স্বল্প আয়ের মানুষেরা কি গৃহহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি’র মধ্যে আছে?
সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯
খুরশিদ আলম
কানাডার প্রায় সবকটি শহরেই বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। ফলে যারা ন্যূনতম মজুরীতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন তাদের পক্ষে বাড়িওয়ালাকে প্রতি মাসের বাড়ি ভাড়ার চেক প্রদান করাটা সত্যিকার অর্থেই কঠিন হয়ে পড়েছে। চোখে এখন সর্ষেফুল দেখছেন অনেকেই। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার অলাভজনক হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় প্রতি পাঁচ জনে একজন অর্থাৎ ১৮ শতাংশ মানুষ তাদের উপার্জনের অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশি অর্থ বাড়ি ভাড়া ও ইউটিলিটির পেছনে ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছেন। অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এটা হলো ব্যয়ের এমন এক ‘সঙ্কটের পর্যায়’ যখন মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি’র মধ্যে পড়ে।
গত মাসে সিবিসি নিউজের এক খবরে বলা হয়, কানাডার প্রায় সব শহরেই ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা কোনও ব্যক্তির পক্ষে মাস শেষে এক বা দুই বেডরূমের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া যোগাড় করার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। অন্টারিও-ভিত্তিক এক থিঙ্কট্যাঙ্কের নতুন রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে।
বাড়িভাড়া বিষয়ক সাইট পডম্যাপারের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে গত এক বছরে কানাডার ২৪টি শহরের মধ্যে ১৭টিতেই বাড়িভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আগে যে-সব শহরের বাড়ির বাজার সবচেয়ে সুলভ ছিলো সে-গুলোরও কয়েকটিতে বাড়িভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
কানাডার সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়িভাড়ার বাজার হিসাবে টরন্টো এখনও তার অবস্থান ধরে রেখেছে। এখানে এক বেডরূমের বাড়ির ভাড়া এক বছরে ১১.৯ শতাংশ বেড়ে প্রতিমাসে মোটামুটি ২.২৬০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। দুই বেডরূমের বাড়ির ভাড়া বেড়েছে ১৩.১ শতাংশ হারে এবং ভাড়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাসিক ২,৮৫০ ডলার।
কানাডায় অস্বাভাবিক হারে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির প্রধান দুুটি কারণ হলো- বাড়ির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং ইমিগ্রেন্ট এর সংখ্যা বৃদ্ধি। আরেকটা কারণ হলো, যারা বাড়ির সম্ভাব্য ক্রেতা ছিলেন তারা এখন ব্যাংক বা অর্থ লগ্নিকারী কোন প্রতিষ্ঠান থেকে সহজে ঋণ পাচ্ছেন না। একদিকে সুদের হার বৃদ্ধি অন্যদিকে ‘স্ট্রেস টেস্ট’ নামের এক কঠিন প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা হয়েছে গত বছর। ফলে সম্ভাব্য এই ক্রেতাগণ ভাড়া বাড়িতেই থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। পাশাপাশি নতুন বাড়ির চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তেমন ভাবে তৈরী হচ্ছেনা।
কানাডার সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভস (সিসিপিএ) এর অর্থনীতিবিদ ডেভিড ম্যাকডোনাল্ড বলেন, “ভাড়াটেদের অনেকেই বিশেষ করে যারা ন্যূনতম মজুরিতে বা প্রায় ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করেন, যাদের আয় নির্দিষ্ট এবং এক ব্যক্তির আয়ে চলে এমন পরিবারের ভাড়াটেরা যেখানেই খোঁজ করুন না কেন সাধ্যের মধ্যে বা মোটামুটি বাসযোগ্য অ্যাপার্টমেন্ট পাবেন না। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সক্ষমতা ক্রমশই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।”
ভ্যাঙ্কুভারে বর্তমানে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা একজন ব্যক্তিকে এক রূমের বাড়ির ভাড়া নেওয়ার সক্ষমতা অর্জনের জন্য সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টা এবং দুই রূমের বাড়ির জন্য ১১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। টরন্টোও খুব পিছিয়ে নেই। এখানে একজন শ্রমিককে এক রূমের বাড়ির জন্য সপ্তাহে ৭৯ ঘণ্টা এবং দুই রূমের বাড়ির জন্য ৯৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।
গত প্রায় এক দশকে টরন্টোতে বাড়ির দাম, বাড়ি ভাড়া এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সেই তুলনায় কর্মজীবী মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে খুবই সামান্য। ফলে মানুষজন বিশেষ করে স্বল্প আয়ের কর্মজীবী যারা তারা সত্যিকার অর্থেই একটি সংকটময় অবস্থা পার করছেন। আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনে এটি একটি ইস্যু হয়ে উঠতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন।
সিসিপিএর হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশের বাড়িভাড়ার হার অনুযায়ী একজন শ্রমিককে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে দুই বেডরূমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে সক্ষম হতে হলে তাকে প্রতিঘণ্টায় ২২.৪০ ডলার করে আয় করতে হবে। আর এক বেডরূমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়ার সক্ষমতা পাবার জন্য এই পরিমাণটা কমে ঘণ্টায় ২০.২০ ডলার হবে।
কিন্তু টরন্টোতে অনেকেরই সেই পরিমাণ আয় নেই। এখানে সরকারীভাবে নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরী হলো ১৪ ডলার। কথা ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী হবে ঘন্টায় ১৫ ডলার করে। অন্টারিওর বিগত লিবারেল সরকার এই আইন করে গিয়েছিল। কিন্তু ড্যাগ ফোর্ডের প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় এসে তাতে বাধ সাধে। তারা ন্যূনতম মজুরী ঘন্টায় ১৫ ডলার করার পরিকল্পনাকে স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। অথচ আমরা দেখেছি অন্টারিওর ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত চাকরীর বাজারে নেতিবাচক কোন প্রভাব ফেলেনি।
হাফিংটন পোস্ট এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনেক অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী ঘন্টায় ১৪ ডলার করার ফলে এখানকার চাকরীর বাজারে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। চাকরী হারাবেন অনেকে এবং নতুন কোন চাকরী সৃষ্টি হবে না।
টিডি ব্যাংক এর ভবিষ্যতবাণী ছিল ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির ফলে এই প্রভিন্সে প্রায় ৯০ হজার লোক চাকরী হারাবে। ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ ‘রেস্টুরেন্ট কানাডা’র সতর্কবাণী ছিল, ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি এবং অন্যান্য নতুন লেবার ল এর কারণে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার চাকরী হুমকীর মুখে পড়বে। ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির পর কিছু কিছু চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠান আত্মরক্ষার নামে কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধাও কর্তন করে। কিন্তু দেখা গেল সেই সময় অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী ১৪ ডলারে উন্নীত করার পর ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও নতুন চাকরী সৃষ্টিতে তা নেতিবাচক কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং বেকারত্বের হার কমে এসে ৫.৪ এ ঠেকেছে। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব এটি। এবং গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ম বেকারত্বের হার এটি।
আমরা জানি কানাডা বিশ্বের অন্যতম একটি ধনী দেশ। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই ধনী দেশেটিতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দারিদ্রতার শিকার। ‘ Canada Without Poverty ’ এর তথ্য মতে দেশটিতে এখন প্রায় ৫ মিলিয়ন বা অর্ধকোটি মানুষ (মোট জনসংখ্যার প্রতি ৭ জনে একজন) দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস করছেন। গত দুই দশকে দেশটিতে অনিশ্চিত চাকরীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০%। গত ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দরিদ্র মানুষের আয় কমেছে ২০%। গত ২৫ বছরে কানাডার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০%। কিন্তু আবাসন খাতে বিনিয়োগ কমেছে ৪৬%।
কানাডার বড় বড় শহরে যারা মাস শেষে সঠিক ভাবে বাড়ি ভাড়া যোগাড় করতে পারেন না তারা এই দ্ররিদ্র জনগোষ্ঠীরই অংশ। আর এদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশই ইমিগ্রেন্ট।
নতুন আসা উচ্চশিক্ষিত এই ইমিগ্রেন্টদের সবচেয়ে বড় যে সমস্যটি মোকাবেলা করতে হয় সেটি হলো- নিজ নিজ পেশার চাকরীতে প্রবেশ করতে না পারা। নতুন এই ইমিগ্রেন্টদের প্রায় নব্বুই থেকে পচানব্বুই ভাগই তাদের নিজ পেশাভিত্তিক চাকরী পান না। ফলে বাধ্য হয়ে জীবন ধারণের জন্য এমন সব পেশায় তাদেরকে প্রবেশ করতে হয় যেখানে বেতন অনেক কম। তাছাড়া কোন সুযোগসুবিধাও প্রদান করা হয়না। নেই কোন ড্রাগ প্লান এরও সুবিধা। সংসার চালানো জন্য একার আয় মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই চাকরী করতে হয়। কিন্তু তারপরও তাদের আয় থেকে যায় দারিদ্রসীমার নিচে। এবং যার পরিণতিতে মাস শেষে বাড়ি ভাড়ার চেক প্রদান করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। আয়ের অর্ধেক বা তারো বেশী চলে যায় বাড়ি ভাড়ার পিছনে। এর প্রভাব পড়ে গিয়ে শিশুদের জীবনমানের উপর, শিশুসহ নিজেদের পুষ্টিহীনতায়, মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এবং আরো কিছু মৌলিক চাহিদার উপর।
কানাডার একজন মনস্তত্তবিদ ড. ম্যারিলিন চোহেম তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “কানাডায় দারিদ্র্য হলো শিশুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত যেমন, মনোযোগের অভাব ও অস্বাভাবিক সক্রিয়তাজনিত অসুস্থতা, বিষন্নতা, উদ্বেগ ও আচরণগত ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি।” তিনি আরো বলেন, “দরিদ্র অভিবাসী শিশু বা দরিদ্র কানাডীয় শিশু এই উভয়ের মধ্যেই স্বচ্ছল পরিবারের শিশুদের চেয়ে বেশি সমস্যা থাকে।”
কানাডিয়ান প্রেস এ প্রকাশিত আরেক গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, কানাডায় সাধারণ কর্মজীবী মানুষদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থা এমন যে, কোন এক পক্ষের পে চেক পেতে সপ্তাহখানেক দেরী হলে দৈনন্দিন জীবনের কর্মকান্ডে ছন্দপতন ঘটে। সময় মত বাড়ি ভাড়া প্রদান, ক্রেডিট কার্ডের বিল প্রদান, লাইন অব ক্রেডিট এর বিল প্রদান, টেলিফোন বিল প্রদান, গাড়ির পেমেন্ট, ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম প্রদান এমনকি সাপ্তাহিক গ্রোসারী করাও সমস্যা হয়ে দাড়ায়। সাম্প্রতিক কালের উর্ধ্বগামী খরচ এবং ঋণের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে আমরা দেখছি, কানাডায় অতি ধনীদের হাতে সম্পদের পরিমাণ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা রূপকথাকেও হার মানায়। আর এর উল্টো চিত্রটি হলো, দেশটির নিন্ম আয়ের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষেরা প্রতিনিয়ত কঠিন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন কোন রকম বেঁচে থাকার জন্য। নুন আনতে তাদের পান্তা ফুরায়। সঠিক সময় বিভিন্ন বিল পে করতে পারেন না। বাড়ি ভাড়াও সঠিক সময় দেওয়া হয়ে উঠেনা প্রতিমাসে।
কানাডার নিন্ম আয়ের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের এই যে ভোগান্তি, মাস শেষে বাড়ি ভাড়া সঠিক সময়ে দিতে না পারার যে গ্লানি তা থেকে তাদের মুক্তির উপায় কি?
আমরা জানি, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় একটা দরিদ্র জনগোষ্ঠি সবসময়ই বিদ্যমান থাকে। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠি পুঁজিবাদী অর্থনীতিরই বাইপ্রোডাক্ট। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে শোষণ করেই কতিপয় লোক অতি ধনী হয়ে উঠেন।
তবে আশার কথা এই যে কানাডা একটি পূঁজিবাদী রাষ্ট্র হলেও একই সাথে এটি একটি কল্যাণ রাষ্ট্র-ও (Welfare State)। অর্থাৎ জনগণ বিশেষ করে দরিদ্র বা স্বল্প আয়ের জনগণের জন্য দেশটির কিছু বিশেষ কার্যক্রম রয়েছে। কল্যাণ রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বলা আছে, “A system whereby the government undertakes to protect the health and well-being of its citizens, especially those in financial or social need, by means of grants, pensions, and other benefits.” এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই কানাডার হেলথ সিস্টেমে, চাইল্ডটেক্স বেনিফিটে, পেনশনে, সাবসিডাইজড হাউজিং সহ আরো কিছু ক্ষেত্রে।
আমরা জানি, কানাডায় স্বল্প আয়ের মানুষদের সুবিধার্থে সাবসিডাইজড হাউজিং এর একটি সিস্টেম গড়ে উঠেছে বহু বছর আগে থেকেই। টরন্টোতে এই জাতীয় বাড়িগুলোর নাম ‘টরন্টো কমিউনিটি হাউজিং’। এই বাড়িগুলোতে যারা থাকেন তারা মাস শেষে তাদের আয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাড়ি ভাড়া হিসাবে দেন। অর্থাৎ কোন পরিবারের আয় ২০০০ ডলার আয় হয়ে থাকলে বাড়ি ভাড়া হিসাবে তাদের কাছ থেকে নেয়া হয় প্রায় সাড়ে ৬ শ ডলারের মত। বর্তমানে টরন্টো কমিউনিটি হাউজিং এ ১১০,০০০ জন ভাড়াটিয়া রয়েছেন। ওয়েটিং লিস্টে আছেন ১০২,০৪৯ জন। যারা ওয়েটিং লিস্টে আছেন তাদেরকে এপার্টমেন্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১০ থেকে ২০ বছর!
কানাডার মত একটি ধনী দেশ এবং টরন্টোর মত একটি অভিজাত শহরের এই চিত্র মোটেই কাম্য নয়। কানাডার অন্যান্য শহরেও মোটামুটি একটি চিত্র।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কানাডায় ধনী দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান সীমাহীন ও বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের কল্পনাকেও হার মানায় এমন ধনীও আছেন কানাডায়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কানাডার এই অতি ধনীরা দিন দিন আরো বেশী পরিমাণের সম্পদের মালিক হচ্ছেন। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যা ঘটছে তার প্রায় পুরো ফয়দাটা তারাই বাগিয়ে নিচ্ছেন। বাদবাকী যারা আছেন তারা পাচ্ছেন অতি সামান্য সুবিধা অথবা কিছুই পাচ্ছেন না। ফলে সমাজে তৈরী হচ্ছে সীমাহীন বৈষম্য। অক্সফ্যামের পলিসি এন্ড ক্যাম্পেইন ডিরেক্টর লরেন রেভন বলেন, যে সমাজে বৈষম্য অনেক বেশী সে সমাজ অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়।
আর শুধু অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনেই যে এই বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে তা নয়। অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকেও প্রায় একই ধরণের চিত্র পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের জুনে প্রকাশিত কানাডার সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভ নামের বাম ঘরাণার একটি সংগঠনের রিপোর্টে দেখা যায়, সবচেয়ে ধনী ৮৬ জন ব্যক্তি বা পরিবার অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ০.০০২ শতাংশ লোক ক্রমশ আরও ধনী হয়ে উঠছেন এবং এই মুহূর্তে তাদের হাতে দেশের দরিদ্রতম এক কোটি ১৪ লাখ লোকের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত রয়েছে।
রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এই পরিসংখ্যান ১৯৯৯ সালের চেয়ে বেশি। ওই বছর সবচেয়ে ধনী ৮৬ ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ছিলো সবচেয়ে গরীব এক কোটি ১লাখ মানুষের সম্পদের সমান। তাদের ওই সম্পদ দিয়ে কানাডার নিউ বার্নসউইক প্রভিন্সের সবকিছু কিনে ফেলার পরও আরো ৪ হাজার কোটি ডলার তাদের হাতে থেকে যাওয়ার কথা!
কানাডায় মাত্র কয়েকজন লোকের হাতে পর্বতসমান উচ্চতার সম্পদ কুক্ষিগত হবে আর অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দারিদ্রতার মধ্যে বাস করে অসুস্থ্য জীবনযাপন করবেন সেটা কোন সুস্থ্য সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন নয়। আমরা দেখেছি, অক্সফ্যামও তাদের প্রতিবেদনে বিপজ্জনকভাবে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, যে সমাজে অধিক বৈষম্য থাকে সে সমাজে অপরাধের মাত্রাও অধিক থাকে। ঐ সমাজ হয় অস্বাস্থ্যকর। মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করেন না। মানুষজন মনে করতে থাকেন তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন যখন দেখেন ঐ অতি ধনীরা নিজেদের সুবিধার্থে আইন তৈরী করে নেন।
আমরা জানি কানাডা একটি কল্যাণ রাষ্ট্র। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠির কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। মনে রাখা দরকার যে, দারিদ্রতা কোন বিলাসিতা নয়। মানুষ ইচ্ছে করে দরিদ্র হয় না। তাকে দরিদ্র বানানো হয়। এবং মানুষকে দরিদ্র বানানোর নিপুন কারিগর হলেন ঐ অতি ধনীরা।
ইতিপূর্বে অন্টারিও লিবারেল সরকার ‘গ্যারান্টিড বেসিক ইনকাম’ এর একটি পাইলট প্রজেক্ট চালু করেছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠির কল্যাণে। কিন্তু এর ফলাফল কি হয় তা না দেখেই ড্যাগ ফোর্ডের প্রগ্রেসিভ কনজাভেটিভ সরকার ক্ষমতায় এসে সেই প্রজেক্ট বাতিল করে দেয়। ধারণা করা হচ্ছিল যে ঐ বেসিক ইনকাম প্রকল্প স্বল্প আয়ের মানুষদের জীবন মান উন্নয়নে যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবে।
অবশ্য অন্টারিওর বর্তমান সরকার ‘গ্যারান্টিড বেসিক ইনকাম’ এর পাইলট প্রকল্প বাতিল করে দিলেও স্বল্প আয়ের কানাডিয়ানদের জন্য ‘গ্যারান্টিড বেসিক ইনকাম’ প্রকল্প চালুর বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে ফেডারেল সরকার। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রী জিন-ইয়েভস ডুকল্স যুক্ত দেখান এই বলে যে, লিবারেল সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত কানাডা চাইল্ড বেনিফিট এবং অন্যান্য কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই প্রাথমিকভাবে গ্যারান্টিড বেসিক ইনকাম এর পক্ষ হয়ে কাজ করছে।
কানাডিয়ান প্রেস-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রী জিন-ইয়েভস ডুকল্স ইতিপূর্বে বলেন, জনগণের সেবায় বর্তমানে ফেডারেল সরকারের যে সকল কর্মসূচী রয়েছে সেগুলো একসময় আরো বর্ধিত আকার ধারণ করে হয়তো একধরণের গ্যারান্টিড মিনিমাম ইনকাম হিসাবেই ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে যে সকল পরিবারে কোন শিশু নেই এবং সিনিয়র সিটিজেন ও স্বল্প আয়ের কর্মজীবীগণ এ থেকে উপকৃত হবেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে স্বল্প আয়ের সব কানাডিয়ানই ইউনিভার্সাল গ্যারান্টিড মিনিমাম ইনকাম এর আওয়তায় আসবেন।
সেই দিনটি কবে আসবে এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী ডুকল্স অবশ্য নিশ্চিত করে কিছু বলেননি। তিনি যা বলেন তা হলো, একদিন আমরা সেই অবস্থানে পৌঁছাব।
ফেডারেল কর্মকর্তারাও বিষয়টিকে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিস্তৃত সম্ভাবনা হিসাবেই দেখছেন, বিশেষ করে যখন শ্রমবাজারে অধুনিক অটোমেশন সিস্টেম চালু হওয়ার কারণে অনেক কর্মজীবী মানুষ তাদের চাকরী হারাচ্ছেন। এর সাথে আরো রয়েছে চাকরীর বাজারে অনিশ্চিত পরিস্থিতি এবং অস্থায়ী ও স্বল্প বেতনের চাকরী।
গ্যারান্টিড মিনিমাম ইনকাম এর বিষয়টি চিন্তাভাবনায় আসছে এই কারণে যে, জনগনের সেবায় সরকারের বর্তমান যে সকল কর্মসূচী রয়েছে সেগুলো সেকেলে হয়ে গেছে।
দাতব্য সংস্থা অক্সফ্যাম ইতিপূর্বে কানাডায় মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটাতে ‘নতুন অর্থনৈতিক মডেল’ প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে। অক্সফ্যাম বেশ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করেছে যার মধ্যে আছে বাজেটে প্রগ্রেসিভ টেক্সেশন এর নীতি গ্রহণ করা। এই নীতি নরডিক দেশসমূহে রয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড। ঐ নীতিতে যাদের আয় বেশী তাদেরকে একটা বড় অংশ প্রদান করতে হয় টেক্স হিসাবে।
আমরাও মনে করি কানাডার সরকারের উচিৎ এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হওয়া। নয়তো দেশটির সমাজব্যবস্থা এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে যাবে যা কারো কাম্য হতে পারে না।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ