কানাডায় কর্মস্থলে বদ প্রকৃতির বসদের শিষ্টাচারহীন আচরণ

ডিসেম্বর ৭, ২০১৯

খুরশিদ আলম

কানাডায় বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এক শ্রেণীর বস বা সুপারভাইজারদের বদ আচরণের কারণে চাকরী ছেড়ে দেন। চাকরী ছেড়ে দিয়ে তারা অন্যত্র যোগদান করেন। আর যাদের সেই উপায় থাকে না, তারা দিনের পর দিন এক চরম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেন। বদ প্রকৃতির ঐ সব বসদের অসদাচরণ বা অবমাননাকর আচার-আচরণের ভয়ে কর্মস্থলে তারা সারাক্ষণই একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। আর এর পরিণতি যা হবার তাই হয়। অর্থাৎ শিল্প-কারখানা হলে উৎপাদন হ্রাস পায়। আর সেবা প্রতিষ্ঠান হলে সেবার মান হ্রাস পায়। কারণ, একজন আতঙ্কগ্রস্থ কর্মী কর্মস্থলে কখনোই স্বাভাবিক মাত্রার শ্রম দিতে পারেন না। অন্যদিকে মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করায় প্রায়শ তিনি কর্মস্থলে হাজির হতে পারেন না। এ সব কারণে একটা উল্লেখযোগ্য হারে কানাডার জাতীয় উৎপাদন ব্যাহত হয়।

কানাডার হিউম্যান রিসোর্স প্রফেশনালস এসোসিয়েশন কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে এই বদ প্রকৃতির বস বা সুপারভাইজার অথবা ম্যানেজারগণ কর্মস্থলের জন্য একটি বড় ধরণের সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। তাদের বদ আচরণের কারণে অধস্তন কর্মীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ৭৩% হিউম্যান রিসোর্স প্রফেশনালসদের অভিমত, এক শ্রেণীর বদ প্রকৃতির বস কর্তৃক কর্মচারীদেরকে কঠোরভাবে তিরস্কার করা, তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা, আবার অন্যদিকে পছন্দের কোন কর্মচারীর প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ দেখানোর কারণে এই সমস্যা তৈরী হচ্ছে।

একই সমীক্ষায় আবার এটিও দেখা গেছে যে, মালিক পক্ষ এই ধরণের বদ প্রকৃতির বসদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের পদক্ষেপতো নেনই না বরং উল্টো তাদের এই বদ আচরণকে প্রশ্রয় দেন যথেষ্ট মাত্রায় যদি তারা কোম্পানীর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেন। পোস্টমিডিয়া নিউজ এই তথ্য জানায়।

হিউম্যান রিসোর্স প্রফেশনালস এসোসিয়েশন এর পরিচালক ক্লড বালথাজার্ড পোস্টমিডিয়াকে বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু লোক আছেন যাদেরকে সুপারভাইজার পদে উন্নীত করা হয়েছে ভুল কারণে। পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হলে তারা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখতে পারেন। কিন্তু পদোন্নত কিছু লোক আছেন যাদের আচরণ এবং মূল্যবোধ কোনভাবেই নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে না। এদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েও কোন লাভ হয় না।

বস বা সুপারভাইজার কর্তৃক যে সকল অসদাচরণ করা হয় তার মধ্যে আছে, অনুপযুক্ত বা বেমানান মন্তব্য করা। হিউম্যান রিসোর্স প্রফেশনালস এসোসিয়েশন এর সমীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৭৪% এ কথা বলেছেন। আর ৭০% মনে করেন এই বদ সুপারভাইজারগণ নির্দিষ্ট কিছু কর্মীর প্রতি সহানুভ‚তি প্রদর্শণ করেন। ৬৩% মনে করেন এই শ্রেণীর বসগণ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন না। ৬২% মনে করেন বদ সুপারভাইজারগণ কর্মীদের প্রতি অসৌজন্যমূলক বা শিষ্টাচারবহিভর্‚ত ব্যবহার করেন। ৫৭% মনে করেন বদ সুপারভাইজারগণ বুলিং অথবা ভীতি প্রদর্শন করে থাকেন।

কর্ম সন্ধানের ওয়েবসাইট ‘মনস্টার কানাডা’ কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায়ও দেখা গেছে বদ প্রকৃতির বসদের জন্য নানান রকমের সমস্যা হচ্ছে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ৪২% কর্মী চাকরী ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।

শ্রমজীবী মানুষ নানান করণেই চাকরী ছাড়েন বা বদল করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আসলে এরা চাকরী ছাড়ছেন না, ছাড়ছেন বসকে। অর্থাৎ বসের অশোভন ব্যবহারের কারণে বিরুপ হয়ে কোম্পানী বদল করেন। মনস্টার এর সমীক্ষায় বলা হয়, এটি নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান বা কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। কানাডায় সার্বিকভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক কর্মীই চাকরী ছাড়েন এই বদ প্রকৃতির বসদের কারণে। কোন প্রতিষ্ঠানে এরকম একজন বদ প্রকৃতির বস থাকলে কর্মীদের মধ্যে সার্বক্ষণিক আতংক বিরাজ করে এবং ঐ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়াই ব্যাহত হয়।

কানাডার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ম্যাকলিন’স এক প্রতিবেদনে এই বদ প্রকৃতির বসদের চিত্রায়িত করেছে এভাবে – “এরা তারস্বরে চীৎকার করেন, জিনিসপত্র ছুড়ে মারেন, ফন্দিফিকির করেন, চক্রান্ত করেন, মিথ্যা বলেন এবং প্রতারণাও করেন। এ সমস্ত করে তারা কানাডার লক্ষ লক্ষ কর্মজীবী মানুষের জীবনকে শোচনীয়ভাবে দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেন। আর এদের সংখ্যাও কম নয়। বিভিন্ন কর্মস্থলে যত বস আছেন তাদের প্রায় অর্ধেকই এই শ্রেণীতে পড়েন!

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা এরকম করেন? ম্যাকলিন’স এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি ঐ বদ প্রকৃতির বসদের চরিত্রের মধ্যেই গ্রোথিত থাকে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কর্মক্ষেত্রে বদ প্রকৃতির বসের কারণে কর্মীরা বিষন্ন থাকেন আর এর প্রভাব পড়ে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য ও কর্মস্পৃহায়। কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টির কারণে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশির ভাগ কর্মীই তাঁদের কর্মস্পৃহাও হারিয়ে ফেলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে চাপের কারণে হৃদরোগ, মুটিয়ে যাওয়া ছাড়াও মানসিক অস্থিরতাজনিত নানা রোগ হতে পারে। শিল্প-মনোবিজ্ঞান পরামর্শক রালফ ইভান্স বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যেসব বস অকারণে সব সময় চিৎকার-চেঁচামেচি করেন; তাঁদের সামনে কর্মীরা সবসময়ই তটস্থ থাকেন। এ অবস্থাটি তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

১০ বছর ধরে চালানো সুইডিশ একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, কর্মক্ষেত্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক কর্মীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে ওই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। বিবিসি’র এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায় ।

আমরা জানি কানাডা একটি সুসভ্য দেশ। এখানকার মানুষের সৌজন্যতাবোধ ও ভদ্রতা জ্ঞান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক উঁচুতে। কেউ কেউ বলেন পৃথিবীর সেরা শিষ্টাচারের দেশ কানাডা। কথাটা বাড়িয়ে বলা হয় তা কিন্তু নয়। সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, বিনয়, অথবা শিষ্টাচার যাই বলিনা কেন এ বিষয়ে কানাডিয়ানদের জুড়ি মেলা ভার। বরং বিশ্বে কানাডিয়ানদের একটি ‘বদনাম’ আছে এই বলে যে, তারা একটু বেশী ভদ্র।

এখন এরকম একটি দেশে যদি শুনা যায় যে, কর্মস্থলে প্রায় অর্ধেক বসই বদ প্রকৃতির, তারা তাদের অধিনস্থ কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক বা শিষ্টাচারবহিভর্‚ত ব্যবহার করেন, ভীতি প্রদর্শন করে থাকেন, তারস্বরে চীৎকার করেন, জিনিপত্র ছুড়ে মারেন, ফন্দিফিকির করেন, চক্রান্ত করেন, মিথ্যা বলেন এবং প্রতারণাও করেন তাহলে তো আশ্চর্য হবারই কথা! এবং এই অত্যাচারের মাত্রা কোথাও কোথাও এত বেশী যে লোকজন বাধ্য হয়ে চাকরী ছেড়ে অন্যত্র চলে যান! এ কেমন শিষ্টাচারের দেশ তাহলে কানাডা? আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই বদ প্রকৃতির বসদেরকে মালিক পক্ষ যথেষ্ট কদরও করেন। অবশ্য যদি সেই বদ বসটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা যথাসময়ে অর্জন করতে পারেন।

তবে মালিক পক্ষ বোধ হয় একটি বিষয় সম্পর্কে তেমন অবগত নন যে, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বদ প্রকৃতির বসের প্রয়োজন হয়না। বরং বদ প্রকৃতির বসদের কারণে উৎপাদন প্রকৃতপক্ষে হ্রাস পায়। কারণ, তাদের অত্যাচারের কারণে কর্মীরা মনোবল হারিয়ে ফেলেন। কাজে কর্মে উৎসাহ পান না। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে একসময় তাদের মধ্যে নানারকম অসুখ-বিসুখ দেখা দেয়। কর্মস্থলে উপস্থিতির হার কমে। আর তার পরিনতিতে দেখা দেয় উৎপাদনে ধীরগতি। ফলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। আর এর ফল ভোগ করতে হয় মালিক পক্ষকেও যিনি বদ প্রকৃতির বস বা সুুপারভাইজারকে কদর করেন শ্রমিকদের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করার কারণে। অথচ নানান গবেষণায় দেখা গেছে, কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মী বা শ্রমিক যাই বলা হোক না কেন, তাদের সঙ্গে যদি শোভন আচরণ করা হয়, তাদের কাজের যদি প্রশংসা করা হয় এবং তাদেরকে যদি গুরুত্ব দেয়া হয় তবে সেই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন মাত্রা এমনিতেই বৃদ্ধি পায়। কঠিন প্রকৃতির বসের প্রয়োজন হয় না। আর বদ প্রকৃতির বসের তো প্রশ্নই উঠে না।

কানাডার গ্লোবাল স্টাফিং প্রতিষ্ঠান রবার্ট হাফ -এর সিনিয়র ডিস্ট্রিক্ট ডাইরেক্টর ডেভিড কিং বলেন, “ম্যানেজাররা অফিসের মেজাজ তৈরি করেন এবং কর্মচারীদের দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতা এবং তাদের সন্তুষ্টির ওপর যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টি করেন- সেটা ভালো বা মন্দ যেটাই হোক।” তিনি বলেন, “সুপারভাইজাররা যখন কোনও প্রকল্প বা নতুন উদ্যোগের বিষয়ে সত্যিকারের উৎসাহ দেখান এবং কর্মস্থলে খোলামেলাভাবে সব সময় যোগাযোগের বিষয়টিকে উৎসাহিত করেন তখন কর্মচারীরা ওই কাজের সঙ্গে অধিকতর একাত্মতা বোধ করেন এবং দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভালোভাবে সহায়তা পাচ্ছেন বলে অনুভব করেন।”

কিং আরও বলেন, “কর্মচারীদের কাজের প্রশংসা করাও উদ্বুদ্ধকরণের আরেকটি শক্তিশালী উপকরণ। কর্মচারী নিজেকে যত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করবেন ততই বেশি করে তারা কাজের ভেতর ডুবে থাকবেন।”

বদ প্রকৃতির বসদের কারণে কানাডায় কি কি সমস্যা হচ্ছে তা আমরা উপরে দেখলাম। কানাডায় এটি একটি সার্বিক চিত্র। কিন্তু এই বদ প্রকৃতির বসেরা আলাদাভাবে ইমিগ্রেন্টদের প্রতি কতটা নির্দয় আচরণ করছেন তার কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ নিয়ে কোন গবেষণাও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে বাঙ্গালীদের বিভিন্ন আড্ডায় বা বিভিন্নজনের অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমাদের কাছে মনে হয়েছে ইমিগ্রেন্টরা মূলধারার কানাডিয়ানদের চেয়ে বেশীমাত্রায় নিগ্রহের শিকার হন ঐ সকল বদ প্রকৃতির বসদের হাতে।

চাকরী পাবার ক্ষেত্রে ইমিগ্রেন্টারা যেমন বৈষম্যের শিকার হন, তেমনি কোনভাবে চাকরী একটি পাওয়ার পর কর্মক্ষেত্রেও নানারকম বৈষম্যের শিকার হন। এর মধ্যে প্রথম হলো শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানদের চেয়ে কম বেতন পাওয়া। একই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও ইমিগ্রেন্টার কম বেতন পান।

আমরা জানি, বেশিরভাগ নবাগত আসেন অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসাবে, তারা সুদক্ষ এবং কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু অনেক সময় তারা তাদের শিক্ষা, যোগ্যতা ও পোশাগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় এমন কাজ খুঁজে পান না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে কেবল অস্তিত্ব রক্ষার মতো কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন। এর ফলে আমাদের সবাইকে মূল্য দিতে হয়। কানাডায় ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে আছেন এমন একজন অভিবাসী একই স্থায়ী চাকরিতে একই কাজ করে কানাডায় জন্মানো একজন নাগরিকের আয় করা প্রতি ডলারের বিপরীতে মাত্র ৬৭ সেন্ট আয় করবেন এটা হতে পারে না। কিন্তু সেটাই হচ্ছে।

এই বেতন কম পাওয়ার পাশাপাশি কর্মস্থলে মন্দ বসদের মন্দ আচরণতো রয়েছেই। ইমিগ্রেন্টরা এই মন্দ বসদের সহজ শিকার হন কারণ, তারা সহসাই চাকরী বদল করতে পারেন না। এক চাকরী পেতেই তাদের অনেক কাঠ-খর পোড়াতে হয়। নেটওয়ার্কিং এর অভাব, হায়ারিং এর সময় বৈষম্যের শিকার হওয়া এসব কারণে ইমিগ্রেন্টদের পক্ষে সম্ভব হয় না এক চাকরী ছেড়ে অন্য চাকরীতে সহজে চলে যাওয়া। ফলে বসের বুলিং মুখ বুজে সহ্য করতেই হয়। অন্যদিকে নবাগত ইমিগ্রেন্টরা দেশটির আইন-কানুন, কর্মস্থলের সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে খুব বেশী অবগত থাকেন না। তাছাড়া চাকরী হারালে কি বিপদ হতে পারে সেটি প্রতিটি ইমিগ্রেন্টই জানেন। বসের অত্যাচারে চাকরী ছেড়ে দিলে সাধারণত আনএম্প্লয়মেন্ট বেনিফিটও পাওয়া যায় না। আর আনএম্প্লয়মেন্ট বেনিফিট পেলেও তা দিয়ে সংসার চলে না। তাছাড়া কয়েক মাসের বেশী ঐ বেনিফিট পাওয়াও যায় না। নতুন দেশে ইমিগ্রেন্টরা যখন আসেন তখন হাতে কিছু ডলার থাকে। কিন্তু সেটি খরচ হতে ছয় মাসও লাগে না। ক্রেডিট কার্ডের লিমিটও নতুন অবস্থায় থাকে কম। তাছাড়া ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ নিলে সেটি তো পরিশোধ করতে হবে। চাকরী না থাকলে তা পরিশোধ করার উপায় কি? নতুন ইমিগ্রেন্টদের সেরকম পরিচিতজনও তেমন থাকেনা যার কাছ থেকে অর্থ ঋণ করা করা যেতে পারে বিপদের সময়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক নড়বড়ে ও অনিশ্চিত অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে কাটাতে হয় নতুন ইমিগ্রেন্টদেরকে। তাই বসের অত্যাচার বলুন আর গাল-মন্দ যাই বলুন, মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়। আর সহ্য করা মানেই বসের আরো বেপরোয়া হয়ে উঠা। এবং এর অবসম্ভাবী পরিনতি হলো, এই ইমিগ্রেন্টদের স্বাস্থ্যহানী। সেটা যেমন মানসিক তেমনি শারীরিকও। এর প্রভাব পড়ে পরিবারেও। সংসারে শুরু হয় অশান্তি।

উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা বলছে, খারাপ বস একজন কর্মীর শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির জন্য দায়ী যা সিগারেটের চেয়েও ক্ষতিকর। ২শ জনের ওপর গবেষণা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। কর্মক্ষেত্রে চাপের অন্যতম কারণ হলো চাকরি হারানোর ভয়। যাদের মধ্যে এ ধরনের চাপ থাকে তারা তাদের সহকর্মীদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভোগেন।

তবে এও সত্যি যে, কর্মস্থলে অশান্তির কারণ শুধু বদ প্রকৃতির বসেরাই নন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বসের রাগের পেছনে যথেষ্ঠ যৌক্তিক কারণ থাকে। যেমন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু কর্মী থাকেন যারা কাজে ফাঁকি দেন বা দেয়ার চেষ্টা করেন। কর্মস্থলে দেরী করে আসেন। একজন ভালো বসও কর্মীদের এরকম আচার আচরণের কারণে অনেক সময় বিরক্ত হতে পারেন। সঠিক সময়ে কর্মীরা তাদের কাজ শেষ করতে না পারলে বা কাজের গুরুত্ব না বুঝলে বসের রেগে যাওয়া বা খারাপ আচরণ করাটা খুবই স্বাভাবিক। এরকম পরিস্থিতিতে বস বদ প্রকৃতির না হলেও ফাঁকিবাজ কর্মীদের উপর রাগ প্রকাশ করতে পারেন। প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারেন। এটি অস্বাভাবিক কোন আচরণ নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোন কোন বস কাজের সময় রাগারাগি করেন বা উচ্চস্বরে কথা বলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার হাসি-তামাশা বা রসিকতা করে তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ফেলেন। এটি আসলে কর্মীদের কাছ থেকে যথাসময়ে কাজ আদায়ের একটি কৌশল। তিনি এমনটা করেন যেন কর্মীরা সবাই সঠিক সময়ে নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেন। এ জাতীয় বসকে বদ প্রকৃতির বস বলার কোন সুযোগ নেই।

কানাডায় অবশ্য বদ প্রকৃতির বসদেরকে মোকাবেলা করার জন্য আইনী সুযোগ রয়েছে। আমরা দেখেছি, কোন কোন বস হন অত্যাচারী। তারা তাদের অধিনস্ত কর্মীদেরকে দাস মনে করেন এবং সে কারণে প্রভ‚র মত আচরণ করেন। অন্যকে যন্ত্রণা দিয়ে বা অপমান করে আনন্দিত হন তারা। অথচ এটি মোটেও উচিত নয়। কিন্তু তারপরও হচ্ছে এগুলো। এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বদ প্রকৃতির এই বসদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচী, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, বø্যাকমেইল করার হুমকী বা শারীরিক নির্যাতন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। এরকম পরিস্থিতিতে কোন প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মীর অধিকার রয়েছে আইনের আশ্রয় নেওয়ার। কর্ম সন্ধানের ওয়েবসাইট মনস্টার.সিএ অত্যাচারের কয়েকটি দৃশ্যপটের বর্ণনা দিয়েছে যে পরিস্থিতিতে একজন ভুক্তভোগী কর্মী আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।

যেমন -অপমান বা হয়রানি যা বৈষম্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

যখন কোন বদ প্রকৃতির বস কর্তৃক অপমান বা বৈষম্যমূলক আচরণ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে তখন একজন কর্মীর উচিৎ নিজেকে শান্ত রেখে বিষয়টি রেকর্ড করা এবং প্রয়োজনে নিরাপদ স্থানে নিজেকে সরিয়ে নেয়া।

কানাডার হিউম্যান রাইটস এ্যাক্ট বা মানবাধিকার আইন একজন কর্মীকে প্রতিরক্ষা দেয় যখন কেউ তার জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, বংশ, জন্মস্থান, বয়স, শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা, পারিবারিক অবস্থা, আয়ের উৎস, যৌন দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ করেন।

একজন কর্মী যদি মনে করেন তিনি তার বস কর্তৃক এরকম নির্যাতের শিকার হয়েছেন তবে তিনি তার বসের বিরুদ্ধে প্রভিন্সিয়াল হিউম্যান রাইটস ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

এছাড়াও যদি কোন বস কাউকে কোন অনিরাপদ বা বিপজ্জনক কাজ করার জন্য জোর করেন, না করলে চাকরী থেকে বাদ দেয়ার হুমকী প্রদান করেন তবে সেই বসের বিরুদ্ধে প্রভিন্সিয়াল হিউম্যান রাইটস ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে।

কোন বস যদি চিৎকার চেঁচামেচী না করেও ক্রমাগত একজন কর্মীকে অপমান করার চেষ্টা করেন তাহলেও তার বিরুদ্ধে প্রভিন্সিয়াল হিউম্যান রাইটস ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে। তাছাড়া কর্মস্থলে যে কোন ধরণের ভায়োলেন্স এর বিরুদ্ধেই একজন কর্মী তার বসের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

উপরের এই তথ্য কোন আইনী পরামর্শ নয়। যদি কেউ মনে করেন তিনি তার বস কর্তৃক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তবে তিনি একজন এম্পøয়মেন্ট ল’ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ