কানাডায় ৩০ বছরের অবস্থান আমাকে শিখিয়েছে বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি
ডিসেম্বর ৭, ২০১৯
সুরজিৎ সিং ফ্লোরা
আমরা কানাডীয়রা ১ জুলাই কানাডা দিবস পালন করি। এটি হলো সেই স্মারক দিবস যেদিন ফেডারেশন গঠন করা হয়, যেদিন কানাডা একটি স্বতন্ত্র জাতি হয়ে ওঠে।
১৯৮৯ সালের নভেম্বরে যেদিন আমি কানাডায় পৌঁছি সেদিন তুষারপাত হচ্ছিলো। আর ছিলো হাড় কাঁপানো শীত। সেদিন মিসিসগায় তুষার ঝড় আঘাত হেনেছিলো এবং রাস্তায় ২০ সেন্টিমিটার পুরু বরফ জমেছিলো যা আমি ভারতে কখনও দেখিনি। এটি ছিলো এক অচেনা নতুন দেশের পক্ষ থেকে আমাকে দেয়া উষ্ণ অভ্যর্থনা আর সেই মুহূর্তেই দেশটি আমার হৃদয় জয় করে নিয়েছিলো।
কানাডায় আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় অষ্টম গ্রেড থেকে। তখন আমার ইংরেজি জ্ঞান ছিলো খুবই সীমিত। তারা আমাকে ইএসএল-এ ভর্তি করতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি তা রোধ করেছি। যে ক্লাশের কোনও শিক্ষার্থীই ইংরেজি বলতে পারে না সেই ক্লাশে আমি কীভাবে আমার ইংরেজি জ্ঞানের মানোন্নয়ন ঘটাবো? আমি কানাডায় জন্মানো শিশুদের সঙ্গে নিয়মিত ক্লাশে যোগ দিতে চেয়েছিলাম। আমি আমার স্কুলকে স্বমতে আনতে পেরেছিলাম আমার গ্রেডের চেয়ে দুই বছরের উঁচু গ্রেডের অঙ্ক ও বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ দিতে।
আমি যখন প্রথম স্কুলে যাই তখন সেটা ছিলো ভয়ংকর একটা ব্যাপার। আমি ছিলাম লাজুক, নার্ভাস এবং খুবই নিঃসঙ্গ বোধ করছিলাম। আমার সঙ্গে কেউই দলগত কাজ নিতে চায়নি কারণ আমার ইংরেজি ছিলো দুর্বল। আমার কোনও বন্ধু ছিলো না। তবে আমাকে বিব্রত করার সুযোগ আমি তাদের দিইনি।
একজন নবাগত কানাডীয়র বার্তা
নেতিবাচক ভাবনার লোকদের উপেক্ষা করো এবং যারা তোমাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক তাদের সঙ্গে থাকো। আমি এধরণের লোকদের খুঁজে বের করি এবং যত ধরণের সহায়তা নেওয়া যায় তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করি। এর সুফলও পেয়েছি। কানাডায় নতুন আসা যে কোনও মানুষের জন্য আমার পরামর্শ, সাহসী হোন, নিরাশ হবেন না এবং কঠোর পরিশ্রম করুন। নিজেই নিজের উপদেষ্টা হয়ে যান; আপনার সক্ষমতা সম্পর্কে অন্যরা যখন সন্দিহান হবে তখন তাদেরকে দেখিয়ে দিন আপনি কি করতে পারেন।
শীতল আবহাওয়া, অতিরিক্ত বিনয়ী লোকজন এবং হকি এদেশের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতীক তবে নবাগতদের জন্য এই দেশটির এমন অনেক কিছু আছে। আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে কানাডায় আছি এবং এদেশের ১৫২তম জন্মদিন উদযাপন করতে পেরে আমি সুখী।
কানাডার বিশেষ দিনগুলো কাটান কোনও আনুষ্ঠানিকতায়, কোনও সামাজিক পার্টিতে, সিটি হলে যান; শুধু যাওয়া বা উপস্থিত থাকাই নয় বরং অনুষ্ঠানে অংশ নিন। সেখানে আপনার এলাকার পার্লামেন্ট সদস্য ও স্থানীয় রাজনীতিকদের খুঁজে নিন এবং তাদের সঙ্গে হাত মেলান। যদি আপনি এলাকায় নতুন হন তাহলে ওই এলাকার ইতিহাস বিষয়ক প্রেজেন্টেশন দেখুন। আপনার চারপাশের বিভিন্ন জিনিস এবং লোকজন সম্পর্কে জানুন।
আমি আনন্দিত যে, আমার যাত্রাপথে কানাডাকে বেছে নিয়েছিলাম যেজন্যে এখানকার চমৎকার, সাহায্যকারী মানুষদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কানাডা একটি দেশ হিসাবে সফল কারণ, নিজে পছন্দ করে এখানে আসা লোকেরাই এই দেশটি গড়ে তুলেছেন। একটি নতুন জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে যারা অভিবাসী হয়ে এদেশে আসেন, যারা এদেশকে গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি সহনশীল সমাজ গঠন করেন।
শান্তি এদেশের গভীরে প্রোথিত। এটি এমন এক দেশ যেখানে লোকেরা নিজের ইচ্ছামত নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে। আমরা আমাদের ভাষা, ধর্ম, আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস, কাকে পছন্দ করবো এবং কী পোশাক পরবো তার সবই নিজের পছন্দে বেছে নিতে পারি। সব কানাডীয়রই এই স্বাধীনতার নিশ্চয়তা আছে এবং আমরা এসব অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি সুষ্ঠু বিচার বিভাগের ওপর নির্ভর করতে পারি।
কানাডায় বহু সংস্কৃতিবাদ
বৃহত্তর টরন্টো এলাকায় বহু সংস্কৃতির পরিবেশে বিশেষ করে একজন সাংবাদিক হিসাবে বসবাস করাটা খুবই আকর্ষণীয়। আমার সুযোগ আছে সমাজের বিভিন্ন পশ্চাদপটের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার। বহুসাংস্কৃতিক চেতনা হলো সেটাই যার ওপর কানাডার ভিত্তি এবং এটাই আমাদেরকে মহৎ করেছে। কানাডীয়রা সবাইকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়, প্রত্যেককে শ্রদ্ধা করে। তারা কে কোত্থেকে এসেছে সেটা বিবেচনা করে না।
অবশ্য, কুইবেকে বসবাসকারী মানুষদের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টে গেছে। কয়েক সপ্তাহ আগে কুইবেক সরকার ২১তম বিল পাশ করেছে যাতে সরকারি কর্মচারীদের কর্মরত অবস্থায় ধর্মীয় পোশাক বা প্রতীক পরিধান করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী যেমন, শিক্ষক, পুলিশ কর্মকর্তা ও বিচারকরা নতুন এই আইনের আওতায় পড়বেন। সরকারি অফিস আদালতকে ধর্মনিরপেক্ষ রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে এই আইন করা হয়েছে। ধর্মীয় উপকরণ যেমন হিজাব, টুপি, পাগড়ি এবং ক্রস ইত্যাদির সবই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তবে বর্তমানে যারা সরকারি কর্মচারী রয়েছেন নতুন আইনে তাদের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
এসব সত্তে¡ও কানাডা এখনও বিশ্বের অন্যতম মহৎ একটি দেশ। চারটি ঋতু, ভূ-প্রকৃতি, ভালোবাসা, শান্তি, হকি, বিনামূল্যে চিকিৎসা ইত্যাদি অপর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের জন্য যে বিনামূল্যে সহায়তা দেওয়া হয় সেকথা না হয় না-ই বললাম।
কানাডাই এখন আমার দেশ। আর এই দেশের জন্য আমার গভীর ভালোলাগা ও ভালোবাসা আছে। এই দেশ আমাকে উপহার দিয়েছে অসংখ্য বিশেষ মুহূর্ত এবং অনন্য সব বন্ধু, পরিচিতজন। আমি একজন কানাডীয় হিসাবে গর্ব বোধ করি। -সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ