কভিড-১৯: গুজব, ভুল তথ্য ও অমানবিক কর্মকান্ড
জুন ১৬, ২০২০
খুরশিদ আলম
ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাস কভিড-১৯। খালি চোখে দেখা যায় না একে। অদৃশ্য এই ভাইরাস আজ গোটা মানবজাতির জন্য ভয়াবহ এক হুমকী হয়ে দেখা দিয়েছে। কম্পন ধরিয়ে দিয়েছে গোটা বিশে^। বিপর্যস্ত করে তুলেছে সবার জীবন। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যেই এই ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে ৪,২২,৯৮১ জন মানুষের প্রাণ। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৭৫,৭০,৮০১। ১৩ জুনের হিসাব এটি। প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে এই সংখ্যাগুলো। আর সেই সাথে বাড়ছে করোনাকে কেন্দ্র করে গুজব আর ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ভুল তথ্যের কারণে লোকজন ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছেন এবং করোনা থেকে মুক্ত থাকার পরিবর্তে করোনায় আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে পড়ছেন।
ভাবতে অবাক লাগে, এত শক্তি মানুষের, গোটা মানবজাতিকে কয়েকবার ধ্বংস করে দেওয়ার মত পর্যাপ্ত পরিমাণ মারণাস্ত্র মজুদ আছে যাদের, তারাই কি না আজ অদৃশ্য এক অণুজীবের কাছে এমনভাবে ধরাশায়ী! নির্মূল করতে পারছে না এই ভাইরাসকে!
আজকে করোনার কারণে বিশে^র প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। কেউ কারো কাছে আসছেন না। নিকট আত্মীয়রাও একজন আরেকজনকে এড়িয়ে চলছেন। করোনায় কেউ আক্রান্ত হয়েছেন শুনলে পরিবারের লোকজনসহ তার চারপাশের সবাই আতঙ্কে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ছেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। উদ্ভট সব আচরণ করতে থাকেন।
ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে দেখলাম, ফেনীর সোনাগাজীতে সাহাব উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তার স্ত্রী,পুত্র, মেয়ে সবাই মিলে তাকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখেন। তিনি যাতে ঘর থেকে বের না হতে পারেন সে জন্য বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর আগে ঐ ভদ্রলোক অনেক ডাকাডাকি করেছিলেন পরিবারের সদস্যদের নাম ধরে। কিন্তু কেউই দরজা খুলে দেননি। এমনকি খাবারও দেওয়া হয়নি তাকে। ছোট ছেলেটি একবার বাবার কাছে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বোনেরা তাকে সেই চেষ্টা থেকে বিরত রাখেন। মারা যাওয়ার পরও কেউ কাছে আসেননি। দাফনও করেননি। খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়াম্যান রবিউজ্জামান তার লোকজন নিয়ে এসে দাফনের ব্যবস্থা করেন। খবরে বলা হয়, সেই দাফন করতে গিয়েও স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে বাধা আসে। মসজিদ কমিটির লোকজন খাটিয়া দিতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি কবর দিতে গেলেও বাধা দেন। পরে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় গভীর রাতে পরিবারের লোকজনের অনুপস্থিতিতে জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।
এরকম আরো কিছু অমানবীয় ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন সন্দেহে বৃদ্ধ মা অথবা বাবাকে জঙ্গলে ফেলে আসা হয়েছে এমন খবরও আমরা দেখেছি। আর শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এরকম ঘটনা ঘটছে। তুরস্কে এক নামকরা ফুটবলার নিজের ৫ বছর বয়সী ছেলেকে হত্যা করেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এই সন্দেহে। শিশুটি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল কি না তা তখনো জানতে পারেননি বাবা। নমুনা পাঠানো হয়েছিল টেস্ট করানোর জন্য। টেস্ট রিজাল্ট আসার আগেই বাবা নিজের জীবন রক্ষার জন্য ছেলেকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন!
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এ সব অমানবিক ও নৃশংস ঘটনার পিছনে করোনা নিয়ে গুজব সৃষ্টি ও ভুল তথ্য ছড়ানোর বিরাট ভূমিকা রয়েছে অবশ্যই। আর এই গুজব ও ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা এই চরম দায়িত্বহীনতার কাজটি করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে, তারা নিজেরাও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
দায়িত্বজ্ঞানহীন এই লোকগুলো হয় নিজেরা মুর্খ অথবা কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ কাজগুলো করছেন। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনেক শিক্ষিত লোকজনও এই গুজব বা ভুল তথ্যগুলো কোনরকম যাচাই-বাছাই না করেই বিশ্বাস করছেন। নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাচ্ছেন না।
একটি গুজবের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে এখানে। গুজবটি হলো – মুসলমানরা করোনায় আক্রান্ত হবেন না। সে কারণে মুসলমানদের মসজিদে যাওয়া বন্ধ করা উচিৎ নয়। আরো বলা হচ্ছে, এই করোনা কাফেরদের তৈরী। তাই মুসলমানদের ধারে কাছে আসবে না এটি। ইহুদী-নাসারা চায় মুসলমানদের নামাজ পড়া বন্ধ হোক। তাই তারা করোনার কথা বলছেন। কেউ কেউ আবার এমনো ভিডিও শেয়ার করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেখানে দেখানো হচ্ছে বিধর্মীরা ভয়ে নামাজ পড়ছেন।
বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও আশংকার বিষয় হলো, এক শ্রেণীর লোক এগুলো বিশ^াস করছেন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে দেদার ঘুরে বেরাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মসজিদ বন্ধ রাখা হলেও গুজবে বিশ্বাসী এই লোকেরা শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে বাড়ির ছাদে বা অন্য কোথাও জামাতের আয়োজন করে নামাজ পড়ছেন। জামাতে নামাজ পড়ার একটি নিয়ম হলো, কাতারে দাড়াঁনো মুসল্লিদের মাঝে কোন ফাঁক রাখা যাবে না। মসজিদের ইমামরা বলে থাকেন, কাতারে ফাঁক থাকলে সেখানে শয়তান প্রবেশ করে। তাই গুজবে বিশ্বাসীরা নামাজে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে ফাঁক রাখছেন না।
গুজবের ডালপালাগুলো ছড়ায় খুব দ্রুত। আর ভাবনার বিষয় হলো, এগুলো বিশ^াস করার লোকও আছে প্রচুর এবং করোনার এই মহামারী কালে এই গুজব বা ভুল তথ্যগুলো ছড়াচ্ছেও প্রচুর।
টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে কানাডার সিংহভাগ অধিবাসী করোনা সম্পর্কে নানান গুজব বা ভুল তথ্যের মুখমুখি হয়েছেন তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। করোনা প্যানডেমিক শব্দের সাথে মিল রেখে এই গুজব বা ভুল তথ্যের নামকরণ করা হয়েছে ইনফোমেডিক। এই ইনফোমেডিক এর মুখমুখি হয়েছেন সমীক্ষায় অংশ নেয়া প্রতি দশ জনের মধ্যে সাত জন। গত ৭ মে টরন্টো স্টার এ তথ্যটি প্রকাশ করে। আর দেখা গেছে এই ইনফোমেডিক এর ছড়াছাড়ি সবচেয়ে বেশী ফেসবুকে। ফেসবুক গত এপ্রিল মাসে ৫০ মিলিয়ন ভুল তথ্যসম্বলিত পোস্টিং চিহ্নিত করেছে। তবে আশার কথা এই যে, ফেসবুক যখন এই ভুল তথ্যসম্বলিত পোস্টিংগুলো চিহ্নিত করে ব্যবহারকারীদেরকে সতর্ক করে তখন প্রায় ৯৫% লোকই তা পড়েন না। ফেসবুকের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা জনগণের জন্য ক্ষতিকারক পোস্টিংগুলো মুছে ফেলে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় কানাডিয়ানরা যখন অনলাইনে ভুল তথ্যের মুখোমুখি হন তখন সাধারণত তারা সেই তথ্য যাচাই করে দেখার জন্য অন্যান্য উৎসগুলো ভিজিট করেন। কিন্তু আবার দেখা গেছে প্রায় ৬৯% কানাডিয়ান কিছুটা সময় ব্যয় করেন এমন সব সাইটে যেখানে ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। রায়ারসন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত সমীক্ষায় এমন ফলাফলই দেখা গেছে। এ কারণে সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের উচিৎ বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নেয়া। কারণ অল্প সময়ের জন্য হলেও গুজব বা ভুল তথ্যের পিছনে ছুটছেন কানাডিয়ানরা।
কানাডিয়ানরা যে কভিড-১৯ সম্পর্কিত গুজব বা ভুল তথ্যের আগ্রাসন থেকে মুক্ত নন সে কথা উঠে এসেছে অটোয়ায় অবস্থিত কার্লটন ইউনিভার্সিটি কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষাতেও। সিটিভি নিউজ জানায়, কার্লটন ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম এ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট এর ঐ সমীক্ষায় দেখা গেছে ৪৬% কানাডিয়ান কভিড-১৯ নিয়ে প্রচলিত প্রধান চারটি গুজবের অন্তত একটিতে বিশ্বাস করেন। এর মধ্যে তারা সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস স্থাপন করেছেন যে গুজবটিতে তা হলো, কভিড-১৯ চীনের ওহান এ অবস্থিত একটি ল্যাবরটরিতে তৈরী করা হয়েছে বায়োউইপন বা জৈবিক অস্ত্র হিসাবে এবং তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই গুজেবে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের হার ২৬%।
দ্বিতীয় গুজবটি হলো হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন (hydroxycholoroquine) নিয়ে। ২৩% কানাডিয়ান বিশ^াস করেন যে, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নামের ঔষধটি কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বেশ কার্যকরী। এই ঔষধটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুদিন ব্যবহার করছেন কভিড-১৯ থেকে মুক্ত থাকার জন্য। এ কথা ট্রাম্প নিজেই ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে প্রচার করেছেন। কিন্তু বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা’র পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে বলা হয়েছিল যে করোনা চিকিৎসার জন্য এই ঔষধটির ব্যবহার নিরাপদ নয়। হেলথ কানাডাও এই ঔষধটির ব্যাপারে সতর্কবাণী প্রচার করেছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটি ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে ঐ সতর্কবাণীতে। ঔষধটি মূলত ম্যালেরিয়া রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু এখন আবার দেখা যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের অবস্থান পাল্টিয়েছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে আবারো হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে এই বলে যে, কভিড-১৯ এর চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকরিতার বিষয়টি তাহলে গুজব ছিল না! প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সঠিক পথেই ছিলেন? বলা কঠিন। তবে বলা যায়, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে বিভ্রান্তি আরো বাড়লো।
প্রধান চারটি গুজবের তৃতীয়টি হলো, স্যালাইন সল্যুশন দিয়ে নিয়মিত নাক ধুলে কভিড-১৯ থেকে মুক্ত থাকা যায়। ১৭% কানাডিয়ান এই গুজবে বিশ্বাস করেন। চতুর্থ গুজবটি হলো কভিড-১৯ কোন গুরুতর রোগ নয়। এটি ফাইভ জি ওয়্যালেস টেকনলজী’র (5G wireless technology) কারণে সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন ফাইভ জি টেকনলজী মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।
আনলাইনে এছাড়াও গুজব রটেছিল যে, কোকেন গ্রহণ করলে বা ব্লিচ পান করলে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা যায়। এই ভাইরাস তৈরী করা হয়েছে চীন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগারে। কানাডার নামও এসেছে এই তালিকায়।
করোনা নিয়ে আরো যে সব গুজব বা ভুল তথ্য রয়েছে তার মধ্যে আছে : –
১. ‘আপনার যদি সর্দি থাকে তাহলে আপনার দেহে ভাইরাসটি নেই।’
২. ‘করোনা ঠেকাতে হলে বেশি করে গরম পানি পান করতে হবে’ এবং ‘পারতপক্ষে বরফ না খাওয়া’
৩. ‘আদা-পানি পান করলে করোনা নিরাময় হবে’
৪. ‘শিশুদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা নেই’
৫. ‘গরম পানির ভাপ নিলে করোনা ভাইরাস দূর হয়ে যায়’
৬. ‘সাপের তেল খেলে করোনা ভাল হবে’
৭. ‘স্পিরিট বা এ্যালকোহল পান করলে শরীরে থাকা করোনা ভাইরাস মরে যায়’
৮. ‘গরম আবহাওয়ায় করোনা ভাইরাস মরে যায়’
৯. ‘দশ সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ করে রাখতে পারলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে কোন ব্যক্তি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি’
১০. ‘আইসক্রিম বা অন্যান্য ঠান্ডা খাবার এড়িয়ে চললে করোনা ঠেকানো সম্ভব’
১১. ‘গরম পানিতে গোসল করলে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে’
১২. ‘অতিবেগুনি রশ্মির মাধ্যমে শরীরে অবস্থিত করোনা ভাইরাসকে মেরে ফেলা যায়’
১৩. ‘শরীরে ক্লোরিন ছড়িয়ে দিলে এই ভাইরাস মরে যায়’
১৪. ‘১৫ মিনিট রোদে দাড়িয়ে থাকলে শরীরে থাকা করোনা ভাইরাস মরে যায়’
১৫. ‘১২ ঘন্টা বাড়িতে বসে থাকলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বন্ধ করা সম্ভব’
১৬. ‘ভারী তুষারপাত হলে করোনা ভাইরাস দূর হয়ে যাবে।’
১৭. ‘রসুন খেলে করোনা ভাইরাস দূর হবে শরীর থেকে’
১৮. ‘গোমূত্র পান করলে করোনা ভাইরাস ঠেকানো যায়’
এরকম আরো কিছু গুজব ও ভুল তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে লক্ষ করা গেছে। গুজবে কান দিয়ে স্পিরিট বা এ্যাকোহল পান করে ইরান ও ভারতে বেশ কিছু মানুষ মৃত্যুবরণও করেছেন।
সমস্যা হলো, এই সব গুজব অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকও বিশ^াস করেন। আর তাদের অনুসরণ করে স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকেরাও গুজবে বিশ্বাস স্থাপন করেন। সুপারস্টার সেলিব্রিটিরাও গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন কখনো কখনো। উদাহরণ হিসাবে বলিউড সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন এবং রজনীকান্তের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে অমিতাভ বলেন, ‘হাততালি ও শঙ্খের তরঙ্গ করোনা ভাইরাসের শক্তি কমিয়ে দেয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘নতুন নক্ষত্র রেভতিতে যাচ্ছে চন্দ্র। একসাথে শব্দতরঙ্গ তৈরি করবে রক্ত চলাচল ভালো হবে।’
অন্যদিকে রজনীকান্ত জনগণকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন ১২-১৪ ঘন্টায় ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করা যাবে।
বিশ^ব্যাপী যে কোন মহামারীকালে, এমনকি জাতীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ের কোন সংকটকালেও গুজব বা ভুল তথ্যের বিস্তৃতি একটি বড় ধরণের সমস্যা তৈরী করে। এই গুজব বা ভুল তথ্য জনগণের মধ্যে অযথা আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তাদেরকে ভুল পথে নিয়ে যায়। এমনকি দাঙ্গা বা রায়টও লেগে যায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর তাতে প্রাণহানীও ঘটে বহু লোকের। সম্পদ নষ্ট হয় লক্ষ-কোটি টাকার। তখন মূল সমস্যা বা সংকট মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এই গুজব বা ভুল তথ্যকে প্রতিহত করা জরুরী সকলেরই স্বার্থে।
কানাডার সরকার ইতিমধ্যে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এই গুজব বা ভুল তথ্যকে মোকাবেলা করার জন্য। সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী অর্থ বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে কিভিড-১৯ এর ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিস্কারের জন্য। আর এই অর্থ থেকে প্রায় হাফ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হবে গুজব বা ভুল তথ্যের বিস্তার প্রতিহত করার জন্য। এ ব্যাপারে যৌথভাবে কাজ করার জন্য একমত হয়েছে টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভার্সিটি এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রয়েল রোড ইউনিভার্সিটি ।
গুজব সম্পর্কে ফেসবুক কী করছে?
ফেসবুকের একজন মুখপাত্র বিবিসি-কে জানান: এই ধরণের পোস্ট আমাদের নীতি বিরুদ্ধ এবং এগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আর করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ভুল তথ্য সরিয়ে নিতে আমরা ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছি।
ভাইরাস সংক্রান্ত ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য যেন না ছড়ায় তা নিশ্চিত করতে ফেসবুক, মাইক্রোসফট, গুগল, লিঙ্কড ইন, রেডিট, টুইটার এবং ইউটিউব একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে বলে জানায় বিবিসি।
বিবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে গুজব বা ভুল তথ্য কি ভাবে মোকাবেলা করা যায় সে সম্পর্কে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলে-
“কোনোকিছু শেয়ার করার আগে যে তিনটি প্রশ্ন করবেন নিজেকে:
১. তথ্যের উৎস কী অসমর্থিত মনে হচ্ছে অথবা এমন কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে আসছে বলে মনে করছেন যাকে আপনি খুঁজে বের করতে পারবেন না?
কোথা থেকে এই তথ্য শেয়ার হলো তার মূলে যাওয়ার চেষ্টা করুন। না পারলে এটি শেয়ার করা থেক বিরত থাকুন। আপনার বিশ্বস্ত কেউ এটি আপনাকে পাঠিয়েছে তার মানে এই নয় যে তারা তাদের পরিচিত কারো কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে।
২. সব তথ্যই সত্যি মনে হয়?
যখন অনেক তথ্যের লম্বা একটি তালিকা থাকে তখন সেই তালিকার সব তথ্য বিশ্বাস করার প্রবণতা থাকে কারণ এর মধ্যে হয়তো একটি বা কিছু সঠিক তথ্য থাকে।
৩. কন্টেন্ট কী আপনাকে খুশি, রাগান্বিত বা আতঙ্কিত করে?
ভুল তথ্য ভাইরাল হয় কারণ সেগুলো আমাদের অনুভূতি নিয়ে খেলা করে। এটি একটি ইঙ্গিত যে পোস্টের তথ্য বিভ্রান্তিকরও হতে পারে। এরকম সময় নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, সতর্কতামূলক উপদেশ বা গণ বিজ্ঞপ্তির ওপর ভরসা করুন।”
করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত গুজব ও ভুল তথ্য থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ-ও। এক বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘জনসাধারণের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারা কীভাবে নিজেকে এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন, সে সম্পর্কে যাচাইকৃত উৎস থেকে সঠিক তথ্য সন্ধান করুন।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘বিশ্বজুড়ে লোকজন করোনভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বনের প্রেক্ষাপটে এ মুহূর্তে প্রয়োজন হলো বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে যথাযথ প্রস্তুতি।’
যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা সম্পর্কে গুজব ছড়াচ্ছেন বা জেনেশুনে ভুল তথ্য সরবরাহ করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সরকারী ভাবে। ‘কুইন্স প্রিভি কাউন্সিল ফর কানাডা’র প্রেসিডেন্ট ডমিনিক লিব্লাঙ্ক সিবিসি নিউজকে বলেন, জেনেশুনে কেউ মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রচার করলে তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য লিবারেল সরকার একটি আইন করার বিষয়ে চিন্তা করছে।
আমরা জানি করোনা কোন সহজ রোগ নয়, অতিমাত্রায় ছোঁয়চে এই প্রাণঘাতি রোগটিকে প্রতিহত করতে হলে প্রকৃত তথ্য জানা খুবই জরুরী। গুজবে কান না দিয়ে বা ভুল তথ্যের উপর নির্ভর না করে কভিড-১৯ সম্পর্কে সত্যটা জানতে হবে। এটি সবার জন্যই মঙ্গল।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ