করোনার দিনগুলো
জসিম মল্লিক
বাংলাদেশঃ শঙ্কা ও ভয়!
কালকে টরন্টোর জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেল সিপি২৪ এর স্ক্রলে বার বার বাংলাদেশের খবর দেখাচ্ছিল। সম্ভবত আক্রান্তের সংখ্যা দশ হাজার ক্রস করেছে বলেই খবরটি গুরুত্ব পেয়েছিল। কানাডার মতো প্রো এক্টিভ দেশেও এখন পর্যন্ত ৬২ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, ২৬ হাজার রিকভারি করেছে এবং ৪ হাজারের মতো মারা গেছে। কানাডার লোক সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির কিছু কম। আয়তন প্রায় ১ কোটি বর্গ কিলোমিটার। জনঘনত্ব ৪ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সতেরো কোটির মতো। আয়তন দেড়লাখ বর্গ কিলোমিটার। জনঘনত্ব বারোশোর কিছু বেশি প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। সেখানে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮৭ জন মারা গেছে এবং ১১ হাজারের মতো আক্রান্ত হয়েছে।
আপাতঃ দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থা কানাডা বা ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় খুবই ভাল মনে হয়। সেকথা সরকার বারবার বলছেও। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী! পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন করোনা সামান্য সর্দি জ্বরের মতো। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন কিছু পত্রপত্রিকা এবং বিএনপি করোনা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মন্ত্রীদের কথা সত্যি প্রমাণের জন্যই হয়তবা লক ডাউন শিথিল করা হচ্ছে। গার্মেন্টস খুলে গেছে, শপিং মল খুলবে। এরপর অন্যরাও দাবী করবে। পরিবহণ দাবী করবে, হোটেল রেষ্টুরেন্ট দাবী করবে, কোর্ট কাছারি খুলবে। কিন্তু লোকজন মারাত্মক ভয় এবং শঙ্কার মধ্যে আছেন। প্রতিদিন বেড়েই চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা!
টরন্টো ৬ মে ২০২০
নতুন করে পাব বলে..
আমার মধ্যে সব সময়ই একটা ছন্নছাড়া আমি আছে। সন্ন্যাসী টাইপ আমি। ছোটবেলা থেকেই এই বাউল আমিকে লালন করি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নিজেকে মনে হতে লাগল আজব। অর্থহীন জীবন যাপন। শৈশব থেকেই আমি নির্জন হয়ে পড়ি। একলা একলা ঘুরতাম যেখানে সেখানে। বাড়িতে আমার খেলার সাথী বা পাড়ার সম বয়সীদের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠেনি কখনো। আমি খুব নিঃসঙ্গ একজন ছিলাম। আমি বুঝতে পারতাম আমি ওদের মতো না। ওদের মতো আমার কোনো স্বপ্ন নাই, উচ্চাশা নাই, বড় হওয়ার চেষ্টা নাই। ওসব বোধ তৈরী হয়নি। তখন থেকেই আমি মানুষের বড় হওয়ার চেষ্টাকে, জীবন ফেনানোকে ঘৃণা করতাম। সংসারী প্রতিটি মানুষের প্রতি আমার অনুকম্পা হতো। আমাকে নিয়ে কেউ কোনো আশা করেনি কখনো। কোনো অহংকার ছিল না কারো। সংসারের কিছুই আমি গ্রহণ করতে চাইনি, পৈত্রিক সম্পত্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলাম। বয়স নিয়ে মাথা ঘামাইনি, ধার্মিক না হয়েও সন্ন্যাসী মনে হতো নিজেকে।
চোখ বুজলেই একটা নদী দেখতে পেতাম, অথৈ নদী, ঘোলা জল, উঁচু বালিয়াড়ি, সাপের খোলস। এখনও সেই নদী আমার সঙ্গে আছে। দূর দিগন্তে চলে গেছে সমান্তরাল পথ, কাঁধে রুক-স্যাক, পায়ে ময়লা স্যান্ডেল, নোংরা জামা কাপড়, গালে খোঁচা দাড়ি-আমি চলছি। চোখে কোনো কামনা বাসনার বাস নেই, পরিষ্কার চোখ, সেই চোখে পাহাড়, অরণ্য, সমুদ্র। আজকাল প্রায়ই মনে হয় আরে অনেকিদিনতো বেঁচেছি! মৃত্যু ভয়ও কাজ করে। নিজেকে পুরনো মনে হয়, বয়ষ্ক একজন মনে হয়। বাউন্ডেলে স্বভাবটা কোথায় গেলো! যেনো আমার দৌড় সাজ ঘর থেকে স্টেজ পর্যন্ত।
কারো কাছে কখনো আইডল হতে চাইনি। এই যে আমি সংসারী- স্ত্রী, সন্তানদের কাছেও না। সন্তানরাই আমার আইডল। সব সময় মনে হয় বেরিয়ে পড়ব। রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় মুখে কয়েকটা সর্পিল রেখা ফুটে উঠে, আর ভিতর থেকে কেউ বলে উঠে বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। মৃত্যুভয়, ধ্বংসের ভয়, হারানোর ভয় সঞ্চারিত হয়না আর। কবেই নিজেকে নিজে মেরেছি। ভালবাসাই আমাদের দুঃখের কারণ কেননা সব ভালবাসার জিনিষেরই মৃত্যু আছে। আকাশ, বাতাস, মাটি অনেক নিয়েছি, সেটা শোধ করতে হবে। পৃথিবী আমার জন্য পড়ে আছে..।
টরন্টো ৯ মে ২০২০
মাদার্স ডে এবং একটু ছুঁয়ে দেখা..
অরিত্রি এমনই। সব মেয়েরাই তাই। বাবা মায়ের জন্য মন কাঁদে। বাবা মায়েরও কি কাঁদে না! খুব কাঁদে। অন্য সময় সপ্তাহে দুই তিনবার আসত অরিত্রি। ইউকএন্ডে তো কথাই নেই। হোক শনি বা রবি আসতোই। এসেই নিজের রুমে ঢুকবে, কিছুই তো চেঞ্জ হয় নাই। যেভাবে রেখে গেছিল সবকিছু সেভাবেই আছে। কিছুই নিয়ে যায় নাই। এমনকি কসমেটিকসও রয়ে গেছে। বাসার চাবির গোছাও একই আছে। এসে চেঞ্জ হবে, শাওয়ার করবে, খাবে।
একটু পরই বলবে বাবা চা বানাও।
আমি চা বানাই।
তুমি কিন্তু জীমে যাবা, কার্ব নিবানা।
আমি বলি ওকে।
সেই অরিত্রি গত প্রায় পঞ্চাশ দিন আসেনি। আসতে চায় কিন্তু আমি সায় দিইনা। আমি আর জেসমিন মাঝে মাঝে ডাউনটাউন যাই অরিত্রির এপার্টমেন্টের নিচে। অরিত্রি নেমে আসে। জেসমিন খাবার দাবার দিয়ে আসে। বেশিক্ষণ থাকি না। অরিত্রি ম্লান মুখে তাকিয়ে থাকে। আহারে! মনটা হুহ হু করে ওঠে।
অর্ক একটু বেশি সাবধান। সেও বাসার নিচে পর্যন্ত আসে। আমি দূর থেকে দেখি। তারপর চলে যায়। কিন্তু কাল ছিল মাদার্স ডে। অরিত্রি নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। আমরা গিয়েছিলাম গ্রোসারি করতে। এসে দেখি অরিত্রি বাসায়। মনে মনে আমি খুব খুশী। মায়ের জন্য গিফ্ট, ফুল ইত্যাদি নিয়ে এসেছে।
আমি বললাম, আম্মু ইফতার করে যেও।
অরিত্রি বলল, আচ্ছা।
অনেক কিছু তো শিখে ফেলেছো রান্না বান্না তাই না!
অরিত্রি আমাকে বৃত্তান্ত দেয় কি কি শিখেছে।
অর্ক আজকে এসেছিল ফুল নিয়ে। কিন্তু বাসায় ঢোকেনি।
আহা জীবন। নিজের সন্তানকে ছুঁয়ে দেখতে পারি না! গায়ের ঘ্রাণ নিতে পারি না!
টরন্টো ১১ মে ২০২০
মাথায় মধ্যে ভুতুরে একটা আকাশ ঢুকে পড়ে..
আজকাল মানসিক স্বাস্থ্যের কথা খুউব উচ্চারিত হচ্ছে। শুধু শারীরিক নয় মানসিক সুস্থ্যতাও জরুরী হয়ে পড়েছে। এই বিষয়টির উপর আগে কেউ জোর দেয়নি তেমন। কিন্তু এখন যে কঠিন পরিস্থিতি পৃথিবীতে তাতে মানসিক সুস্থ্যতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এরকম আরো অনেক দিন থাকলে কোটি কোটি লোক মানসিক ঝুঁকিতে পড়বে। অনেক মানুষ পাগল হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করবে। আমি নিজেও সেটা টের পাচ্ছি। খুব অস্থির লাগছে প্রতিদিন। কোনো কিছুতে স্বস্তি পাচ্ছি না। মনে হয় মাথার মধ্যে বিশাল একটা আকাশ ঢুকে পড়েছে। মেঘের মতো আবছা সবকিছু। প্লেন যেমন মেঘের উপরে উঠে গেলে সবকিছু ধোঁয়াটে দেখায় আমারও তেমন অবস্থা। দিকচিহ্নহীন আকাশের দিকে তাকালে যেমন অপার্থিব লাগে তেমন।
মনে হয় আমি এই পৃথিবীর আর কেউ না। আমার আর কোনো অধিকার নেই। পৃথিবীর অনেককিছু ভোগ করেছি অনেকদিন। পৃথিবী এখন তার শোধ তুলছে কড়ায় গন্ডায়। আকাশের ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছি পালকের মতো। বোধবুদ্ধি কিছু কাজ করছে না। মাথার মধ্যে ঝম্ ঝম্ একটা শব্দ হয়। তখন পাগল পাগল লাগে। আজকাল যখনই কিছু পড়তে বসি, একটানা কিছুক্ষণ পড়ার পর মাথায় কোথাকার কোন সাজঘর থেকে দু’খানা নূপূর-পরা পা মাথার মঞ্চে চলে আসে নাচতে নাচতে। কীরকম রিম্ঝিম্ শব্দ হতে থাকে। সেই শব্দে একধরণের সম্মোহন জাগায়। চোখের সামনের সব দৃশ্য মুছে গিয়ে ফুটে উঠে এক শূন্যতার দৃশ্য। কেবল শব্দ আর শব্দ। রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ -দু’খানা নাচের পা ঘুরছে, উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিম দিচ্ছে সব গুলিয়ে। সেই শব্দে সব বোধ বুদ্ধি ডুবে যায়।
পাখিদের মতো মানুষের পালক নেই যে উড়ে গেলেও দু’একটা পালক পড়ে ধাকবে। কিন্তু পালকের মতোই হালকা মিহি নরম কী যেনো সব পড়ে আছে চারিদিকে টের পাওয়া যায়। হাওয়া দিলে সেগুলো উড়ে উড়ে বেড়ায়। চোখে দেখা যায় না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখা যায় জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে বিছানা ভাসিয়ে দিচ্ছে। সেই জ্যোৎস্নার দিকে অনেকক্ষন চেয়ে থাকলে হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় হাল্কা কুয়াশার মতো কী যেন ভেসে আছে। ঘুরছে ফিরছে উঠছে নেমে আসছে। এসবই হয়তবা মানুষের অদৃশ্য পালক। যেখানে মানুষ কিছুদিন বাস করে সেইখানে তার কথার স্বর বাতাসে থেকে যায়। থাকে কামনা বাসনার ছাপ, ইচ্ছে অনিচ্ছা থেকে যায়। সে সবই হালকা মিহিন পালকের মতো ঘোরে ফেরে, বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
জানালার ডালে একটা নিমডাল ঝুঁকে পড়েছে। নতুন বর্ষার পাতা এসেছে। সতেজ পাতা। তাতে রোদ পড়ে সবুজ আলো দিচ্ছে চারধারে। পোকামাকড়ের আনন্দের শব্দ ওঠে চারিদিকে। একটা কেন্নো জানালার শিক বায়। সতেজ নিমগাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে ঐ দূরের মেঘহীন আকাশ দেখা যায়। ঐখানে থাকে স্বপ্নের শিশুরা। লাল নীল বল। চারদিকে ওড়াওড়ি করে মানুষের ফেলে যাওয়া পালক। জানালা দিয়ে মেঘভাঙা রোদ এসে পড়ে। চারদিকে আলোয় আলোময়। চড়াই পাখিরা উড়ে আসে ঘরে। আসে এক-আধটা মৌমাছি, ফড়িং। পিঁপড়েরা দেয়ালে বায়, কেন্নো আসে, সবুজ পোকা একটা জানালার শিক বেয়ে ওঠে। ভেজা জঙ্গলে রোদ পড়ে একটা বুনো মিষ্টি গন্ধ ছড়াতে থাকে। বকুলগাছ যখন অন্ধকারে তার বকুল ঝরায় তখন সেই পতনশীল বকুলের শব্দে গন্ধে পুরনো সব কথা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
রাতে অদ্ভুৎ সব স্বপ্ন দেখি। কোনো মাথা মুন্ড নাই যার। এমন এমন সব মানুষদের এমন সব অবস্থায় দেখতে পাই যা কখনো ভাবিনি। অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়, বিদঘুটে, হাস্যকর ঘটনা ঘটে স্বপ্নে। নিজেকে অচেনা লাগে। জেসমিনকেও মনে হয়ে একটা চলমান শরীর আমার আশ পাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করছে। স্বপ্নে বিদঘুটে সব ব্যাপার ঘটে, হরর মুভির মতো গাড়ির পিছনের সীটে একটা মৃতদেহ বসে আছে। কে যেনো কখন অলক্ষ্যে মৃত দেহটি পাচার করে গেছে। একটা মৃত লোক বসে আছে পিছনের সীটে। ঘাড় লটকে-লট্পট্ করছে দুলুনিতে। হঠাৎ পিছনের সীটে মচ করে শব্দ হয়। পরিষ্কার শব্দ। কোনো ভুল নাই। ঐ ডেডবডিটা। বস্তুত ডেডবডিটা দেখা যায় না কখনো। কিন্তু শালা আছে ঠিকই। ডাকটিকিটের মতো সেঁটে আছে।
এভাবেই আধাভৌতিক দিন যায়, দুপুর গড়ায়, ভোর নামে। আর প্রতিদিন একটু একটু করে মাথায় মধ্যে একটা ভুতুরে আকাশ ঢুকে পড়ে..।
টরন্টো ১৫ মে ২০২০
ঈদের ঘুম
ঘরবন্দী ঈদ আমার জন্য নতুন কোনো ঘটনা না। এরকম অনেক ঈদ আমার জীবনে এসেছে। তাই ঈদে বাইরে যেতে পারব না বলে খারাপ লাগছে না। কোলাকুলির ব্যপারেও আমি একটু শাই। প্রিয়জনদের বাড়িতে সেমাই আর পোলাও মাংস খাওয়া হবে না বলে খারাপ লাগছে না। জীবন এমনই। কত ঈদ এভাবে পার হয়েছে! মনে আছে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতাম প্রায়ই বরিশালে ঈদ করতে যেতে পারতাম না। হল খালি হয়ে যেতো। খা খা শূন্য হল। আমার মতো দু’চারজন হলে পড়ে থাকত। তারা কেনো যেতোনা তা কখনো জানা হয়নি। আমি যেতাম না কারণ আমার যাওয়ার লঞ্চভাড়া থাকত না তাই। নতুন কাপড় কেনা হয় নাই তাই। জানি মা পথের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। কবে আসব আমি। কিন্তু মাকে বলতাম, মা, ঈদের পর পরই আমার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা তাই আসতে পারব না। মা কষ্ট পেতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। ঈদের দিন অদ্ভুত ঘুম পেতো আমার। ঘুম থেকে উঠে হলের বিশেষ ফীষ্ট খেতাম মজা করে।
টরন্টো ২৪ মে ২০২০
এ কেমন ঈদ!
এমন করুন আর দুঃখী ঈদ আর আসেনি। তবুও কাল ঈদের দিন টরন্টোতে একটা ঈদ ঈদ আবহ ছিল। আমি যে এলাকায় থাকি সেটা মুসলিম সংখ্যাধিক্য বলেই এমনটা মনে হয়েছে। আমার অন্য ধর্মের বন্ধুরাও ঈদ উৎসবে সামিল হয়েছে, শুভেচ্ছায় ভাসিয়েছে, ছবি পোষ্ট করেছে। অনেকেই সীমিত পরিসরে প্রিয়জনদের সাথে দেখা করেছে। অতি সহসীরা খানিকটা কাছেও গিয়েছে। বাংলাদেশ আর এক ধাপ এগিয়ে ছিল। যদিও গন পরিবহন বন্ধ আছে তা সত্বেও অনেকে নাড়ীর টানে ছুটে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। যারা সচেতন তারা ঘরেই আছেন।
আমাদের ঈদ ছিল ভিন্নমাত্রার। আমি একা একা ঈদের নামাজ পড়েছি। নতুন কাপড় পড়া হয়নি। কোথাও যাওয়া হয়নি। ঈদের দিন অরিত্রি এসেছিল গিফট নিয়ে। অরিত্রি আসবে এটা জানা কথা। একজন কেউ না এলে ঈদ ১০০ ভাগ দুঃখের হতো। রান্না করে বসে আছে জেসমিন কে খাবে! অর্ক অতিরিক্তি সতর্ক তাই বাইরে থেকে দেখা করে চলে গেছে। তবে সারপ্রাইজ হচ্ছে অর্ক আর খাতিজা ফুল সহ মজার মজার খাবার- রোষ্ট, কোফতা, গাজরের হালুয়া, কুকি ইত্যাদি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। ওয়াও! আমি দূর থেকে ছবি তুলে রেখেছি।
টরন্টো ২৫ মে ২০২০
করোনাকাল এবং সিনেমার গল্প..
১৯৭৩ সালে ’রংবাজ’ সিনেমা দেখে আমি প্রথম একশন মুভির প্রেমে পরি। তখন আমার বয়স কতই আর। বারো হবে। সেই থেকে সিনেমা মানেই একশন।
রংবাজ সিনেমার প্রথম দৃশ্যটা ছিল এমন, নায়ক রাজ্জাক জসিমকে বলে, কিরে জসিম তুই নাকি আজকাল মাস্তানি করছস।
জসিম বলে, করছি তো কি হইছে।
রাজ্জাক এরপর জসিমের পিঠে টোকা দিয়ে বলে এই জসিম,
জসিম ঘুরে তাকাতেই মুখে প্রবল ঘুসি। তারপর হেভি ফাইট। এখনও টিভির রিমোট হাতে নিয়ে ছবির জেনেরি একশন কিনা দেখি আমি। নিদেনপক্ষে থ্রিলার হলেও চলে। হলিউড মুভি আমার প্রথম পছন্দ, তারপর হিন্দী। আজকাল ঢাকার মুভিতেও ভাল একশন করে। স্পেশাল ইফেক্টগুলো ভাল হয়। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঢাকাইয়া একশন মুভি দেখলাম।
আবার এটাও ঠিক একশন ছবিতে টু মাচ ভায়োলেন্স আমার পছন্দ না। আমি পছন্দ করি সফট ভায়োলেন্স, যেমন ভিলেন ঘুষি খেয়ে স্লো মোশনে উড়ে গিয়ে ঝুর ঝুর করে কাঁচ সহ ভেঙ্গে পড়বে, নায়ক ঘুষি খেয়ে পড়ে গিয়েও ব্যাঙের মতো জাম্প করে উঠে দাঁড়াবে এই রকম দৃশ্য। গান ফাইট পছন্দ আমার। শিহহহহ শব্দ তুলে রিভলভারের গুলি থ্রি ডাইমেনশনে চোখের সামনে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে এফোর ওফোর করে দেবে দুষ্ট লোকের বুক। ছুড়ি, চাকু, তলোয়ার, বর্শা, তীর, ধনুক আমার পছন্দ না। এজন্য ঐতিহাসিক ছবি আমি দেখিনা। হরর বা সাইন্স ফিকশনও না পছন্দ। যখনই ভায়োলেন্স টাইপ কোনো দৃশ্য সামনে আসে, যেমন ঝক ঝকে ধারালো নাইফ দিয়ে কন্ঠনালী ঘ্যাচাং করে পোচ দিয়ে কেটে ফেলবে বা কথা আদায় করতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলবে মনে হলেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। অপরাধীকে যখন আচ্ছামতো পেটায় তখন আমার ধমনীতে রক্তের নির্যাস ছোটা ছুটি করে। মনটা তৃপ্ত হয়।
করোনা নিয়ে প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখতাম। এখন লিখি না। লিখতে ইচ্ছে করে না। লেখার মন নাই। মন বিষন্ন। তাই এখন স্মৃতিকথা, ফিলোসফিক প্রেম, ছেলে মেয়ে এসব এলেবেলে টাইপ লেখা লিখি। অনেকটা একশন ছবির ভায়োলেন্স থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর মতো। করোনা ভুলে থাকার চেষ্টা। ব্ইমেলার জন্য উপন্যাস লেখার কথা ছিল। বইমেলা হবে কিনা কে জানে! পৃথিবীতে কোথাও কোনো ভাল খবর নাই। প্রতিদিন মুত্যুর খবর। রাতে ঘুমাতে পারি না। মন শরীরের উপর প্রভাব ফেলে প্রবলভাবে।
এর আগেও পৃথিবীতে অনেক প্লেগ এসেছে, অনেক মানুষ মরেছে, আবার একদিন ঠিক হয়ে গেছে। বন্ধু কবি মোয়াজ্জেম খান মনসুরের একটা লেখা থেকে জানলাম ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকান সৈন্যরা এক ভয়ংকর মরণ ব্যাধি নিয়ে এসেছিল। হংকং ফ্লু নামে এই রোগে এক লাখ আমেরিকান এবং চার হাজার কানাডিয়ান মারা গিয়েছিল। ইউরোপেও হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। তখন এতো প্রচার ছিল না।
সাংবাদিক নঈম নিজামের একটি সচিত্র পোষ্টে দেখলাম ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর সময় থেকেই মানুষ মুখে মাস্ক, হাতে গ্লভস পড়ত এবং দশ জনের বেশি একত্রিত হতে পারত না। একশ বছর পরও নিয়ম কানুন তেমন পাল্টায়নি। সে সময় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। এখন হাইটেকের যুগ বলেই এতো আপডেট জানতে পারছি আমরা এবং হতাশাও বাড়ছে।
দুর্যোগ আর হতাশা কেটে যাবে একদিন। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন। সুন্দর ভোর হবে। ইতিমধ্যে আমরা অনেক আপনজন হারিয়েছি। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। কার কখন ডাক আসবে জানা নেই। আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সেটা হচ্ছে আমরা কি একটুও বদলেছি! আমরা কি আমাদের ভিতরের পশুটাকে একটুও দমন করতে পেরেছি! সত্যবাদী হতে পেরেছি! নিজেকে নিজে এই প্রশ্ন করার দরকার আছে।
আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না…
মিনেসোটা অঙ্গরাজ্জ্যের জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ছয় মিনিটের ভিডিওটি দেখে চমকে গেছি! নির্মম, নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড। একজন প্রতক্ষদর্শী ভিডিওটি করেছে। তাতে দেখা যায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওফিন ফ্লয়েডের গলায় হাটু চেপে ধরায় ফ্লয়েড নিশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার বলছেন, ’আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না’। কুৎসিত বর্ণবাদের জঘন্যতম ঘটনা এটি। এই পৈশাচিক ঘটনায় পুরো আমেরিকা ফুঁসে উঠেছে। শ্বেতাঙ্গরাও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। অনেক শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কানাডায়ও প্রতিবাদ হয়েছে। উত্তাল আন্দোলনে চাপা পড়েছে করোনা ভীতি। ডেরেক চাওফিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তার কমপক্ষে ১২ বছরের জেল হবে বলে খবরে বলা হয়েছে। বর্ণবাদকে আমি ঘৃণা করি। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বর্ণবাদ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। পৃথিবী থেকে বর্ণবাদকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে এবং এখনই সময়। আর যেনো কেনো ফ্লয়েডকে বলতে না হয় আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।
জসিম মল্লিক
টরন্টো ৩১ মে ২০২০