কানাডা নামের এই চমৎকার দেশটি কোভিড-১৯ এর সময় বিজ্ঞানের শৃঙ্খলায় পরিচালিত হয়েছে

অক্টোবর ৮, ২০২০

মারকাস গি

চলতি গ্রীষ্মে অটোয়া সফর করার সময় আমি পার্লামেন্ট হিলের পিস টাওয়ারের দিকে তাকাই। তখন এর বিখ্যাত উঁচু দণ্ডের পেঁচানো অংশের ওপর কানাডার পতাকা উড়ছিলো।  এটি যে কোনও সময়ই একটি মনোরম দৃশ্য। মৃদুমন্দ বাতাসে উঁচু দণ্ডের উপর উড়ছে উজ্জ্বল লাল ও সাদার মিশ্রণে তৈরি সত্যের মত খাড়া এই পতাকা। এবার অবশ্য দেখি আমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠছে- এ হলো কৃতজ্ঞতার অশ্রু।

বর্তমানের এই সমস্যাসঙ্কুল এবং সংশয়াকুল সময়ে যখন অসংখ্য মানুষ কষ্ট ও ক্ষতির মধ্যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সেই সময়ে আমি অনেক কিছুর জন্যই কৃতজ্ঞ বোধ করি। এসবের মধ্যে অন্যতম হলো এই চমৎকার দেশটিতে বসবাসের সৌভাগ্য লাভ করা। আমার কী সৌভাগ্য- কতই না সৌভাগ্যবান আমরাÑ যে এমন একটি স্থিতিশীল, সহিষ্ণু, সমৃদ্ধ, উদার এবং মৌলিকভাবেই মনোরম দেশে আমরা বসবাস করছি।

বিশ্ব এখন সাম্প্রতিক ইতিহাসের বৃহত্তম সঙ্কটের মোকাবিলা করছে। আমাদের দক্ষিণের মহান ও প্রশংসনীয় দেশটিসহ অনেক দেশই এক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। এর বিপরীতে কানাডা খুবই ভালোভাবে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে।

মুখ্য জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা থেরেসা ট্যাম এক সংবাদ সম্মেলনে হাসিমুখে প্রশ্নের জবাব দেন। এড্রিয়ান ওয়াইল্ড/-কানাডিয়ান প্রেস

আমাদের নেতারা করোনাভাইরাসের হাতুড়ে চিকিৎসার ওপর নির্ভর করেননি বা এর হুমকির মাত্রাকে খাটো করে দেখেননি। যদিও আমাদের রাজনীতি কখনও সংকীর্ণ এমনকি কুৎসিত, কিন্তু তা এখনও আবেগনির্ভর সমর্থনের এঁদো ডোবায় নিমজ্জিত হয়নি বা মিথ্যা কৌশলের পর্যায়ে নেমে যায়নি যেমনটা আমরা সর্বত্র দেখতে পাই। রাজনীতিকদেরকে চোর কিংবা নির্বোধ হিসাবে অবজ্ঞা করাটা যতই জনপ্রিয় হোক আমাদের রাজনীতিকদের বেশিরভাগই ভালো মানুষ। তারা এই সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছেন দায়িত্ব ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে। এমনকি সময়ের গুরুত্ব বুঝে সবচেয়ে সমস্যাজনক লোকগুলিও নিবিষ্টচিত্তে কাজ করেছেন। জনগণকে যতটা সম্ভব নিরাপদ রেখে দেশকে আবারও মুক্ত করে দেওয়ার কাজটি তাদের জন্য ছিলো অত্যন্ত কঠিন। তারা তাদের সাধ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজটি করে চলেছেন। তাদের কাছে আমরা এটুকুই আশা করতে পারতাম।

তাদের সঙ্গে ছিলেন সরকারি কর্তকর্তাদের একটি অনন্য টিম: আমাদের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তারা। এদের কিছু সংখ্যক এই মুহূর্তের বীরে পরিণত হয়েছেন। এই বীরের মর্যাদা পাওয়ার তারা সত্যিই যোগ্য। বিজ্ঞানের শৃক্সক্ষলা দিয়ে পরিচালিত এই কর্মকর্তারা এই প্রাণঘাতী এবং সেভাবে বুঝে উঠতে না পারা রোগের বিষয়ে জাতিকে সম্ভব সর্বোত্তম পরামর্শ দিয়েছেন।

কানাডীয় নাগরিকদের বেশিরভাগই সেসব পরামর্শ মেনে চলেছেন। তারা বারবার হাত ধুয়েছেন এবং পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখেছেন। পরামর্শ মানেননি এবং মাস্ক পরেননি এমন লোকের সংখ্যা সামান্যই। এখন এটা বলা যেতেই পারে যে, এই মেনে চলার প্রবণতা এসেছে নৈতিক শ্রেষ্ঠতা থেকে যেখানে কানাডীয়রা সব সময় ‘আমি’র চেয়ে ‘আমরা’কে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন- তবে কারণ যেটাই হোক না কেন, তারা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেছেন।

অনেকেই আরও বেশি কিছু করেছেন। তারা অন্যদের সহায়তায় নিজের অর্থ, সময় ও শক্তি নিয়োজিত করেছেন। এই সঙ্কট যে বোধগম্য উদ্বেগ-উৎকণ্টার সৃষ্টি করে তার পাশাপাশি এটি মহত্ত্ব ও সংহতির চেতনারও জোয়ার বয়ে আনে। কোভিডকালে ব্যক্তিগত-সহায়তা কর্মী, জরুরী-বিভাগের কর্মচারী এবং অন্যান্য দৈনন্দিন কর্মীদের ভূমিকার প্রশংসায় গোটা কানাডীয় জাতি একাত্ম।

অবশ্যই কানাডীয়দেরও ভুলত্রুটি ঘটেছে, যার পরিমাণও বিপুল। অন্যদের মত কানাডাও এ রোগের হুমকির ব্যাপকতা বুঝতে এবং এর বিরুদ্ধে সাড়া দিতে দেরি করেছে। সেবাকেন্দ্রে ভর্তি হওয়া বৃদ্ধ ও রোগাক্রান্তদের রক্ষা করতে দেশটি দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশটি অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা দিতেও ব্যর্থ। এদেশের সবচেয়ে গরীব এলাকার বাসিন্দারা বৈষম্যমূলক বঞ্চনার শিকার হয়েছেন অসমানুপাতিক হারে যা এদেশের জাতি ও শ্রেণীগত বিভেদের চিত্র উন্মোচন করে দিয়েছে। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহুল প্রতিক্ষিত গণজাগরণ অন্য অনেক দেশের মত কানাডাকেও বাধ্য করে তার অতীতের পাপ এবং বর্তমান অসাম্যের ওপর আলোকপাত করতে।

কিন্তু আমরা যখন ভুলত্রুটিগুলি কাটিয়ে ওঠার সংগ্রাম করছি তখনও আমাদের সৎ গুণাবলীর কথা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। এগুলোও বিপুল। আমাদের গণতন্ত্র শক্তিশালী যা আইনের কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ এবং একটি প্রশংসনীয় সংবিধানের দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও শক্তিশালী অর্থনীতি যদিও এই মুহূর্তে ধকল কাটিয়ে ওঠার লড়াই করছে, তবু দেশ যখন কাজের ধারায় ফিরবে তখন এই অর্থনীতি নিশ্চিতভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে। বহু সংস্কৃতির পরিপোষক আমাদের সফলকাম নগরীগুলো সফল সহাবস্থানের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত। যদিও আমরা এইমুহূর্তে আমাদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, তারপরও কানাডা হচ্ছে মুক্ত ও সবাইকে গ্রহণ করে নেওয়ার মত উদার একটি জায়গা। একটি আদর্শ নমুনার প্রেক্ষিতে বিচার করা হলে আমরা পিছিয়ে থাকবো ঠিক কিন্তু সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে বিচার করলে আমাদের অবস্থান নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল।

আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতির ভেতর বসবাস করবো এবং এই সঙ্কট কেটে গেলে জীবনযাত্রা কিভাবে পাল্টে যাবে সেই বিষয়ে কানাডীয়রা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হলেও দেশের ওপর তাদের অপরিসীম আস্থা এখনও অটুট। এটা থাকাই উচিৎ। এদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এর শক্তিমত্তার জায়গাটা বহুমুখি। এখন আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে আমি আমার সৌভাগ্য নির্ধারক নক্ষত্রগুলোকে ধন্যবাদ দিই যে আমি কানাডায় বসবাস করছি।

– ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

সৌজন্যে : দ্য গ্লোব এ্যান্ড মেইল