করোনার দিনগুলো

জসিম মল্লিক

(চতুর্থ পর্ব)

এইভাবে বেঁচে থাকা

যার সাথেই কথা বলি সেই বলে ভাল নাই। আমরা কেউ ভাল নাই। ভাল থাকার কথাও না। আমরা কেউ কাউকে ভাল রাখতে পারছি না। সবার এক ও অভিন্ন সমস্যা। যদিও সবাইকে বলি ভাল থাক, সাবধান মতো থাক। আসলে আমি নিজেই কি ভাল আছি! এখনও যে বেঁচে আছি এটাই আসলে ভাল থাকা। এটাই আর্শীবাদ, এটাই বোনাস লাইফ। কারো সাথে কারো দেখা হয় না, স্পর্শ হয় না। ঘর থেকে বের হওয়া যায় না, বের হলেও দ‚রত্ব বাজায় রাখতে হয়, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লা­ভস। বিরাট ঝক্কি। বাইরে বের হওয়ার ইচ্ছাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আবার ঘরে অর্হনিশি বসে থাকাও যন্ত্রণাদায়ক। পথ চলতে মানুষ দেখলে দ্বিধাভরে দ‚রত্ব রচনা করি। গ্রোসারি করতে যাওয়া যেনো এক আতংক! যতই সোশ্যাল ডিসটান্সিং থাক কাছাকাছি হতেই হয়। আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি পরস্পরের কাছে থাকতে, সান্নিধ্যে পেতে, আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে। এভাবে কি মানুষ বেশিদিন বাঁচবে! একঘরে থেকেও পরস্পরের কাছ থেকে দ‚রত্ব রচিত হয়। আত্মীয়, বন্ধু এমনকি সন্তানরা পর্যন্ত কাছে আসতে পারে না, পাশে থাকতে পারে না।

কিন্তু তারপরও জীবন থেমে নেই। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, হাজারো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কিন্তু মানুষের লড়াই থেমে নেই। লড়াই করছে বিজ্ঞানীরা একটি কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য। মানবতাকে বাঁচানোর জন্য লড়াই। দেশে দেশে সরকারগুলো তার জনগনকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। নানা ভাবে সাহায্য করছে, প্রণোদনা দিচ্ছে। লড়াই করে বাঁচার নামই জীবন, এটাই সভ্যতা। দেশে দেশে লকডাউন উঠে যাচ্ছে। এর মধ্যেই বাঁচতে হবে। অভ্যস্ত হতে হবে এই জীবনে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল করতে হবে। তাই জীবনের ঝুঁকি থাকলেও পথে নামতেই হচ্ছে মানুষকে। অনেকেই এসবের মধ্যেও কাজ চালিয়ে গেছেন। পৃথিবী জুড়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা শ্রদ্ধার আসনে জায়গা করে নিয়েছেন।

টরন্টো ১ জুন ২০২০

আমি লঞ্চের সারেং হতে চেয়েছিলাম

ছাত্র হিসাবে আমি মোটেও ভাল ছিলাম না। কিন্তু আমার ইমাজিনেশন ভাল ছিল। আইডিয়ার উপর দিয়ে আমি চালিয়ে নিতাম। স্কুলের পড়াশুনা আমার ভাল লাগত না। আমি বনে বাদারে ঘুরে বেড়াতাম, ঘুড়ি উড়াতাম, মার্বেল আর চারা খেলতাম। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতাম আর লাইব্রেরী থেকে গল্পের বই এনে পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়তাম। বাউন্ডেলে টাইপ ছিলাম। বাড়ির অন্য ছেলেদেরকে আমার সাথে মিশতে দিত না। মা বলত, লেখাপড়া না শিখলে খাবে কি! কিন্তু আমার একদম পড়তে ভাল লাগত না। মনে আছে ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছি। প্রোগ্রেস রিপোর্ট নিয়ে বড় ভাইকে দেখালাম। বড় ভাই ছিল আমাদের জম। তিনি রিপোর্ট দেখে বললেন, ফার্ষ্ট না, সেকেন্ড না, থার্ড! এতো ফেল!

সে যাত্রা বড় ভাবি আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন।

মা চাইতেন আমি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কিছু হই। কিন্তু আমি মনে মনে লঞ্চের সারেং বা বাস ড্রাইভার হতে চাইতাম। এমনকি আমি সিনেমা হলের টিকেট চেকার বা দর্জিও হতে চেয়েছিলাম। লঞ্চ, বাসে চড়ে দূরে দূরে চলে যাওয়া যায়, সিনেমা হলের চেকার হলে প্রতিদিন ফ্রী সিনেমা দেখতে পারতাম আর দর্জি হলে মেয়েদের বøাউজের মাপ নিতে পারতাম। কিশোর মনটাই এমন! আমার স্পর্শ উপন্যাসে এইসব ঘটনার কথা আছে।

ইউনিভার্সিটিতে মোটেও পড়াশুনা করতাম না। বিচিত্রায় কাজ করে যা পাই তাই দিয়ে কোনো রকম চলি। প্রায়ই না খেয়েও থাকি। বিকেল হলে রোকেয়া হল আর টিএসসির পাশ পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করি। কখনো শাহবাগে আঁতেল দেখতে যাই। জেসমিন নামে একটি রুপসী মেয়ে আমাকে নোট সাপ্লাই দেয়। আমি সেসব মুখস্থ করি। এই হলো আমার ছাত্র জীবনের ইতিহাস।

কিন্তু আমার ছেলে মেয়ে দু’জন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। অর্ক একদমই পড়তে চাইত না, শুধু গল্পের বইয়ের নেশা। গুজবাম্পস আর জিআইজু ছিল ফেবারিট। ছিল খুব চঞ্চল। স্থির হয়ে চেয়ারে বসত না পর্যন্ত। কিন্তু ক্লাসে ফার্ষ্ট সেকেন্ড হতো। ব্যবসা বা ঘুষ ওয়ালা চাকরি না থাকলে স্কলাস্টিকার মতো স্কুলে ভর্তি হওয়া সহজ ছিল না। আমরা দু’জন তখন মোটামুটি ঘুষ ছাড়া ভাল চাকরি করি। সুপারিশ করার মতো প্রভাবশালী কেউ নাই। কিন্তু অর্ক এবং অরিত্রি দু’জনই ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করেছিল। অতি ভাল। অরিত্রির ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটু ঝামেলা করেছিল কিন্তু আমি যখন চ্যালেঞ্জ করলাম, তখন তারা বাধ্য হয়েছিল ভর্তি নিতে। অরিত্রির যখন আড়াই বছর বয়স তখন ইন্টারভিউ দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলের চেয়ারপারসন ইয়াসমিন মোরশেদ ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। তিনি বার বার আমাদের স্টাটাস জানতে চাইছিলেন। দু’জনকে পড়ানোর সামর্থ্য আছে কিনা এটা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন।

অর্ক অরিত্রির মধ্যে মিল যেটা সেটা হচ্ছে দু’জন একই প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়েছে। কানাডা আসার পর এলিমেন্টারি স্কুল, মিডল স্কুল, হাই স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব এক। অর্ক যখন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে সেন্টজর্জ ক্যাপাসে এডমিশন নিল অরিত্রি সিদ্ধান্ত নিল সেও একই ক্যাপাসে যাবে।

আমি বললাম, দু’জন দুই ইউনিভাসির্টতে যাও। অরিত্রি রাজী হলো না, সে বলল, ভাইয়া যেখানে পড়বে আমিও সেখানে পড়ব।

অর্ক খুব ইজিগোয়িং। চাপ নিতনা কখনো। কোনো টেনশন ওকে স্পর্শ করে না। ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষার আগের রাতেও দেখেছি সে গল্পের বই পড়ছে।

কিছু বললে বলত, রিলাক্স থাকার জন্য গল্পের বই পড়ছি।

কিন্তু অরিত্রি খুব সিরিয়াস। ঢাকায় যখন স্কুলে পড়ে তখনও দেখতাম গাড়িতে বসেও পড়ত। ড্রাইভার বা কাজের মানুষদের কখনো ব্যাগ ধরতে দিত না, নিজের ব্যাগ নিজেই কাঁধে নিত।

অরিত্রি একদিন আমাকে বলল, বাবা, ভাইয়া হচ্ছে গফট গিফটেড ট্যালেন্ট কিন্তু আমি তা না। আমি ট্রাই করি ওর মতো হতে। ও আমার আইডল। ওর সমান হতে চাই। তাই আমাকে একটু বেশি পরিশ্রম করতে হয়।

ওদের জন্য কখনো প্রাইভেট টিউটর দরকার হয়নি। জেসমিন পড়াত অথবা অর্ক হেল্প করত। টিউটরের জন্য আমার অনেকগুলো টাকা বেঁচে গেছে!

আমি নিজে অংকে অতি জঘন্য ছিলাম। অংকের ভয়েই পড়াশুনা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। এলজাবরা পারতাম না বলে বাতেন স্যার ঠাস ঠাস করে বেতের বারি মারত হাতের তালুতে।

আজকালকার ছেলে মেয়েরা অনেক ট্যালেন্ট। আমরা ছোটবেলায় পুষ্টিকর খবার পাইনি, ক্যালরির হিসাব জানা ছিল না। কিন্তু এখনকার ছেলে মেয়েরা অনেক ভাগ্যবান। তারা গর্ভে থাকতেই পুষ্টির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে..।

টরন্টো ৫ জুন ২০২০

ফেসবুক নিয়ে কথা, ফেসবুক আসলে কেমন!

আমার ফেসবুক বন্ধুদের ব্যাপারে আমি খুবই প্যাশোনেট। অনেকের সাথে বন্ধুত্বের বয়স দশ বছর হয়ে গেছে। আমরা যেনো পরস্পরের আত্মীয় হয়ে গেছি। দেখা সাক্ষাৎ না হলেও যেনো চিনি একে অপরকে। ভাব বিনিময় হয়। চেনা হয়ে যায় লেখায়, ছবিতে। আমার এমন কয়েকজন বন্ধু আছে যারা আমি যাই পোষ্ট দেই, লাইক দেয়, কমেন্টস করে। একজনকে পেয়েছি ২০১৪ থেকে যাই লিখেছি তাতেই লাইক দিয়েছে। আমি কারো ভাই, কারো পিতৃসম, কারো আঙ্কেল, কারো বন্ধু হয়ে উঠেছি। আমার ভাললাগে এসব! অনেক পিচ্চি বন্ধুও আছে। পনেরো বিশ বছরের কিন্তু বন্ধু হতে আটকায়নি। অনেকের সাথে চেনা পরিচয়ও হয়েছে। যখন বইমেলায় যাই আমার নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয় হয়। বই কিনে অটোগ্রাফ নেয়। আমার যারা ফলোয়ার তারাও। এরচেয়ে সুন্দর আর কি হতে পারে!

ফেসবুক একটা অসাধারণ মাধ্যম। মানুষের কাছে যাওয়ার মাধ্যম। মানুষকে ভালবাসার বিরাট সুযোগ। করোনাকালের এই অবরুদ্ধ জীবনে ফেসবুক এক মহা আর্শীবাদ। না হলে জীবন হতো আরো দুঃসহ। ফেসবুক থাকার কারণে দ্রুত তথ্য আদান প্রদানই নয়, আত্মীয় বন্ধুদের সাথে কমিনিউকেশন সহজ হয়েছে। আবার মনের উপর চাপও বেড়েছে। খারাপ সংবাদগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তা সত্বেও ফেসবুক উপকারীও বটে। নানা গ্রুপ হচ্ছে, লেখালেখির গ্রুপ, কবিতার গ্রুপ, সাহিত্যের গ্রুপ, বিজনেস গ্রুপ। ফেসবুক এক বিশাল সমুদ্রের মতো। ফেসবুক থাকায় অনেকে পত্র পত্রিকায় লেখাই ছেড়ে দিয়েছে। যারা আগে কখনো লেখালেখি করেননি তারাও লিখে হাত পাকিয়েছেন। লেখক তৈরী হয়েছে। পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ এখনও পড়ে। ভাল লেখা অবশ্যই পড়ে।

আমার একজন বন্ধু আছে। বয়স বাইশ তেইশ হবে। দুবাই থাকে। সুদর্শন দেখতে। একবার আমার সাথে দেখা হয়েছে। ফেসবুকে তার প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফলোয়ার! ভাবা যায়! হ্যাঁ ভাল যেমন আছে মন্দ দিকও আছে কিছু। ফেসবুকের কারণে অনেকের সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়েছে। আবার অনেক মধুর সম্পর্ক গড়েছে। অচেনা চেনা হয়েছে। অধরা ধরা দিয়েছে। প্রেম, প্রণয়, হয়েছে। ভাঙ্গনও হয়েছে। ফেসবুকের কারণে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে উঠেছে, অন্যায়ের প্রতিকার হয়েছে আবার মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে সমাজ ও ব্যাক্তির ক্ষতি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারনে দেশে দেশে আইন পর্যন্ত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অনেকে সরকারের রোষানলে পড়েছে। ফেসবুকের কল্যানে কে সত্যিকার আদর্শবান, কে চামচা সেসব চেনাও সহজ হয়েছে। লুটেরাদের সম্পর্কে জানতে পারছে মানুষ। অনেকে আছে মাত্র এক লাইন দু’লাইন পোষ্ট দিয়েই সেলিব্রেটি! কয়েক হাজার লাইক আর কমেন্টস থাকে। কেউ কেউ শুধু ছবি পোষ্ট করেই সেলিব্রেটি! বিশেষকরে মেয়েরা। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন একটা আর্ট বটে। অনেক গ্রুপে দেখা যায় সস্তা আর আধা অশ্লীল টাইপ লেখায় হাজার হাজার লাইক কমেন্টস থাকে। তবে ফেসবুকে মানুষ সবসময় ভাল লেখা, সত্যবাদিতা আর সহজ সরল ভাষা পছন্দ করে।

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখি ম্যাসেজে ভরে আছে ইনবক্স। অনেকে বিরক্ত হন। আমি হইনা। এসব থেকেও অনেক কিছু জানার থাকে। আমি সহজে আনফ্রেন্ড বা বø­ক করি না কাউকে, তাই অনেক রিকোয়েষ্ট অপেক্ষমান আছে, তাদের সুযোগ দিতে পারি না বলে খারাপ লাগে। আবার একেবারেই যে আনফ্রেন্ড করি না তা না, বøকও করি। অনেকে দীর্ঘদিন থেকে নিথর হয়ে আছে। হয়ত সে আর এক্টিভ নাই। অনেকে যন্ত্রণায় অতিষ্ট করে ফেলে তাদের বাদ দেই। ঘোষনা দিয়ে বাদ দেওয়ার পক্ষে আমি নই। বাদ দিতে গিয়ে অনেক সময় ভুল হয়। আমাকেও অনেকে বাদ দেয় নিশ্চয়ই। অনেকে প্রোফাইল লক করে ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পাঠায়, তাদেরও আমি সুযোগ থাকলে একসেপ্ট করি। অনেক ফেক আইডি থাকে সেগুলো জানতে পারলে সরিয়ে দেই।

বন্ধু তালিকায় একমুখো এবং দলকানা আছে অনেক। সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন খারাপ ঘটনাগুলো ঘটে তখন তারা নিশ্চুপ থাকেন। তাদের সুযোগ সুবিধা নষ্ট হতে পারে এই ভয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না। বরং ঘটনা অন্য দিকে প্রবাহিত করার জন্য তখন ফুল পাখী লতা পাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সমাজের চেনা মানুষরাই এটা করেন। ফেসবুকের কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের সরকার অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটাও বিরাট প্রাপ্তি। সর্বশেষ উদাহরণ জর্জ ফ্লয়েড।

অনেকে ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে খুব সোচ্চার। যে কোন ছোট খাট ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এইসব ক্ষেত্রে আমি নিরব থাকার চেষ্টা করি। কাউকে সমর্থন করি না। ধর্মের চেয়েও মানুষ বড়। মনুষত্ব বড়।

আমাকে যারা একদমই পাত্তা দেয় না, কখনো কোনো লেখা বা পোষ্টে লাইক কমেন্টস করেনা তেমন বন্ধুও আছে ভুড়ি ভুড়ি। কিন্তু তাদের পোষ্টে আমি সাড়া দেই। এটা তাদের প্রাপ্য বলে তারা মনে করে, আমারও তাতে সম্মতি আছে। অনেকে আছে লেখা পড়ে ঠিকই কিন্তু লাইক কমেন্টস করে না। তাদের কিছু হিসাব নিকাশ আছে। লাইক দিয়ে অন্যের বিরাগভাজন হতে চায় না এমনও আছে। আবার অনেক হেভিওয়েট যারা তারা মনে করে কোনো একজনকে লাইক দেওয়া মানেই তাকে উপরে তুলে দেওয়া বা অন্যে কি ভাববে! অনেকে আছে বন্ধু হয় কিছু পাওয়ার জন্য। কেউ কেউ শুরুতেই টাকা পয়সা চেয়ে বসে। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ধরণের দাবী থাকে। অনেকের সত্যি সাহায্যের প্রয়োজন। কিছু বন্ধু আছে অলঙ্কার হিসাবে। নিজের ফেসবুকের সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য।

ফেসসবুক মানুষের মনোজগত চিনতে সাহায্য করে। কেনো যেনো মনে হয় পরষ্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থার সঙ্কটে ভুগছি আমরা। অনেকে বিশ্বাসের অমার্যদা করে বলেই এমনটা হচ্ছে। মেয়েরা বেশি যন্ত্রণাগ্রস্থ হয়, পুরুষও হয়। তাই আস্থার জায়গাটা ফিরিয়ে আনতে হবে। সবকিছুরই ভাল মন্দ থাকে। তাই আমাদের সবসময় ভালর অন্বেশন করতে হবে। ফেসবুকের কারনে দ্রুতই বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের রকমফের। অনেকে সামান্য কারণে ভুল বোঝে, অভিযোগ করে। আমার সম্পর্কেও অভিযোগ আছে। যে কেনো সম্পর্কই হচ্ছে রেসিপ্রোকাল। গিভ এন্ড টেক। আমি যে কারো বন্ধু হতে পারি। আমার কোনো সমস্যা নাই। সেদিন দেখলাম একজন লিখেছে, তার বন্ধু হতে হলে রেফারেন্স লাগবে। আমার এসব মনে হয় না।

কিছু সম্পর্ক আছে পাথরের মতো ভারি। বহন করা যায় না। যন্ত্রণাদায়ক। কিছু আছে তোষামোদির সম্পর্ক। বস আর কর্মচারি যেমন তেমন। কিছু আছে লেনাদেনার। যেখানে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা আছে সেখানে তোষামোদি আছে। ক্ষমতায় থাকা লোকরা জানে কিছু লোক তার সবকিছুতে লাইক দেবে। অনেকে আবার মনে করে সেই বেষ্ট। তাকে কেয়ার করতে হবে। বিচিত্র এই দুনিয়া, বিচিত্র মানুষের মন। আমি নিয়মিত বন্ধুদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই। মৃত্যু, অসুস্থতা, সাফল্য, আনন্দ বেদনার ঘটনাগুলোতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি সাধ্যমতো। আমাকে অপছন্দ করে এমন মানুষেরও অনেক কিছু আমার পছন্দ হয়।

আমার নিজেরও অনেক ক্রুটি আছে। আমি তোষামোদি করতে পারি না। কিছু পাওয়ার আশায় বসে নেই। জীবনে অনেক কিছু পাব না, তাই বলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে না। আমি যে কেনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। এমন কোনো অন্যায় ঘটনা নাই যার আমি প্রতিবাদ করিনি। দ্রুত রিএক্ট করি। এটা আমার স্বভাব। এজন্য কিছু বন্ধু আমাকে পছন্দ করে না। অনেকে আমাকে খারিজ করে দেয়। আমার বন্ধুরা প্রায়ই বলে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নাই। তোমার কাজ লেখালেখি সেটা করো। বিপ্ল­বী হওয়ার দরকার নাই। কে কাকে লাইক, কমেন্টস করল এটাও অনেক বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সমালোচনাম‚লক কমেন্টস সহজভাবে নিতে পারি না। মতামত দেওয়ার অধিকার সবার আছে কিন্তু আমরা ক্ষুব্ধ হয়ে আনফ্রেন্ড করি বা আক্রমন করি। বন্ধুদের সবার লেখা আমি মন দিয়ে পড়তে চেষ্টা করি। মন্তব্য করতে গিয়ে আমি অনেক ফান করি, এটা আমার স্বভাব। আবার অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য করতে দ্বিধা করি না। কখনো কখনো কৌশলীও হই।

সুস্থ্য বিতর্ক অবশ্যই কাম্য। একজনের লেখা থেকেই মানুষটির ব্যাক্তিত্ব বোঝা যায়। রুচি, সংস্কৃতি বোঝা যায়। লেখা মনের আয়না। অনেকে আছেন তিনি যে অনেক বড়, তার যে অনেক যোগাযোগ এটা প্রমানেই ব্যস্ত থাকেন। অনেকে ঘরবাড়ি, শাড়ি, গয়না, বাগান, রান্না, বান্না, বন্ধু আত্মীয়, স্ত্রী, সন্তানের ছবি পোষ্ট করতে, সন্তানের গল্প করতে ভালবাসে। এটাই ফেসবুক। আমিও এসব করি। মোটকথা পরিমিতিবোধটাই আসল। সবচেয়ে বেদনার কথা হচ্ছে আমার অনেক বন্ধু এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। করোনাকালে জীবন আরো অনিশ্চিত। যে যায় সে আর ফেরে না। অনেকের খবর জানতেও পারি না। একদিন আমিও চলে যাব। অনেকেই জানবে না। পজেটিভ মনোভাব সবসময় সমাজ এবং সম্পর্কের জন্য ভাল। সবাই ভাল থাকুন। সুন্দর থাকুন। ফেসবুক নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে পারেন।

টরন্টো ১১ জুন ২০২০

যোদ্ধারা এভাবেই জয়ী হন

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতটা পুরোপুরি সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী। প্রবল পরাক্রমশালী মাফিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে স্বল্প খরচে চিকিৎসা কিংবা অল্প দামের ওষুধ দিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বা ডাক্তার জাফরুল্ল­াহর মতো মানুষের টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু তিনি টিকে আছেন। কারণ তিনি যোদ্ধা। দেশপ্রেমিক। লুটেরা নন। বাংলাদেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কোনো চিকিৎসা হয় না। ওগুলো করা হয়েছে মানুষের পকেট কাটার জন্য। মানব সেবার কোনো আদর্শ নিয়ে নয়। আমি একবার স্কয়ার হাসপাতালে গিয়েছিলাম আমার গলা ব্যথা নিয়ে। সেখানকার সবকিছুই সুন্দর, ছিমছাম পরিপাটি, যেনো পাঁচ তারকা হোটেল। বসার জায়গা, ওষুধের ফার্মেসি, টাকা পয়সার ক্যাশ কাউন্টার সবই আমার পছন্দ হয়েছে। শুধু চিকিৎসা পছন্দ হয় নাই। অনেক ভোগান্তি আর টাকা পয়সা খরচ করার পর কানাডায় এসে আমার গলা ব্যথা ভাল হয়েছিল। ডাক্তার ধরতেই পারেনি কেনো গলা ব্যথা হয়েছিল।

যে দেশে মৃত মানুষকে লাইফ সাপোর্টের নামে আটকে রেখে বিল আদায় করা হয় সে দেশের মানুষের মানবতা কোন পর্যায়ের বলার অপেক্ষা রাখে না। এই করোনা কালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুরো কঙ্কাল বের হয়ে পড়েছে। মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছেনা। রাস্তায় রাস্তায় মারা যাচ্ছে। ডাক্তাররা পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। নকল মাস্ক, নকল পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে। কি ভয়াবহ! কি মর্মান্তিক! সিন্ডিকেটের কারণে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিটের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে! ডা. জাফরুল্ল­াহ একজন সত্যিকার যোদ্ধা। তিনি মানুষের দোয়ায় তার হাসপাতাল থেকেই করোনা মুক্ত হয়েছেন। ৭৯ বছর বয়সের মানুষটার উদ্যম দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।

দেশে সৎ লোকের কোনো জায়গা নাই। সৎ মানুষকে সবাই বোকা ভাবে। সংসারে তার কোনো দাম নাই। সন্তান, স্ত্রী, আত্মীয়রা তারে গোনায় ধরে না। তার সাথে কেউ বন্ধুত্ব করে না, দাওয়াত দেয় না, কোথাও আমন্ত্রিত হয় না। আবার বেশি সত্যবাদীর গন্তব্য হচ্ছে জেলখানা। চুরি চামারিতে দেশটা ছেয়ে গেছে। নকল আর ভেজাল সবকিছুতে। নৈতিকতা শ‚ন্যের কোঠায়। সর্বত্র দ‚র্নীতি আর দ‚র্নীতি। এমপি বিদেশে গিয়ে আটক হয়। ব্যাংক লুটপাট আর টাকা পাচার করে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে মিথ্যার বেসাতি, দালালি, চাটুকারিতা। যারা এসবে পারদর্শী তারাই সব হাসিল করে নেয়। তারাই সুখে শান্তিতে আছে, সুখের জীবন। নৈতিকতা আর সততার দিন শেষ!

টরন্টো ১৪ জুন ২০২০

ভালবাসার শহরে

বাংলাদেশ এবং কানাডা নামক দুটো মহান দেশের নাগরিক বলে এই দেশ দুটি আমার ভালবাসার তালিকার শীর্ষে থাকবে সবসময়। এর পরের দেশ দুটি হচ্ছে ভারত এবং আমেরিকা। কারণ বলছি। আমি বরিশালে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি। আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে বরিশালে। সর্বোপরি বরিশালে আছে আমার মা-বাবা, আমার ভাই-বোন, আমার আত্মীয়-পরিজন আর বন্ধুরা। তাই বরিশাল আমার সব সময়ের জন্য প্রিয় শহর। আবেগের শহর। আমি যদি কখনও আবার ফিরি তাহলে বরিশালেই ফিরব।

বরিশাল ছেড়ে একদিন আমি ঢাকা আসলাম। আমার লেখাপড়া, জীবন সংগ্রাম, চাকরি, সংসার সবই ঢাকায়। তাই ঢাকা সবসময় আমার স্মৃতির শহর হয়ে থাকবে। ঢাকা আমাকে অনেক দিয়েছে। তারপর একদিন আমি কানাডায় পাড়ি জমাই। এক বছর অটোয়া কাটিয়ে আমি টরন্টোতে স্থায়ী হই। দীর্ঘদিন এই শহরে থেকে শহরের গলিপথ, আনাচ কানাচ সব আমার অতি পরিচিত হয়ে উঠেছে। ভালবাসার শহর টরন্টো। এই শহরের পথে নামলেই মনে হয় এটা আমার নিজের শহর। মোলায়েম, নিরাপদ, উষ্ণ আর সহজ একটি শহর।

ভারত আমার প্রিয় দেশ নানা কারণে। আর কোলকাতা শহর হচ্ছে আমার একটি আবেগের নাম। আমি প্রথম ইমিগ্রেশন পার হয়ে যে শহরে গিয়েছি সেটা ভারতের কোলকাতা। জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমন। তাই ভারত আমার ভালবাসার দেশ হিসাবেই থাকবে। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের এক কোটি মানুষকে নয় মাস আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয় বেড়ানো, কেনাকাটা, চিকিৎসা,পড়াশুনা বা ব্যবসার কাজে আমরা বেশি যাই ভারত। ঐতিহাসিকভাবেই দুই বন্ধু দেশ। দুই পাড়েই রয়েছে আত্মীয়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ভারতের গান শুনে, সিনেমা দেখে আর বই পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। আমার ছেলে হায়দারাবাদের মেয়ে বিয়ে করেছে। ভারতে আমার অনেক বন্ধু আছে। কানাডায় আমার অনেক সহকর্মী ভারতীয়, আমার প্রতিবেশি ভারতীয়।

আমার অপর ভালবাসার দেশ হচ্ছে আমেরিকা। এর কারণ হচ্ছে কোলকাতার পরই আমার দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণ ছিল আমেরিকা। একলাফে আটলান্টিক পারি দেওয়া যাকে বলে। আমেরিকার যে শহরটিতে প্রথম পা রেখেছিলাম সেটি হচ্ছে বিশ্বের রাজধানী হিসাবে খ্যাত নিউইয়র্ক। তাই নিউইয়র্ক সবসময় আমার প্রিয় জায়গা। নিউইয়র্কে আমার অনেক বন্ধু আর আত্মীয় আছে। নিউইয়র্কের মাটিতে যখনই পা রাখি মনে হয় এটা আমার নিজের শহর। এই শহরের মানুষ আমাকে অনেক ভালবাসা, প্রশ্রয় আর সম্মান দিয়েছে। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।

এরপর তো অনেক দেশেই গিয়েছি, অনেক শহর ঘুরেছি। আমেরিকারই বিশ পঁচিশটা স্টেটে গিয়েছি কিন্তু নিউইয়র্কের কোনো তুলনা নাই। গত বিশ বাইশ বছরে কমপক্ষে পঞ্চাশবার নিউইয়র্কে যাওয়া হয়েছে আমার। আমেরিকা এই পৃথিবীর মানুষকে অনেক দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষের আমেরিকার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

টরন্টো ১৯ জুন ২০২০