করোনায় অতি মাত্রায় আতঙ্কিত না হয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখুন : আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে

এপ্রিল ৯, ২০২০

খুরশিদ আলম

করোনা (COVID-19) নিয়ে আমরা যদি খুব বেশী আতঙ্কগ্রস্ত হই বা উদ্বিগ্ন হই তাহলে আমরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বো। আর মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার অর্থ হলো শারীরিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়া। আর শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার অর্থ হলো করোনায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলা। সেটি নিশ্চই কারোরই কাম্য হতে পারে না।

এখানে আরেকটি রোগের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যার নাম ইনফ্লুয়েঞ্জা (ভাইরাস-ঘটিত একধরনের ছোঁয়াচে সর্দিজ্বর)। এই রোগটি সম্পর্কে সকলেরই ধারণা আছে এবং এতে আক্রান্ত হননি এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে আছে বলে মনে হয় না। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে কত মানুষ মারা যান তার একটা তথ্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এর হিসাব অনুযায়ী দেখা গেছে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন এই রোগে। অল্পমাত্রা বা মধ্যমাত্রায় যারা আক্রান্ত হন তাদের হিসাব এখানে ধরা হয়নি। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত এই ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রতি বছর মারা যান প্রায় আড়াই লাখ থেকে ৫ লাখ মানুষ।

কিন্তু COVID-19 ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত (৭ এপ্রিল, ২০২০) বিশ্বজুড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৮০ হাজার মানুষ। COVID-19 ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে চীনের উহান প্রদেশে গত বছর ডিসেম্বরে। এই লেখা যখন লিখছি তখন উহানের ঘটনার পর প্রায় চার মাস পার হয়ে গেছে। এবং এই চার মাসে বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৩ লাখ ৪৮ হাজারে এবং মৃতের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির হিসাব এটি। জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েও গত চার মাসে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছন ৮০ হাজার মানুষ। এখন ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃতের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করলে করোনায় মৃতের সংখ্যা কি খুব বেশী?

আমরা দেখেছি, গত প্রায় চার মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে বছরে যদি ৫ লাখ মানুষ মারা যান তবে প্রতি মাসে মৃতের সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ৪১,৬৬৬ জনে। আর চার মাসে মৃতের সংখ্যা দাড়ায় ৪১৬৬৬x ৪= ১,৬৬,৬৬৬ জনে। অর্থাৎ ৪ মাসে করোনায় মৃতের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার আর ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার।

প্রিয় পাঠক, উপরের হিসাব থেকে আমরা যে বার্তাটি পাচ্ছি তা হলো, ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে যে সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছেন তা নিয়ে যদি আমাদের অতিমাত্রার আতঙ্ক না থাকে তবে করোনো নিয়ে অতিমাত্রায় আতঙ্কিত হওয়ার সময় বোধ হয় এখনো আসেনি। আর অতিমাত্রায় আতঙ্কিত হলে মানুষের শরীর ও মনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। সেই প্রভাবে দুর্বল হয়ে যায় শরীর ও মন। দুর্বল হয়ে যায় শরীর ও মনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আর তখন করোনাসহ অন্যান্য রোগের আক্রমণের পথ সুগম হয়।

তবে এ কথাও সত্যি যে, আমরা এখনো জানি না আগামী দুই বা তিন মাসে বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিবে। হয়তো নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে অথবা আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তখন মৃতের সংখ্যা হয়তো ইনফ্লুয়েঞ্জাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে আশার কথা এই যে, করোনা ভাইরাসের উপত্তিস্থল চীনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এসেছে। ইটালী ও স্পেনেও কমে আসছে আক্রান্তের সংখ্যা। কমে আসছে থাইল্যান্ডেও। এবং আমাদের কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়াতেও কমে আসছে সংক্রমনের হার। সুতরাং আমরা আশা করতেই পারি যে কানাডাসহ অন্যান্য দেশেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। তাই আশাহত হওয়ার কোন কারণ নেই এবং অতিমাত্রায় আতঙ্কিত হওয়ারও কোন কারণ নেই। তাছাড়া কানাডার পরিস্থিতি এখনো ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেকটাই ভাল অবস্থায় আছে। আর পৃথিবীতে কোন ভাইরাসের আক্রমণই বেশী দিন মারাত্মক আকারে অব্যাহত থাকেনা। একটা পর্যায়ে গিয়ে তা স্তিমিত হয়ে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সার্স, ইবোলা ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব দেখেছি। এর কোনটাই কিন্তু বেশীদিন টিকে থাকেনি। সুতরাং COVID-19 ও বেশীদিন টিকে থাকবে না।

আর COVID-19 এ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হারও কিন্তু বেশী নয়। বিশেষ করে যাদেরে বয়স অল্প তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার অনেক কম। সেন্টার ফর এভিডেন্স-বেসড মেডিসিন এর তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যাদের বয়স ১০ থেকে ১৯ এর মধ্যে তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ০.১৮%। ২০ থেকে ৪৯ যাদের বয়স তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ০.৩২%। ৫০ থেকে ৫৯ যাদের বয়স তাদের বেলায় মৃত্যুর হার ১.৩%। ৬০ থেকে ৭০ যাদের বয়স তাদের বেলায় মৃত্যুর হার ৩.৬%। ৭০ থেকে ৭৯ যাদের বয়স তাদের বেলায় মৃত্যুর হার ৮.০% এবং ৮০+ যারা তাদের বেলায় মৃত্যুর হার ১৪.৮%। সুতরাং যারা অল্প বয়সী, এমনকি ৭০ পর্যন্ত যাদের বয়স তাদের ক্ষেত্রেও অতিমাত্রায় আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। আর এমনো দেখা গেছে, ৯০+ বয়সী লোকদের মধ্যেও কেউ কেউ সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ভয়টা একটু বেশী যদি তাদের অন্য কোন শারীরিক জটিলতা থাকে। যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, হৃদ রোগ, ফুসফুস জটিলতা ইত্যাদি।

তবে করোনা নিয়ে অতিমাত্রায় আতঙ্কিত না হয়ে স্বাভাবিক মাত্রায় আতঙ্কিত থাকার প্রয়োজন আছে। তাতে করে লোকজন সাবধান হবে। এবং সাবধানে থাকলে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সীমিত থাকবে। করোনা ভাইরাসের অন্যতম একটি সমস্যা হলো, এটি অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে কোন সিম্পটম বা লক্ষণ না থাকলেও সে ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই এই সংকটকালে জরুরী কোন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে অন্য লোকদের কাছ থেকে অন্তত ৬ ফুট দূরত্বে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন ডাক্তারগণ। এছাড়াও ঘন ঘন হাত ধোয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন ডাক্তারগণ।

COVID-19 এর আক্রমণ থেকে নিজেকে কি ভাবে মুক্ত রাখা যায় তার বিস্তারিত পরামর্শ দেওয়া আছে ‘পাবলিক হেলথ এজেন্সী অব কানাডা’র ওয়েবসাইটে (https://www.canada.ca/en/public-health/services/diseases/2019-novel-coronavirus-infection/awareness-resources.html)। সরকারী এই ওয়েবসাইটে পরামর্শের কিছু অংশ বাংলায়ও দেওয়া আছে। প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইট ও প্রিন্ট কপিতেও (পৃষ্ঠা ১০) বাংলায় অনুবাদ করা পরামর্শগুলো দেওয়া আছে। সংকটের এই মুহুর্তে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য ‘পাবলিক হেলথ এজেন্সী অব কানাডা’র পরামর্শ অনুসরণ করাই উত্তম।

করোনার এই মহামারি কালে কেউ যদি অতিমাত্রায় আতঙ্কিত হয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন বা মানসিক রোগে আক্রান্ত হন তবে তাকে নানারকম সমস্যার মুখে পড়তে হবে। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা হতে পারে তার মনোরোগের চিকিৎসা নিয়ে। কারণ, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই মানসিক রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে বিস্তর সময় লাগে। আর এখন তো এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জরুরী প্রয়োজন না হলে ক্লিনিক বা হাসপাতালে যাওয়াটাও এখন ঝুঁকিপূর্ণ।

মনোবিজ্ঞানী লিটন বড়–য়ার মতে ‘ভয়, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ যদি একই সঙ্গে আপনার মনকে গ্রাস করে এবং আপনার মন এই তিনটি নেতিবাচক অনুভূতির বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রতিরোধের দেয়াল তুলতে না পারে, তবে আপনি যেকোনো সময় আতঙ্কিত হয়ে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আপনার বিবেক, বুদ্ধি, বোধ, যুক্তি কোন কিছুই ঠিকঠাক মত কাজ করবে না। হরেক রকম অনির্ভরযোগ্য তথ্য আপনাকে আতঙ্কিত করে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক সবচেয়ে বিপজ্জনক। ফেসবুকের হরেক রকম অনির্ভরযোগ্য তথ্য আপনাকে আতঙ্কিত করে তুলতে পারে।’

মনোরোগ চিকিৎসক মেখলা সরকার বলেন, ‘করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। যে জিনিসটা আমরা আসলে জানি না, সেই জিনিসটা আমাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করে। অনিশ্চয়তা থেকে আমাদের মধ্যে একধরনের ভয় হয়। ভয়টা আতঙ্কে রূপ নিতে পারে। যখন মানুষের করার কিছু থাকে না, তখন কিন্তু মানুষের মধ্যে একধরনের অসহায়ত্ব তৈরি হয়। অসহায়ত্ব মানুষের মধ্যে একধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। আর যখনই উদ্বেগ, ভয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক বডি (শরীর) থেকে কিছু নিউরো কেমিক্যাল মোবিলাইজড করে। এটা যদি ক্রনিক হয়ে যায়, তখন আমাদের মধ্যে কিছু উপসর্গ তৈরি হয়। আমাদের যে ইন্টারনাল অর্গান সিস্টেম আছে, যেমন: ফুসফুস, লিভার, কিডনি, সেটাকে কিন্তু ইফেক্ট করবে।’

মেঘলা সরকারের এই বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে আতঙ্কিত হলে আমাদের শরীরের ভাইটাল অর্গান বা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো প্রভাবিত হয়। এর মধ্যে একটি হলো আমাদের ফুসফুস। আর যারা কঠিনভাবে করোনায় আক্রান্ত হন তাদের ফুসফুস বিকল হয়ে যেতে পারে এবং অন্যান্য অঙ্গও বিকল হয়ে যেতে পারে যার কারণে মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরী হয়। ফুসফুস আক্রান্ত হলে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা তৈরী হয়। পরিণামে নিউমোনিয়াও হতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া হলে বাঁচার সম্ভাবনা কমে যায়। তাই আতঙ্কিত হওয়া চলবে না।

করোনার ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতের হায়দরাবাদে অবস্থিত এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজির (এআইজি) চেয়ারম্যান ও পদ্মভূষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক জি পি নাগেশ্বর রেড্ডি। দি নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এ ভাইরাসকে ঘিরে নানা কাহিনী আর মিথ্যা সংবাদ তৈরি হয়েছে। প্রথম কথা হলো, আমাদের ভীত হওয়া যাবে না একেবারেই। এমন কোনো ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়নি যে আমাদেরকে ভীত হতে হবে। সাধারণভাবে যাঁদের বয়স সত্তেরর বেশি এবং যাঁদের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন বা ক্যানসার আছে, তাঁদেরকে এই ভাইরাস মারাত্মকভাবে ঘায়েল করতে পারে। কিন্তু এমন শারীরিক সমস্যা না থাকলে ৬০-৬৫ বছর বয়সীদেরও ভয়ের কারণ নেই। শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান যে কারও জন্য এই ভাইরাস বড় কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। ভয় দূর করতে হবে।’

নাগেশ্বর রেড্ডি আরো বলেন, ‘যে বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে না, তা হলো মানসিক স্বাস্থ্য। এই ভীতির কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ, যারা মানসিকভাবে শক্ত ও সুখী, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। আমরা হতাশ হয়ে গেলে ভালো থাকব না।’

ডাক্তার নাগেশ্বর রেড্ডি এ কথাগুলো বলেছেন ভারতের প্রেক্ষাপটে। তবে অন্যান্য দেশের প্রেক্ষিতেও কথাগুলো গুরুত্ব বহন করে অবশ্যই। আর সংকটের মুহুর্তে গুজবে কান না দেওয়া হলো নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখার একটি বড় উপায়। আজকের যুগে গুজবের প্রধান উৎস হলো ফেসবুকসহ নানারকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কিছু কিছু অনলাইন মিডিয়াও আছে যেগুলোর কর্ণধার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত তথাকথিত সম্পাদকগণ (সাংবাদিকতায় যাদের কোন অভিজ্ঞতাই নেই) কোন কিছু যাচাই বাছাই না করেই এমন সব সংবাদ পরিবেশন করেন যার মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরী হয়। আমরা জানি, সাধারণ মানুষ নেতিবাচক সংবাদের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হন। আবার একশ্রেণীর মানুষ আছেন যারা যে কোন সংবাদকেই লুফে নেন। নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে কোন কিছু বিচার করেন না বা সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখেন না। এর একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে ভারতের একটি ঘটনা থেকে। বিবিসি’র এক খবরে বলা হয়, ‘ভারতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ যত বাড়ছে, ততই নানা দিকে গোমূত্র এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারে – এমন প্রচার চালাচ্ছেন কিছু ব্যক্তি এবং সংগঠন। আর এই প্রচারে প্ররোচিত হয়ে শিবু নামের এক যুবক গোমূত্র পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন আগে এক বোতল গোমূত্র দিয়ে তৈরি গো-আরক কিনেছিলাম। চারদিকে এত করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে, অনেকেই দেখছি গোমূত্র খাওয়ার কথা বলছে। তাই আমিও এক ছিপি খেয়েছিলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই গলা, বুক, পেট পুরো জ্বলে যাচ্ছিল। জল খেয়েও স্বস্তি পাই নি। তাই হাসপাতালে যেতে হয়েছিল।’

মূলত যে কোন সংকটের মুহ‚র্তে মনোবল ধরে রাখতে না পারলে মানুষ যে শুধু শারীরিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ে তা নয়, নানারকম দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে তাদের জীবনে। এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দেয় কারো কারো মধ্যে।

আজকে করোনা ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে যে আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, আমরা সবাই আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আমরা জানিনা আগামী দিনগুলোতে আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কি হবে। আমরা জানিনা খাদ্য সংকট দেখা দিবে কি না। আমরা জানিনা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাব কি না। কারণ ইতিমধ্যেই চিকিৎসা খাতে নানারকম সংকট দেখা দিয়েছে। মাস্ক, এপ্রোন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা সামগ্রীর সংকট দেখা দিয়েছে হাসপাতালগুলোতে। যে হারে রোগী বাড়ছে তাতে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এরও সংকট দেখা দিচ্ছে। যাদের ক্রনিক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হার্ট এর সমস্যা, প্রেসারসহ আরো নানান রোগ রয়েছে তারাও উদ্বগ্ন। উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ, ঔষধ শেষ হয়ে গেলে তারা সময়মত নতুন করে ঔষধ সংগ্রহ করতে পারবেন কিনা।

আজকে এই চরম সংকটের মুহুর্তে যারা ফ্রন্টলাইনে কাজ করছেন তাদের মধ্যে আছেন ডাক্তার, নার্স, এম্বুলেন্স কর্মী, ফার্মাসিস্ট, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মী, গ্রোসারী বা সুপাস্টোরের কর্মী, ডেলিভারী কর্মী, পরিবহন সেক্টরের কর্মীসহ আরো কিছু কর্মী। এরা নিজেদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে আছে জেনেও জনগনের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরকে এখন জাতীয় বীর বলে আখ্যায়িত করা হচেছ। এই বীরদের কথা চিন্তা করুন। তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিন। মানসিক সংকট বা অতি মাত্রায় আতঙ্কিত হওয়ার প্রবনতা বাহুলাংশেই কমে আসবে।

বিশেষজ্ঞরাও এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে এই ভাইরাস প্রতিরোধে সবাইকেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। কানাডিয়ান মেন্টাল হেলথ এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকেও কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কি ভাবে এই সংকটকালে নিজের মানসিক অবস্থাকে সুস্থ রাখা যায়। এই এসোসিয়েশনের ইয়র্ক ও সাউথ সিমকো ব্রাঞ্চের প্রধান নির্বাহী রেবেকা সিল্ডস এবং ক্লিনিকাল ডিরেক্টর ডক্টর ডিয়েন সেমস এর পরামর্শগুলো হলো –

১. মহামারীর কালে আতঙ্কিত হওয়াটা স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও আতঙ্ককে উপেক্ষা করা বা দমন না করার চেষ্টা করুন। তার বদলে আপনার আতঙ্ক সম্পর্কে সচেতন হন এবং স্বীকার করুন যে আপনি এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ বোধ করছেন। তবে লক্ষ্য রাখুন আপনার চিন্তা যেন চরম আকার ধারণ না করে এবং অপ্রয়োজনীয় না হয়ে উঠে।

২. নিজের যতœ নেয়া এই সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যতœ না নিলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার পরিস্থিতি খারাপ আকার ধারণ করতে পারে। সামাজিক সমর্থনের উপর নির্ভর করুন, পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান, ব্যয়াম করুন এবং উপভোগ্য কার্যক্রমে জড়িত থাকুন। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আপনি আপনার স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য যে কাজগুলো করতেন তা অব্যাহত রাখুন। সেই সাথে হেলথ এ্যন্ড সেফটি গাইডলাইন মেনে চলুন।

৩. সংকটের মূহুর্তে করোনা সম্পর্কে একমাত্র নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করুন। সারাক্ষণ সর্বশেষ সংবাদ চেক করার প্রবনতাকে সীমিত করুন। প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত তথ্য আপনার উদ্বেগকে শান্ত করতে পারে এবং বিপদের ধারণাকে হ্রাস করতে পারে।

৪. হেলথ কানাডা বা অন্য কোন বিশ্বাসযোগ্য স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সুপারিশকৃত সাবধানতা অবলম্বন করুন। আপনার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে এমন বিষয়গুলোর উপর নজর রাখুন। যেমন ঘন ঘন হাত ধোয়া, কাশি বা হাঁচির সময় মুখ ঢেকে রাখা, জরুরী নয় এমন সব স্থানে যাওয়া আসা বন্ধ রাখা ইত্যাদি।

৫. যদি দেখেন যে COVID-19 বা অন্যকোন কারণে আপনার উদ্বেগ উৎণ্ঠা বা আতঙ্ক সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, আপনার স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে তবে কোন স্বীকৃত মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থার (যেমন কানাডিয়ান মেন্টাল হেলথ এসোসিয়েশন) স্বরণাপন্ন হোন।

করোনার এই মহামারি কালে চেষ্টা করুন মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকতে। মন ভাল থাকলে শরীরও ভাল থাকে। অতিমাত্রায় আতঙ্কিত না হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন। মনে রাখবেন চীনে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। চীন থেকে বেশী মাত্রায় আক্রান্ত স্পেনে COVID-19 আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। চীন এবং ইউরোপ এর তুলনায় কানাডার হাসপাতাল বা চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক ভাল। কানাডার সরকারও আমাদের বিপদের সময় আমাদের পাশে আছে।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ