কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ আরো বেশী ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০
খুরশিদ আলম
কানাডায় যারা মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ আরো বেশী ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ ব্যবসা, চাকরী বা পারিবারিক কাজে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাইবেন, তাদেরকে এখন আরো বেশী মাত্রায় দেশটির বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের নজরদারিতে পড়তে হবে। আর এ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে অনেকের মধ্যেই। কানাডার আইনজীবীদের মধ্যেও কেউ কেউ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইতিমধ্যে।
এই উদ্বেগ এর মূল কারণ হলো, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে অবস্থিত প্রিক্লিয়ারেন্স এলাকায় কর্মরত মার্কিন বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তারা এখন আরো বেশী ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। এই সিকিউরিটি কর্মকর্তারা ইচ্ছে করলে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে ইচ্ছুক যে কোন ব্যক্তিকে প্রয়োজনে উলঙ্গ করে তাদের অনুসন্ধানের কাজ চালাতে পারবেন। যে কোন ধরণের প্রশ্নও করতে পারবেন তারা তা যত আপত্তিকরই হোক। এমনকি তাদের চোখে ‘সন্দেহভাজন’যে কাউকে গ্রেফতারও করতে পারবেন। এবং সেটি কানাডার মাটিতে অবস্থিত প্রিক্লিয়ারেন্স এলাকাতেই। অর্থাৎ কানাডার অভ্যন্তরেই। তাদেরকে এই সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে খোদ কানাডার সরকার! অথচ অনুরুপ কোন ক্ষমতা কানাডিয়ান সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর বিষয়টি হলো, কানাডিয়ান নাগরিক বা ইমিগ্রেন্টদের কেউ যদি ভ্রমণ বা কার্য উপলক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান তবে ইউএস কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়াসমূহ কানাডার বিমানবন্দর বা রেল স্টেশনে থাকা অবস্থায়ই নির্দিষ্ট একটি এলাকায় তা সেরে নিতে পারেন।
ইউএস বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের এই অধিকতর ক্ষমতা প্রদানের বিষয়টি কানাডার নতুন প্রিক্লিয়ারেন্স এ্যাক্ট এর মধ্যেই আছে। আর কানাডা সরকার বলছে, এর কারণে সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ আরো সহজ হবে। সিবিসি নিউজ এই তথ্য জানায়।
তবে কানাডার দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য ইরানীয়ান-কাডিয়ান নাগরিক পেনটিয়া জাফারী সিবিসি নিউজকে বলেন, ইউএস বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের নতুন এই বর্ধিত ক্ষমতার কারণে তার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা অধিকতর মাত্রায় দুরূহ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, কানাডার প্রিক্লিয়ারেন্স এ্যাক্ট -এ ইউএস বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের অধিকতর ক্ষমতা এমন সময় দেয়া হলো যখন ঐ দেশটি তাদের ইমিগ্রেশন আইন আরো কঠিন করছে এবং একই একই সময় ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের তিক্ততা অনেক বেশী মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন ইউএস বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তাকে আমার সম্পর্কে সীমাহীন প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে চাই না।
পেনটিয়া জাফারী একজন ইমিগ্রেশন আইনজীবী। টরন্টোতে তার কার্যালয়। তিনি অনেক ইরানী ক্লায়েন্টকে ইমিগ্রেশন সেবা দিয়ে থাকেন। গত আগস্টে কানাডার প্রিক্লিয়ারেন্স এ্যাক্ট কার্যকর হওয়ার পর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ব্যাপারে তার উদ্বেগ শতকরা ১০০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হন। সোলাইমানিকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে ইশ্বর তার পাশে আছেন বলে দাবি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর প্রতিশোধ হিসাবে কদিন পর ইরান বাগদাদে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেনা ঘাটিতে রকেট হামলা চালায়। এ সমস্ত ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চরমে উঠেছে। এবং এরই ধারাবাহিকতায় দিনকয়েক পর কমপক্ষে ১৫০ জন ইরান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিককে আটক করেছে ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষ। কানাডা থেকে আমেরিকায় ফেরার পথে এসব নাগরিককে আটক করা হয় বলে জানিয়েছে মিডল ইস্ট আই। ওই মার্কিন নাগরিকরা ইরানের একটি পপ কনসার্ট উপভোগ করতে কানাডার ভাঙ্কুবারে এসেছিলেন। কনসার্ট শেষে ফেরার পথে ওয়াশিংটনের ব্লেইন এলাকার পিচ আর্চ সীমান্ত অতিক্রম করার সময় তাদের আটক করে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তারা। এ আটক ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে ইরানিয়ান আমেরিকান কম্যুনিটি সংগঠন। এ বিষয়ে সংবাদ এক সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটির নেতা হোদা কাতেবি বলেন, ‘যাদের আটক করা হয়েছে তাদের পূর্বপুরুষ ইরানের হলেও তারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাই জন্মসূত্রে তারা মার্কিন নাগরিক। কোনো কারণ ছাড়াই মার্কিন নাগরিককে ১১ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আটকে রাখা এবং জিজ্ঞাসাবাদ আইনত অবৈধ।’
ন্যাশনাল ইরানিয়ান আমেরিকান কাউন্সিল (এনআইএসি) নামক এক সংস্থার যোগাযোগ বিভাগের পরিচালক মানা মোস্তাতাবি মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, প্রায় ১৫০ ইরান বংশোদ্ভূতকে ১১-১৬ ঘণ্টা ধরে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদেরকে আত্মীয়-স্বজন, জন্ম তারিখ, ইরানে সর্বশেষ সফর এবং ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
তবে এর জবাবে মার্কিন বর্ডার সিকিউরিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইরানি বংশোদ্ভুত হওয়ার কারণে এসব লোকজনকে আটক করা হয়নি। সীমান্ত দিয়ে যেই আসুক তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়া হয়। এটা সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর রুটিন ওয়ার্কের অংশ। তবে ঐ সময় সীমান্তে কর্মরত অফিসারদের সংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল না এবং হলিডে সিজন হওয়াতে লোকজনের চাপ ছিল বেশী। এ কারণে চেকিং করতে গিয়ে দেরী হয়ে থাকতে পারে। সিবিসি নিউজকে এই ব্যাখ্যা দেয় তারা।
কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। এটা মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা কাস্টমস কর্মকর্তাদের কোন রুটিন ওয়ার্ক ছিল না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই তারা সীমান্তে ঐ ইরানী-আমেরিকারনদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ইরানী-আমেরিকান বা ইরানী-কানাডিয়ানদের পক্ষ থেকে মার্কিন সীমান্তে কর্মরত কাস্টমস বা নিরাপত্তা রক্ষিদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে অভিযোগগুলো করা হচ্ছে তার সত্যতা মিলে জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে ফাঁস হয়ে যাওয়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এক অভ্যন্তরীন নির্দেশনামা থেকে।
সিবিসি নিউজের হস্তগত হওয়া ঐ নির্দেশনামার শিরোনাম হলো ‘টঢ়ফধঃবফ চৎড়পবফঁৎবং ’। ওতে বলা হয়, যে সকল পুরুষ বা নারী ১৯৬১ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে জন্মেছেন এবং প্যালেস্টাইন বা লেবাননের সঙ্গে যাদের যোগসূত্র আছে অথবা ঐ সকল দেশে যারা যাওয়া আসা করেছেন তাদের উপর বিশেষ নজর রাখতে হবে। যে সকল ইরানী এবং লেবানিজ যারা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা কিংবা ল্যাটিন আমেরিকা থেকে এসেছেন এবং আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, জর্ডান ইসরাইল এর সাথে যোগসূত্র আছে তাদের উপর বিশেষ নজর রাখতে হবে। এমনকি অন্যান্য দেশের নাগরিক যারা ইরান এবং লেবাননে যাতায়ত করেছেন তাদের উপরও বিশেষ নজর রাখতে হবে।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছেই যাচ্ছে মুসলিমদের জন্য বর্ডার পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটেছে। যেখানে খোদ আমেরিকার মুসলিম নাগরিকদেরই আটক করে হেনস্থা করা হচ্ছে সেখানে কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়কে কতটা ‘আদর যত্ম’করা হবে তা অনুমান করা বোধ করি কঠিন নয়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রগামী সব কানাডিয়ান মুসলিমকেই যে বর্ডারে আটকে রেখে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তা নয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন ছয়টি দেশের ওপর বিধিনিষেধ দিয়ে বিস্তৃত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। গত ৩১ জানুয়ারী এক আদেশে তিনি এ নতুন নিষেধাজ্ঞা দেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। নতুন বিধিনিষেধের ফলে ইরিত্রিয়া, নাইজেরিয়া, মিয়ানমার ও কিরগিজস্তানের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ কমে আসবে। সুদান ও তানজানিয়ার নাগরিকদের জন্য বন্ধ হবে ‘ডাইভারসিটি ভিসা’। তবে দেশ ছয়টির নাগরিকদের ভ্রমণ ভিসা, শিক্ষার্থী ও ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ভিসা আগের মতোই চালু থাকবে। দুই বছর আগে লিবিয়া, ইরান, সোমালিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া ও ভেনিজুয়েলার নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
উল্লেখ্য যে, গত বছর ১৫ আগস্ট ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ঘোষণা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা দুই দেশের মধ্যে সড়ক পথে, রেল পথে, নৌ পথে এবং আকাশ পথে প্রিক্লিয়ারেন্স চুক্তি বাস্তবায়িত করেছে। এই চুক্তিটি আসলে করা হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৬ মার্চ এবং তখন চুক্তিতে সই করেছিলেন ইউএস সেক্রেটারী অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং কানাডিয়ান মিনিস্টার অফ পাবলিক সেফটি এ্যান্ড এমার্জেন্সী প্রিপার্ডনেস। কানাডার কনজার্ভেটিভ পার্টি তখন ক্ষমতায় এবং স্টিফেন হারপার ছিলেন তখনকার প্রধানন্ত্রী। ‘প্রিক্লিয়ারেন্স ইন কানাডা রেগুলেশনস’গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় গত বছর জুন মাসের ৪ তারিখে। আর তার ফলস্বরূপ দুই দেশের মধ্যে ডিপ্লোমেটিক নোট বিনিময় হয় গত ১৫ আগস্ট, ২০১৯ সালে এবং এই চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়িত হয়।
এর আগে প্রিক্লিয়ারেন্স সংক্রান্ত যে আইনটি ছিল তাতে কানাডার কোন নাগরিক বা ইমিগ্রেন্ট প্রি-ক্লিয়ারেন্স এলাকায় প্রবেশের পর ইউএস বর্ডার সিকিউরিটি বা কাস্টমস কর্মকর্তাদের আপত্তিকর প্রশ্নে বিব্রত বা অসন্তুষ্ট হলে তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ফিরে আসতে পারতেন। কিন্তু এখনকার আইনে ইউএস বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না দিয়ে কেউ ফিরে আসতে পারবেন না। তাকে বলতে হবে কেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ না করে ফিরে আসতে চাইছেন। প্রশ্নের উত্তর না দিলে বা প্রশ্নের উত্তরে ইউএস বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তাগণ সন্তুষ্ট না হলে তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে।
উল্লেখ্য যে, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে সীমান্তে প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর এই প্রক্রিয়াটি গত প্রায় ষাট বছর ধরেই চলে আসছে। সীমান্তে অত্যধিক ভিড় এড়াতেই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল ইতিপূর্বে।
প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর আগের আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রগামী কোন যাত্রীকে স্ট্রিপ সার্চ (গায়ের কাপর খুলে) করতে পারতেন শুধুমাত্র একজন কানাডীয় বর্ডার কর্মকর্তা। ঐ সময় কোন ইউএস বর্ডার এজেন্ট ইচ্ছে করলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে পারতেন। নতুন আইনে এখন একজন ইউএস বর্ডার এজেন্ট নিজেই এই স্ট্রিপ সার্চ এর কাজটি করতে পারবেন যদি কোনা কানাডীয় কর্মকর্তা তা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ না করেন বা তা করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। আর ইউএস বর্ডার এজেন্ট এর প্রশ্নের (যত আপত্তিকর বা অবমাননাকরই হোক) উত্তর দিতে না চাইলে একজন ভ্রমণকারী কানাডার আইনও ভঙ্গ করবেন এবং কানাডার ফেডারেল আইনে তিনি অভিযুক্ত হবেন।
ইতিপূর্বে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডারের একটি ঘটনা। মরক্কো বংশোদ্ভূত হিজাব পরিহিতা এক কানাডিয়ান মুসলিম মহিলা ফাদওয়া আলাওই মন্ট্রিয়ল এর উপশহর ব্রোসার্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলেন। সাথে তার দুই শিশু সন্তান ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক কাজিনও ছিলেন। ফাদওয়া আগেও অনেকবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন বিনা বাধায় তার বাবা মা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু সেবার তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডার গার্ড এর সদস্যরা বাধা দেন। প্রায় চার ঘন্টা আটকে রেখে তাকে নানান প্রশ্ন করেন। আর ঐ সব প্রশ্নের প্রায় সবই ছিল তার ধর্ম সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে তার কি অভিমত তাও জানতে চাওয়া হয় বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে। কিন্তু এত কিছু জিজ্ঞেস করার পরও ইউএস বর্ডার গার্ড এর সদস্যগণ তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি এবং তাকে বর্ডার থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ফিরিয়ে দেয়ার আগে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তুলে রাখা হয়। সিবিসি নিউজে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাদওয়া বলেন, আমি ইউএস বর্ডার গার্ডদের আচরণে খুবই অপমানিত ও বিষন্ন হই।
সিবিসি নিউজের পক্ষ থেকে তখন ইউএস কাস্টমস এ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন এর নিকট একটি ইমেইল পাঠানো হয়েছিল ফাদওয়ার বিষয়টি জানার জন্য। ইমেইলের উত্তরে বলা হয়, ইউএস কাস্টমস এ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন এর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয় হলো, দেশের অভ্যন্তরে যাতে জঙ্গী ও তাদের অস্ত্র প্রবেশ করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা। যারা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে আসেন নানান কাজে আমরা তাদের প্রতি বর্ডারে কোনরকম বৈষম্যমূলক আচরণ করি না তাদের ধর্ম, এথনিসিটি, লিঙ্গ প্রভৃতি বিচার করে।
যুক্তরাষ্ট্রে কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন প্রায় ১২ লক্ষ ভিজিটর এসে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এর মুখমুখি হন। এদের মধ্যে গড়ে তিন শত থেকে পাঁচ শত ভিজিটরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না।
উল্লেখ্য যে, কানাডীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে গিয়ে নানান রকম ঝক্কি-ঝামেলা ও অশোভন আচরণের মোকাবেলা করে আসছেন। এখন প্রি-ক্লিয়ারেন্স আইনে কিছু পরিবর্তন আনায় এই ঝক্কি-ঝামেলা ও অশোভন আচরণের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে এমনটাই আশংকা করছেন কেউ কেউ। কানাডিয়ান ক্রস-বর্ডার লিগ্যাল কোয়ালিয়শন এর টরন্টো কোঅর্ডিনেটর কোরী শেফম্যান সিবিসি নিউজকে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর কানাডিয়ান বিশেষ করে কানাডিয়ান মুসলিমদের প্রতি ইউএস কাস্টম কর্মকর্তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কানাডার একজন ইমিগ্রেশন আইনজীবী মাইকেল গ্রীন ইতিপূর্বে বলেছিলেন, “কানাডার নতুন এই আইন কানাডিয়ানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারকে হরণ করবে। সেটা হলো, তারা আগের মত প্রি-ক্লিয়ারেন্স এলাকা (যেটি কানাডার মাটিতেই অবস্থিত) থেকে নিজের ইচ্ছায় ফিরে আসতে পারবেন না যদি ইউএস বর্ডার গার্ডদের করা প্রশ্ন পছন্দ না করেন। ইউএস বর্ডার গার্ডরা শক্তি প্রয়োগ করতে পারবেন প্রশ্নের উত্তর আদায় করার জন্য। প্রয়োজন মনে করলে গ্রেফতারও করতে পারেন কানাডার মাটিতেই। মাইকেল গ্রীন বলেন, এটি বাস্তবিক অর্থেই আক্রমণাত্মক এবং অপমানকর একটি আইন।”
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য দাবী করেন যে, এই আইনের কারণে ‘কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম’এ কানাডার নাগরিকগদের যে অধিকার দেয়া আছে সেই অধিকার ইউএস বর্ডার এজেন্টদের তল্লাসীর কারণে ক্ষুন্ন হবে না। তিনি বলেন, “কেউ যখন প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর জন্য যাচ্ছেন কানাডার অভ্যন্তর থেকে তখন তিনি কানাডার চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম এর প্রটেকশনের আন্ডারেই থাকছেন।”
উল্লেখ্য যে, কানাডার বিমানবন্দর এবং অন্যান্য বন্দরে প্রি-ক্লিয়ারেন্স সম্পর্কিত নতুন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ইতিপূর্বে বিপুল সংখ্যক মানুষের ই-মেল বার্তা পেয়েছিল। নতুন আইনে মার্কিন সীমান্ত রক্ষীদেরকে যে ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ঐ সময় সিবিসি নিউজে একটি খবর প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ই-মেলের বন্যা বয়ে যায়। সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, জনগণের পক্ষ থেকে পাঠানো বার্তার সংখ্যা “নজীরবিহীন”এবং জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা এটা দেখে বিস্মিত হয়েছেন।
কিন্তু বার্তার সংখ্যা নজীরবিহীন হলে কি হবে বা কর্মকর্তারা বিস্মিত হলে কি হবে, বর্ডার সিকিউরিটি বা কাস্টমস কর্মকর্তাদেরকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা অনেক কানাডীয় নাগরিকের জন্যই চিন্তার বিষয়।
এক জরিপেও দেখা যাচ্ছে বেশীরভাগ কানাডিয়ানই মনে করছেন প্রিক্লিয়ারেন্স আইনের মাধ্যমে কানাডার মাটিতে আমেরিকান বর্ডার সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের অতিমাত্রায় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অহমঁং জবরফ ওহংঃরঃঁঃব পরিচালিত জরিপে এই তথ্য উঠে আসে।
সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমালোকচরা বলছেন এই আইন বিরক্তিকর এবং উপদ্রবকারী। ইউএস বর্ডার এজেন্টদেরকে অধিকতর ক্ষমতা দেয়ার অর্থ হলো যাত্রীদের নাজেহাল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া, বিশেষ করে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত একজন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছেন। তাছাড়া ট্রাম্প নিজেই বলেছেন তিনি বিশ্বাস করেন না যে ইউএস- কানাডা বর্ডার নিরাপদ। আর তিনি যে একজন চরম ইগ্রেন্ট বিদ্বেষী এবং একই সাথে মুসলিম বিরোধী তা এখন নতুন করে আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই আইনের প্রধান টার্গেট কানাডার মুসলিম সম্প্রাদায়। যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ ভূখন্ডে জঙ্গী হামলার আশংকায় থাকে সবসময়ই, আর সেই হামলা প্রতিরোধ করার জন্যই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের এই পদক্ষেপ। এই অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই আছে। একটি দেশের নাগরিকদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সেই দেশের সরকারেরই। আর সেটি করতে গিয়ে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করতেই পারে যে কোন দেশের সরকার। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে অন্য দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে কি না তা কি খতিয়ে দেখা উচিৎ নয়? কানাডার মাটিতেই কানাডিয়ানদের অধিকার মার্কিনীদের দ্বারা লঙ্ঘিত হবে সেটি কি লজ্জাজনক নয় কানাডা সরকারের জন্য?
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ