করোনার কারণে কানাডায় কি খাদ্য ঘাটতি দেখা দিবে?
মে ১৮, ২০২০
খুরশিদ আলম
দীর্ঘদিনের কোন যুদ্ধ, খড়া বা বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা কোন মহামারীর পরে একটি দেশ বা অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ইতিহাস ঘাটলে আমরা এরকম ঘটনার অনেক নজির দেখতে পাই। আর এটিও দেখতে পাই যে, অতীতে ঐ সকল দুর্ভিক্ষ কেড়ে নিয়েছে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণ। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা অনেকই শুনেছেন। ঐ দুই মন্বন্তরের শিকার হয়ে বাংলায় প্রায় এক কোটি সত্তর লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটেছিল বাংলা ১১৭৬ সালে। ঐ সময় বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষের (প্রায় এক কোটি) মৃত্যু ঘটেছিল। বৃষ্টির কারণে ফসলহানি, খাদ্য মজুদ, ইংরেজ বেনিয়াদের মালিকানাধিন কোম্পানি কর্তৃক অধিক কর আরোপ, কৃষকদের জোর করে নীল চাষ করানো, কোম্পানির অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে এত মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। আর পঞ্চাশের মন্বন্তর ঘটেছিল বাংলা ১৩৫০ সালে। ঐ সময় (ইংরেজী ১৯৪৩ সাল) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবলে পড়ে দুর্ভিক্ষের শিকার হয় এ অঞ্চলের মানুষ। সরকারি নির্দেশে খাদ্য মজুত করা হয়েছিলো। যুদ্ধে পার্শ্ববর্তী বার্মা জাপানিদের অধিকারে চলে যাওয়ায় খাদ্য আমাদানিও তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া সৈন্যদের খাদ্য সরবরাহ, সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, সরকারের দূরদর্শিতাহীন সিদ্ধান্ত ও লোভী মজুদদারদের কারণে ঐ দুর্ভিক্ষের ঘটনা ঘটে। ঐ দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ। এরকম দুর্ভিক্ষ যুগে যুগে হানা দিয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও। রাশিয়া, চিন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া প্রভৃতি দেশে কয়েক কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঐসব দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য সংকটের কারণে। ১৯৩২-৩৩ সালে চিনে সংঘটিত দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেছিলেন প্রায় ৪ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ।
আজকে করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯)কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিটি মানুষ এক ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে পড়েছে। একটি চরম উৎকন্ঠা, ভীতি ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন পার করছি আমরা সবাই। পৃথিবীর প্রায় কোন দেশই বাদ পড়েনি এই কভিড-১৯ এর বিষাক্ত ছোবল থেকে। ইতিমধ্যেই এই ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার মানুষের প্রাণ। আক্রান্ত হয়েছেন ৪৫ লাখ মানুষ। ১৫ মে’র হিসাব এটি। ছেলে বুড়ো কেউই বাদ পড়ছেন না এর কবল থেকে। বাদ পড়ছেন না রাজা বাদশারাও। আর এই উৎকন্ঠা, ভীতি ও অনিশ্চয়তার সাথে নতুন এক আশংকা যোগ হয়েছে যার নাম দুর্ভিক্ষ। অনেকেই আশংকা করছেন কোভিড-১৯ কর্তৃক সৃষ্ট মহামারীর কারণে হয়তো বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আর যদি তাই হয় তবে কানাডা কি সেই দুর্ভিক্ষের কবল থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?
উল্লেখ্য যে, করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বের ৩৬টি দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডাব্লিওএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলি। তিনি বলেন, অনেক দেশে এই মানবিক সমস্যাটার কারণে নানাধরনের সহিংসতা, দ্বন্দ্ব ও বিবাদ সৃষ্টি হতে পারে। খবর বিবিসি’র।
বিবিসি’র খবরে আরো বলা হয়, বর্তমান মহামারীর কারণে বিশ্বে বেড়েই চলেছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। এ মুহূর্তে তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোগ করছেন অন্তত ২৬ দশমিক ৫ কোটি মানুষ। দেশে দেশে লকডাউনের কারণে এ সংখ্যা অচিরেই দ্বিগুণ হতে পারে। এমনটাই হুশিয়ারি দিয়েছে জাতিসংঘ। সেই সঙ্গে ঝুঁকি মোকাবেলায় যতদ্রুত সম্ভব ত্রাণ তহবিল গঠনের জন্য দাতা গোষ্ঠীগুলোর কাছে জরুরি আবেদন জানিয়েছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম যে ৩৬টি দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে ভবিষ্যতবাণী করছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিপদের মুখে আছে ইয়েমেন, কঙ্গো,আফগানিস্তান, ভেনিজুয়েলা, ইথিওপিয়া, সাউথ সুদান, সিরিয়া, সুদান, উত্তর নাইজেরিয়া ও হাইতি। এই দেশগুলোতে করোনা আভির্ভাবের আগে থেকেই খাদ্যাভাব ছিল। এখন তা আরো তীব্র আকার ধারণ করছে দিনে দিনে। উত্তর আফ্রিকার দেশ সিরিয়া গরীব দেশের তালিকায় পড়ে না। কিন্তু গত কয়েক বছরের যুদ্ধের কারণে দেশটিতে দুর্ভিক্ষের অবস্থা বিরাজ করছে।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এর হিসাব মতে দেখা যায় ২০১৯ সালের শেষের দিকে বিশ^ব্যাপী ১৩৫ মিলিয়ন লোক তীব্র ক্ষুধার মধ্যে বাস করছিল। এর মধ্যে ইউরোপের একটি দেশ আছে যেখানে ০.৫ মিলিয়ন লোক তীব্র ক্ষুধার মধ্যে ছিল। দক্ষিণ আমেরিকার ৮টি দেশে ১৮.৫ মিলিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ১০ দেশে ৪৩ মিলিয়ন এবং আফ্রিকার ৩৬টি দেশে ৭৩ মিলিয়ন লোক তীব্র ক্ষুধার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছিল। এখন ২০২০ সালে এসে করোনার কারণে এই ক্ষুধার্থ মানুষের সংখ্যা ১৩৫ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৬৫ মিলিয়নে দাড়াতে পারে বলে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম জানিয়েছে।
আমরা জানি বিশে^ প্রথম সারির যে কয়টি ধনী দেশ আছে, কানাডা তার মধ্যে একটি। সেই বিচারে দেশটি দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে, এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমরা এও জানি, বিশে^র বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একযোগে দেখা দিয়েছে মহামারী। আগের মহামারীগুলো ছিল মূলত নির্দিষ্ট একটি বা গুটি কয়েকটি দেশ বা অঞ্চল ভিত্তিক। আর এক দেশ বা অঞ্চল থেকে আরেক দেশ বা অঞ্চলে ছড়াতে সময় নিতো অনেক। কখনো কখনো কয়েক বছর। কারণ সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনেক অনুন্নত। কিন্তু কভিড-১৯ ছড়িয়েছে অতি দ্রুত মাত্রার গতিতে।
এখন বিশ^ব্যাপী যদি খাদ্য সংকট দেখা দেয় তবে কানাডায় তার ছোঁয়া লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় কানাডার গ্রোসারীগুলোতে যে পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায় তার ৩০% আসে অন্যদেশ থেকে। এই পরিস্থিতিতে অন্যদেশগুলো যদি করোনার কারণে খাদ্য রফতানী বন্ধ করে দেয় সাময়িকভাবে তবে কানাডায় কিছুটা খাদ্যঘাটতি দেখা দিতেই পারে। ওয়ার্ল্ড ইন্টিগ্রেটেড ট্রেড সল্যুশন এর তথ্য মতে কানাডা যে সকল দেশ থেকে খাদ্য আমদানী করে থাকে তার মধ্য অন্যতম হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইটালী, ব্রাজিল, চীন, মেক্সিকো, থ্যাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জার্মানী, স্পেন, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ। ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, ফিলিপিন-ও আছে এই তালিকায়। তালিকায় বাংলাদেশ থাকলেও সেখান থেকে খাদ্য আমদানীর পরিমাণ অনেক কম। আর এই দেশগুলোর কোনটাই করোনা’র আক্রমণ থেকে মুক্ত নয়।
তবে আশার কথা যে, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডার এখনো খোলা রয়েছে পণ্যবাহী ট্রাক এর জন্য। প্রথমে আশংকা করা হচ্ছিল হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই দুই দেশের সীমান্ত। সীমান্ত অবশ্য এক পর্যায়ে বন্ধ হয়েছে সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য, তবে জরুরী পণ্যবাহী ট্রাক এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েনি। কিন্তু এই দুই দেশের মধ্য জরুরী পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধও হয়ে যেতে পারে যে কোন মূহুর্তে। এমন আশংকা ইতিপূর্বে করেছিলেন ডালহোউসি ইউনিভার্সিটির এগ্রি-ফুড এনালাইসিস ল্যাব এর পরিচালক অধ্যাপক সিলভাইন চারলেবোইস।
অবশ্য করোনা পরিস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও গত কয়েক সপ্তাহে কিছুটা স্বস্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও চাচ্ছেন কিছু কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করতে। অন্যদিকে কানাডার পরিস্থিতিও আশাব্যাঞ্জক। সাস্কাচুয়ান ও ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় পরিস্থিতি অনকে উন্নতি হয়েছে। অন্টারিওর পরিস্থিতি একটা স্থিতির মধ্যে চলে এসেছে। প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড কয়েকটি খাত থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন। কুইবেকের পরিস্থিতি অবশ্য এখনো অন্যান্য প্রভিন্সের তুলনায় বেশ খারাপ। তবে সব মিলিয়ে দুই দেশের মধ্যে জরুরী পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেয়ার মত পরিস্থিতি এখনো হয়নি । এবং সম্ভবত হবে না।
রিটেইল কাউন্সিল অব কানাডার প্রেসিডেন্ট মার্ক ফর্টিন গ্লোবাল নিউজকে বলেন, এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি অতটা খারপ হয়নি যার কারণে কানাডায় ফুড সাপ্লাই ব্যহত হতে পারে।
উল্লেখ্য যে, করোনার কারণে কানাডিয়ানদের মধ্যে প্রথম আতঙ্ক সৃষ্টি হয় যখন তারা জানতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রাগোয়ার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর তখনই মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রোসারীগুলোতে জিনিষপত্র কিনে স্টক করার জন্য। দেখা যায় প্রথমদিন যখন মানুষজন দলে দলে গ্রোসারীতে আসতে শুরু করেন সেইদিন কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গ্রোসারীগুলোর অনেক সেলফ খালি হয়ে যায়। বিশেষ করে টিস্যু পেপার, সেনিটাইজার, ফ্রোজেন ফুড, প্যাকেট ফুড ইত্যাদির সেলফগুলো একেবারেই খালি হয়ে যায়। মার্ক ফর্টিন বলেন, সাধারণত ৪ দিনে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি হয় গ্রোসারীতে, তা মাত্র ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বিক্রি হয় যায় আতঙ্কিত কানাডিয়ানদের কারণে।
মার্ক ফর্টিন অবশ্য বলেন, কানাডিয়ানদের আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ কথা বলেন লবলজ কোম্পানীর চেয়ারম্যান গ্যালিন ওয়েস্টন-ও। কিন্তু সেদিনের অবস্থাটা যারা স্বচক্ষে দেখেননি তারা হয়তো আতঙ্কিত হওয়ার বিষয়টি সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারবেন না। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরণের ভীতি সঞ্চার হয়ে গিয়েছিল। কারণ চিনের উহান প্রদেশের লকডাউনের খবর ইতিমধ্যেই তারা জেনে গিয়েছিলেন। কানাডায়ও যদি লকডাউনের আদেশ জারী হয় তবে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে এই আশংকায় অধিকাংশ কানাডিয়ান ভীত হয়ে পড়েছিলেন।
কয়েক সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পর কানাডিয়ানদের মধ্যে প্যানিক বাইং (চধহরপ নুঁরহম) এর মাত্রা কমেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু খাদ্যাভাবের আশংকাটা এখনো কমবেশী বিদ্যমান রয়েছে অনেকের মধ্যেই। আর শুধুই কি খাদ্যাভাবের আশংকা? বিদ্যুত, টেলিকমিউনিকেশনসহ অন্যান্য আরো জরুরী সার্ভিসেস নিয়মিত পাওয়া নিয়েও কেউ কেউ আশংকা প্রকাশ করছেন। আর সর্বপোরি চাকরী হারানোর আশংকা তো রয়েছেই কমবেশী সবার মধ্যে। আমরা দেখেছি ইতিমধ্যেই বহুলোক চাকরী হারিয়েছেন অথবা লে-অফ এর শিকার হয়েছেন। ছোটখাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরণের ক্ষতির শিকার হয়েছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিমান পরিবহন, রেলওয়ে, বাস, টেক্সী, ওবার ইত্যাদি সবগুলোই ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতির মুখে পড়েছে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে সিবিসি নিউজে প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায়, কানাডার সরকার নিজেও কিছুটা চিন্তায় আছে সম্ভাব্য খাদ্যাভাব ও অন্যান্য জরুরী সেবার বিষয়গুলো নিয়ে। তবে এটি নির্ভর করছে কভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যার উপর। যদি আক্রান্তের সংখ্যা অ্যব্যাহত ভাবে অধিক মাত্রায় বাড়তে থাকে তখন তা নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে। ‘পাবলিক সেফটি কানাডা’ ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক তৈরী এক ডকুমেন্ট এ বলা হয়েছে কভিড-১৯ এ লোকজন বর্ধিত মাত্রায় আক্রান্ত হতে থাকলে জরুরী বিভাগগুলোতে শ্রমিকের অভাব দেখা দিতে পারে। আর এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে খাদ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য জরুরী অবকাঠামেগুলোর কার্যক্রম প্রভাবিত হতে পারে। ‘পাবলিক সেফটি কানাডা’ মনে করছে এরকম অবস্থায় সবচেয়ে বেশী উদ্বেগের বিষয় হতে পারে মেডিকেল পণ্য যোগাড় করা এবং খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় স্থিতি বজায় রাখা।
শ্রমিক সংকট দেখা দিলে আরো যে সকল খাতে সমস্যা হতে পারে তার মধ্যে আছে বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থা, ব্যাংকিং এবং টেলিকমিউনিকেশনস। এই সংকট কানাডার জীবনমানকে আরো দুর্বল করে দিতে পারে করোনার কারণে সৃষ্ট এই বিপদকালে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারী কর্মকর্তা সিবিসিকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কোন কোন জরুরী বিভাগের কর্মীদের কেউ কেউ কাজে না আসার সিদ্ধান্ত নিতে পারে নিজেদের নিরাপত্তার কারণে।
কানাডিয়ান লেবার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হাসান ইউসুফ বলেন, কর্মীদের অধিকার আছে কাজে না আসার যদি তারা মনে করেন তারা কর্মস্থলে নিরাপদ নন। তবে এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে এরকম পরিস্থিতি কিছুটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বৃদ্ধদের জন্য লং-টার্ম কেয়ার ফ্যাসিলিটিগুলোতে যাদের জন্য পর্যাপ্ত সঠিক সুরক্ষা বর্ম নেই। তিনি বলেন, কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত সঠিক সুরক্ষা বর্মের ব্যবস্থা করতে পারলে কর্মস্থলে ভীতি হ্রাস পাবে।
উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি আলবার্টার কারগিল মিট প্যাকেজিং প্লান্ট এ ৯৩৫ জন কর্মী কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। গত ৩ মে তারিখের হিসাব এটি। বিশাল এই মিট প্লান্টে ২০০০ শ্রমিক কাজ করেন। অন্টারিওর গুয়েল্ফ এ রয়েছে এর একটি শাখা যেখানে ৯৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। কানাডায় হালাল মাংসের একটি বড় অংশের সরবরাহ আসে এখান থেকে। কভিড-১৯ এর সংক্রমণ ধরা পড়ার পর প্লান্ট-টি দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে তা আবার খুলে দেয়া হয়। কিন্তু এর ৮৫% কর্মী কাজে ফিরে আসতে চান নি নিরাপদ বোধ করছিলেন না বলে। কর্মীদের ইউনিয়নও চেষ্টা করেছে কাজ বন্ধ রাখার জন্য। কিন্তু মালিক পক্ষ কোন অজুহাত শুনেননি। তারা প্লান্ট খুলে দিয়েছেন এবং কর্মীদের কাজে আসার জন্য বলেছেন। মালিক পক্ষের দাবী-তারা যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই প্লান্ট খুলে দিয়েছেন। এর মধ্য আছে কর্মস্থলে প্রবেশ করার সময় সকলের টেম্পারেচার পরীক্ষা করা, প্লান্টের অভ্যন্তরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি। তারা ডাক্তার দিয়ে প্লান্ট পরীক্ষা করিয়েছেন। ডাক্তারগণ বলেছেন প্লান্ট খুলে দেয়া যায় যদি কভিড-১৯ প্রতিহত করার জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য বিধি মেনে চলা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও স্মিথফিল্ড ফুডস নামের একটি বড় ধরণের মিট প্যাকেজিং এর প্লান্টে কভিড-১৯ এর সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। ফলে দুই সপ্তাহ বন্ধ ছিল। মে মাসের শুরুতে আবার খুলে দেয়া হয়েছে প্লান্টটি। ১৭০০ শ্রমিক কাজ করেন সেখানে।
এভাবে বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ফুড ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কর্মীবাহিনী যদি কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হতে থাকেন তবে স্বাভাবিকভাবেই শ্রমশক্তির ঘাটতি দেখা দিবে। সেই সাথে দেখা দিবে খাদ্যঘাটতি। কানাডার কৃষি মন্ত্রী মেরি-ক্লড বিবিউ সিবিসিকে বলেন তিনি সুনিশ্চিত যে কানাডায় পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে। তবে তিনি এও বলেন যে, ফুড ইন্ডাস্ট্রি ও ফার্মগুলোতে সংক্রমণ শুরু হলে শ্রমিক সংকট বা শ্রমিক ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং তার পরিনতিতে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
মন্ত্রী অবশ্য একথাও বলেন যে, কানাডার সিস্টেম যথেষ্ট শক্তিশালী এবং যথেষ্ট স্থিতিস্থাপক। তবে এখনকার সময়টা চ্যালেঞ্জিং। তা সত্বেও আমি মনে করি না আমাদের পর্যাপ্ত খাবার থাকবে না। হয়তো খাবারের আইটেমে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে এবং খাবারের মূল্য-ও কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। যদিও আমি আশা করছি এমনটা হবে না।
লক্ষনীয় যে, শুরুতে আমরা দেখেছিলাম কানাডিয়ানদের মধ্যে প্যানিক বাইং এর প্রবণতা আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল, তেমনটা কিন্তু এখন আর নেই। গ্রোসারীর সেলফগুলোতে এখন টিস্যু পেপার পাওয়া যাচ্ছে, চাল, ডালসহ অন্যান্য শাকসবজী ও ফল এবং ফ্রোজেন ফুডও পাওয়া যাচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। শুধু সেনিটাইজার জাতীয় পণ্যগুলোর স্বল্পতা রয়েছে এখনো। এ কারণে গ্রোসারীর মালিকেরাও নিয়ম করে দিয়েছেন সেনিটাইজার জাতীয় পণ্য একটি বা দুটির বেশী কেনা যাবে না।
কানাডায় করোনা রোগী প্রথম সনাক্ত হয় গত ২৭ জানুয়ারী। ঐ ব্যক্তিটি চিনের হুবেই প্রভিন্সের রাজধানী উহান থেকে টরন্টো এসেছিলেন রোগটি সাথে নিয়ে। ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে তিন মাস পার হয়ে গেছে। এবং আমরা দেখেছি কতটা ভয়াবহরকমের ছোঁয়াচে এই রোগটি। এই অল্প কয়দিনেই অন্টারিওতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছে ২২ হাজারে। আর মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৮শ’ তে। ১৫ মে ২০২০ এর হিসাব এটি। তবে আশার কথা এই যে, করোনা ভাইরাসটি কানাডায় তেমনভাবে বিস্তার লাভ করতে পারেনি যেমনটা করেছে ইউরোপের স্পেন, ইটালী বা ফ্রান্সে অথবা আমাদের পাশ^বর্তী নিউইয়র্ক শহরে। গত প্রায় এক মাসে লক্ষ্য করা গেছে অন্টারিওতে একটি স্থিতি অবস্থায় রয়েছে আক্রমণের হার। মৃতের হারও প্রায় একই রকম। শুধু বেশীমাত্রায় সমস্যা হয়েছে সিনিয়রদের লং-টার্ম কেয়ার ফেসিলিটিগুলোতে।
ডাক্তার আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অব্যাহত সতর্কবাণী আর সহযোগিতার কারণে এবং একই সঙ্গে কানাডিয়ানদের সতর্কতার কারণে রোগটির বিস্তার মারাত্মকভাবে ঘটেনি। ফেডারেল সরকারও কর্মহীনদের জন্য আর্থিক প্রনোদনা ঘোষণা করে তাদেরকে ঘরে রাখতে সহায়তা করেছে। গত কয়েকদিনের পর্যবেক্ষনেও দেখা যাচ্ছে কোভিড-১৯ এ সংক্রমনের হার হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কানাডায় শ্রমিক ঘাটতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে এবং খাদ্যঘাটতির সম্ভাবনাও কমে আসছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে কানাডিয়ানরা তাদের খাবারের মাত্র ৩০% অন্যদেশ থেকে আমদানী করে থাকেন আর ৭০% খাবার নিজেরাই উৎপন্ন করে থাকেন। এখন করোনার কারণে ৩০% খাবার বিদেশ থেকে না আসলেও বড় ধরণের কোন সমস্যা হবে না। আর ঐ ৩০% এর সবটাই একসাথে বন্ধ হবারও কোন সম্ভাবনা নেই। বন্ধ হলে বড়জোড় ১০ থেকে ১৫% বন্ধ হতে পারে সাময়িকভাবে। সুতরাং কানাডিয়ানরা নিরাপদেই থাকবেন। খাদ্য সংকট তাদেরকে ছুঁতে পারবে না। বড়জোড় আমদানীকৃত খাবারের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পাবে সাময়িকভাবে। সুতরাং আতঙ্কিত হবার কারণ নেই। কানাডায় দুর্ভিক্ষ আসবে না।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক প্রবাসী কণ্ঠ