করোনার দিনগুলো
জসিম মল্লিক
(পঞ্চম পর্ব)
অভিমানই বাবাদের অস্তিত্ব
বাবাদের নিয়ে তেমন কথা হয় না। একসময় বাবারা খুউব একা হয়ে যায়। একা হতে হতে একদিন শূন্যে মিলায়। সন্তানক্ষুধা বাবাদের যে কত তীব্র এই কথাটা কেউই প্রায় বোঝে না। মায়ের কাছে সন্তানেরা যতটা স্বচ্ছন্দ, অকপট বাবাদের কাছে ততটা না। আমার সন্তানেরা তার মায়ের সাথে প্রতিদিন কথা বলে, মায়েরা অনেক কিছু খুঁটিয়ে জানতে চায়। কিন্তু বাবারা তেমন না। আমার বাবা মারা গেছেন আমার দু’ বছর বয়সে। মানুষ নাকি ইচ্ছে করলে তার জন্মমুহূর্তও মনে করতে পারে। আমি ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি , নাকের জ্বলে, চোখের জ্বলে পড়ে আছি মাটিতে, মা ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, সাজু কখনো আমাকে একটু কোলে নিয়ে পাড়ায় ঘুরতে বের হয়, মা অনেকক্ষন পর এসে একটু আঁচলে নাক মুখ মুছে দেয়। মাকে বাবা বলছেন, দেখেছো তোমার ছেলেটা কেমন জিদ্দী আর অভিমানী! তারপর বাবা আমার হাতে লজেন্স গুজে দেন। এই পর্যন্ত অস্পস্ট চোখে ভাসে। হয়ত এটা একটা কল্পনা।
আমি নিজেও এখন বাবা। সন্তানের জন্য বাবাদের মমতা আর লড়াইটা থাকে নিভৃতে। আমি অনেক বাবা দেখেছি যারা মায়ের ভূমিকাও পালন করে। তবে সন্তানদের বেড়ে ওঠা, তাদের মানুষ করার ব্যাপারে মায়েদের কৃতিত্ব বেশি। মায়েরা সন্তানকে নয় মাস গর্ভে ধারণ করে এবং সন্তান প্রসবের যন্ত্রণা ভোগ করে। মৃত্যু যন্ত্রণার পরই এই যন্ত্রণা। কিন্তু মায়েরা এই কষ্টটা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে ভুলে যায়। তারপর বড় হয়ে সন্তান একসময় দূরে চলে যায়। সন্তান মানে সমতান। এদের মধ্য দিয়েই বাবারা বেঁচে থাকে। সন্তানের জন্য বাবাদের বুকের গভীরে চৈত্রের কুয়োর তলানি জলের মতো কিছু ভালবাসা সবসময় পড়ে থাকে। ওই দুস্তর পথ পার হয়ে সেইটুকু স্পর্শ করবে কে? অভিমানই বাবাদের অস্তিত্ব। তার সঙ্গে চলে অপেক্ষা অপেক্ষা। তার পাশে কেউ আসুক, সবাই আসুক..।
টরন্টো ২১ জুন ২০২০
স্মৃতিতে অনিন্দ্য সুন্দর স্টীমার জার্নি
তখন রকেট স্টীমার সার্ভিস ছিল দিনে। আমরা জাহাজ বা রকেটও বলি। কেনো তা জানি না। সকাল এগারোটায় বাদামতলী ঘাট থেকে ছাড়ত সন্ধ্যা ছটায় বরিশাল পৌঁছে যেতো। বরিশাল এক ঘন্টা স্টপ ওভার করে চলে যেতো খুলনা। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন প্রায়ই স্টীমারে বরিশাল যেতাম। দিনে দিনে পৌঁছে যাওয়া যায়। রাতে ঘুমানোর ঝামেলা নাই। টিকিট কাটতাম তৃতীয় শ্রেণীর কিন্তু স্টীমারের দোতলায় প্রথম শ্রেণীর সামনেই যে বিশাল ডেক আছে সেখানে চলে যেতাম। সুন্দর বসার ব্যবস্থা সেখানে। স্টীমারটা সদর ঘাট টাচ করে বুড়িগঙ্গার বুক চিরে কেমন ভোঁ দিয়ে ছেড়ে যায়। দুই পারের দৃশ্যাবলী দেখতাম আমি। ছোট ছোট নৌকা কোথা থেকে কোথায় চলে যায়! চাঁদপুরের মোহনায় এলে বিশাল মেঘনা নদীর ঢেউয়ে স্টীমারটা দুলত। মাঝিরা নদীতে জাল ফেলত। রুপালী ইলিশ ঝক ঝক করে উঠত সূর্যের আলোতে। মাঝিরা ভয় পেতো না। ফার্ষ্ট ক্লাসের রুপসী নারীদের চুল উড়ত বাতাসে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। স্টীমার জার্নি নিয়ে আমার একটি প্রেমের গল্প আছে, নাম জীবন বারে বারে আসে। গল্পটি বিচিত্রার কোনো এক ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। মাঝে মাঝে আমরা তরুণরা দলে ভারি হয়ে কাঠের ফ্লোরে বসে কোরাস গাইতাম। একবার মলি নামের একটি রুপসী মেয়ের সাথে প্রায় প্রেম হয়ে যেতে নিয়েছিল জার্নিতে..।
দুপুরে দুই টাকা দিয়ে গরুর মাংস আর ডাল দিয়ে ভাত খেতাম। পঞ্চাশ পয়সায় ঘন দুধের চা পাওয়া যেতো। কলা, বিস্কিট, বনরুটি পাওয়া যেতো। আনলিমিটেড ভাত এবং ডাল দিত খাবারের সাথে। ওরকম স্বাদের গরুর মাংস আর কোনোদিন খাইনি। পুরো স্টীমার মাংসের ঘ্রানে ’ম ’ম করত। জীবনে অনেক জার্নি করেছি, প্লেনের বিজনেস ক্লাস থেকে শুরু করে বুলেট ট্রেনে চড়েছি, ইউরো স্টারে চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পারি দিয়ে লন্ডন-প্যারিস গিয়েছি কিন্তু ঢাকা বরিশাল স্টীমার জার্নি পৃথিবীর সেরা।
বিয়ের পরও ফ্যামিলী নিয়ে স্টীমারে যেতাম। আমার বাচ্চারা এবং জেসমিন খুব এনজয় করত। তারপর একদিন হঠাৎ করে স্টীমার সার্ভিস দিনের পরিবর্তে রাতে শিফট হলো। কেনো তা জানিনা। ব্রিটিশ আমল থেকে ঐতিহ্যবাহী দিনের সার্ভিস বদলে রাতে হওয়ায় স্টীমার তার বৈচিত্র হারালো। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন বদলে হয়ে গেলো ডিজেল চালিত। তারপর একদিন সবচেয়ে বিলাসবহুল গাজী স্টীমার রহস্যজনকভাবে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেলো। শোনা যায় বিআইডব্লিউটিসি এবং প্রাইভেট লঞ্চ কোম্পানীর লোকজন এর সাথে জড়িত ছিল। এছাড়াও অস্ট্রীচ এবং পিএস মাসুদ সহ কয়েকটি জাহাজ চলে এখনও। আজও স্টীমারে বরিশাল গেলে পুরনো সেই স্মৃতি মনে পড়লে মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে।
টরন্টো ২৬ জুন ২০২০
নতুন অধ্যায়, নতুন চরিত্র, নতুন ঘটনা
জীবনে অনেক বিভ্রান্তি থাকে, ভুল থাকে, পদস্খলন থাকে, মোহ, লোভ, লালসা এসব থাকে। মানুষতো আর ফেরেশতা না যে ভুল করবে না! একমাত্র ফেরেশতারাই ভুল করে না। ভুল আছে বলেই বোঝা যায় জীবন সচল আছে। আবার ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে বলেই বোঝা যায় মানুষ সভ্যতাকে ধারণ করে। সংসার হচ্ছে একটা জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডলির মতো। প্রতিক্ষন খেয়াল রাখতে হয় আগুনের লেলিহান শিখার প্রতি। সংসার শুধু আগুনের লেলিহান শিখাই নয় সংসার হচ্ছে একটা আপসের নাম। প্রতিমুহূর্তে আপস করতে হয়। সংসার হচ্ছে একটা বোঝাপড়ার জায়গা। প্রতিমুহূর্তে বোঝা পড়া করতে হয়। সংসার হচ্ছে সার্কাসের তাঁরের উপর দিয়ে হাঁটার মতো ঝুঁকিপূর্ণ। দুই দিকেই ব্যালেন্স করতে হয়, না হলে ধপাস!
আবার সংসার হচ্ছে একটা মায়ার খেলা। আগুনের কুন্ডলিকেই মায়া, মমতা, ভালবাসা আর প্রেমের শীতল পরশ বুলিয়ে নেভাতে হয়। জ্বলন্ত অঙ্গারকে ছাই বানাতে হয়। সংসার কেনো ভাঙ্গে! সংসার ভাঙ্গে ভুল থেকে। অতিরিক্ত নারীবাদ বা অতিরিক্ত পুরুষ তান্ত্রিক হওয়া মোটেই কোনো ভাল আইডিয়া না। দিন শেষে আমাদের সংসারের কাছেই ফিরতে হয়। সংসারেই শান্তি, নিরাপত্তা। তাই প্রেমের মানুষটিকেই বেশি প্রধান্য দেওয়া উচিত। প্রেমিক হলো ক্লাসিক, রোমাঞ্চোপন্যাসের মতো। প্রতিদিন তাকে মনে হবে নতুন অধ্যায়, নতুন চরিত্র, নতুন ঘটনা। সকালে যে হবে শরৎ, দুপুরে গ্রীষ্মের খরতাপ, পড়ন্ত বিকেলে গোধুলি রাঙা হেমন্ত- শরীর জুড়ে নতুন ধানের গন্ধ আর রাতে অবশ্যই বর্ষা। স্নিগ্ধ, সবুজ, দেহ-মনে আকন্ঠ আর্দ্র করা বর্ষা।
টরন্টো ৬ জুলাই ২০২০
শোকের আয়ু একদিন
সোশ্যাল মিডিয়া আছে বলে এই করোনাকালে মানুষের একধরণের রিলিফ হচ্ছে, খানিকটা স্বস্তি দিয়েছে। বিশেষকরে ফেইস বুক এবং টুইটার। ভাল খবরের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া অনেক দুঃখের খবরও বহন করছে। প্রতিদিন এতো এতো মৃত্যুর খবর আমাদের অনুভূতিকে ভোতা করে দিয়েছে। এই যে কন্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, ছড়াকার আলম তালুকদার, সাংবাদিক রশিদ উন নবী দুই দিনের ব্যবধানে চলে গেলেন। শোকে ভাসছে বাংলাদেশ। প্রতিটা মৃত্যুই বেদনার। যার যায় সেই জানে। এক একটা মৃত্যুর শোক একদিনের বেশি স্থায়ী হতে পারছেনা। নতুন শোক এসে পুরনো শোককে হটিয়ে দিচ্ছে। মানুষ ভুলে যায় কার জন্য শোক করেছিল। মনে পড়ে না নাম।
মানুষের মনোযোগ আসলে মৃত্যু আতঙ্কের মধ্যে বন্দী। প্রতিদিন শোকগাঁথা রচনা করতে হচ্ছে। গভীর মনোনিবেশ ব্যাপারটা নষ্ট হয়ে গেছে। কারো প্রতি আর একাগ্রতা নাই। ফেসবুকে এই যে এতো এতো পোষ্ট সেসব মনোযোগ দিয়ে পড়ার সময় নাই! এতো ঘটনা যে কোনোটাই ঠিকমতো হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। সবকিছু দায়সারা গোছের হয়ে গেছে। অর্ধেকটা পড়েই লাইক কমেন্টস দিচ্ছে। কখনো না পড়েই। কখনো দেখেও ইগনোর করে যাচ্ছে। আসলে কোনটা রেখে কোনটা দেখবে! তিন লাইনের কবিতা, পাঁচ লাইনের উপন্যাস, স্মৃতিকথা, প্রেমকাহিনী না অন্য কিছু! ইনবক্সে যে কথা চলাচালি হয় তাও আমরা ভুলে যাই। পড়া হয় না ঠিক মতো। এতো এতো বন্ধু! এতো কথা মনে থাকে! প্রচন্ড অমোনোযোগ অন্যের প্রতি।
আসলে মাথার মধ্যে অজানা ভয়, অজানা ভবিষ্যত, মৃত্যু চিন্তা। কে কখন চলে যায়। শোকে পাথর হয়ে গেছে মানুষ! ভোতা হয়ে গেছে অনুভূতি। আমিও একদিন চলে যাব। আর কখনো বন্ধুদের সাথে দেখা হবে না। আর কোনো পোষ্ট দেবো না। যারা ভালবাসে তারা আমাকে খুঁজবে কিন্তু পাবে না। যারা পছন্দ করে না তারা নির্বিকার থাকবে। মৃত্যুর মছিলে নতুন আর একটি মৃত্যু এমন কিইবা! একটি মহান ঘুম মাত্র!
টরন্টো ৭ জুলাই ২০২০
তবুও জীবন অনেক সুন্দর
যে কোনো অসুখ বিসুখ হলেই আমি ভেঙ্গে পড়ি। মনে হয় আর বাঁচব না। একেবারে মোটা দাগে নিজের শেষটা দেখতে পাই। আমি এতো শক্ত মানুষ না। আমার মনের জোর কম। অনেক সময় সামান্য ব্যাপারেও অনেক টেনশন করি, ভয়ে মরে যাই। আবার অনেক বড় বড় ঘটনায় আমি নির্বিকার থাকি। ডর ভয় আর শঙ্কা মাথায় নিয়েও নির্ভার হয়ে যাই। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। অনেক কষ্ট দিয়েছি মানুষকে। কিছুটা বুঝে দিয়েছি, কিছুটা আবেগে, কিছুটা না বুঝে। আবার কষ্ট পেয়েছিও কম না। এখন এই বেলায় এসে সব কষ্ট. রাগ,অভিমান,ক্ষোভ ভুলে গেছি। কিছুই মনে রাখিনি। সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমিও অন্যের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমি আমার আনন্দ বেদনাকে কখনো লুকাইনি। কিছু গোপন কষ্ট থাকে যা শেয়ার করা যায় না।
জীবন আসলে খুবই তুচ্ছ। কারোনাকাল বলেই না, যে কোনো কারণে, যে কোনো অসুখে, যে কোনো দুর্ঘটনায় মুহূর্তে চলে যেতে পারি। এখন এমন একটা বয়স, ষাটের দ্বারপ্রান্তে। এই বয়সটার কোনো গ্যারিন্ট নাই, মাথা মুন্ডু নাই। কোনো বয়সেরই গ্যারিন্টি নাই যদিও। কিন্তু এই রকম কাছাকাছি বয়সে আমার অনেক বন্ধুরা, অনেক আপনজন চলে গেছেন। ষাটের আগেও গেছে, পরেও গেছে। তাই সামান্য কিছু হলেও মনে হয় এটাই শেষ যাত্রা। অন্য সময়েও গভীর রাতে মুত্যু ভীতি পেয়ে বসে আমাকে। মনে মনে ভাবি এই সুন্দর পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে! তাই যাবই যখন রোগে শোকে কষ্ট না পেয়ে ঘুমের মধ্যে চলে যেতে চাই, কাউকেই কষ্ট দিতে চাই না। সেই রকম কী ঘটবে জীবনে!
সবসময় ভাবি কিছুইতো করা হলো না জীবনে। কত কি করার ছিল। শুধু শুধু সময় নষ্ট করলাম। সময়তো আর ফিরবে না। কিছু বই লেখার কথা ছিল, ভাল কিছু বই লেখার দরকার ছিল। সেসব লেখা হলো না। অথচ লিখব বলে জীবনে কত ত্যাগ স্বীকার করেছি। মা ছেড়েছি, ঘর ছেড়েছি। বরিশালে একটা লাইব্রেরী করার স্বপ্ন ছিল, চ্যারিটিবেল কিছু করার স্বপ্ন দেখি এখনও। অনেক মানুষকে ভালবাসার দরকার ছিল। আরো দেশ ঘোরার কথা ছিল। কখন যে শুরু করব সে সব! একটাই জীবন কত যে কাটা ছেঁড়া করতে হয়! কত যে ভাগাভাগি করতে হয়! জীবন সংগ্রাম করতে করতেই জীবনটা পার হয়ে গেলো।
তারমধ্যে দুঃখ কষ্ট, অভাব অনটন ছিল, অসুখ বিসুখে ভোগা ছিল। আনন্দ ছিল, ভালবাসা ছিল, প্রেম ছিল, পাওয়া ছিল। কি ছিল না! সবই ছিল। জীবন হচ্ছে একটা লড়াই। অনন্ত লড়াই। মানব জীবনের স্বার্থকতা কিসে! মানুষের জন্য কিছু করতে পারাটাই আসল কথা। যে কোনো অবস্থান থেকে কিছু করা। তারপর একদিনতো অনন্তের পথে যাত্রা করতেই হবে! কখন সেটাই শুধু জানা নাই। জানা থাকলে ভাল হতো। যে কোনো সময় হতে পারে সেটা-তাই প্রস্তুতি থাকা ভাল। এই লেখার অর্থ এই না যে মৃত্যু ভয়ে কাতর থাকতে হবে, মোটেই তা না। জীবন অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকা অনেক আনন্দের।
টরন্টো ১১ জুলাই ২০২০
হৃদয়ে মিলেছে হৃদয়
নারীদের কাছ থেকে সমসয়ই আমি আনুকল্য পেয়েছি। প্রশ্রয় পেয়েছি। তাই নারীদের কাছে আমার বেশি প্রত্যাশ্যা থাকে সবসময়। পুরুষদের চেয়ে নারীদের আমি বেশি প্রাধান্য দেই। আমি আমার মাকে নিয়ে অনেক লেখা লিখেছি। আমার স্ত্রী জেসমিন বা আমার মেয়ে অরিত্রিকে নিয়েও অনেক লিখেছি। ‘আমার মা’ নামে একটা বইও আছে। জেসমিন আর অরিত্রিকে নিয়ে যত লেখা লিখেছি সেগুলো দিয়েও আলাদাকরে বই হতে পারে। আমার জীবনে অসংখ্য ঘটনা আছে যেখানে নারীর পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই এই পক্ষপাত। এমন না যে আমি একজন সুদর্শন, ধনাঢ্য এবং বিশাল বড় কোনো ব্যক্তি। আমি খুবই সিম্পল একজন মানুষ। গোটানো মানুষ। নিজেকে তুলে ধরতে পারি না। আলোয় আসার চেষ্টা করিনি কখনো। লাজুক টাইপ মানুষ। নারীদের পছন্দ খুবই রহস্যে ভরা!
কয়দিন থেকে আমি অসুস্থ্য। ভার্টিগো টাইপ সমস্যায় বেসামাল অবস্থা। আগামী ৪ আগষ্ট ইএনটি স্পেশালিষ্টের সাথে আমার এপয়নমেন্ট। এখনও অনেকদিন বাকী। মাঝে মাঝে সত্যি আমি খুব বুদ্ধিমানের মতো কাজ করি এবং নিজেই নিজের বুদ্ধিমত্তায় অবাক হই। আমি করলাম কি গতকাল একটা ফোন দিলাম স্পেশালিষ্ট ডা. ব্রাড হুবার্টের অফিসে। ধরলেন তার সেক্রেটারী।
আমি বললাম, আমার তো অনেক খারাপ লাগে তুমি যদি কোনোভাবে আমার এপয়নমেন্টটা একটু এগিয়ে দিতে পার খুব ভাল হয়।
এদেশে যেটা হয় নিয়মের বাইরে কেউ যেতে চায় না। কিন্তু সেক্রেটারি মেয়েটি মোলায়েম কন্ঠে বলল, ধরো দেখি কোনো সুযোগ আছে কিনা।
আমি ফোন ধরে অপেক্ষা করছি। অধীর অপেক্ষা। মেয়েটি তিরিশ সেকেন্ড পরেই বলল,
তুমি আজকেই আসতে পারবা! ৪.২০ এ!
তখন দুপুর সাড়ে বারোটার মতো বাজে।
আমি বললাম, নিশ্চয়ই পারব।
মাত্র তিনদিন আগে এই এপয়নমেন্ট পেয়েছি। এখানে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানই সব। এই এপয়নমেন্টের জন্য রিকোয়েষ্ট পাঠিয়েছেন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। যখন যে ডাক্তার প্রয়োজন হয় সব ব্যবস্থাই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান করেন। আমার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানও একজন নারী, চাইনীজ ক্যানিডিয়ান, ডা হো চারমিন। উল্লেখ্য কালকেই ডা হোর সাথে আমার এপয়নমেন্ট ছিল। সময় ছিল দুপুর ২.৫০। ফোন করলেন ৩.১০ এ।
হাই জসিম কেমন আছ আজকে!
দুই দিন পর পর ফোন করে খবর নিচ্ছেন ডা হো।
একই রকম ফীলিংস। স্পিনিং, লাইটহেডনেস, ডিজিনেস আর একটু হার্টবীট।
ওষুধে কাজ হচ্ছে না!
ওয়েল ডাক্তার হো, আমার মনে হয় তেমন কাজ হচ্ছে না।
এক কাজ করো। ওষুধটা তিনবার না খেয়ে শুধু রাতে ঘুমানোর সময় খাও।
ওকে। বাই দ্য ওয়ে ডা. হো, আমার স্পেশালিষ্ট এপয়নমেন্ট ৪ আগষ্ট দিয়েছিল, আমি রিকোয়েষ্ট করে আজকেই করেছি। বিকেল ৪.২০ এ।
তুমি তো মিরাকল করে ফেলেছো!
ডাক্তার হো খুব খুশী।
বলল, তোমাকে একটু ওয়েট করতে হবে চেম্বারে। বিজি ডাক্তার। দুই ঘন্টাও লাগতে পারে। ড্রাইভ করবা না কিন্তু। কাউকে বলো নিয়ে যেতে।
কানাডায় যে কোনো স্পেশালিষ্টের এপয়নমেন্ট পেতে দুই থেকে ছয় মাস পর্যন্ত লেগে যায়। সেখানে আমার তিন দিনেই হয়ে গেলো! আমি ডাক্তার দেখিয়ে আসার সময় সেক্রেটারি মেয়েটিকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে এসেছি। বাংলাদেশে দেখেছি হাসপাতাল বা ডাক্তারের সিরিয়াল পেতে প্রভাবশালী কেউ থাকতে হয়, তদবির লাগে। বিপদে কোথায় যাবে জানেনা। দিশেহারা হয়ে আরো অসুস্থ্য হয়ে যায়।
এদিকে ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা তৈরী হলো। আমার ড্রাইভ করা নিষেধ। অর্ককে ম্যাসেজ দিলাম, তুমি ফ্রী থাকলে আমাকে একটু ড্রপ দিয়ে এসো। আমার বাসা থেকে অর্কর বাসা বেশ দূরে। বন্ধু আলমকে বললাম কিন্তু সে তার অনলাইন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। কোভিডের কারণে আমি উবার বা ট্যাক্সি এভোয়েড করতে চাচ্ছি। এর মধ্যেই অর্কর ম্যাসেজ, Baba Khatiza will come to take you because Iam verz busy with work. . আমি বললাম ওকে সমস্যা নাই। একটু পরই খাতিজার ম্যাসেজ, Baba do u need me to come? I can come, no problem।
আমার অসুস্থ্যতা নিয়ে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম ১৬ জুলাই। পোষ্টটা ছিল এরকম,..“৪ জুলাই রাতে প্রথম ধাক্কা। এরকম আগে কখনো হয়নি। নতুন অনুভূতি। খুব অস্বস্তি এবং কষ্টের। ডাক্তার বলছেন ভার্টিগো। এতোদিন নাম শুনেছি এখন নিজেই এর শিকার। ওষুধ খাচ্ছি। আশা করি ঠিক হয়ে যাব। বন্ধুরা দোয়া করো।..” বন্ধুরা এতো এতো উৎকন্ঠা আর শুভকামনা জানিয়েছেন যে আমি মনে মনে খুবই লজ্জিত হয়েছি। এই কান্ড এর আগেও আমি করেছি। শুধু শুধু মানুষকে উৎকন্ঠায় ফেলা। মানুষের কি আর অসুখ হয় না! পৃথিবীতে কত মানুষ কত কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে! যার কষ্ট সেই জানে। আর এই করোনাকালে জীবন আর মৃত্যু দুই যেনো সমান হয়ে গেছে। শোকের আয়ু একদিনের বেশি স্থায়ী হতে পারছে না। নতুন শোক পুরনো শোককে হটিয়ে দিচ্ছে। মানুষ পাথর বনে গেছে। সেই পোষ্ট দেওয়ার পর টরন্টোর একজন নারী আমাকে শুধু বিস্মিতই করেনি আমার চোখে পানি এনে দিয়েছিল।
সে ম্যাসেজ দিয়ে জানাল, ইফ ইউ নীড এনি হেল্প অর গ্রোসারিস প্লীজ লেট মী নো, আই ইউল ডু ইট ফর ইউ। কোনো দ্বিধা করবেন না দাদা। ভগবান যেনো আপনাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ্য করে দেন।
আমার অনেক নারী বন্ধু প্রতিদিন খোঁজ নিয়েছে, নামাজ পড়ে দোয়া করেছে। অন্ততঃ দুজন মানত করেছে।
একজন নারী ঢাকা থেকে লিখেছেন, জসিম ভাই, কালকে আমার টরন্টোর ফ্লাইট। কিছু দরকার হলে বলেন।
ঢাকায় তখন রাত। সাধারণতঃ আমি সহজে কারো ফেবার নিতে চাইনা তাও আমি একটা ওষুধের নাম বললাম। ভার্টিগোর ওষুধ। জেসমিনের ফ্রেন্ড রুমানা ওষুধটার কথা বলেছে।
তিনি ঘন্টাখানেক পর ওষুধের ছবি পাঠিয়ে বললেন, কেনা হয়ে গেছে, নিয়ে আসব।
এভাবেই নারীরা আমার প্রতি তার পক্ষপাত দেখিয়েছে। এতোটা আমার প্রাপ্য না। এই ভালবাসার কোনো তুলনা নাই। ভালবাসলেই শুধু ভালবাসা মেলে এটা জেনেছি। টরন্টো ১৮ জুলাই ২০২০