেরা এই দেশের নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য বিভিন্ন ধরণের বাধ্যতামূলক কর্মকান্ডের জন্য অনেকেই সিঙ্গাপুরকে একটি রেজিমেন্টাল দেশ হিসেবে গণ্য করে থাকে। সেই বাধ্যতামূলক কর্মকান্ডের ভিতর অন্যতম হচ্ছে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’ – দুই বছর মেয়াদী সামরিক শিক্ষা যা ইসরাইলের কাছ থেকে সিঙ্গাপুর অ্যাডাপ্ট করেছে। গ্রেড টুলেভ পাশ করার পর অর্থাৎ ইউনিভার্সিটি শুরু করার আগে প্রত্যেক পুরুষ নাগরিককে যেতে হয় এই সার্ভিসে। এখানে উল্লেখ্য যে স্কুল কারিকুলামের পাশাপাশি এই ন্যাশনাল সার্ভিস সিঙ্গাপুরের জনগণের মাঝে ‘দেশপ্রেম উপাদান’ ইঞ্জেক্ট করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তিনটি পৃথক জাতিসত্ত্বার সম্বনয়ে গঠিত সিঙ্গাপুরের নাগরিকেরা যখন মালেয় ভাষাতে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তাদের জাতীয় সংগীত ‘মাজুলা সিঙ্গাপুরা’ গায় তখন আক্ষরিক অর্থেই হাজার বাধা বিপত্তি দূর করে ‘এগিয়ে চলে সিঙ্গাপুর’।

বাংলাদেশ সরকার তার চৌকস প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে দেশের প্রচলিত শিক্ষাবোর্ডের অধীনে বেশ কিছু ভিন্ন মাত্রার স্কুল-কলেজের ধারা প্রবর্তন করেছে, অথবা উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া স্কুল-কলেজগুলির কাঠামো অপরিবর্তিত রেখেছে। তার ভেতর প্রথমেই আসবে ক্যাডেট কলেজগুলোর নাম। আমাদের দেশে তিনটি মহিলা ক্যাডেট কলেজ সহ মোট বারোটি সম্পূর্ণ আবাসিক ক্যাডেট কলেজ আছে যেখানে রেগুলার স্কুল কারিকুলামের পাশাপাশি প্রাথমিক সামরিক ট্রেনিং দেয়া হয়ে থাকে। ক্যাডেট কলেজের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে এর ছাত্রছাত্রীদের ভিতর ‘লীডারশীপ’ এলিমেন্টটা ঢুকিয়ে দেয়া। আর সেজন্যেই অনেকে বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজগুলোকে ব্রিটনের ‘ইটন কলেজ’-এর সাথে তুলনা করে থাকে। ক্যাডেট কলেজ ছাড়াও আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীর সাথে যৌথভাবে পরিচালিত অনেক স্কুল-কলেজ আছে যা সাধারণ ভাবে ‘ক্যান্ট-পাবলিক’ স্কুল নামে পরিচিত। এই স্কুলগুলিতেও রেগুলার কারিকুলামের পাশাপাশি শৃংখলা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশে ‘ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর’ নামে একটি সংগঠন আছে যেখানে সাধারণ স্কুলের ছাত্ররা স্বেচ্ছামূলকভাবে যোগ দিয়ে প্যারা মিলিটারি ট্রেনিং নিতে পারে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ একটি সুসংহত ও শৃংখলাবদ্ধ সামরিক বাহিনী অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে যাদের সুনাম আজ বিদেশের মাটিতেও বিস্তৃত।

বাংলাদেশের আবাসিক ক্যাডেট কলেজের আদলে পূর্ণাঙ্গ সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও কানাডাতে আছে ‘রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ার ক্যাডেট’ প্রোগ্রাম যা বারো থেকে উনিশ বছরের কানাডিয়ান ছাত্রছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত। কানাডিয়ান সরকার অতীতে ইনডিজেনাস বাচ্চাদের জন্য আবাসিক স্কুলের স্কিম চালু করেছিল যা পরবর্তীতে একটি ‘ষ্টিগমা’-তে পরিণত হয়েছিল। হয়ত এ কারণে কানাডাতে এখন আর সরকার পরিচালিত আবাসিক স্কুল দেখা না গেলেও বেশ কিছু উঁচু মানের প্রাইভেট রেসিডেন্সিয়াল স্কুল রয়েছে। এই সব রেসিডেন্সিয়াল স্কুলগুলিতে আবার প্রচুর ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রছাত্রীদের ভিড় দেখা যায়।

‘রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ার ক্যাডেট’ প্রোগ্রাম হচ্ছে কানাডার সর্ব বৃহৎ ইয়ুথ প্রোগ্রাম যা ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাশনাল ডিফেন্সের অর্থায়নে এবং কানাডিয়ান ফোর্সের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে থাকে। এই প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্যাডেটদেরকে দেশের প্রতি দায়িত্বপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যাদের মধ্যে লিডারশীপ গুণটি বিদ্যমান থাকবে। পাশাপাশি তাদেরকে বিভিন্ন ধরণের সামরিক শিক্ষাও দেয়া হয়ে থাকে। কেউ যদি কানাডিয়ান ফোর্সে যোগ দিতে চায় তবে এই প্রোগ্রাম তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করবে। কানাডিয়ান ফোর্সে যোগ না দিলেও এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে যে কেউ নিজেকে আগামী দিনের একজন নিয়মানুবর্তী ও চৌকস মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। টরন্টোর মুষ্ঠিমেয় হাইস্কুলে এই ‘রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ার ক্যাডেট’ প্রোগ্রাম আছে, তবে এই প্রোগ্রামে যোগ দেয়ার জন্য সেই স্কুলের ছাত্র হওয়াটা জরুরী নয়। আমার ছেলে টরন্টোর নর্থ ইয়র্কে অবস্থিত ‘জর্জ ভ্যানিয়ে সেকেন্ডারি স্কুল’-এর গ্রেড টেনে পড়াকালীন সময়ে অল্প সময়ের জন্য এই প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছিল এবং সেখান থেকে সে বিশেষ উপকৃত হয়েছিল। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো