করোনার দিনগুলো
আবার লকডাইন আবার ঘরবন্দী এবং ভ্যাকসিন!
জসিম মল্লিক
(নবম পর্ব)
১. প্রতিদিন রেকর্ড ভঙ্গ হচ্ছে। আবার লকডাউনের চক্করে পড়েছে টরন্টো। নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে ২৩ নভেম্বর থেকে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অবস্থা এখন ভয়াবহ। এ লেখা যখন প্রকাশিত হবে ডিসেম্বরে তখনকার হেলথ কানাডার প্রজেকশন হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার আক্রান্ত হবে কানাডায়। মুত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। আইসিউতে জায়গার সঙ্কুলান হচ্ছে না। অন্যান্য সার্জারী ব্যহত হচ্ছে চরমভাবে। মানুষ এই মহামারিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে। কাজ আর ঘর ছাড়া আর কোনো জীবন নাই। অনেকে কাজ হারিয়েছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। যারা বাইরে কাজ করছেন তাদের আট ঘন্টা মুখে মাাস্ক পড়ে থাকাটাও এক কষ্টকর অভিজ্ঞতা। কিন্তু এটাই সবচেয়ে উত্তম পন্থা কোভিডের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। শীত মৌসুম এসে গেছে। যখন এ লেখা লিখছি তখন টরন্টোতে দিনভর স্নো পড়েছে। মৌসুমের প্রথম স্নো প্রকৃতঅর্থে। ফ্লুর সময় বলেই কোভিডের প্রকোপ বেড়েছে। শুধু কানাডা নয় আমেরিকা সহ পুরো পৃথিবী জুড়ে এক আতঙ্ক। সেই আতঙ্কেও নাম কোভিড। তবে আশার কথা ফাইজার, মডার্না বা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এসে যাচ্ছে। ডিসেম্বর থেকেই ফাইজার বা মডার্নার ভ্যাকসিন এফডিএর পারমিশনের জন্য উপস্থাপন হবে। এতো দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কার মানবতার জন্য বিরাট ঘটনা। কানডাও ভ্যাকসিন প্রাপ্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কবে সেটা পাওয়া যাবে এটাই বড় খবর আপাততঃ।
মুখোশ বা মুখোশধারী বলতে আমরা নেগেটিভ কিছু বুঝি। যারা ভাল মানুষের ভেগ ধরে খারাপ কাজ করে তাদেরকেই মুখোশধারী বলে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। এখন মুখোশ বা মাস্ক জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে গেছে। জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপকরণ এখন মাস্ক। তারমানে এই নয় যে মুখোশধারীরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা ছিল, তারা থাকবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে। আমেরিকায় এ পর্যন্ত যে একাশি লক্ষ আক্রান্ত এবং দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার মানুষ মারা গেছে সে জন্য অনেকখানি দায়ী ট্রাম্প এবং মাস্ক না পড়া। তার নির্বাচনী জনসভাতেও অনেকে মাস্ক ছাড়া অংশ নিয়েছে। মাস্কের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনও হয়েছে। টরন্টোতেও হয়েছে। মাস্ক নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারিও আছে। খোদ বাংলাদেশেই নকল মাস্ক সরবরাহ করার ঘটনা আছে।
পৃথিবী জুড়ে কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ চলছে। পথমবারের চেয়েও অবস্থা ভয়াবহ। কিন্তু তা সত্বেও অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছে না। কানাডার মতো সভ্য দেশেও অনেকের মাস্কের প্রতি অনীহা আছে। কালকে বরিশালে আমার ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, এখানে একজনও কেউ মাস্ক পড়ে না। করোনাকে সবাই স্বাভাবিক সর্দি জ্বরের মতোই মেনে নিয়েছে। ঘরে ঘরে আক্রান্ত হচ্ছে। ঘরেই ভাল হচ্ছে। জীবন স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। কানাডাতেও পূর্বের ভীতি কমে গেছে। তবে এখনও বেশিরভাগ মানুষ সচেতন এবং সোশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করছে এবং মাস্ক ব্যবহার করছে। এলিভেটরে দুজনের বেশি ওঠার নিয়ম নেই। গ্রোসারি স্টোরে বা ব্যাংকে দুই মিটার দূরত্ব থাকতে হয়। এতো সতর্কতার পরও প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে টেষ্টের সংখ্যাও। অন্টারিও প্রভিন্সেই প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টেষ্ট হচ্ছে। কানাডায় সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রায় দুই লক্ষ চৌদ্দ হাজার আক্রান্ত এবং প্রায় দশ হাজার মৃত্যুবরন করেছে।
হ্যাঁ এ কথা সত্যি যে মাস্ক পড়ে থাকতে থাকতে মানুষ ক্লান্ত। আমি নিজেও। কাজের জায়গায় প্রতিদিন আট ঘন্টা মাস্ক পড়ে থাকা চাট্টিখানি কথা না। সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা! ভাবা যায়!। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। যতদিন না এই মহামারি দূর হবে ততদিন এইভাবেই বাঁচতে হবে। আমি এ বছর ফেব্রুয়ারীর ১ তারিখ ঢাকা যাই। তখনও কোভিড সেভাবে শুরু হয়নি। টরন্টোতে একটা দুটো কোভিড আক্রান্ত পাওয়া গেছে। আমার ফ্লাইট ছিল কুয়েত এয়ার। ফ্লাইটে উঠে দেখি কেবিনক্রু সবাই মাস্ক পড়া। কিন্তু প্যাসেঞ্জার কেউই প্রায় মাস্ক পড়া না। কিন্তু আমি মাস্ক পড়ে ছিলাম। একবার একজন সুন্দরী কেবিন ক্রু আমাকে মজা করে বলল, তুমি মাস্কটা ঠিকমতো পড়ে থাকো। বারবার খুলছ কেনো! ঢাকায় পৌঁছেই একবাক্স মাস্ক কিনে ফেলি আমি। সেটা যতনা করোনার ভয়ে তারচেয়ে বেশি ধূলাবালি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। প্রতিদিন বইমেলায় মাস্ক পড়ে গিয়েছি। এমনকি গত বছর যে আমি হজ্জে গিয়েছি তখনও আমি মাস্ক ব্যবহার করেছি। মিনায়, আরাফাতে এমন কি মুজদালিফায় আমি মাস্ক পড়েছি মনে আছে।
মাস্কের অনেক হ্যাপাও আছে। চট করে কাউকে চেনা যায় না। এজন্য অবশ্য আমি খুবই স্বস্তিতে আছি। আমাকে কেউ চিনতে পারে না। যেমন তেমন কাপড় পড়ে বের হই। চেনা মানুষের গা ঘেষে গেলেও সমস্যা নাই। বুঝতে পারে না কে গেলো পাশ দিয়ে। মাস্কের কারণে অনেকেই প্রতিদিন শেভ করে না। দরকার হয় না। যারা হোম অফিস করছে তাদের অনেকের দাড়ি হাঁটু পর্যন্ত নামার অবস্থা হয়েছে। আমার ছেলেরও তাই। আজ রাতে এসেছিল। প্রথমে মনে হলো এই মৌলভি সাব কে! মাস্ক পড়ে কথা বললে অর্ধেক বুঝিনা। কাজের জায়গায় বস বলছে একটা, শুনি আর একটা। সাদাদের কথা আরো বোঝা যায় না। অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা নাই। ইশারা ইঙ্গিতে কাজ চলে যায়। এজন্য কেউ মাইন্ড করে না। আজকাল মাস্ক একটা ফ্যাশনও বটে। অরিত্রি একটা হুডি গিফট করেছে সাথে দেখি ব্রান্ড নেইমের মাস্ক আছে। কস্টকো থেকে কটনের মাস্ক কিনে নিয়েছি। দম নিতে ভাল। ওয়াশেবল। অতএব বন্ধুরা যত কষ্টই হোক মাস্ক পড়ো, অন্ততঃ ভ্যাকসিন আসা পর্যন্ত, জীবন বাঁচাও..।
২. মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি আমার কি কোনো দুঃখ আছে! মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি আমি কি সুখী! আমি আমার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলির সাথে বর্তমানের দিনগুলির তুলনা করি এবং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। এই দুইয়ের মাঝে মধ্যবর্তী যে জীবন ছিল আমার সেখানে অভাব, অনটন, লড়াই, সংগ্রাম, অপমান, অবহেলা, আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না সব ছিল। কি ছিল না সেই জীবনে! সবই ছিল। সেসবেরও ব্যবচ্ছেদ করি। সুখ বা দুঃখ কোনোটা নিয়েই আমি কখনো আদিখ্যেতা করিনি। কোনোটাই নিরবচ্ছিন্ন নয় জীবনে। দুটোই জীবনের অংশ। তাই জীবনের বঞ্চনাগুলো নিয়ে আমি কখনো নিজেকে দুঃখিত করে তুলিনি। ভারাক্রান্ত হইনি। নির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়ী করিনি। বরং আমি যে এখন নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি সেজন্য নেপথ্যের মানুষগুলোর প্রতি অবনতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জানাই। যারা আমাকে স্বার্থহীনভাবে ভালবেসেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, পাশে থেকেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে তাদের প্রতি আমার একবুক ভালবাসা সবসময়। এখনও যারা আমার প্রতি সহমর্মীতার হাত বাড়ায়, ভালবাসে, মাথায় হাত রাখে তাদের স্পর্শ আমার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। বাঁচতে শেখায়।
মনে আছে যখন স্কুলে পড়ি লেইজারে আমি খুব দিনই মালেক ভাইয়ের মালাই আসিক্রীম খেতে পারতাম। একটা দুটোর বেশি জামা, প্যান্ট বা জুতা ছিল না আমার। রোদ্রে বৃষ্টিতে ভিজত, আবার গায়েই শুকাত। ঠান্ডা লাগত না। শরীর সব সয়ে নিত। আমার ক্লাসের যে বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে আইসক্রীম অফার করত তার কথাও আমি কখনো ভুলিনি। এক ঈদে আমার নতুন জামা ছিল না। পুরনো জামা ধুয়ে মা ইস্ত্রী করে দিয়েছিল। বাড়ির সব্ইা নতুন জামা পড়ে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছে, আমি পুরনো জামা পড়েছি, তাও আমার মনে কষ্ট হয়নি। মা বলেছিল কষ্ট পেয়োনা। তোমার জন্য দোয়া করি, একদিন তুমি অনেক জামা পড়তে পারবে। আমার ছেলে মেয়েরা যে আমাকে এতো এতো জামা কাপড় গিফট দেয় অনেক প্যাকেট তিন বছরেও খোলা হয়নি আমার। যখন ঢাকা শহরে আমার থাকার জায়গা ছিল না, খাওয়ার পয়সা ছিল না তখন যারা আমার পাশে থেকেছিল আমি তাদের কথা কি করে ভুলি! প্রথম দিন যে বন্ধুর জামা পড়ে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তার কথা কি ভোলা যায়! বিয়ের সময় যে বন্ধুরা বিভিন্নভাবে হেল্প করেছিল তারাও থাকে হৃদয়ের গভীরে।
এমনি অনেক কিছুই জড়িয়ে থাকে এক জীবনে। ব্যক্তি জড়িয়ে থাকে, ঘটনা জড়িয়ে থাকে। সেখানে বঞ্চনা আর অপমান যেমন থাকে আনন্দও থাকে। মোটা দাগের সে সব অপমানের কথা মনে করে আমি কখনো নিজের জীবনকে বিষিয়ে তুলিনি। এসব সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরনা হিসাবে কাজ করেছে। এখনও করে। যারা আমাকে তাচ্ছিল্য করেছিল বা অবহেলা আমি সেইসব মানুষদের গিয়ে কখনো বলিনি তোমরা আমার সাথে এমন কেনো করেছিলে! কেনো কষ্ট দিয়েছিলে! বরং সেসব মানুষই যখন আমাকে ভালবাসে কাছে টানতে চায় বা সম্মান দেখায় তখন আমি পিছনের সবকিছু ভুলে যাই। হ্যাঁ কিছু কষ্ট থাকে যা সহজে ভোলা যায় না। কিছু বঞ্চনা থাকে যা মনের গভীরে দাগ ফেলে দেয়। সবকিছু মনে রাখলে মানুষ যেমন বাঁচতে পারত না আবার সবকিছু ভুলেও যাওয়া যায় না। ভুলতে পারলে ভাল হতো। ভুল ত্রুটি নিয়ে এই জীবন।
কিছু মানুষ থাকে সারাজীবনই অন্যকে ছোট করে দেখে, তাচ্ছিল্য করে। এই ধরণের মানুষ আমি অনেক দেখেছি। সেসব মানুষদের কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করেছি। কারো সাথে লড়াই করার চেয়ে এভোয়েড করা ভাল সমাধান মনে করি। অনেক কাছের মানুষরাও আমার সাথে এমন আচরন করে, দূরের মানুষরাও করে। আমার প্রতি নির্বিকার থাকে। আমি সবসময় তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই। তাদের প্রতি আমি কোনো ক্ষোভ নিয়ে বসে নেই। আমি আমার নিজের মধ্যে একটা জগত তৈরী করে নিয়েছি। সেই জগতে আমার বসবাস। বাঁচার জন্য আমাকে এমনটা করতে হয়েছে। এই একাকী জীবনে হঠাৎ হঠাৎ এক একজন আমার জীবনে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়। আমার জগতটা আলোকিত হয়ে ওঠে। সাধারন এই জীবনে অসাধারণ অনুভূতি দেয়। সকল গ্লানি মুছে যায়।
বৃদ্ধাশ্রমের জীবন কেমন! বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি। সেটা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। সবকিছু আগাম চিন্তা করার একটা বাতিক আছে আমার। আগামীকাল বা পরশু কি ঘটতে পারে এরকম চিন্তাও আমি করি এবং প্রায় ক্ষেত্রেই আমার ধারণা সঠিক হয়। এইসব কারণে আমি অনেক অঘটন থেকে রেহাই পাই। মানুষের ক্ষেত্রেও আমি আগাম ধারণা করতে পারি। শতভাগ না হলেও অনেকটাই সত্য হয়। যত কাছের মানুষই হোক বা দূরের আমার মন আগাম বলে দেয় তার সাথে সম্পর্ক কতদূর পর্যন্ত টেনে নেওয়া যাবে। সম্পর্ক বিষময় হয়ে উঠবে কিনা বা কোনো স্বার্থে আছে কিনা আমি বুঝতে পারি। আমার নিজের কোনো স্বার্থ আছে কিনা তাও আমি টের পাই। সম্পর্ককে আমি অনেক মূল্য দেই। সহজে কেনো সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলিনা। কিছু ক্ষতি স্বীকার করে হলেও মানুষের প্রতি সহজে আস্থা নষ্ট হয় না বা মুখ ফিরিয়ে নেই না। আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আমার জন্য কখনো কিছু করে নাই, কোনো অনুকম্পা দেখায়নাই তারাও যখন আমার স্মরণাপন্ন হয় আমি তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি না বা পুরনো প্রসঙ্গ টেনে আনি না। অভিযোগ করতে আমার লজ্জা লাগে। কে কি ভাবে!
বৈষয়িক কিছু নিয়ে আমি কখনো এডভাঞ্চ চিন্তা করিনি অথচ করা উচিত। আচ্ছা যখন বৃদ্ধ হবো তখনকার জীবন কেমন হবে! আজকাল এসব আমাকে ভাবাচ্ছে। খুউব ভাবাচ্ছে। তখন কি অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে! আর এখানেই আমার আপত্তি। আমি একদম অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে চাই না। আমার জীবনে অনেক লড়াই সংগ্রাম, না পাওয়ার বেদনা আছে। কিন্তু আমি কখনো নিজের জন্য কারো কাছে হাত পাতিনি। চেয়ে নেওয়ার মতো গ¬ানিকর আর কিছু নেই। চেয়ে না পাওয়ার বেদনা আমি সহ্য করতে পারব না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার অর্ধেক জীবন গ্রন্থে বলেছেন, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভবনা আছে এমন কারো কাছে কখনো চুম্বন প্রার্থনাও করিনি। আমিও তাই। আমি কারো কাছে কোনো প্রতিদান চাই না। কোনো কিছু পাওয়ার আশা নিয়ে আমি কিছু করি না। এমনকি আমি আমার সন্তানদের কাছেও কিছু চাই না। তারা কিছু করবে এই আশা নিয়ে আমি বসে নেই। আজকালকার অনেক মামা মায়েরাই এমনটা ভাবে। অনেকের সাথেই আমার কথা হয়। তারা পরনির্ভরশীল হতে চায় না।
তাহলে আমাদের এই জেনারেশন যখন বুড়ো হবে বা অথর্ব হবে তখন কেমন হবে তাদের জীবন! কোনো অলৌকিক কেউ এসে কি হাত ধরে বলবে কোনো চিন্তা নাই, আমি পাশে থাকব, সেবা করব, রাত জেগে বসে থাকব, পায়খানা প্রস্রাব পরিষ্কার করব! এমন ঘটনা পৃথিবীতে সম্ভব। তবে আমি সবসময় নিজের জন্য যেটা প্রার্থনা করি সেটা হচ্ছে আমি যেনো সুস্থ্য অবস্থায় বিদায় নিতে পারি। এরচেয়ে সুন্দর চাওয়া আর কিছু নেই। রোগে শোকে কষ্ট পাওয়া নেই, কাউকে কষ্ট দেওয়াও নেই। কিন্তু কোনো কিছু আমাদের হাতে নেই। আমার মা শেষ সময়টায় খুউব কষ্ট পেয়েছিলেন। মায়ের সেই কষ্টের পান্ডুর মুখ আমি ভুলতে পারি না। তখন ভাবতাম এতো কষ্ট পাওয়ার চেয়ে চলে যাওয়াই ভাল। অথচ আমি সবসময় মনে করতাম মা আমাকে ছেড়ে যাবেন না কোনোদিন। এমন হতে পারে না। মা যখন মৃত্যুর কথা বলতেন আমি রাগ করতাম। বলতাম, আপনি কখনো মরবেন না। আমি সেটা মেনে নেবো না। মা আমার কথা শুনে হাসতেন।
সেই থেকে আমার মধ্যে একটা ভয় ঢুকে আছে; শেষ জীবনটা কেমন হবে! খুউব কি একলা হয়ে যাব! খুউব কি কষ্টের হবে! ছেলে মেয়ে বা স্ত্রী কি বিরক্ত হবে! তাদের কি পাশে পাব! কে জানে! স্বামী বা স্ত্রীর চেয়ে আপন কেউ নাই এটা যেমন সত্যি তেমনি যাদের কোনো একজন নাই তাদের শেষ জীবনটা কেমন হবে! আমি বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমার বন্ধু আলম এই বিষয়টা নিয়ে অনেকবার আমার সাথে কথা বলেছে। আজকেও আমাদের কথা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল বা ধনী শ্রেনীর বাবা মায়েরা বৃদ্ধ বয়সে বেশি একলা হয়ে যায়। উন্নত দেশগুলোতে অতি উন্নতমানের বৃদ্ধাশ্রম আছে। কানাডাতেও আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটা গড়ে ওঠেনি। দরিদ্রদের জন্য অনেকেই বৃদ্ধাশ্রম করেছেন কিন্তু স্বচ্ছলদের জন্য এমন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না। এই কনসেপ্ট এখনও কেউ মেনে নেয়নি। ধনীরা তাদের প্যারেন্টসদের বৃদ্ধাশ্রমে থাকাকে অসম্মানজনক মনে করে। বরঞ্চ তাদের একলা, নিঃসঙ্গ এপার্টমেন্টে থাকাকে বেশি সম্মানের মনে করে। অনেকটা নির্বাসনে দেওয়ার মতো। সপ্তাহান্তে একদিন দেখতে যায়। অথচ বৃদ্ধাশ্রমে সবার সাথে মিলে মিশে থাকলে অনেক আনন্দ হয়। খেলা ধুলা, খাওয়া দাওয়া, গল্প, আড্ডায় মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকে, নিঃসঙ্গতা থাকে না এবং সেবাও পাওয়া যায়। আশা করি এই ব্যপারটা নিয়ে বাংলাদেশের ধনী শ্রেনীরা ভাববেন।
৩. আমার বরিশাল ছেড়ে ঢাকা আসার কথা ছিল না, কোনো কারণও ছিল না। ঢাকা ছিল কেবলই একটি নাম আমার কাছে। বাংলাদেশের রাজধানী, বইয়ে পড়েছি। ঢাকা শহর দেখতে কেমন, ওখানকার মানুষ কেমন তা ছিল একটা কল্পনা মাত্র, যেমন আমেরিকা দেশটা কেমন, সত্যি কি ওরকম একটা দেশ আছে পৃথিবীতে! এইসব ভাবনা আমার মাথায় এসেছিল বই পড়ে। আমি স্কুল জীবন থেকেই গল্পের বই পড়তে শুরু করি। প্রথম উপন্যাস পড়ি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। উপন্যাসের নাম ছিল তেইশ নম্বর তৈলচিত্র। লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ। পড়তে দিয়েছিল আমার ক্লাসের ফার্ষ্ট বয় নাসির। ঠিক তার দু’বছর বছর পর যখন ক্লাস নাইনে উঠেছি তখন আমি প্রথম ঢাকা শহরে আসি। সামাদ লঞ্চে চড়ে এক কাক ডাকা ভোরে সদর ঘাট নামলাম। প্রথম এসে মুগ্ধ হয়ে ঢাকা শহর দেখছিলাম। কী ছিম ছাম সবুজে ঘেরা ঢাকা। বনানীতে আমার এক বোনের বিয়েতে এসেছিলাম। বনানী মসজিদের কাছেই ডি ফাইভ নম্বর বাড়ি। তখন বনানী ছিল অনেক পরিচ্ছন্ন। সামনেই বিশাল খোলা প্রান্তর। সেখানে আমরা ফুটবল খেলতাম। ৬ নম্বর বাসে চড়ে গুলিস্তান যেতাম। গুলিস্থান যেনো ম্যানহাটন, ফিফথ এভিনিউ দিয়ে হাঁটছি। রাতের গুলিস্থান হচ্ছে টাইম স্কয়ার।
একদিন গুলিস্থান হলে সিনেমা দেখলাম। সিনেমা দেখে বের হয়ে রিক্সাওয়ালাকে বললাম, আমাকে বায়তুল মোকাররম নিয়ে যান। বায়তুল মোকাররম তখন ট্যূরিষ্টেদের জন্য আকর্ষনীয় স্থান। সবচেয়ে বড় মসজিদ, শপিং সেন্টার।
একটু পরই রিক্সাওয়ালা, বলল নামেন।
আমি বললাম ভাড়া কত!
রিক্সাওয়ালা বলল, বারো আনা।
আমি অবাক হয়ে বললাম এইটুকু রাস্তা, ওইতো গুলিস্থান দেখা যায় তাও বারো আনা!
রিক্সাওয়ালা বলল, আকাশের চাঁদভি দেখা যায়, ভাড়া দ্যান!
তারপর আমি আরো কয়েকবার ঢাকা এসেছি। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে একবার আসলাম। সেবার মুন্সীগঞ্জ গিয়ে আপেলের সাথে পরিচয় হলো। মালপাড়ায় আপেলদের বাসা। আবাহনী মোহামেডানের খেলা দেখতে আসতাম মাঝে মাঝে। আমি আবাহনীর সাপোর্টার। একবার খেলা শেষে স্টেডিয়ামে মারামারির মধ্যে পড়ে গেলাম। সেটা ছিল আবাহনী আর ব্রাদার্স ইউনিয়নের খেলা। তারপর অনেকদিন আর ঢাকা আসিনি। ঢাকার কথা ভুলেই গেছিলাম। কলেজে যখন উঠেছি তখন থেকেই আমি খুব চিঠিপত্র লিখি। আমার প্রচুর চিঠি ছাপা হয় পত্রিকায়। তারমধ্যে বিচিত্রা নামের একটা পত্রিকা আছে। লাইব্রেরিতে যাই, গল্প উপন্যাস গোগ্রাসে গিলি। মাথার মধ্যে গল্পের চরিত্ররা ঘুরঘুর করে সারাক্ষন। পত্রমিতালী করি।
বিচিত্রা পত্রিকাটা আমাকে দারুণ আকর্ষন করত। দুই টাকা দিয়ে কিনতাম। লেখা ছাপা হলে চিত্রালী পূর্বানীও কিনতাম। বিচিত্রার চিঠিপত্র বিভাগে লিখতাম। বিচিত্রার সব লেখাই আমার ভাল লাগত। কোন লেখাটা ভাল সেসব আমি জেনেছি বই পড়ে পড়ে এবং আমার গভীর অনুভূতি থেকে। আমাদের বংশে কোনো সাহিত্যের কারবার ছিল না। লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়ারও রেওয়াজ ছিল না। চিঠি লেখা বা পত্রমিতালী করা তো খারাপ কাজ! কিন্তু মা সবসময় আমার পক্ষে ছিল। আমি ছিলাম প্রথাবিরোধী। দলছুট, একাকী, নির্জন মানুষ। দুঃখ, দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে উঠছি। অভিমানী, জেদী। একদিন হঠাৎ মনে হলো বরিশাল থেকে চলে যাব। কেনো যাব কার কাছে যাব তা স্পষ্ট না। কিন্তু যেতে হবে। বরিশালের নিস্তরঙ্গ জীবন থেকে আমার মুক্তি দরকার। আমাকে নতুন কোনো পথের সন্ধান করতে হবে। মা কষ্ট পাবে, কাঁদবে তাও আমাকে যেতে হবে। অতপর একদিন ঢাকায় পারি জমালাম। ঢাকা শহরে আমার একমাত্র চেনা মানুষ হচ্ছে আপেল। একমাত্র ভরসা।
আমি ঢাকা এসেছিলাম বিচিত্রার টানে। বিচিত্রা যেনো এক যাদু আমার কাছে, আর এর সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী যেনো এক বংশী বাদক। কিন্তু আমি জানি আমার মতো ভীতু, লাজুক, মফস্বলের এক যুবকের পক্ষে বিচিত্রার মতো মহা পরাক্রমশালী পত্রিকার চৌকাঠে পা রাখা সম্ভব হবে না। ঢাকায় এসে গোপিবাগে ফালুর মেসে উঠেছি। কখনো খাই, কখনো না খেয়ে থাকি। একটা টিউশানি করি। কিন্তু পড়ানোতে মন নাই। আর মাঝে মাঝে দৈনিকবাংলার নিচ দিয়ে ঘোরাঘুরি করি। তিনতলায় বিচিত্রা কার্যালয় শুনেছি। সেদিকে তাকিয়ে দেখি। একদিন সাহস করে দৈনিকবাংলার তিনতলায় গেলাম। তারপরের গল্প অনেকবার লিখেছি। এখনও ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে। রোমহর্ষক মনে হয়। আমি যে একদিন ঢাকায় আসব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, সাংবাদিকতা বা সাহিত্য করব, প্রেসক্লাব বা বাংলা একাডেমির মেম্বার হবো, ঢাকার মেয়ের সাথে পরিচয়, প্রণয় ইত্যাদি হবে তা ছিল অকল্পনীয়। স্বপ্নেও এসব ভাবিনি। কিন্তু মানুষ যা ভাবে হয় তার উল্টো।
আজকের লেখার প্রসঙ্গ আসলে এসব নয়। আজকে আমার নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা ভারি অন্যায়। এই যে আজও আমি লেখালেখি নিয়ে আছি, আমার যে প্রায় ৩৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে গল্প উপন্যাস, নিবন্ধ, স্মৃতিকথা এজন্য তৎকালীন দৈনিক বাংলা, বিচিত্রা, আনন্দ বিচিত্রা বা আরো পরে সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার অবদান সবটুকু। বিশেষকরে বিচিত্রা। আর আমি যাদের সাথে কাজ করেছি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে যারা এইসব পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। অনেক মেধাবী মানুষদের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সেইসব মানুষদের সাথে আমাকে টিকে থাকার লড়াই করতে হয়েছে। তাদের সান্নিধ্য আমাকে সৃজনশীল হতে অনুপ্রানিত করেছে। সাংবাদিকতা বা সাহিত্য দু’ক্ষেত্রেই সেইসব মানুষেরা ছিলেন শানিত, চৌকশ, ট্যালেন্ট। আজ যারা খ্যাতিমান, যাদের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি, যাদের লেখনী আমাকে সবসময় সমৃদ্ধ করেছে, সেটা সাংবাদিকতা হোক আর সাহিত্য তাদের কথা মনে করেই এই লেখা।
সেই মানুষগুলো হলেন শাহরিয়ার কবির, শামীম আজাদ, মঈনুল আহসান সাবের, রেজোয়ান সিদ্দিকী, মাহমুদ শফিক, চিন্ময় মুৎসুদ্দী, চন্দন সরকার, আনু মুহাম্মদ, সাজ্জাদ কাদির, মাহফুজউল্লাহ, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, খায়রুল আনোয়ার মুকুল, আবদাল আহমেদ, অরুণ চৌধুরী, নাসির আহমেদ, হাসান হাফিজ, আবদুল হাই শিকদার, আমীরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন, আসিফ নজরুল, ইরাজ আহমেদ, আশরাফ কায়সার, মিজানুর রহমান খান, গোলাম মোর্তোজা, মাহফুজুর রহমান, এমদাদ হক, আনোয়ার শাহদাত, আকবর হায়দার কিরন, কবিতা দিলওয়ার, মুনাওয়ার হোসাইন, করভি মিজান রিভি, বদরুল আলম নাবিল, রাশেদ মাহমুদ তিতুমির, পলাশ মাহবুব, ফজলুর রহমান সহ আরো অনেকেই। এর বাইরেও অনেক খ্যাতিমান মানুষেরা বিচিত্রায় নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখতেন। বিচিত্রায় লেখা ছাপা না হলে নিজেকে সাহিত্যিক ভাবা একটু কঠিন ছিল। বিচিত্রা মধ্যবিত্তের জীবনধারা বদলে দিয়েছিল। আজও অনেকেই আমাকে বিচিত্রার একজন হিসাবে মনে রেখেছে। যারা বিচিত্রায় আমার লেখা পড়তেন তাদের অনেকেই এখন আমার ফেসবুক বন্ধু। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে বিচিত্রা ছিল বাইবেলের মতো। আর সেখানের একজন হতে পারা আমার এই জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়ে থাকবে।
আবুল হাসানের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি,
”সব রৌদ্র ফিরে যায় না, লুকিয়ে থাকে
রাতের ফাঁকে যেমন তুমি
কোথায় ছিলে? কোন পাহাড় কোন পোস্টাফিসে
চিঠির মতো..”
জসিম মল্লিক
টরন্টো ২২ অক্টোবর ২০২০