আমাদের সংগে মহামারীর দেখা হয়েই গেল
মে ১৮, ২০২০
সালাহ উদ্দিন শৈবাল
আমাদের পেছনের উঠানে একটা খরগোশ থাকে। নাকি দুইটা? জানি না। দুইটা এক সংগে দেখি নাই। সব সময় একটাই দেখি। খরগোশের চেহারা চিনে রাখার টেকনিক আমার জানা নাই।
আমি পেছনের কাঁচের দরজায় হাত দিলেই হয়…দরজা খুলতে হয় না। সে যতো দূরেই থাকুক..টের পেয়ে যায়। পালিয়ে যায়।
আজকে গেল না। চুপচাপ একটা গাছের নিঁচে বসে থাকলো। আমাকে ছবিও তুলতে দিল। এরপর তরংগ আসলো। খরখোশ কান খাঁড়া করে শুনলো। আমাদের কথা শুনলো। পালালো না। সে কি আমাদের আর বিপদ মনে করছে না? নাকি বুঝে ফেলেছে আমরাও বিপদে আছি?
ভয়ানক বিপদে কি প্রাণীদের আচরণ চেঞ্জ হয়? মানুষের আচরণ চেঞ্জ হয়? পৃথিবীতে এই মানুষের বসবাস দুই লক্ষ বছর! কম না…মানুষ কি পাল্টেছে? কতোটা পাল্টেছে?
তরংগ এসে আমার পাশে দাঁড়ালো, “আমার প্রশ্ন আছে।”
আমার ছেলের বয়স পনের। এই মহামারী নিয়ে তার সংগে আমার একটা চুক্তি হয়েছে। অনেকটা দায়িত্ব ভাগাভাগি বলা যায়। আমি তার মহামারী খবরের চ্যানেলের দায়িত্ব নিয়েছি। তাকে বোঝাতে পেরেছি যেহেতু সে এখনো ভুল খবর বা সঠিক খবরের পার্থক্য ঠিক ঠাক জানে না তাই আমি তার জন্য সব সঠিক খবর সংগ্রহ করে রাখবো। সে কোন চ্যানেল বা মিডিয়া ফলো না করে ‘আব্বা মিডিয়া’ ফলো করবে। আমি প্রতিশ্রæতিবদ্ধ সঠিক খবর সরবরাহ করবো। এখনো পর্যন্ত আমার একমাত্র অডিয়েন্স আমার উপর খুশি আছে। তার প্রশ্নগুলো সাধারণত পুনরাবৃত্তিমূলক। আপনারা শুনলেই বুঝবেন।
“বাংলাদেশ কেমন আছে? আমার আত্মীয়রা কেমন আছে?”
আমি খুব অবাক হই…আমার ছেলে কানাডা এসেছে ছয় বছর বয়সে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশ দিয়েই তার প্রশ্ন শুরু হয়। আমি কি খুশি হবো? বুঝি না। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এই ছেলেটাও কি আমার মতো বুকের ভেতর বাংলাদেশ নিয়ে প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেবে? সেটা কি তার জন্য ভালো হবে? জানি না। পরে ভাববো। আপাতত: আমার সাংবাদিক ভূমিকা শুরু হোক।
“বাংলাদেশে আক্রান্ত আর মৃত্যু দুটোই কিছুটা বেড়েছে। তবে অবস্থা এখনো খুব খারাপ না..যতোটা হতে পারতো। ইউরোপ..আমেরিকার চেয়ে ভালো আছে। আমাদের আত্মীয়রা ভালো আছে।”
“কানাডার অবস্থা কি?”
“ভালো বলতে পারলে আমারও ভালো লাগতো। কিন্তু আক্রান্তের দিক থেকে পৃথিবীর বারো নম্বর দেশকে খুব ভালো অবস্থায় আছে বলা যায় না। এ পর্যন্ত (১৪ মে) দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৩,৩৯৫ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৫,৫৭৬ জন। তবে সরকার এখনো হাসপাতালগুলো ঠিক রাখতে পেরেছে। সেখানে মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে..এটাই ভালো খবর।”
ছেলে ঝিম মেরে শুনলো। তারপর হেসে দিয়ে বললো..“আমার ভালো লাগে তুমি আমাকে বানিয়ে বানিয়ে পজিটিভি কিছু বলো না। আমার মন ভালো করার জন্যও না। সেই জন্য আমি তোমার খবরকে সঠিক মনে করি।”
এবার আমি হেসে দিলাম।
“এতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই বাবু। মজার একটা গল্প বলি। গল্পটা সাইকোলজির প্রফেসর এধনৎরবষষব ঙবঃঃরহমবহ এর। তার একটা বিখ্যাত বই আছে নাম জবঃযরহশরহম চড়ংরঃরাব ঞযরহশরহম। গ্যাব্রিয়েলসহ অনেকেই অনেক রিসার্চ করেছে পজেটিভ চিন্তার উপর। একবার দুই দল মোটা মানুষকে ওজন কমানোর জন্য ডাকা হলো। একদলকে অনেক পজেটিভ চিন্তা দেয়া হলো। তাদের ভাবতে দেয়া হলো…তারা শুকিয়ে গেলে কেমন দেখাবে.ইত্যাদি..ইত্যাদি। সব সময় আশার কথা বলা হলো। আরেকদলকে বিশেষ কিছুই বলা হলো না। মজার বিষয় রিসার্চ শেষে দেখা গেলো..যাদের বেশি বেশি পজেটিভ চিন্তা তাদের ওজন খুব কম কমেছে। কারণ হচ্ছে যারা সারাক্ষন জয় হবেই ভেবেছিল…তারা জয় অর্জনের জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেনি। গ্যাব্রিয়েল বললেন..পজেটিভ চিন্তা অবশ্যই ভালো তবে লিমিট রেখে। সত্য গোপন করে নয়। ‘ঞযব সড়ৎব ঢ়ড়ংরঃরাবষু ঢ়বড়ঢ়ষব ভধহঃধংরুব ধহফ ফধুফৎবধস ধনড়ঁঃ ঃযবরৎ ভঁঃঁৎব ংঁপপবংং, ঃযব ষবংং বিষষ ঃযবু ফড় রহ ঃবৎসং ড়ভ যধারহম ধপঃঁধষ ংঁপপবংং.”
পুরনো সেই অর্ধেক পানিভরা গ্লাসের গল্পটাই বলি। যে বলছে অর্ধেক গ্লাস খালি আর যে বলছে অর্ধেক ভরা….এরা কেউই পুরো গ্লাসের কথা বলছে না। যার যার মতো করে বলছে। এতে গ্লাসের পানি বাড়ছেও না..কমছেও না। গ্লাসে পানি যা ছিলো তাই থাকছে।
অনেক বেশি কথা বলে ফেললাম। ছেলে কি বুঝলো সেই জানে। হঠাৎ শক্ত গলায় প্রশ্ন করে বসলো,
“আমি কবে স্কুলে যেতে পারবো? কবে এইসব শেষ হবে? আমার কিছু ভালো লাগছে না। রোজা চলছে। সামনে ঈদ…”
আমাকে থমকে যেত হলো। এই প্রশ্নের উত্তর কি?
“সরি…বাবু….পৃথিবীর কারো কাছে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই।..ভ্যাকসিন ছাড়া আসলে আর কোন উপায় নেই। সেই ভ্যাক্সিন আসতে সময় লাগবে। সব ঠিক ঠাক থাকলে এই বছরের শেষের দিকে বা আগামী বছরের শুরুতে….”
ছেলের মন খারাপ করে বসে পড়লো। “এ-তো দিন…ভ্যাকসিন বানাতে এতো দেরী হচ্ছে কেন আব্বা?”
তরংগের দিকে তাকিয়ে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। আমার নিজের জন্যও হলো। গত একশ বছরে পৃথিবী বড় কোন মহামারী দেখেনি। বেশ কয়েকটা প্রজন্ম জন্ম নিয়েছে। সংসার করেছে। আবার নিয়ম মেনে মরেও গেছে। আমরা পারলাম না। আমাদের সংগে মহামারীর দেখা হয়েই গেল।
আজ বাইরে রোদ আছে। কিন্তু বেশ ঠান্ডাও পড়েছে।
“তোমাকে ১৯১৮ সালের মহামারীর কথা বলেছি। প্রায় দেড় বছর ছিল। মানুষ তখন ভাইরাস কি….হাত ধুলে ভালো থাকা যায়…এইসব কিছুই জানতো না। অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল এটা সত্য। ৫ কোটির উপরে..। কিন্তু পৃথিবীতে তখন প্রায় ২০০ কোটি মানুষ ছিল। বেশির ভাগ মানুষ আক্রান্তই হয়নি। ভাইরাস এক সময় হটাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেল। চলে গেল। আর আসে নাই। কেন? কিভাবে?…আমরা জানি না।
ছেলের চোখ চকচক করে উঠলো..“এমনি এমনি চলে গিয়েছিল! এবারো কি যেতে পারে?”
যেতে পারে….নাও পারে। তবে তোমাকে একটা আশার কথা বলতে পারি। যেটা মিথ্যা আশা না। অহেতুক পজেটিভ চিন্তাও না। এটাই সত্য। এটাই ইতিহাস। মানুষ এই পৃথিবীর কেন সবচেয়ে শক্তিশালী প্রানী জানো?….
মানুষই একমাত্র প্রানী যারা অনেক অনেক….হাজার..হাজার..মানুষ মিলে একসাথে লড়াই করতে পারে। এই ধরো…এই মুহুর্তে শত শত বিজ্ঞানী বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাসকে পরাজিত করার জন্য একযোগে কাজ করছে। তারা একে অন্যের সংগে যোগাযোগ রাখছে। নতুন নতুন জ্ঞান শেয়ার করছে। পুরনো যেসব আবিস্কার আছে সেগুলো বারবার পড়ে পড়ে দেখছে। তারপর যখন ভ্যাকসিন বা ঔষধ আবিস্কার হবে…তখন সেটা যে দেশেই হোক না কেন…সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে দেয়া হবে দ্রুত। কোরোনা কিন্তু সেটা পারছে না। তারা তাদের মতো একা একা লড়াই করছে। কানাডার ভাইরাসের সংগে বাংলাদেশের ভাইরাসের কোন যোগাযোগ নেই। সম্ভব না। আমি কি ঠিক বললাম?
ছেলে কথা বললো না। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। অন্য সময় হলে হয়তো দ্বিধাহীন চিত্তে তার মাথা আমার বুকে চেপে ধরতাম। এখন কেমন অস্বস্থি হয়। আমি কোন ক্ষতি করছি নাতো?
মানুষ স্পর্শ পছন্দ করে। প্রিয় জনের স্পর্শ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আফসোস…করোনা মানুষের সবচেয়ে প্রিয় আচরণকে তার আক্রমনের হাতিয়ার বানিয়ে বসেছে।
আমি আস্তে আস্তে বললাম-
“বাবুৃ রোদ-আলো-হাওয়া এই সব মিলিয়ে আমাদের এই পৃথিবী দেখো। এই পৃথিবী আমাদের প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নিয়েছে। নিচ্ছে। মানুষ একদিনও কারো দয়ায় এই পৃথিবীতে বাঁচেনি। লড়াই করেই বেঁচে আছে। টিকে আছে। আরো লক্ষ বছর টিকে থাকবে এটাই আমি ইতিহাস থেকে শিখেছি।”
কথাগুলো কি আমি আমার ছেলেকে বললাম? মনে হয় না। কথাগুলো আমার নিজের জন্যও দরকার।
সালাহ উদ্দিন শৈবাল – টরন্টো