করোনায় বদলে যাওয়া ফোর্ড

সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০

খুরশিদ আলম

গত প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনের আগে ড্যাগ ফোর্ড এর ব্যাপারে সাবধান বা সতর্ক থাকার জন্য একটি স্লোগান প্রচার করা হয়েছিল ভোটারদের উদ্দেশ্যে। স্লোগানটি ছিল এরকম – ‘Beware of Doug Ford.’ অর্থাৎ ‘ড্যাগ ফোর্ড হইতে সাবধান’।

Beware of Doug Ford এর সরল বাংলা অনুবাদ যদিও ড্যাগ ফোর্ড হতে সাবধান এই অর্থ বোঝায় কিন্তু এর নিগূঢ় অর্থ যে কি সেটা সেদিন বুঝে নিয়েছিলেন সবাই। কৌশলে ড্যাগ ফোর্ডকে নিয়ে ব্যঙ্গ করার একটা জুতসই স্লোগান ছিল এটি।

কেউ কেউ তখন ড্যাগ ফোর্ডকে নর্দান ট্রাম্প বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহা ‘কীর্তিমান’ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর সঙ্গে ড্যাগ ফোর্ডের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তারা কোন কোন ক্ষেত্রে। আর সে কারণেই ড্যাগ ফোর্ডকে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর সঙ্গে তুলনা করা হতো।

তবে এই সব সমালোচনা ও ব্যঙ্গকে উপেক্ষা করে গত প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে ড্যাগ ফোর্ড সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বিপুল ভোট পেয়ে তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন এবং ক্ষমতার মসনদে আসন গ্রহণ করেন সগর্বে। ঐ নির্বাচনে তখনকার ক্ষমতাসীন দল লিবারেল পার্টির পরাজয় ঘটে অত্যন্ত লজ্জাজনক ভাবে। ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়ে সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদাও পায়নি দলটি। পার্লামেন্টে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে কমপক্ষে ৮টি আসন পেতে হয়। লিবারেল পেয়েছিল মাত্র ৭টি আসন।

ঘুরে দাড়িঁয়েছেন ড্যাগ ফোর্ড। অন্টারিওতে করোনা নিয়ন্ত্রণে জোরালো ভূমিকা রেখে জনপ্রিয়তা আবারো ফিরে পেয়েছেন।  ছবি: ব্রাম্পটন গার্ডিয়ান

কিন্তু ড্যাগ ফোর্ডের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামতে বেশী সময় লাগেনি। এক বছরেই একেবারে তলানীতে নেমে এসেছিল তার জনপ্রিয়তা। যে দলটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল লিবারেলকে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল সেই অন্টারিওর প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান ও প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডের অবস্থা এক বছরের মাথায় লিবারেল পার্টির পরাজিত নেত্রী ক্যাথলিন উইনের চেয়েও খারাপ অবস্থায় নেমে আসে। মেইনস্ট্রিট রিসার্স কর্তৃক পরিচালিত এক জরীপে তখন দেখা গিয়েছিল অন্টারিওবাসীদের মধ্যে শতকরা ২০ জন ড্যাগ ফোর্ডকে পছন্দ করেন। কিন্তু তাকে অপছন্দ করেন এমন অন্টারিওবাসীর সংখ্যা তখন দাড়িয়েছিল শতকরা ৭৩ জনে। আর দিন যতই যাচ্ছিল ততই ড্যাগ ফোর্ডের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছিল। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তখন এ তথ্য জানান মেইনট্রিট রিসার্সের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিইটো ম্যাজি। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কখনো দেখিনি কোন ক্ষমতাসীন প্রিমিয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে জনগনের এতটা বিরাগভাজন হয়ে উঠেছেন।’

ড্যাগ ফোর্ডের সমস্যাটা তাহলে কোথায় ছিল? তিনি এমন কি কর্ম বা অপকর্ম করেছিলেন যে এক বছরের মাথায়ই তার জনপ্রিয়তায় এমন ধ্বস নেমেছিল! এমনকি তার দলের লোকেরাই তখন তাকে অপছন্দ করছিল! ঐ সময় তার দুইজন ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী কর্মকর্তা কি কারণে তাকে ত্যাগ করেছিলেন?

‘নাউ’ এর মতে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম এক বছরে বিভিন্ন খাতে ড্যাগ ফোর্ডের অপরিকল্পিত ব্যয় সংকোচন এর উন্মাদনা এবং নিজ প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার কারণে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। শতকরা ৭৫ জনই তখন তাকে পছন্দ করছিলেন না।

কিন্তু সেই প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন! আবার তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ড্যাগ ফোর্ড এখন অন্য এক মানুষ। সেই অহমিকা ও দাম্ভিক আচরণ আর নেই তার মধ্যে। তিনি এখন সত্যিই জনগণের নেতা হয়ে সামনের কাতারে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিদিন তিনি জনগনের হয়ে কথা বলছেন। আর এটি সম্ভব করে তুলেছে কভিড-১৯ নামের অদৃশ্য এক অনুজীব বা ভাইরাস!

মহা শক্তিশালী এই ভাইরাস পাল্টে দিয়েছে গোটা পৃথিবীর দৈনন্দিন চালচিত্র। পাল্টে দিয়েছে অর্থনীতির গতিবিধি, সামাজিক চিত্র, মানুষে মানুষে সম্পর্ক এবং সর্বোপরি নেতাদের চরিত্র! অনেক স্বৈরাচারী শাসক হয়ে উঠেছেন মানবিক, আবার কোন কোন নেতা হয়ে উঠেছেন চরম দায়িত্বহীন। তাদের এই চরম দায়িত্বহীনতার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এই দায়িত্বহীনদের মধ্যে পালের সেরা… হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই কাতারে আরো আছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারো। এই দুই নেতার দেশে কয়েক লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। কারণ শুরু থেকে তারা তাদের দেশে কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেননি। উল্টো করোনা নিয়ে তামাশা করেছেন। এখনো করছেন। আর তার বলি হচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ।

তাদের তুলনায় আমরা ড্যাগ ফোর্ডকে অনেক উন্নত মানের নেতা বলতেই পারি। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি অন্টারিওতে করোনা প্রতিরোধে যা যা করা দরকার তার সবই করেছেন। নিয়েছেন কঠিন সব সিদ্ধান্ত। কানাডায় করোনায় সবচেয়ে বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন যে কটি প্রভিন্সে তার মধ্যে অন্টারিও অন্যতম। কিন্তু তারপরও ড্যাগ ফোর্ডের নেতৃত্বে যথাযথ পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে করোনাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছে এই প্রভিন্স। আগস্টের শেষের দিকে প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এক শতের কাছাকাছি সীমাবদ্ধ ছিল।

অন্টারিওতে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষও বড় ভূমিকা রেখেছেন। তারা চিকিৎসকদের পরামর্শ ও সরকারের নির্দেশ যথাযথভাবে মেনে চলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেছেন। মাস্ক পরেছেন। শেষের দিকে অবশ্য তরুণ সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যে কিছুটা বেহিসাবীপনা লক্ষ্য করা গেছে। তারা সামাজিক দূরত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। ফলে নতুন আক্রান্তদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই বেশী দেখা যাচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬০ বা তারো বেশী তরুণ সম্প্রদায়ের সদস্য। ড্যাগ ফোর্ড বার বার তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সতর্ক হওয়ার জন্য। অন্যদিকে যারা অন্টারিও পার্লামেন্টের সামনে জড় হয়ে করোনা কালে সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন তাদেরকে ‘এ বাঞ্চ অব ইয়াহু’ বলে কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন।

শুরুর দিকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সদের ব্যবহারের জন্য পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট এর চরম সংকট দেখা দিয়েছিল। ড্যাগ ফোর্ড হন্যে হয়ে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেছেন এগুলো সংগ্রহের জন্য। এমনকি স্বশরীরে গিয়ে হাজির হয়েছেন ফ্যাক্টরিতে তা সংগ্রহের জন্য। রাজনৈতিক জীবনের চরম শত্রু লিবারেল দলের সঙ্গেও সমঝোতা করেছেন করোনার হাত থেকে জনগণের জীবন রক্ষার জন্য। লিবারেল দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি তার অন্যতম সুহৃদ বানিয়েছেন যার সাথে করোনার আগে কোন বিষয়েই বনাবনি হতো না। এ সবই ড্যাগ ফোর্ড করেছেন অন্টারিওর জনগণের কল্যানের জন্য। আর এতে করে তিনি ফলও পেয়েছেন। ফল পেয়েছেন দুদিক থেকেই। প্রথমত, তিনি করোনা নিয়ন্ত্রণে সুফল পেয়েছেন। আর দ্বিতীয়ত, নিজের জনপ্রিয়তা ফিরে পেয়েছেন। এমনকি যারা তাকে এতদিন পছন্দ করতেন না তারাও তার প্রতি সদয় হয়ছেন।

অথচ ক্ষমতা গ্রহণের পর আমরা অন্টারিওবাসীরা অন্য এক ড্যাগ ফোর্ডকে দেখেছিলাম। তিনি প্রিমিয়ার নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা দেন সিটি কাউন্সিলর এর সংখ্যা ৪৭ থেকে নামিয়ে ২৫ করবেন। তার ঐ ঘোষণা নিয়ে তখন তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি আদালত পর্যন্তও গড়ায়। তবে শেষ পর্যন্ত ড্যাগ ফোর্ডেরই বিজয় হয়। এবং ২৫ টি ওয়ার্ডেই সিটি কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পর ড্যাগ ফোর্ডের কাট-ছাটের উৎসব অব্যাহত থাকে। শুরুর দিকেই তিনি বাতিল করে দেন স্বল্প আয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ফ্রি টিউশন’ এর সুযোগ। ফ্রি টিউশন প্রক্রিয়া বাতিল করে দিয়ে সরকার কি পরিমাণ অর্থ বাঁচাতে পারবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। টরন্টো স্টার এর এক সম্পাদকীয়তে তখন বলা হয়, “এ সবই শিক্ষার্থীদের জন্য খারাপ খবর। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা এই প্রভিন্সে যে মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছে সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

উল্লেখ্য যে, সাবেক লিবারেল সরকার ‘অন্টারিও স্টুডেন্ট গ্র্যান্ট’ নামে একটি প্রকল্প সৃষ্টি করেছিল যার মাধ্যমে নিন্ম আয়ের পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরা বাস্তব অর্থে ফ্রি লেখাপড়া করতে পারতেন। ২০১৭/১৮ স্কুল বর্ষ থেকে শুরু হয়েছিল ঐ প্রকল্প।

ড্যাগ ফোর্ডের আরো ‘কীর্তি’ হলো, ক্ষমতায় এসেই তিনি অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী ঘন্টায় ১৫ ডলার করার পরিকল্পনাকেও স্থগিত করার ঘোষণা দেন। বিগত লিবারেল সরকারের করা fair workplaces better jobs act  অনুযায়ী এ ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাস থেকে ন্যূনতম মজুরী ১৫ ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল।

উল্লেখ্য যে, অন্টারিওতে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের কর্মীদেরকে উপযুক্ত বেতন দিচ্ছেন না, দিচ্ছেন না ভেকেশন পে এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধাও। ফলে এই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণ বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের পাওনা অধিকার থেকে। বিভিন্ন কর্মস্থলে শ্রম মন্ত্রণালয় পরিচালিত তদন্তে দেখা গেছে অন্টারিও’র শ্রম আইনের লংঘন হচ্ছে শতকরা ৭৫ থেকে ৭৭ ভাগ ক্ষেত্রেই। খবরটি প্রকাশ করে কানাডিয়ান প্রেস।

হাফিংটন পোস্ট ইতিপূর্বে তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, অন্টারিওর সাবেক লিবারেল সরকার কয়েক দফায় ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি করলেও চাকরীর বাজারে তার বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। অনেক অর্থনীতিবিদও ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি করার ফলে চাকরীর বাজারে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। চাকরী হারাবেন অনেকে এবং নতুন কোন চাকরী সৃষ্টি হবে না। টিডি ব্যাংক এর ভবিষ্যতবাণী ছিল ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির ফলে এই প্রভিন্সে প্রায় ৯০ হজার লোক চাকরী হারাবে। ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ ‘রেস্টুরেন্ট কানাডা’র সতর্কবাণী ছিল, ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি এবং অন্যান্য নতুন লেবার ল এর কারণে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার চাকরী হুমকীর মুখে পড়বে।

কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে বাস্তবে তার কোনটাই ঘটেনি। অবশ্য ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির পর কিছু কিছু চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠান আত্মরক্ষার নামে কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা কর্তন করে। কিন্তু দেখা গেল অন্টারিওতে যখন ন্যূনতম মজুরী ১৪ ডলারে উন্নীত করা হয় তখন পরবর্তী ছয় মাসেও নতুন চাকরী সৃষ্টিতে তা নেতিবাচক কোন প্রভাব ফেলেনি। বেকারত্বের হার কমে এসে ৫.৪ এ ঠেকেছিল। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব এটি। এবং গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ম বেকারত্বের হার ছিল এটি।

অন্যদিকে ড্যাগ ফোর্ড বর্ণবাদী এমন অভিযোগও রয়েছে। ড্যাগ ফোর্ড অন্টারিও’র প্রিমিয়ার নির্বাচিত হওয়ার পর হাফিংটন পোস্ট এর কলামিস্ট ডেভিড মাস্ট্রাচি লিখেছিলেন, “গত ৭ই জুনের নির্বাচনে প্রোগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ী হয়ে গত ১৫ বছরে এই প্রথম বারের মত ক্ষমতায় এলো। এই বিজয় পার্টির নেতা ড্যাগ ফোর্ডের জন্যে দারুন একটা বিজয় ছিল। এবং সেদিক থেকে এটা ছিল শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের বিজয়। কারণ হলো এই যে, ফোর্ড ছিলেন চরম ডান পন্থীদের পছন্দের প্রার্থী। ”

তিনি আরো লিখেন, “আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে চরম বর্ণবাদী Alt-right group এবং the Proud Boys  ফোর্ডকে “Proud Boy of the month,” হিসাবে উল্লেখ করেছে। এখন এদের স্বপ্ন হলো ফোর্ড ‘Will Make Ontario Great Again’। এই জাতীয় স্লোগান নির্বাচনের আগে দিয়ে আসছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় তার সমর্থকদের উদ্দেশে।”

গত নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ড্যাগ ফোর্ড বরাবরই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু ঐসব বিতর্কের ফলাফল তার জন্য ইতিবাচক হয়নি। তার জনপ্রিয়তায় বিপুলভাবে নেমেছিল ধ্বস।

আসলে ড্যাগ ফোর্ড বরাবরই ছিলেন বিতর্কের মধ্যে। প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনের আগেও তাকে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। তিনি এক সময় ড্রাগ ডিলার ছিলেন এমন খবরও কানাডার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা গ্লোব এন্ড মেইলে প্রকাশিত হয়েছিল ইতিপূর্বে।

সেই ফোর্ড এখন অন্টারিওতে রাতারাতি সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়ে গেছেন। গত বছরের তুলনায় এটি বড় ধরণের পরিবর্তন। অন্টারিও’র বিরোধী দলের নেতারাও তেমন কোন ফাঁক খুঁজে পাচ্ছেন না ড্যাগ ফোর্ডকে কোন ইস্যুতে ঘায়েল করার জন্য।

অন্টারিওতে যখন করোনা টেস্ট করা হচ্ছিল সীমিত মাত্রায়, তখন ড্যাগ ফোর্ডই প্রতিদিন ন্যূনতম বিশ হাজার লোকের করোনা টেস্ট করানোর জন্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের চাপ দিতে থাকেন। তিনি এমনও হুমকী দেন যে, করোনা টেস্ট বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে তিনি ৮০০ পাউন্ডের বিশাল গড়িলার মত স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসবেন।

কানাডার মেইনস্ট্রিম ম্যাগাজিন ম্যাকলিন’স এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, অন্টারিও’র প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটভ পার্টির সিনিয়র কর্মকর্তারাও বলছেন করোনা মোকাবেলা করার জন্য ড্যাগ ফোর্ড তার পক্ষপতিত্বকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। ফেডারেল সরকারে যারা তার শত্রু ছিলেন তাদেরকেও তিনি সহসাই মিত্র বানিয়েছেন। তার মোবাইল ফোনকে কমান্ড সেন্টার বানিয়েছেন এবং অধিক রাত পর্যন্ত তা খোলা রাখছেন যোগাযোগ রক্ষা ও নির্দেশ দেওয়ার জন্য। তার চরিত্রের সঙ্গে বেমানানভাবে তিনি কোমল আচরণ করছেন, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন, স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশংসা করছেন।

তবে করোনা মোকাবেলায় ড্যাগ ফোর্ডকে যে সমালোচনার মুখমুখি হতে হয়নি তা কিন্তু নয়। কারণ, দেখা গেছে অন্টারিওতে লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে করোনার হামলা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি যথাযথভাবে। প্রায় তিন হাজার বয়স্ক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এই লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ড্যাগ ফোর্ডের সরকার। লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে আগে থেকেই প্রচুর অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান ছিল। জীবন যাপনের অবস্থা ছিল খারাপ। কর্মী স্বল্পতা ছিল প্রকট। করোনার হামলা শুরু হওয়ার পর এই অব্যবস্থাপনা ও কর্মী সংকটের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে যখন প্রতিদিনই লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। অবস্থা বেগতিক হয়ে দাঁড়ালে সেখানে জরুরী ভিত্তিতে সেনা মোতায়েন করা হয়। সেনা মোতায়েনের কয়েক সপ্তাহ পরে বেরিয়ে আসে আরেক নির্মম চিত্র। লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে লিভিং কন্ডিশন খুব খারাপ অবস্থায় আছে এমন এক রিপোর্ট প্রকাশ করে নিয়োজিত ঐ সেনারা।

অন্যদিকে বিরোধী দল এনডিপি নেতা এ্যন্ড্রিয়া হরওয়াথ অভিযোগ করে বলেন, ‘করোনা মোকাবেলায় জরুরী আইন পাশ করার ক্ষেত্রে আমরা বিরোধী দল হিসাবে সহায়তা করেছি। কিন্তু আইন পাশের পর ড্যাগ ফোর্ড আর বিরোধী দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না।’

কানাডিয়ান ম্যাগাজিন ম্যাকলিন’স এক রিপোর্টে উল্লেখ করে এই বলে যে, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর ড্যাগ ফোর্ড প্রথম ভুলটা করেন যখন তিনি অন্টারিওবাসীদেরকে মার্চ ব্রেকের সময় ভ্রমণে রেরিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। এই আহ্বানটা তিনি জানান মার্চের ১২ তারিখে। তবে করোনা পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যাচ্ছে এ বিষয়টি টের পেয়ে তিনি ঐ দিনই ঘোষণা দেন স্কুল দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকবে। পরের দিন তিনি রাজধানী অটোয়ায় যান ফার্স্ট মিনিস্টারদের এক বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে তিনি জানতে পারেন যে বৈঠক হঠাৎ করে বাতিল করা হয়েছে। ড্যাগ ফোর্ড তার দলবল নিয়ে ফিরে আসেন টরন্টোতে এবং পরের দিন জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী সোফি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন যার কারণে জাস্টিন ট্রুডোও আইসোলেশনে গিয়েছেন।

ড্যাগ ফোর্ড বিশ^ব্যাপী করোনা পরিস্থিতি অবলোকন করে ১৭ মার্চ অন্টারিওতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। ২৩ মার্চ নন-এসেন্সিয়াল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেন। প্রতিদিনই তিনি সংবাদ সম্মেলন করে প্রভিন্সের করোনা পরিস্থিতিতে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তা জনগণকে অবহিত করেন। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি কখনো কখনো তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। কণ্ঠ কেঁপে উঠতেও দেখা গেছে তার। এই তথ্য জানায় ম্যাকলিন’স ম্যাগাজিন।

এই আবেগী ও দায়িত্ববান ড্যাগ ফোর্ডকে আগে কেউ দেখেনি। তিনি করোনার কারণে সম্পূর্ণ বদলে যান। হয়ে উঠেন একজন জনদরদী নেতা। Angus Reid Institute  এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ড্যাগ ফোর্ডের জনপ্রিয়তা ৩৮ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে গত ফেব্রুয়ারির তুলনায়। কানাডায় করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ঐ সময় থেকেই। অন্টারিও’র ৬৯% অধিবাসী মনে করেন ড্যাগ ফোর্ড তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন। মাস চারেক আগে এই রেটিং ছিল মাত্র ৩১% যা ছিল সর্বনিম্ম রেকর্ড।

অবশ্য কানাডার অন্যান্য প্রভিন্সের প্রিমিয়ারগণের এপ্রুভাল রেটিংও বৃদ্ধি পেয়েছে করোনা পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ অবদান রাখার জন্য। রেটিং বৃদ্ধি পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোরও।

তবে আগস্টের শেষের দিকে ও সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ড্যাগ ফোর্ডকে স্কুল খোলা নিয়ে ব্যাপক সামলোচনা মুখে পড়তে হয়। অভিভাবক ও শিক্ষকদের বেশীরভাগই চাচ্ছেন না এই সময় স্কুল খোলা হোক। কারণ তারা এখনো নিরাপদ বোধ করছেন না করোনার কারণে। গত কয়েকদিনে অন্টারিওতে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ড্যাগ ফোর্ড স্কুল খোলার ঘোষণা দিয়ে বসে আছেন। অবশ্য তিনি একথাও বলছেন যে, পরিস্থিতি খারাপ হলে স্কুল আবারো বন্ধ করে দেয়া হবে।

ড্যাগ ফোর্ড অন্টারিওর প্রিমিয়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন আরো প্রায় দুই বছর। আগামী ২০২২ সালের জুন মাসের ২ তারিখে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ঐ নির্বাচন সময়মত হবে কি না তাও বলা যাচ্ছে না এখন। সবকিছুই নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির উপর। তাছাড়া ড্যাগ ফোর্ডের উপর সত্যিকার অর্থে কতটা নির্ভর করা যায় সে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। তিনি যে আবার তার পুরাতন রূপে ফিরে আসবেন না তার গ্যারান্টি কি?

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ