এই পরবাসে রবে কে-১২

নাজমুল ইসলাম

আমি আড্ডাবাজ মানুষ। সশরীরে দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডা দেয়ার নেশা বোধহয় আমার রক্তে আছে। আমার বাবাও শুনেছি ভীষণ বন্ধুবৎসল ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় অত্যধিক বন্ধুবাৎসল্য তাঁর পড়াশুনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে যতটুকু মেধা থাকলে মানুষ উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারে তার অধিক মেধা থাকার পরেও উচ্চশিক্ষার পথে না গিয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বাবাকে চাকরিতে ঢুকে পড়তে হয়। তবে ছাত্রজীবনে খেলাধুলায় বাবা অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। পঞ্চাশ ষাটের দশকে পাবনার নামকরা অ্যাথলেটদের অন্যতম ছিলেন আমার বাবা। আমরা সন্তানেরা তাঁর এই গুনের ছিটেফোঁটাও পাইনি। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ।

আড্ডার কথায় ফিরে যাই। আড্ডা নিয়ে নানা মানুষের নানা মতভেদ আছে। এরমধ্যে সর্বসাধারণ্যে যে ধারণাটি সবচেয়ে উজ্জ্বল তা হলো- আড্ডা অলস মানুষদের দুষ্ট কর্মকান্ড। আসলে আড্ডা কি? রাজশেখর বসু সংকলিত ‘চলন্তিকা’ অভিধানে প্রথমে আড্ডা অর্থ ‘মিলনের স্থান’ উল্লেখ করলেও বিস্তারিত বর্ননায় উদাহরণ হিসাবে যেভাবে ‘কুলোকের বা দুষ্টলোকের মিলনস্থল’, ‘আখড়া’, ‘চোরের আড্ডা’, ‘তাসের আড্ডা’, ‘গাঁজার আড্ডা’, ‘আড্ডা মারা’ ইত্যাদি শব্দগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে তাতে আড্ডা যে মোটেও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা জরুরী মিটিং নয়, সেকথা স্পষ্টই বোঝা যায়। কোন কোন অভিধানে আড্ডাকে ‘দুবৃত্তলোকের মিলনস্থান’ বলা হয়েছে। লক্ষ্যনীয় যে প্রায় সব অভিধানেই আড্ডাকে কমবেশী নিন্দনীয় একটি বিষয় হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মোটকথা আড্ডা যে মোটেও একটি উন্নত বা মহৎ কর্ম নয় এটি প্রায় সর্বজনস্বীকৃত। তারপরেও আমার স্থির বিশ্বাস, নির্ভেজাল আড্ডা মোটেও অস্বাস্থ্যকর নয়।

বাঙালীরা সত্যিই এক আড্ডবাজ জাতি। আড্ডার এই ফরম্যাটটি পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। ছবি : লেখক

আজকাল ফেসবুকসহ নানা প্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ করে আড্ডা বা ‘গ্রুপ চ্যাট’-এর প্রচলন দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এইসব অনলাইনের আড্ডা বা ভার্চুয়াল আড্ডায় আমি খুব একটা উৎসাহ বোধ করি না। আমার কাছে এসব অনলাইন আড্ডা মোটেও উপভোগ্য নয়। কারণ ঐ যে বললাম, সশরীরে বসে জমিয়ে আড্ডাতেই আমার নেশা বেশী। এমন নেশা যে, আমি যে কোন সশরীর আড্ডাতেই আনন্দ পাই। অনলাইন আড্ডাকে আমার মিথ্যা আড্ডা বলে মনে হয়।

‘আড্ডা’ শব্দটি শুনলেই আমরা বেশীরভাগ বাঙালীরা বুঝি পাড়ার ক্লাবঘরে ‘তাসের আড্ডা’ অথবা পাড়ার মোড়ের দোকানে বা রেস্টুরেন্টে ‘চায়ের আড্ডা’। এদেশে অবশ্য আমরা চায়ের দোকানে (টিম হর্টন) দেশী আড্ডার ধরণটা চালু রেখেছি বেশ। তবে কেবল রেস্টুরেন্ট বা চায়ের দোকান কেন? কোন আড্ডাতেই আমার অরুচি নেই। পারিবারিক আড্ডা যেন বেশী টানে আমাকে। বাসায় থাকলে আমার ইচ্ছে করে স্ত্রী কন্যাদের সঙ্গে আড্ডা দিই। আত্মীয়স্বজনের বাসায় গেলে তো কথাই নেই। মধ্যরাতেও যদি কোন বন্ধু ফোন করে বলে, ‘দোস্ত, আসবি নাকি’? অথবা ‘ভাবীকে নিয়ে চলে আয়’। পারলে তখনই উড়ে যাই। লম্বা পারিবারিক বন্ধুদের আড্ডার এমন সুযোগ তো সচরাচর হয় না। ২০২০ সালের প্রথম আড্ডাটি এবার জমেছিল প্রবাসী কণ্ঠ সম্পাদক খুরশিদ ভাইয়ের বাসায়। উনি প্রবাসী কণ্ঠের নিয়মিত এবং অনিয়মিত লেখকদের নিয়ে সুন্দর এক আড্ডার আয়োজন করেছিলেন।

আমার স্ত্রী কন্যারা বাসায় আড্ডা উপভোগ করলেও বাইরে আমার আড্ডার কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে। বাসায় বসে কম্পিউটারে ইমেইল চেক করতে বসলেও তারা বলে ওঠে, ‘এই যে শুরু হয়ে গেল’। বাজার থেকে যে কারণেই ফিরতে দেরী হোক না কেন, আমার স্ত্রী আড্ডার খোঁচা মারতে দেরী করে না। ‘কী? বাজারে গিয়েও বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছিলে নাকি?’ আমার আর বলা হয় না যে, এক জিনিসের জন্য তিন দোকান ঘুরতে হয়েছে। ঢাকা শহর হলে ট্রাফিক জ্যামের দোহাই দেয়া যেতো। টরন্টো শহরে তো সে উপায়ও নেই।

এদেশে মেইনস্ট্রিম কানাডিয়ানদের মধ্যে আড্ডার প্রচলন নেই বললেই চলে। বাঙালীদের মতো চুটিয়ে আড্ডার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা বাঙালীরা সত্যিই এক আড্ডবাজ জাতি। আমাদের আড্ডার এই ফরম্যাটটি পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এটা যেন সত্যিই বাঙালীদের এক অনন্য আবিস্কার। তবে উপমহাদেশের শিল্প সংস্কৃতির বিকাশে আড্ডার পজিটিভ ভুমিকা অনস্বীকার্য। বাঙালীর আড্ডা নিয়ে অনেক বিখ্যাত মানুষদের নানা রকম অবজারভেশন আছে।

বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “বাঙালীর আড্ডার মেজাজ নেই অন্য কোন দেশে, কিংবা থাকলেও যথোচিত পরিবেশ নেই। অন্যান্য দেশের লোক বক্তৃতা দেয়, রসিকতা করে, তর্ক চালায়, ফুর্তি করে রাত কাটিয়ে দেয়, কিন্তু আড্ডা দেয় না। আমাদের ঋতুগুলো যেমন কবিতা জাগায়, তেমন আড্ডাও জমায়। আমাদের চৈত্রসন্ধ্যা, বর্ষার সন্ধ্যা, শরতের জ্যোৎস্না-ঢালা রাত্রি, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল- সবই আড্ডার নীরব ঘন্টা বাজিয়ে যায়, কেউ শুনতে পায় কেউ পায় না।”

বাঙালী আড্ডার এমন অসাধারণ বর্ননা আমি আর পড়েছি বলে মনে পড়ে না। সত্যিই তো। আমাদের ঋতুগুলোও তো নানা ধরণের আড্ডার পরিবেশ তৈরী করে। তৈরী করে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী। ষড়ঋতুর এমন অপূর্ব বর্ণনা বাঙালী সংস্কৃতি, বাঙলা সাহিত্য ছাড়া আর কোথায় আছে? মান্না দে ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ বলে কেন আক্ষেপ করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা বোধহয় কেবল আড্ডাতেই পাওয়া সম্ভব। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঙালীর আড্ডাতৃষ্ণা নিয়ে একটা বড় ধরণের গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

জীবনে কখনও আড্ডা দেয়নি, এমন বাঙালী এই পৃথিবীতে পাওয়া যাবে কিনা বলা মুশকিল। সুপ্রাচীন আড্ডার ইতিহাস বাঙালী জাতির। বাঙালীর আড্ডার সঙ্গে তুলনা না করা গেলেও শোনা যায় ফরাসিরা নাকি আড্ডার ব্যাপারে বাঙালীদের কিঞ্চিৎ কাছাকাছি। কোন এক আড্ডাবাজ ফরাসির মন্তব্য: ‘আমরা ফরাসিরা নিজেদের ইউরোপের বাঙালী বলে গর্ববোধ করি’। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত জার্মান ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাস-এর মন্তব্য- “বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এক বড় উদ্দীপনা শক্তি – বাঙালীর আড্ডা”। তিনি বিশ্বাস করতেন, আড্ডা প্রতিভা বিকাশের সহায়ক।

আড্ডা এতটাই নেশা ধরানো বিষয় যে একবার জমে উঠলে আর রক্ষে নেই। দিন রাত যেন সব এক হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা হলে থেকেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, তাদের কাছে আড্ডার মাধুর্য বর্ননা অপ্রয়োজনীয়। কোথায় না আড্ডা দিয়েছি আমরা। পাবলিক লাইব্রেরী থেকে শুরু করে টিএসসি, হাকিম চত্তর, কার্জন হলের মতিনের চায়ের দোকান, হকের দোকান, ক্যান্টিন, ডাইনিংসহ অসংখ্য স্থানে আড্ডা জমেছে। আড্ডার বিষয়ের অন্ত নেই। নোংরা চুটকি থেকে শুরু করে জ্ঞানগর্ভ গুরুগম্ভীর অনেক আলোচনা হয়েছে সেইসব আড্ডায়।

তাসের আড্ডাও কম হয়নি। স্পেড ট্রাম্প খেলা আগেই জানতাম। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ব্রিজ খেলা শিখলাম। ভয়ানক তাসের নেশায় পেয়ে বসলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে হলে (হোস্টেলে) প্রথম তিনতাস আর নয়তাসের খেলা দেখলাম, শিখলাম। ছোটবেলা থেকে ‘জুয়াখেলা’ শব্দটির সঙ্গে পরিচয় থাকলেও বাস্তবে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। হলের অনেক রুমেই টাকা পয়সা দিয়ে খেলা হতো দেখতাম। মাঝে মধ্যে ইচ্ছা যে হয়নি তা নয়। সাহসে কুলায়নি। টাকা দিয়ে খেলা তিনতাসের আড্ডাকে বলা হতো মুনাজাত পার্টি।

কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার দু’বছর নিয়মিত আমাদের বাড়ীসহ বন্ধুদের বাড়ীতে আড্ডা দিয়েছি। মনে পড়ে আমাদের এক শিক্ষক আমাদেরই এক বন্ধুর নামের আগে ‘আড্ডাবাজ’ বিশেষণটি যুক্ত করে তাকে ডাকতেন। স্কুলে পড়াকালীন সন্ধ্যা পার করে বাসায় ফিরলে মুরুব্বীদের গালমন্দ অথবা মা’র খেতে হতো। কিন্তু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সে অনুশাসন শিথিল ছিল। কাজেই আড্ডার বিকাশে কোন ঘাটতি হয়নি। চাকরিসূত্রে কলিগদের সঙ্গে আড্ডা, ঈদের সময় বাড়ী গেলে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মফস্বলী আড্ডা, কোন আড্ডাতেই ক্লান্তি নেই। আমাদের সেই প্রাণসঞ্চারি আড্ডাবাজি আজও আছে। থাকতেই হবে। নইলে বাঙালী বলে পরিচয় দেবো কি করে?

আড্ডা নিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা হয়ে গেল। শেষ করতে হবে। আড্ডা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখা শেষ করবো। ‘চাই সাহিত্যের আড্ডা’ শিরোনামে এক লেখায় সায়ীদ স্যার লিখেছিলেন, ‘আজ আমাদের সেই আড্ডা চাই। আড্ডা- নির্জলা, রক্তিম, অকারণ। প্রশস্ত চালের নিচে নির্ঝঞ্ঝাট দরাজ হৃদয়ের কিছু বেহিসাবী উষ্ণতা। এতে বড় শিল্পসাহিত্যের ভিত তৈরী না হোক, অন্তত আমরা আবার বন্ধু হবো, সুস্থ হবো, হালকা হবো- এটুকু ভাবতে দোষ কী’?

নাজমুল ইসলাম, টরন্টো

জানুয়ারী ২০২০ , টরন্টো, কানাডা। nazmul13@gmail.com