এই পরবাসে রবে কে-১১

ইমিগ্র্যান্টদের হাসি কান্না

জানুয়ারী ৭, ২০২০

নাজমুল ইসলাম

দেশে যাবার জন্য সর্বক্ষণ মন উচাটন হয়ে থাকলেও যেতে পারছিনা। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার আর্থিক অবস্থা। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব যারা দীর্ঘদিন এদেশে আছে তারা প্রতি বছর না হলেও দু’বছর বা তিনবছরে অন্তত একবার ঘুরে আসছে। আর আমি প্রায় পাঁচ বছর হয়ে এলো একবার দেশে যেতে পারলাম না এটা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সপরিবারে দেশে যাবার মতো আর্থিক অবস্থা আমার নেই। অনেক চেষ্টা করেও করে উঠতে পারলাম না। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা আলাউদ্দিনের চেরাগ থাকলে বেশ হতো। ক্রেডিট কার্ড ঘষে হয়তো চলে যাওয়া যায়, কিন্তু সেই ঋণের ভবিষ্যত কল্পনায় ঋণরূপী দৈত্যের যে হু…হু…হু…হা…হা…হা… হাসি দেখতে পাই, তাতে দেশে যাবার চিন্তা আর বেশীদুর যায় না। সান্ত¡Íনা খুঁজি এই ভেবে- গত পাঁচ বছরে গৃহীত ব্যক্তিগত ঋণের বোঝাই যখন হালকা করতে পারছি না, তখন আর নতুন করে আর ঋণ করা কেন?
চল্লিশশোর্ধ বা পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়ে মাইগ্রেট করার অনেক বিড়াম্বনা আছে। বিশেষ করে ফেডারেল স্কীলড ওয়ার্কার ক্যাটাগরিতে যারা এসেছেন। কানাডায় চাকরির বাজারে এসব ইমিগ্র্যান্টের অবস্থা না ঘরকা না ঘাটকা। যারা দেশে থাকতে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কেবল নিজের পছন্দমতোই নয়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বিচারে একটি ভালো বা সম্মানজনক চাকরি করতেন, তাদের জন্য এদেশে এসে একইরকম বা কাছাকাছি একটা কাজ না পাওয়াটা হতাশাব্যঞ্জকই বটে। সব ইমিগ্র্যান্টের একই চিন্তা- একটা চাকরি। ভাল একটা কাজ।
কানাডায় ইমিগ্র্যান্টদের কাছে ভাল কাজ বা চাকরি, ভাল বেতন ইত্যাদির সংজ্ঞা বড়ই অদ্ভুত আর জটিল। কেউ ভাল কাজ বলতে বোঝেন সুটেড বুটেড হয়ে অফিসের কাজ। আবার কেউ ভালো কাজ বলতে বোঝেন ভালো বেতনের কাজ। নিজের কাজ নিয়ে কায়দা করে গল্প করতে ভালবাসেন অনেকেই। এখানে আসার পর থেকে কাজের গল্প নিয়ে বেশ মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। দু’একটা শেয়ার করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে বা কারও মনোবেদনার কারণ হলে এই অধম ক্ষমাপ্রার্থী। এক বাসায় গ্যাদারিংয়ে কাজকর্ম নিয়ে আলাপ জমেছে। কে কি কাজ করে এসব নিয়ে আলাপ চলছে। কানাডার নামকরা একটি ব্যাংকে ঘন্টায় ১৫ ডলারে কাজ করা একজনকে খুব ভাল জব করেন বলে সবাই ধন্য ধন্য করছেন। অন্যদিকে ঘন্টায় ২৫ ডলারের কাজ করেন এমন একজন ফুড সার্ভিস ওয়ার্কার সম্পর্কে তার অনুপস্থিতিতে সবাই মিলে ‘উনি তো বুয়ার কাজ করেন’ বলে হাসাহাসি করছেন। মজার ব্যাপার হলো, যারা হাসাহাসি করছিলেন তাদের বেশীরভাগই ঘন্টায় ১৮-২০ ডলারে চাইল্ডকেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট বা চাইল্ডকেয়ার এডুকেটরের কাজ করেন। উনাদের আলাপ শুনতে শুনতে ভাবছিলাম বলে ফেলি, দেখুন আমি ঘন্টায় ১৪ ডলারের কারখানা শ্রমিক। বর্তমান বাজারে মিনিমাম পেমেন্টের কাজ করে পরিবার নিয়ে চলা যে কত কঠিন তা আমি জানি। আপনারা ২৫ ডলার/ঘন্টার যে কাজটিকে ‘বুয়ার কাজ’ বলে উপহাস করছেন, সেটি আপনাদের ১৮ডলার/ঘন্টায় ‘আয়ার কাজে’র চেয়ে কী ভালো নয়? পরক্ষণেই মনে হলো থাক উনাদের এই স্টেরিওটাইপ রসিকতায় আর বেরসিক নাই বা হলাম।

আর একদিনের ঘটনা। কথা হচ্ছিল কাজ নিয়ে। ভদ্রলোক দালালীর কাজ করেন। ‘দালালী’ শব্দটার প্রয়োগ বোধহয় সঠিক হলো না। দেশের আর্থসামাজিক বিচারে বাংলা ‘দালালী’ শব্দটা বেশ শ্রুতিকটু। তার চাইতে ইংরেজী ‘ব্রোকার’ শব্দটা বোধহয় অনেক বেশী শ্রুতিমধুর। যাইহোক, ভদ্রলোক ব্রোকার হিসেবে নিজেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা উকিলদের মতোই প্রফেশনাল মনে করেন। শুধু প্রফেশনালই মনে করেন না, বরং একটা অদ্ভুত হিসেব দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে তিনি ঘন্টায় ডাক্তারদের চেয়েও বেশী আয় করেন। কথায় কথায় জানালেন যে তিনি ঘন্টায় ৫০০ ডলার আয় করেন। হিসেবটা বোঝাতে তিনি বললেন, একদিন তিনি দুইঘন্টা সময় নিয়ে বাড়ীঘর গোছানোর কাজ করেছেন। এতে তার ১০০০ ডলার লোকসান হয়েছে হয়েছে বটে, কিন্তু যে মানসিক প্রশান্তি পেয়েছেন তা অমূল্য ইত্যাদি ইত্যাদি। আলাপের এক পর্যায়ে জানলাম কোন এক ক্লায়েন্টকে সার্ভিস দিতে গিয়ে তার পিছনে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা খরচ করে ১৫০০ ডলার কমিশন পেয়েছেন। অতএব প্রতি ঘন্টায় তার ইনকাম দাঁড়ালো ৫০০ ডলার। এমন প্রফেশনাল সান্তনা ক’জন নিতে পারেন?
যে কাজের স্কীলস আছে বলে কানাডা সরকার ইমিগ্র্যান্টদের নিয়ে আসে, এদশে আসার পর বেশীরভাগ ইমিগ্র্যান্টই তার ধারে কাছে কোন কাজ পায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় কানাডা সরকারের তথাকথিত স্কীলড ইমিগ্রেশনের ক্ষেত্রে যেন বড় একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সরকার ভিসা দেয়ার সময় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে যে পরিমান লোকের ঘাটতি আছে ঠিক সেই অনুযায়ী ইমিগ্রেশন দিয়ে লোক নিয়ে আসছে। কাজেই এদেশে আসবার আগে স্কীলড ইমিগ্র্যান্টদের মনে এমন ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, নতুন দেশে গিয়ে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে একটা কাজ পেয়ে যাবে। কিন্তু আসার পরে দেখা যায় উল্টো চিত্র। সরকার তাকে স্থায়ী বসবাসের কাগজ ধরিয়ে দিয়েই খালাস। এবার এই জনসমুদ্রে হাবুডুবু খাও আর কাজ খুঁজে বেড়াও। শুরু হয় সারভাইভাল জব বা তথাকথিত অড জব। সারা পৃথিবী থেকে ইমিগ্রেশন দিয়ে নিয়ে আসা মেধাবীদের মেধার এই অপচয়টা যে কানাডা সরকারের অনিচ্ছাকৃত নয়, ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যে সেটি নিয়ে কোন সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না।
এই স্কীলড ইমিগ্র্যান্টরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পাওয়াতে যে আলটিমেটলি সরকারেরই বোঝা হচ্ছে, সেটিও বোধহয় সরকার বাহাদুরের মাথায় নেই। কীভাবে হচ্ছে? এই কাজ না পাওয়া গ্রæপের একটা অংশ সরাসরি সোশ্যাল এসিস্ট্যান্স ক্লেইম করছে। আর একটি অংশ শিক্ষা ঋণ (ঙঝঅচ) নিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়তে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন কমিউনিটি কলেজে। পড়া শেষে একটা অংশ চাকরি পেলেও অনেকেই পড়া শেষ করে কর্মহীন হয়ে বিশাল এক ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কেউ কেউ শুধু ঋণের টাকা পাবার আশায় এক বিষয় পড়া শেষ করে আর এক বিষয়ে পড়তে শুরু করছে। সরকার পড়ার জন্য ঋণ দিচ্ছে ভালো কথা। কিন্তু ত্রিশ বছর বয়সে ঋণগ্রস্থ হওয়া আর পঞ্চাষোর্ধ হয়ে ঋণগ্রস্থ হওয়ার মধ্যে যে তফাৎ আছে সেটি জেনেও অনেকে ঋণ নিয়ে পড়েই চলেছে। এমনকি ষাটোর্ধ হয়েও পড়ে চলেছেন অনেকেই। যদিও ‘এদেশে এসে না পড়লে চাকরি হয় না’ এরকম একটা কথা বাজারে বেশ চালু থাকা সত্বেও স্কীলড ক্যাটাগরিতে আসা অসংখ্য ইমিগ্র্যান্ট এদেশে এসে নতুন করে কোন লেখাপড়া ছাড়াই চাকরি বাকরি করছে।
শিক্ষা ঋণ নিয়ে পড়ার ব্যাপারে অবশ্য পারিপার্শ্বিক চাপও একটা বড় ফ্যাক্টর। এদেশে আসার পর কোন কাজে ঢোকার আগ পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই বলতে শুরু করলো কাজ না পেলে পড়তে শুরু করো। নার্সিং-এ পড়া বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে বলে নার্সিং পড়ো। ট্যাক্স ফাইলারের কাছে গেলে বলে একাউন্টিং পড়ো। রিয়েল এস্টেট বা ইনসিওরেন্স ব্রোকার যার সঙ্গেই কথা হয় সেই তার নিজ নিজ সাবজেক্ট পড়তে উৎসাহিত করে। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে রিফিউজি ক্যাটাগরি কিংবা ফ্যামিলি ক্যাটাগরিতে এসে উচ্চ চাহিদার জব মার্কেটে প্রায় প্রতিযোগিতাহীন কর্মজীবনে প্রবেশ করে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত এসব ইমিগ্র্যান্টদের হাতি ঘোড়া মারা গল্প আর উপদেশ শুনতে আর কতই বা ভাল লাগে?
পড়লে প্রচুর জ্ঞান হয়, জানা হয় একথা ঠিক। সেই জ্ঞান দিয়ে অনেক তর্কও করা যায় সেকথাও মিথ্যে নয়। কিন্তু সমাজের চোখে জীবনে সফলতা বা সার্থকতা বলতে যা বোঝায় তা কি আপেক্ষিক নয়? সীমিত কিছু ক্ষেত্র ব্যতিরেকে লেখাপড়ার সঙ্গে চাকরি বাকরি, আর্থিক স্বচ্ছলতা এগুলোর কোন পজিটিভ কোরিলেশন সম্পর্ক আছে কিনা তা সত্যিই গবেষণার বিষয়। স্বদেশী একজনকে জানি যিনি দেশ থেকে কেবল আন্ডার ম্যাট্রিক (সম্ভবত প্রাইমারি পাশ) হয়ে এসেছেন তাই নয়, এদেশে এসেও আর কোন লেখাপড়া করেননি। কোনরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ভদ্রলোক বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত। কানাডায় একটা ফ্যাক্টরীর মালিক। ভদ্রলোকের মুখে যে ইংরেজী উচ্চারণ শুনেছি অমন বিশুদ্ধ কানাডিয়ান উচ্চারণে ইংরেজী অনেক উচ্চশিক্ষিত বাঙালীর মুখেও শুনিনি।
স্কীলড ইমিগ্র্যান্টদের পূনর্বাসনে সরকারের করণীয় নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। যদিও সরকারের করণীয় সরকারই ঠিক করবে। তবু মনে হয় কোথায় যেন সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি আছে। সরকার যাদের ইমিগ্রেশন ভিসা দিয়ে নিয়ে আসছে তাদের চাইলে একটা ক্র্যাশ প্রগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদী (৬মাস থেকে ২বছর পর্যন্ত হতে পারে) শর্ট কোর্স করিয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে জব মার্কেটে ঢুকিয়ে দিতে পারে। একজন ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট তৈরী করতে সরকারের যে ব্যয় হয়, তার চেয়ে অনেক কম খরচেই সরকার এই কাজটি করতে পারে। এতে সরকারের স্কীলড ওয়ার্কারের ঘাটতিও পূরণ হয়, অর্থেরও সাশ্রয় হয়। সর্বপরি ইমিগ্র্যান্ডদেরও নতুন দেশে এসে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খেতে হয় না।

নাজমুল ইসলাম, টরন্টো