কানাডায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদ এবং পুলিশি নির্মমতা নিয়ে চ্যালেঞ্জিং দৃষ্টিভঙ্গি
বর্ণবাদবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কানাডায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদ রয়েছে এবং পুলিশি নির্মমতাও ঘটে, এই সত্য স্বীকারে জনগণকে বাঁধা দেয় যে মুখোশ সেটি খুলে ফেলার সময় এসেছে।
জুলাই ১৩, ২০২০
সুসান কোরাহ
সম্প্রতি কতিপয় শীর্ষ রাজনীতিক কানাডায় বর্ণবাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। এ প্রেক্ষিতে বর্ণবাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়ার জন্য নতুন করে আহবান জানানো হয়েছে।
নিউ কানাডিয়ান মিডিয়ার পক্ষ থেকে নেওয়া সাক্ষাৎকারে বর্ণবাদবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট ও পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, কানাডায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদের অস্তিত্ব আছে এবং পুলিশি নির্মমতাও ঘটে এই সত্য স্বীকার করতে জনগণকে বাঁধা দেয় যে মুখোশ সেটি খুলে ফেলার সময় এসেছে।
সম্প্রতি আলাদা সংবাদ সম্মেলনে অন্টারিও প্রদেশের প্রিমিয়ার (মুখ্যমন্ত্রী) ড্যাগ ফোর্ড ও কুইবেকের প্রিমিয়ার ফ্রাঁসোয়া লেগল্ট উভয়েই বলেছেন যে, কানাডায় বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের মত অতোটা গুরুতর নয়।
ফোর্ড বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মত কানাডায় বর্ণবাদের অস্তিত্ব একই রকম “পদ্ধতিগত ও গভীরে শেকড় প্রোথিত” নয়। পরে অন্টারিওর এনডিপি দলের নেতা আন্দ্রে হরওয়াথের প্রশ্নের মুখে তিনি নিজের বক্তব্য ফিরিয়ে নেন।
ফোর্ড ও লেগল্ট এমন সময়ে কথা বলছিলেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিসে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে। সেখানে পুলিশি হেফাজতে আফ্রিকান-আমেরিকান যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
রক্ষণশীল দলের সাবেক এমপি এবং ট্রেজারি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট স্টকওয়েল ডে-ও সিবিসি নিউজ নেটওয়ার্কের সংলাপ অনুষ্ঠান ‘পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স’ এ একইভাবে কানাডায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদের অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করেন। পরে ডে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সিবিসি নিউজসহ অন্য যেসব কোম্পানিতে তার সংশ্লিষ্টতা ছিলো সেগুলো থেকে পদত্যাগ করেন।
লেগল্ট অবশ্য নিজের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে অটল থাকেন, তবে তিনি বর্ণবাদ রোধে কর্মসূচি ঘোষণার পরিকল্পনা করছেন বলে খবরে জানা যাচ্ছে। যদিও তিনি “পদ্ধতিগত” শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করেন।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউবিসি) শিক্ষা অনুষদের প্রফেসর মিজ. অ্যানেট্টি হেনরি বলেন, “কানাডার শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা একটি বুদ্বুদের ভেতরে বসবাস করে এবং তারা বর্ণবাদ কি তা বোঝে না।”
“এটি পদ্ধতিগত এবং তারা (ক্ষমতা ও সুবিধাপ্রাপ্ত শ্বেতাঙ্গ জনগণ) এই পদ্ধতিরই অংশ। তাদের উচিৎ নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করা যে, ‘কারা সরকারে আছে, কারা বাইরে? বিশ্ববিদ্যালয় ও করপোরেশনগুলোর বোর্ড কাদের দখলে।”
কানাডায় বহুসংস্কৃতিবাদ
মিজ. হেনরি যুক্তরাজ্যে জন্ম নেয়া কানাডীয়। তার পূর্ব-পুরুষ জ্যামাইকার। তিনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বসবাস করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ যতটা “উগ্রভাবে জাতিভেদ তুলে ধরে” কানাডায় ততটা স্পষ্ট না হলেও নিশ্চিতভাবেই কানাডায় তা অস্তিত্বশীল- পদ্ধতিগতভাবেও এবং ব্যক্তিগত পর্যায়েও- আর শ্বেতাঙ্গদের বেশি সুবিধা পাওয়াটা একটি সামাজিক বাস্তবতা।”
তিনি বলেন, “কানাডায় আমরা একটি সুখি ও বহু সংস্কৃতির সম্প্রীতির পরিবেশে বসবাস করি বলে মনে করি, কিন্তু খেয়াল করে দেখুন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে কারা কম সুবিধা পাচ্ছে। এমনকি এ ধরণের পদ্ধতিগত বর্ণবাদের পথরেখা অনুসরণের জন্য আমরা তথ্য-উপাত্তও সংরক্ষণ করছি না।
হেনরি তার নিজের বর্ণবাদের মুখোমুখি হবার কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন যেমন, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় কোনও কারণ ছাড়াই পুলিশ তাকে অনুসরণ করে এবং এক পর্যায়ে থামিয়ে দেয়।
কুইবেকের মন্ট্রিল শহরের বাসিন্দা হাইতির বংশোদ্ভূত ফৌজদারি আইনজ্ঞ ম্যারি-লিভিয়া বিউজ একটি হ্যান্ডবুক প্রণয়নে সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করছেন। এতে পদ্ধতিগত বর্ণবাদের বিষয়টি তুলে ধরা হবে যা কৃষ্ণাঙ্গ কানাডীয় ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের বিশেষ করে হাইতি থেকে আসা লোকেদের কোভিড-১৯-এ সংক্রমিত হবার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রেখেছে।
খবরে প্রকাশ, গত মাসে মন্ট্রিলের হাইতিয়ানদের মহল্লায় কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ১,৯৭১ যা পুরো শহরের মোট আক্রান্তের প্রায় ১০ শতাংশ।
মন্ট্রিল নর্থ বরোতে বিপুল সংখ্যক অস্থায়ী বিদেশি শ্রমিক এবং হাইতি ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের বসবাস। এদের মধ্যে অনেকেই বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের দেখাশোনার কাজ করে এবং মহামারি সংক্রমণের ঝুঁকির সামনের সারিতে রয়েছে।
বিউজ-এর প্রতিষ্ঠান সামনের সারির শ্রমিকদের মধ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষামূলক উপকরণ বিতরণ করে।
তিনি বলেন, “মন্ট্রিল নর্থ-এ গণপরিবহন ও এবং অন্যান্য সরকারি সেবা না থাকাও পদ্ধতিগত বর্ণবাদের আরেকটি উদাহরণ।”
ইতিহাসের গভীরে এর শিকড়
টরন্টোর অসগুডি আইন বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত প্রফেসর, আইনজীবী এবং মানবাধিকার বিষয়ক অ্যক্টিভিস্ট ফয়সাল কুট্টি দক্ষিণ এশীয় পটভূমি থেকে আসা। তিনি এনসিএমকে বলেন, “গত ১০ বছর ধরে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশে বসবাস করা এবং কয়েক বছর ধরে কানাডায় আইন পেশার চর্চার কারণে, (বলতে পারি) এটি (কানাডায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদ না থাকার দাবি) সন্দেহাতীতভাবেই অসত্য।”
“প্রকৃতপক্ষে কানাডা গড়েই উঠেছে বর্ণবাদের ভিত্তিতে এবং তা এখনও অক্ষুণœ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে একমাত্র যে পার্থক্য, সেটি হলো, কানাডায় আমরা এর অস্তিত্ব অস্বীকার করি, এটিকে ঢেকে রাখি, অমায়িক আচরণ ও মৃদু হাসি দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে আপনি অন্তত জানছেন যে বর্ণবাদ আছে। তারা সচরাচর এটা সেভাবে লুকিয়ে রাখে না।”
অন্টারিওর কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস সমিতির সাবেক সভাপতি রোজমেরি স্যাডলিয়ার একমত যে, “এদেশে বর্ণবাদের চরিত্র পদ্ধতিগতই, কারণ, দাসবৃত্তির ভিত্তিতে এবং আদিবাসী প্রজন্মকে হটিয়ে দিয়েই এদেশ গড়ে উঠেছিলো।”
অটোয়ার একজন লেখক, শিক্ষাবিদ ও বর্ণবাদবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট মিজ. র্যাচেল ডিকোস্টি বলেন, কানাডার তথাকথিত সমঅধিকার বিষয়ক কল্পকাহিনীর মুখোশ খুলে ফেলার এখনই সেরা সময়। তিনি আরও বলেন, কানাডায় বর্ণবাদ আছে কি নেই এমন প্রশ্ন তোলারও ক্ষতিকর পরিণতি আছে।
তিনি বলেন, “এধরণের প্রশ্ন আমাদেরকে বর্ণবাদের কোনও ধরণের সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার পথ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। বিতর্ক আটকে আছে, ‘এটি আছে কি নেই’ এই জায়গায়। কিন্তু হওয়া উচিৎ হলো, ‘এটি আছে এবং কোন পদ্ধতিতে আমরা এটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারি?”
তিনি আরও বলেন, “এটি আমাদেরকে একটি পুরনো খাতের মধ্যে আটকে রেখেছে এবং কীভাবে এর সমাধান করা যাবে সেই পথে এগুনো থেকে বাঁধা দিচ্ছে।”
অটোয়ার পৌর নির্বাচনে সাবেক প্রার্থী, ডন ড্রানসফিল্ড বলেন, “বর্ণবাদের বিষয়টি আমাদের স্বীকার করে নেওয়া এবং সততার সঙ্গে এর মোকাবিলা করা উচিৎ। এটা অনেকটা মাদকাসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার মত। বর্ণবাদ উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হলো, সমস্যা আছে এটা মেনে নেওয়া।” -সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ (সুসান কোরাহ অটোয়া-ভিত্তিক একজন লেখক/সাংবাদিক এবং ব্লগার।)