এখানে প্রাণের স্রোত
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০
জসিম মল্লিক
১. আমি কোনো কৌশলী মানুষ না। কিন্তু অনেকেই আমার সাথে কৌশল করে। তাদের ধারণা আমি কিছু বুঝি না। আমাদের স্বভাব হচ্ছে অন্যকে তুচ্ছজ্ঞান করা। আমি আমার শৈশবকাল থেকেই এসব দেখে আসছি। যখন আমার বয়সীদের সাথে খেলতাম বা আড্ডা দিতাম তখনও এসব আমি খেয়াল করতাম। ওরা মনে করতো আমি তো বোকা সোকা মানুষ আমাকে ঠকানো সহজ। আমাকে যে ঠকানো সহজ এটা ঠিক। আমি ঠকি। প্রতিনিয়ত ঠকি। জেনে শুনেই ঠকি। আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি কেউ একজন আমার সাথে চাতুরি করছে। আমি নির্ঘাত ঠকে যাচ্ছি; কিন্তু আমি কিছু করতে পারছি না। মানুষ হিসাবে আমার সবচেয়ে বড় ক্রটি এটাই, যে মুহূর্তে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত সে মুহুর্তে প্রতিবাদ না করা বা করতে না পারা।
বিদেশে এসে আমার আক্কেল গুরুম হয়েছে অনেক আগেই। আমরা প্রত্যেকেই নিজেকে খুউব স্মার্ট মনে করি, অন্যেও যে তার মতো স্মার্ট এটা ভুলে যাই। মাঝে মাঝে আমাকে নানা জনে ফোন করে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে কথা বলে। এজন্য হঠাৎ অল্পচেনা কারো ফোন পেলে একটু ভড়কে যাই। আবার সরলভাবে অনেক কিছু বলেও ফেলি। পরে মনে হয় আরে এতো ফ্রীভাবে কথা বলাতো ঠিক হয় নাই! এটা মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে অনেকেই আমাকে পরামর্শ দেয় লোকজনের সাথে বেশী মাখামাখি ভালো না। একটু কৌশলী হতে হয়। না হলে পরে পস্তাবা। তোমারতো সহজে শিক্ষা হয় না। যখন ডলা খাবা বুঝবা। জানোনাতো কেউ ওপেন মাইন্ড না। প্রত্যেকেই নিজেকে অবগুন্ঠনে রাখে। কিন্তু এসব কথায় আমি কান দেই না।
একদিনের একটা ঘটনা বলি। এক দুপুরে আমার সেল ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটার দিকে আমি তাকিয়ে আছি। অনেক সময় আমার যেটা হয় কারো নম্বর হয়ত আমার ফোনে সেফ করা আছে। কোনো এক সময় হয়ত কথাবার্তাও হয়েছিল। কিন্তু তাৎক্ষনিকভাবে তাকে আমি চিনতে পারি না। কোথায় দেখেছি তাকে! কবে কথা হয়েছিল! এসব ভাবতে ভাবতে ফোন বাজা থেমে যায়। এবারে যিনি ফোন করেছেন তাকে অবশ্য চিনতে পারলাম। চিনতে পেরে একটু চিন্তিত হলাম। এ মানুষটা তো আমাকে সাধারণতঃ ফোন করে না! কারণ সে আমার তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু না। তবে বন্ধুত্বের একটা ভান আছে। জাষ্ট হাই হ্যালো টাইপ। এই পৃথিবীতে অনেকেই বন্ধুত্বের ভান করে। প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা অতি অল্প। কথায় আছে পরিচিত হই কোটিক বন্ধু হই গুটিক। অর্থাৎ সবাই বন্ধু হয় না। কেউ কেউ হয়। কোটির মধ্যে গুটিক।
২. যিনি ফোন করেছেন তিনি একজন হেভিওয়েট মানুষ। তিনি নিজেই বলেছেন আমি যেই সেই মানুষ না। তার পূর্ব পুরুষরা যে জামিদার গোত্রীয় ছিলেন সেটাও আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। হয়ত এই জন্য যে আমি যেনো তাকে সমঝে চলি। এটাও প্রকান্তরে বলেছিলেন যে সবাই তাকে কেয়ার করে চলে। হয়ত তার কথা ঠিক। মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নাই। আমি সামান্য মানুষ। গর্তের মধ্যে আমার বসবাস। এখানে প্রতিনিয়ত কত কিছুইতো ঘটছে। প্রতিদিন ঘটনার নানান মেরুকরণ হচ্ছে। গ্রুপ তৈরী হচ্ছে। গ্রুপ ভেঙ্গে যাচ্ছে। দল ভারী হচ্ছে, দলছুট হচ্ছে। প্রোগ্রাম পাল্টা প্রোগ্রাম হচ্ছে। দাওয়াত পাল্টা দাওয়াত চলছে। ফেসবুকের কল্যাণে দ্রুত ছাড়িয়ে যাচ্ছে সেসব। আমি এইসব অসাধারণ ইভেন্ট থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছি।
আমি হেভিওয়েটকে পরেরদিন পর ফোন করলাম। কলব্যাক করা ভদ্রতার পর্যায়ে পরে তাই। তিনি ফোন ধরলেন।
আস্লামালেকুম।
-অলাইকুম..।
-ভালো আছেন ভাই! কালকে ফোনটা ধরতে পারিনি..সরি।
-ইটস ওকে। আপনার খবর কী। অনেকদিন যোগাযোগ নাই। ফোন টোন তো করেন না।
আমি হাসি। আসলে ব্যস্ত লাইফ। তাছাড়া আমি কামলা মানুষ। টাইম পাই না।
-সবাই যোগাযোগ রাখে, আপনি রাখেন না।
-কী করবো ভাই। আমি মানুষটাই এমন। একুট অসামাজিক তাইনা!
-আপনার খবরবার্তা কিন্তু পাই। কোথায় যান কী করেন।
আমি হঠাৎ সতর্ক হই। কোন কথায় কী কথা এসে পরে।
-হ্যাঁ আপনার সোর্সতো অনেক স্ট্রং। আমার মতো একজন এলেবেলে মানুষের খেঁাঁজখবর রাখেন এটা বড়ই আশ্চর্য্যরে ঘটনা।
-সেদিন আপনি একজনকে ফেসবুকে ’হাই’ বলেছেন।
তাই নাকি! কিন্তু ফেসবুকে ’হাই’ বলা যাবে না এমন তো কেনো আইন নাই। ফেসবুকতো হ্ইা বলার জন্যই। তা আপনি দেখলেন কিভাবে!
-যাকে হাই দিয়েছেন সে আমার পাশেই ছিল।
বাহ্্ শুনে ভালো লাগলো আপনারা পাশাপাশি থাকেন। যাকগে ’হাই’ দিয়েছি আর কিছু দেই নাইতো!
হেভিওয়েট চুপসে গিয়ে প্রসঙ্গ বদলে বললেন আপনার এবারের লেখাটা হাবিজাবি হয়েছে।
আমি বললাম সেটা আমিও জানি। সবাই জানে।
৩. আর একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। আমার একজন বন্ধু একদিন ফোন করেছে হঠাৎ। ইদানীং সে একটু শীতল। টের পাওয়া যায়। বেশী কথাবার্তা বলে না। অথচ এই কয়দিন আগেও তার সাথে কী মাখামাখিইনা ছিল। প্রবাস জীবনের এটাই মজা। কে যে কখন রং বদলায় আর কে যে কখন রং ধারন করে বোঝা কঠিন। সে ফোন করে আমার কাছে অন্য একজনের ফোন নম্বর চায়। আমি জানি তার কাছে ফোন নম্বর আছে। কারণ নম্বরটা আমি তার কাছ থেকেই পেয়েছি। তবুও কেনো যে আমার কাছে চাইল! আমি ফোন নম্বর দেই। সে আমাকে জানায়, আমার ’বাড়িতে পার্টি’ দিচ্ছিতো তাই। এই কথা বলে সে আমাকে এই বার্তা দিচ্ছে যে তার বাড়ির পার্টিতে আমি আমন্ত্রিত না। এমন হতে পারে কখনও হয়ত আমার কেনো ক্রুটি হয়েছিল।
এভাবেই কৌশলে আমরা মুধুর প্রতিশোধ নেই। এটা একটা অদ্ভুৎ মনস্তাত্বিক প্রতিযোগিতা। কিন্তু আমি কখনও এই জাতীয় প্রতিযোগিতায় সামিল হতে চাই না। আবার কিছু মানুষ আছে যারা বাইরে একরকম অন্তরে অন্যরকম। আমি কয়েকজন মানুষকে চিনি যাদের সাথে দেখা হলে এমন মধুর হাসি দেয় যে মন ভরে যায়। কিন্তু সুযোগ পেলেই ধারালো ছুড়ি শানায়। এই ধরনের মানুষরা আরো বিপদজ্জনক।
তবে এই সামান্য অন্ধকারের মধ্যে আলোর মশালটাই বেশী প্রজ্জলিত। এই পৃথিবীতে সুন্দর মানুষের সংখ্যাই বেশী। আমি খুউবই সামান্য মানুষ। গুরুত্বহীন মানুষ। কিন্তু আমি আমার সারা জীবনে পথ চলতে গিয়ে অসামান্য সব মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই দিয়েছি যত পেয়েছি তার বহুগুন। এর হিসাব কষে শেষ করতে পারবো না। দেশে বিদেশে এবং এই প্রবাসে এবং সর্বশেষ ফেসবুকের কল্যাণে অসাধারণ সব মানুষের সাথে পরিচয় ঘটেছে বা সক্ষাত হয়েছে। গভীরভাবে যখন এসব নিয়ে ভাবি তখন মনটা কেমন আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে। কেউ একটু রুড হলে বা সমালোচনা করলে বা একটু ক্ষতির চেষ্টা করলে সেটাকে এতো ফলাও করে প্রচার করারই বা কি আছে! এর বিপরীতে সুন্দর মানুষদের গল্প কেনো করি না! যারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েছে! যারা শুধু দিতেই চায়!
যারা আমাকে দেখেনি, আমাকে জানেও না তাদের ভালোবাসাও আমি পেয়েছি। বিশেষকরে নারীরা সারা জীবন আমাকে পক্ষপাত ও সমর্থন দিয়েছে। আমি সেইসব মানুষদের কাছে চিরঋনী হয়ে আছি। সেদিন একজন লিখেছে, ’আপনি আর আপনার লেখা জমজ ভাই’। কথাটা সত্যি। আমি মাঝে মাঝে অন্যদের বলি আমার লেখা পড়লে আমাকে চেনা যায়। যদিও আমি আমার এলেবেলে টাইপ লেখা নিয়ে কথা বলতে সংকোচবোধ করি। তবুও বলছি এই বছর টরন্টো বইমেলায় কয়েকজন অনেক দূর দূর থেকে এসেছিল আমার বই কিনতে। যখন আমাকে তারা বলছিল আমি খুউবই সংকোচবোধ করি। আমার কথা হারিয়ে যায়। এই লেখার মাধ্যমে তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ।
এই পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা অনেক আনন্দের। সামান্য অসুন্দরকে যদি আমরা জয় করতে পারি তাহলে এই পৃথিবীটাই হতে পারে স্বর্গ।
জসিম মল্লিকঃ টরন্টো কানাডা