‘কানাডিয়ান ষ্টাইল’

অক্টোবর ৮, ২০২০

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

আমার এক পরিচিতের বাসায় একদিন এক বাংলাদেশী পরিবার বেড়াতে এলো। আমরাও ছিলাম। স্বামী-স্ত্রী, সংগে ১৩-১৪ বছরের মেয়ে। মেয়ে পুরো সময় মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে রইলো। কারো সংগেই কথা বললো না। কিছু খেলো না। বাবা দুই একবার নরম ভাবে মেয়েকে কথা বলার জন্য বললো…খাওয়ার জন্য বললো…প্রতি উত্তরে মেয়েটি শক্ত ইংরেজীতে আমাদের সামনেই শাসিয়ে দিলো,

“তোমাকে বলেছিলাম আমি যাবো না। আমার তোমাদের এইসব পারিবারিক দাওয়াত ভালো লাগে না। কে কি মনে করলো….আই ডোন্ট কেয়ার।”

বাবা ভালো ইংরেজী জানেন না। মেয়ে ভালো বাংলা জানে না। কথা বার্তা এ ভাবেই চললো।

আমি অন্য দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা না দেখার ভান করছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা নিজেই আমার সংগে এ বিষয়ে কথা বলা শুরু করলেন।

“জানেনইতো…এরা কানাডিয়ান শিক্ষায় শিক্ষিত। সেই ছোট বেলায় এসেছে। সব কিছু ষ্ট্রেইট ফরোয়ার্ড বলতে পছন্দ করে। এটাই কানাডিয়ান স্টাইল।”

আমি এই ভদ্রলোককে চিনি। ভদ্র মানুষ। এক যুগ কানাডায় আছেন। দেশ কানাডা। আলো-হাওয়া কানাডিয়ান। কিন্তু ভদ্রলোকের বাংলাদেশী পরিমন্ডলের বাইরে মেশা হয়নি। কাজ যেটা করেন তাতে কাজ বেশি..মেলামেশার সুযোগ কম। সময় কম পান বলে খোঁজ-খবরও কম রাখেন।

ধরুন আপনি বরিশাল চাকরী করতে গেলেন। আপনার অফিসের চারজন কলিগ সবাই বরিশালের বাইরে থেকে এসেছে। আপনি তাদের সংগেই থাকেন। আনন্দ-ফুর্তি..দু:খ-বেদনা…অবসর..সব। স্থানীয় বরিশালবাসীদের সংগে দেখা হলে আপনার হাই-হ্যালো হয়। আশে-পাশে দেখেন। দূর থেকে। মাঝে-সাঝে হয়তো কিছুটা কথা হয়। কিন্তু সে সময় তারাও আপনার সংগে বহিরাগত হিসাবেই কথা বলে। এই পর্যন্তই। এইভাবে আপনি দীর্ঘ দিন বরিশালে থাকলেও বরিশালবাসীদের আচার-ব্যবহার নিয়ে আপনার উপসংহার ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।

বাংলাদেশে কিছুদিন ঘুরে এক বিদেশী মনে করেছিল বাংলাদেশ অনেক উদার দেশ সমকামীদের জন্য। কারণ এখানে পথে-ঘাটে ছেলে-ছেলে হাত ধরাধরি বা কাঁধে হাত দিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুরতে পারে! দূর থেকে অপরিষ্কার চোখে দেখা…না-দেখার চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে…কি বলেন?

কানাডায় আছি দশ বছর। এখানে বাংলাদেশীদের এক বিরাট অংশ কানাডাকে প্রায় বাংলাদেশ থেকে দেখার মতোই….দূর থেকেই দেখে। এটা শুধু বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে না। বেশির ভাগ অভিবাসী দেশের জন্যই সত্য।

কাছাকাছি দেখা আসলে খুব সহজ না। ভাষা সবচেয়ে বড় বাধা। ভাষা বলতে শুধু ভাষা না। একজন বাংলা জানলেই কি আপনার সংগে কথা বলতে পারবে? আপনি কি আগ্রহী হবেন? যদি না সে এবং আপনি একই বিষয়ে কথা বলার মতো জ্ঞান বা আগ্রহ রাখেন। সে যদি বাংলায় হকি নিয়ে কথা বলে আপনি কি ফলো করতে পারবেন? কতোক্ষন ভালো লাগবে?

টরন্টো শহর খন্ডিত শহর। শহর ভাগ হয়ে গেছে। দেশে..দেশে…কালচারে..কালচারে বিভক্ত শহর। বাংলাদেশী বাংগালীদের পাড়ায় বা আড্ডায় তাই কলকাতার বাংগালীদের পযর্ন্ত দেখা যায় না। শহরের পূর্ব দিকে যাওয়ার সাবওয়েতে উঠলে কয়েক ষ্টেশন পর পুরো সাবওয়েতে হাতে গোনা দু-একটা সাদা মানুষের দেখা পাওয়াও সৌভাগ্য। সাদারা অন্য দিকে সরে গেছে।

কানাডা অভিবাসীদের দেশ এটা যেমন সত্য। তেমনি এটাও সত্য কানাডা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাদাদের হাতে তৈরী দেশ। তাই কানাডিয়ান স্টাইল বলতে একটা স্টাইলতো আছেই। থাকাটাই স্বাভাবিক।

পুরো সময় খন্ডিত শহরের খুব পরিচিত পরিমন্ডলে উঠে-বসে…খুব দূর থেকে একটু-আধটু দেখে…যথেষ্ট যাচাই-বাছাই না করে…সে স্টাইল সম্পর্কে না জানা বা ভুল জানাটাও তাই খুব স্বাভাবিক।

শুরুর ঘটনা দিয়েই আজকের মতো শেষ করি। ভদ্রলোক সবার সামনে তার মেয়ের ‘রুড’ আচরনকে স্ট্রেট ফরোয়ার্ড..কানাডিয়ান স্টাইল ভাবছিলেন।

‘ওর্য়ল্ড বিজনেস কালচার’ তাদের ওয়েবসাইটে কানাডিয়ান স্টাইল নিয়ে বলছে, “One striking difference between the US and Canada is that Canadian communication patterns are much more low key. Reserve, understatement, diplomacy and tact are key attributes and contrast sharply with the more direct approach of many Americans.”

আরেকটি ওয়েবসাইট বিভিন্ন দেশের কমিউনিকেশন নিয়ে বলতে গিয়ে বলছে, “In general, communication is `moderately indirect’ perhaps reflecting an amalgamation of both North American and British tendencies. Although most Canadians can disagree openly when necessary, they prefer to do so with tact and diplomacy. Their communication style is essentially pragmatic and relies on common sense. If you come from a culture where communication is very direct, you may wish to soften your demeanor and tone so as not to appear threatening.”

সার কথা হলো কানাডিয়ান কমিউনিকেশন নরম, কিছুটা ইনডাইরেক্ট। তারা আব্রু রেখে ভদ্র কমিউনিকেশন পছন্দ করে। তারা ‘না’ বলতে হলেও রেখে-ঢেকে বলে।

আমিও কম-বেশি তাই দেখেছি। আফসোস ভদ্রলোক বারো বছর পুরো উল্টা আন্দাজ করে বসে আছেন। আমি দেখেছি বেশ কিছু বাংলাদেশী পরিবার তাই ভাবে।

এতো কথা বলার একটাই কারণ। অনেকেই নানা কারণে প্রবাস নিয়ে জানতে চান। হয়তো আসবেন। হয়তো নতুন এসেছেন। কিংবা কৌতুহল রয়েছে। খোঁজ-খবর করছেন।

দুটো শিক্ষা নিয়ে আমি চলার চেষ্টা করি-

এক. শুধু দীর্ঘ দিন এইদেশে আছে বলেই কারো অবজারভেশন সঠিক হবে বলে মনে করি না। এমন মানুষের সংগে কথা বলার চেষ্টা করি যিনি খোঁজ-খবর রাখেন বা রাখার সুযোগ ও যোগ্যতা আছে।

দুই. আমি নিজে যা দেখলাম-বুঝলাম সেটাও ভালো করে খোঁজ-খবর না নিয়ে পুরোপুরি সঠিক মনে করি না।

কি কথাগুলো খুব পরিচিত লাগলো? হ্যাঁ…ঠিক ধরেছেন! শুধু প্রবাস না….নতুন যে কোন কিছু ঠিক-ঠাক জানার এই দুটোই মোক্ষম সূত্র। চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

সুস্থ থাকবেন। ভালো থাকবেন।

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

টরন্টো